বিশাল স্তম্ভগুলো এখানে এল কীভাবে

ইশতিয়াক হাসান
প্রকাশ : ১২ জুন ২০২৩, ১২: ৩২
আপডেট : ১২ জুন ২০২৩, ১৩: ০৩

নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের উত্তর উপকূলে অদ্ভুত ধরনের কিছু পাথরের কাঠামোর দেখা পাবেন। জায়ান্টস কজওয়ে নামে পরিচিত পাথরের স্তম্ভগুলো ষড়ভুজাকৃতির। উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের তীর থেকে একটা পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে এগুলো। স্তম্ভগুলোর আকৃতি এতটাই নিখুঁত যে দেখে মনে হতে পারে মানুষের তৈরি। আবার এক দানো সাগর পেরোনোর জন্য এগুলো এখানে বসিয়ে দিয়েছে এমন কিংবদন্তিও আছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও এই স্তম্ভগুলো পুরোপুরি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি। 

কজওয়ের এই স্তম্ভগুলো তৈরি হয় প্রায় ৬ কোটি বছর আগে। তখনো ইউরোপ সংযুক্ত ছিল উত্তর আমেরিকার সঙ্গে। যখন ভূভাগ আলাদা হতে শুরু করে, তখন ফাটলের সৃষ্টি হয়। আর আগ্নেয়গিরির গলিত লাভা এসব ফাটল দিয়ে বের হয়ে লাভার একটি হ্রদের জন্ম দেয়। তারপর এগুলো ধীরে ধীরে শীতল হতে শুরু করে। আর এই ঠান্ডা হওয়ার সময় লাভা কুঁচকে ও ভেঙে এমন ষড়ভুজাকার স্তম্ভে রূপ নিতে থাকে। 

জায়গাটি ইউনেসকো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। ছবি: টুইটারএকটা সময় পর্যন্ত এগুলোকে কৃত্রিমভাবে তৈরি স্তম্ভ ভাবা হতো। ওই ধারণা যে ভুল আর এগুলো যে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি তা মানুষ জানতে পারে একপর্যায়ে। তবে এই স্তম্ভগুলো ঠিক কী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে তা জানা যায় খুব বেশি দিন হয়নি। ২০০৮ সালে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডির ছাত্র লুকাস গোয়েহরিং এবং তাঁর সুপারভাইজর অধ্যাপক স্টিফেন মরিস এটা আবিষ্কার করেন। 

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার পাশাপাশি কজওয়ের সৃষ্টি নিয়ে আছে মজার এক কিংবদন্তিও। সেটা অনুসারে এখানে পাথরের স্তম্ভগুলো বসায় ফিন ম্যাককুল নামের এক দানো বা দৈত্যাকায় মানুষ। বেনানডোনার নামে স্কটিশ এক দানোর সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব ছিল। সাগরের মধ্যে এই কজওয়ে বা পথ তৈরি করে ফিন দুজনের মধ্যে লড়াইয়ে যেন সুবিধা হয় সে জন্য। তারপরই ফিন আবিষ্কার করে বেনানডোনা তার চেয়েও বিশাল। তখন ভয়ে সে পালায়। 

প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক পর্যটকের পা পড়ে এলাকাটিতে। ছবি: উইকিপিডিয়াফিনের স্ত্রী ওনাঘ স্বামীকে কাপড়ে মুড়ে বিশাল এক শিশুর ছদ্মবেশ দেয়। স্কটিশ দানো বিশাল শিশুকে দেখে ভাবে, না জানি এর বাবা ফিন কত্ত বিশাল! তখন স্কটল্যান্ডের দিকে পালায় সে। পথে কজওয়ের বেশির ভাগ ধ্বংস করে দেয় সে, যেন ফিন অনুসরণ করতে না পারে। 

আশ্চর্য এই স্তম্ভগুলোর কথা বাইরের মানুষ একটা সময় পর্যন্ত জানতেন না। ১৬৯৩ সালে আইরিশ রাজনীতিবিদ ও ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজের সদস্য স্যার রিচার্ড বাল্কলে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটিতে প্রাকৃতিক এই বিস্ময় সম্পর্কে একটি বক্তব্য দেন। ১৭৩৯ সালের দিকে জায়গাটি পর্যটকদের পছন্দের গন্তব্যে পরিণত হয়। এতে বড় ভূমিকা রাখেন সুসানা ড্রুরি, কজওয়ের ছবি জলরঙে ফুটিয়ে তুলে। 

১৮৩৬ সালের দিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে জায়গাটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে পর্যটকদের জন্য নির্মিত হয় দ্য কজওয়ে হোটেল। ১৮৮৩ সালে জায়ান্ট কজওয়ে ট্রামওয়ে আত্মপ্রকাশ হলে আরও সুবিধা হয় পর্যটকদের। এই ট্রাম চলা শুরু করে পোর্টরাস ও কজওয়ের মধ্যে।

সুসানা ড্রুরির আঁকায় জায়ান্ট’স কজওয়ে। ছবি: সংগৃহীত১৯৮৬ সালে এলাকাটিকে ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করা হয়। সে বছরই এখানে ভিজিটর সেন্টার খোলা হয়, ২০০০ সালে যেটি পুড়ে যায়। ২০১২ সালে আবার তৈরি হয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রচুর পর্যটক হাজির হন এখন জায়গাটিতে। ২০১৯ সালে প্রায় ১০ লাখ পর্যটক ভ্রমণ করেন জায়ান্টস কজওয়েতে। 

মোটামুটি .৭ বর্গকিলোমিটার এলাকায় একটার সঙ্গে আরেকটা সংযুক্ত আনুমানিক ৪০ হাজার ব্যাসাল্টের স্তম্ভ থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উঁচুটা ৩৯ ফুট। 

একটা সময় পর্যন্ত কজওয়ের পাথর তুলে নিয়ে বিক্রি হতো। ২০১০ সালে কজওয়ের পাথর দাবি করে বড় সাতটি পাথর একটি নিলামে বিক্রি করা হয় ২০ হাজার পাউন্ডে। যদিও এই দাবির সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের কারও কারও এখনো বাগানে কজওয়ের পাথর শোভা পেতে দেখবেন। 

জায়ান্টস কজওয়েতে আনুমানিক ৪০ হাজার ব্যাসাল্টের স্তম্ভ থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। ছবি: উইকিপিডিয়াএখানকার বেশির ভাগ পাথর ষড়ভুজাকার পাথর হলেও চতুর্ভুজ, পঞ্চভুজ কিংবা অষ্টভুজ আকারের পাথরও আছে। এ ছাড়া কজওয়ে উপকূলে বিভিন্ন অদ্ভুত আকারের পাথর ছড়িয়ে আছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দ্য ক্যামেল আর জায়ান্টস বুট। ক্যামেল নামে পাথরটা বলা হয় একসময় বিশাল এক প্রাণী ছিল যে ফিনকে বহন করতে পারত। এদিকে বিশাল বুটের মতো পাথরটি, বলা হয় পালানোর সময় ফিন হারিয়ে ফেলে। 

জায়ান্ট কজওয়ের অস্বাভাবিক সৌন্দর্য একে চলচ্চিত্রের দৃশ্যায়নের জন্য আদর্শ জায়গায় পরিণত করেছে। ড্রাকুলা আনটোল্ডে (২০১৪) একে ট্রান্সসিলভানিয়ার পর্বত হিসেবে দেখানো হয়েছে। তেমনি ইউর হাইনেসে মিনোটারস মেইজ হিসেবে দেখানো হয়। একে পাবেন হেলবয় টু: দ্য গোল্ডেন আর্মিতেও (২০০৮)। 

কিংবদন্তি অনুসারে পাথরের স্তম্ভগুলো বসায় ফিন ম্যাককুল নামের এক দানো বা দৈত্যাকার মানুষ। ছবি: ফেসবুকজায়ান্টস কজওয়ে সবচেয়ে বেশি নাম কামালেও অনেকটা এ ধরনের স্তম্ভের দেখা পাবেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে। যেমন স্কটল্যান্ডের আইল অব স্টাফার ফিঙ্গাল’স গুহায়, মেক্সিকোর লস প্রিসমাস বাসালতিকোস, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াইয়োমিংয়ের ডেভিলস টাওয়ার, হংকংয়ের হাই আইল্যান্ড রিজারভয়র। এমনকি ২০০৭ সালে লাভার এ ধরনের স্তম্ভের ছবি তোলা হয় মঙ্গলগ্রহ থেকেও। 

কাজেই বুঝতে পারছেন এমন একটি জায়গায় ভ্রমণের সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত হবে না। কিন্তু যাবেন কীভাবে? বেলফাস্ট কিংবা লন্ডনডেরি থেকে ট্রেনে কলেরিন পৌঁছাবেন। সেখান থেকে বাসে সহজেই পৌঁছে যাবেন অদ্ভুত সেই স্তম্ভগুলোর কাছে। 

সূত্র: মেন্টাল ফস, এটলাস অবসকিউরা, আনইউজুয়াল প্লেসেস, উইকিপিডিয়া

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত