Ajker Patrika

ডিম নিয়ে বিচিত্র তথ্য

ল–র—ব—য—হ ডেস্ক
আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০২২, ১৮: ৫৮
ডিম নিয়ে বিচিত্র তথ্য

ডিমের ইতিহাস বড় বিচিত্র! স্তন্যপায়ী প্রাণীর জরায়ুতে শিশু জন্মের আগে বংশবিস্তারের মাধ্যম ছিল ডিম। ডাইনোসরের মতো বিরাটাকার প্রাণীও কিন্তু ডিম পাড়তো। ধারণা করা যায়, অন্য প্রাণীর খাদ্য হিসেবে ডিমের কদর সব সময়ই ছিল। তবে মানুষের মতো শিকারি প্রাণী ডিমকে কবে থেকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করল তার ইতিহাস জানা নেই।

প্রত্ন ও নৃতাত্ত্বিকেরা ধারণা করেন, মানবসমাজে পাখির ডিম প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মূল্যবান খাদ্য হিসেবে সমাদৃত। মানুষের গুহাবাসী শিকারি সমাজ এবং আধুনিক সংস্কৃতিতে পাখি গৃহপালিত প্রাণীদের অন্যতম। ফলে ধারণা করাই যায়, মানুষ পাখির ডিম পছন্দ করত অতি প্রাচীনকাল থেকেই।

ঐতিহাসিকদের মতে, ৭ হাজার ৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দেরও আগে মুরগি সম্ভবত গৃহে পালন করা হতো মূলত ডিমের জন্য। এটির চল প্রথম শুরু হয় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এবং উপক্রান্তীয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশে। জঙ্গলের পাখি থেকে শান্ত সৌম্য মুরগি মানুষের বসতবাড়িতে স্থান পায়।

১ হাজার ৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে গৃহপালিত পাখি হিসেবে মুরগি সুমের এবং মিসরে আনা হয়েছিল। ৮০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এই পাখি গ্রিসে পৌঁছে। গ্রিসে তখন ডিমের প্রধান উৎস ছিল কোয়েল। মিসরের থিবেসে আনুমানিক ১ হাজার ৪২০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের সময়কার হারেমহাবের সমাধিতে একটি দেয়াল চিত্রে দেখা যায়, এক ব্যক্তি উটপাখির ডিম এবং সম্ভবত পেলিকান পাখির ডিম নৈবেদ্য হিসেবে থালায় বহন করছেন।

প্রাচীন রোমে ডিম সংরক্ষণের অনেক পদ্ধতি ছিল। এখানে প্রায়ই ডিমের কোর্স দিয়েই শুরু হতো খাবার। খাবার প্লেটে যেন কোনো অশুভ আত্মা ঘাপটি মেরে থাকতে না পারে সে জন্য রোমানেরা প্লেটে ডিমের খোসা ভাঙতো।

মধ্যযুগে রোমান ক্যাথলিক খ্রিষ্টানেরা ৪০ দিনের উপাসের (লেন্ট) সময় ডিম খেতেন না। এই সময়টিতে ডিম খাওয়া একেবারে নিষিদ্ধ ছিল। কারণ ডিমকে তখন অত্যন্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

অবশ্য ইতিহাস বলে, লেন্টের সময় ডিম বর্জন শুধুই ধর্মীয় রীতি থেকে অনুপ্রাণিত নয়। ডিম খাওয়ার একটি বার্ষিক বিরতিতে খামারিদের কিছু উপকার হতো। তাঁরা এই সময়টাতে ডিম দেওয়া পাখির পালকে কিছুটা সময় বিরতির সুযোগ দিতে পারতেন। তাছাড়া বছরের যে সময়টাতে খাদ্যসংকট থাকে তার জন্য আগে থেকে খাদ্য মজুত করারও একটি সুযোগ তৈরি হতো। তখন মুরগিকে কম খাবার দিয়ে সাশ্রয় করতেন খামারিরা।

টক ফলের রস দিয়ে মাখানো ডিম সপ্তদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি ডিশ ছিল। এই খাদ্য রীতি থেকেই সম্ভবত লেবু–দই–এর উৎপত্তি হয়েছে।

ইউরোপ–আমেরিকায় হিমায়িত ডিম শিল্পের উত্থানের আগে ঊনবিংশ শতাব্দীতে শুকনো ডিম শিল্পের বিকাশ ঘটে। ১৮৭৮ সালে মিসৌরির সেন্ট লুইসে একটি কোম্পানি ডিম শুকানোর বিশেষ প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করে। তারা ডিমের কুসুম এবং সাদা অংশকে হালকা-বাদামি রঙের তৈরি খাবারের মতো পদার্থে রূপান্তর করতে সক্ষম হয়। এটি তারা বাজারজাত করলে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনী এবং মিত্রদের খাবারের জন্য শুকনো ডিমের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।

১৯১১ সালে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার স্মিথার্সে জোসেফ কোয়েল নামে এক ব্যক্তি ডিম বহন ও সংরক্ষণের জন্য বিশেষ কার্টন উদ্ভাবন করেন। বর্তমানে প্লাস্টিক বা অন্যান্য পলিমারের নরম যে কার্টন বাজারে পাওয়া যায় সেটিরই পথিকৃৎ তিনি। মূলত ভাঙা ডিম নিয়ে একজন কৃষক বা খামারি এবং হোটেল মালিকের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তি করতেই জোসেফ এই কার্টন উদ্ভাবন করেন।

ডিমের কার্টনের উদ্ভাবক জোসেফ কোয়েল। পাশে তাঁর নকশা করা কার্টন। ছবি: সংগৃহীতশুরু দিকে ডিমের কার্টন তৈরি করা হতো কাগজ দিয়ে। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে পলিস্টাইরিন দিয়ে তৈরি কার্টন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, কারণ তাপ এবং ভাঙার হাত রক্ষা করার জন্য খুবই উপযুক্ত এসব কার্টন। তবে একবিংশ শতাব্দীতে পরিবেশ দূষণের কথা বিবেচনা করে সহজে পচে যায় এমন বা পুনর্ব্যবহার যোগ্য উপাদানে তৈরি কার্টন বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

এশীয় বন্য মুরগি থেকে গৃহপালিত মুরগির উদ্ভব। প্রতি বছর প্রজনন ঋতুতে প্রায় এক ডজন ডিম দেয় এরা। তবে কয়েক হাজার বছর ধরে ‘বাছাই প্রজননের’ মাধ্যমে মানুষ তাদের চাহিদা অনুযায়ী আধুনিক গৃহপালিত মুরগির জাত উদ্ভাবন করেছে। কিছু মুরগি মাংসের জন্য, আর কিছু জাত তৈরি করা হয়েছে ডিমের জন্য। উন্নত জাতের মুরগি এখন বছরে তিন শতাধিক ডিম পাড়তে সক্ষম। শুধু তাই নয়, এরা সারা বছর ডিম দিতে পারে।

পাখির ডিম এখন একটি সাধারণ খাবার। রান্নায় ব্যবহৃত সবচেয়ে বহুমুখী উপাদানগুলোর মধ্যে একটি হলো ডিম। আধুনিক খাদ্য শিল্পের অনেক শাখায় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠেছে ডিম।

সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পাখির ডিম হলো মুরগি, হাঁস এবং রাজহাঁসের ডিম। ছোট ডিম, যেমন—কোয়েলের ডিম, পশ্চিমা দেশগুলোতে মূল খাবারের সঙ্গে অলংকার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এশিয়ার অনেক অঞ্চলে ডিম একটি সাধারণ দৈনন্দিন খাদ্য, যেমন—চীন এবং থাইল্যান্ড। মজার ব্যাপার হলো, ২০১৩ সালের হিসাবে এশিয়াতে ডিমের উৎপাদন ছিল বিশ্বের মোট ৫৯ শতাংশ।

সবচেয়ে বড় পাখির ডিম হলো উটপাখির ডিম। এটি অবশ্য বিলাসবহুল খাবার হিসেবেই পরিবেশন করা হয়। গালের ডিম (শঙ্খচিল), ইংল্যান্ডের পাশাপাশি কিছু স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ, বিশেষ করে নরওয়েতে উপাদেয় খাবার হিসেবে বিবেচিত হয়। আফ্রিকার কিছু দেশে গিনিফাউলের ডিম প্রায়ই বাজারে দেখা যায়, বিশেষ করে প্রতি বছরের বসন্তে এই ডিম বেশি পাওয়া যায়। তিতিরের ডিম এবং ইমু পাখির ডিমও খাওয়া হয়। তবে ব্যাপকভাবে পাওয়া যায় না। অনেক দেশে, বন্যপাখির ডিম বাজারে বিক্রি এবং খাওয়া নিষিদ্ধ। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে এটি অন্তর্ভুক্ত। আবার কিছু দেশে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে ডিম বেচাকেনা ও খাওয়ার বৈধতা আছে।

২০১৭ সালে মুরগির ডিমের বৈশ্বিক উৎপাদন ছিল ৮০ দশমিক ১ মিলিয়ন টন। বৃহত্তম উৎপাদক ছিল চীন—এই দেশের উৎপাদন ছিল ৩১ দশমিক ৩ মিলিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ৬ দশমিক ৩ মিলিয়ন, ভারত ৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন, মেক্সিকো ২ দশমিক ৮ মিলিয়ন, জাপান ২ দশমিক ৬ মিলিয়ন এবং ব্রাজিল ও রাশিয়া প্রত্যেকে ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন। গড় হিসাবে একটি বড়সড় ডিম কারখানা প্রতি সপ্তাহে ১০ লাখ ডজন ডিম পাঠায়।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র ৯ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডিম উৎপাদন করেছে। এর মধ্যে ৮ দশমিক ২ বিলিয়ন খাওয়া হয়েছে এবং বাচ্চা ফুটানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন। ২০১৯ সালে আমেরিকানরা প্রত্যেকে ডিম খেয়েছে ২৭৯টি ডিম। ১৯৭৩ সালের এটিই সর্বোচ্চ ডিম ভক্ষণ। অবশ্য ১৯৪৫ সালে আমেরিকানরা জনপ্রতি ডিম খেয়েছে ৪০৫ টির কিছু কম।

ডিমের গুণমান পরীক্ষা একটি সহজ পরীক্ষা আছে। বাজার গেলে প্রায় সবাই এই কৌশলটি ব্যবহার করেন—ডিমটিকে আলোর বিপরীতে ধরা। বড় বড় খামার ও কারখানায়ও একই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। সাধারণত মোমবাতির বিপরীতে ধরে মান পরীক্ষা করা হয়। মূলত বায়ু কোষের আকার বোঝার চেষ্টা করা হয়। সেই সঙ্গে ডিমটি নিষিক্ত কি না সেটিও বোঝা যায়। নিষিক্ত হলে আলোর বিপরীতে ভ্রূণের উপস্থিতি শনাক্ত করা যায়। অনেক দেশের নিয়ম অনুযায়ী, ডিম ধুয়ে পরিষ্কার করে এরপর বাক্সে ভরা হয়। অবশ্য এতে ডিম বেশি দিন সতেজ থাকে না।

ডিমের ভেতর দিয়ে আলো প্রবেশ করলে সেটি তাজা। বায়ু কোষ বা কুঠুরী যত বড় ডিমের বয়স তত বেশি। তাজা ডিমে কিন্তু কুসুম সেভাবে নড়াচড়া করে না কারণ বায়ু কুঠুরি তখন খুব ছোট থাকে। বেশি দিন হয়ে যাওয়া ডিমের কুসুম বেশ সহজেই নড়াচড়া করবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আমিনুল ইসলাম নন, শিক্ষা উপদেষ্টা হচ্ছেন অধ্যাপক আবরার

গণপিটুনিতে নিহত জামায়াত কর্মী নেজাম ও তাঁর বাহিনী গুলি ছোঁড়ে, মিলেছে বিদেশি পিস্তল: পুলিশ

বিএনপির দুই পেশাজীবী সংগঠনের কমিটি বিলুপ্ত

বসুন্ধরায় ছিনতাইকারী সন্দেহে ২ বিদেশি নাগরিককে মারধর

উপদেষ্টা হচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আমিনুল ইসলাম

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত