লিঙ্গবৈষম্য বেড়েছে বিশ্বজুড়ে, পুরুষের মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ অধিকার নারীদের

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ০৭ মার্চ ২০২৪, ২০: ২২
Thumbnail image

কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রতি লিঙ্গবৈষম্য বিশ্বজুড়েই বেড়েছে, যতটা ভাবা হয় তাঁর চেয়ে অনেক বেশি। বিশেষ করে সহিংসতা ও শিশু পরিচর্যার ক্ষেত্রে আইনি অধিকারে বড় তারতম্য বিদ্যমান। সামগ্রিকভাবে পুরুষদের দুই-তৃতীয়াংশেরও কম অধিকার ভোগ করেন নারীরা। কোনো দেশই নারীর জন্য সমান সুবিধা দেয় না, এমনকি সবচেয়ে ধনি দেশগুলোও না। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বৈষম্যের এই চিত্র উঠে এসেছে।  

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আগে উইমেন, বিজনেস অ্যান্ড দ্য ল অর্থাৎ ‘নারী, ব্যবসা ও আইন’ শিরোনামে ২০২৪ সালের এই প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। কয়েক বছর ধরে বার্ষিক এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়ে আসছে। বৈশ্বিক শ্রমবাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে এবং নিজের, পরিবারের ও সমাজের বৃহত্তর অগ্রগতিতে অবদান রাখার ক্ষেত্রে নারীরা কী ধরণের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন, তা বেশ কিছু সূচক পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। 

নারীর বিকল্প বাছাইয়ের সুযোগ তৈরি করে বা তাতে বাধার সৃষ্টি করে এমন দুটি সূচক এবার নতুন করে পর্যালোচনার জন্য প্রতিবেদনে যুক্ত করা হয়। এতে দেখা গেছে, পুরুষ যত আইনি অধিকার ভোগ করেন, নারীরা তার মাত্র ৬৪ শতাংশ ভোগ করেন। এই হার আগের অনুমিত হার ৭৭ শতাংশ থেকে অনেক কম। অর্থাৎ বাস্তবে লিঙ্গ বৈষম্য অনেক বিস্তৃত। 

 ‘নারী, ব্যবসা ও আইন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো ১৯০টি দেশে নারীর জন্য আইনি সংস্কারে বৈষম্য ও তার বাস্তব পরিণতি পর্যালোচনা করা হয়েছে। ছাপা আইন অনুসারে পুরুষদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ অধিকার নারীদের ভোগ করার কথা। কিন্তু এটুকু অধিকারের পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য যত প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া-পদ্ধতির প্রয়োজন দেশগুলোতে গড়ে তাঁর ৪০ শতাংশেরও কম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। 

উদারহরণস্বরূপ, পুরুষের সমমূল্যের শ্রমের জন্য নারীর সমান মজুরির বিধান নিশ্চিত করে সংসদে আইন প্রণয়ন করেছে ৯৮টি বা অর্ধেকের বেশি দেশ। কিন্তু মজুরিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত বা মজুরি বৈষম্য নিরসনে কার্যকর প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করেছে মাত্র ৩৫টি দেশ প্রতি ৫ টির একটিরও কম দেশ। 

তবে সমান সুযোগের আইনের কার্যকর বাস্তবায়ন পর্যাপ্ত সহায়ক রূপরেখার উপর নির্ভর করে। এর মধ্যে আছে-আইন কার্যকরের শক্তিশালী প্রক্রিয়া, লিঙ্গ সংক্রান্ত মজুরি বৈষম্য চিহ্নিত করার ব্যবস্থা ও সহিংসতা থেকে বেঁচে যাওয়া নারীদের জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সুবিধা। 

বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ইন্দরমিত গিল বলেন, ‘খুঁড়িয়ে চলা বিশ্ব অর্থনীতিতে বিপুল গতিসঞ্চার করার ক্ষমতা আছে নারীদের। তবু পুরুষের কাতারে দাঁড়িয়ে কাজ করা বা ব্যবসা করা থেকে নারীকে দমিয়ে রাখতে সারা বিশ্বেই বৈষম্যমূলক আইন ও চর্চা অব্যাহত আছে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘এই বৈষম্য নিরসন করলে বিশ্বের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি ২০ শতাংশ হারে বাড়তে পারে। এর ফলে আগামী দশকে বৈশ্বিক জিডিপি দ্বিগুণ হয়ে যাবে। কিন্তু আইনি সংস্কারের গতি গতি শ্লথ হতে হতে এখন একেবারে হামাগুড়ি দিয়ে চলছে। ব্যবসা ও আইনি অধিকারে সমতা আনার গতি ত্বরান্বিত করতে সরকার কি করতে পারে তা এই প্রতিবেদনে তুলে চিহ্নিত করা হয়েছে।’ 

সমান সুযোগের আইন প্রতিষ্ঠা করা দেশগুলোর জন্যও কত কঠিন কঠিন কাজ পড়ে আছে তা অধিকার বাস্তবায়নের এই বিশাল ফারাকের মধ্যে উঠে এসেছে। যেমন, নারীদের পুরুষদের অধিকারের প্রায় ৭৭ শতাংশের আইনি স্বীকৃতি দিয়ে সাব-সাহারান অর্থনীতির মধ্যে অনন্য অবস্থান তৈরি করেছে। কিন্তু দেশটি এখনও এসবের পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদ্ধতির মাত্র ২৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠা করেছে। এই হার মহাদেশীয় গড়হার। 

 ২০২৩ সালে সরকারগুলি সমান সুযোগের আইনি সংস্কারের তিন শ্রেণিতে—বেতন, মাতৃত্বকালীন অধিকার ও কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা—অগ্রগতির জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। তারপরও শিশু যত্নের অধিকার ও নারীর নিরাপত্তা-দুটি ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দুর্বলতা দেখা গেছে। এক্ষেত্রে বিশ্বের গড় স্কোর মাত্র ৩৬ অর্থাৎ নারীরা ঘরোয়া সহিংসতা, যৌন হয়রানি, বাল্যবিবাহ ও নারী হত্যার শিকার হওয়ার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনি সুরক্ষার মাত্র এক তৃতীয়াংশ ভোগ করে। ১৫১টি দেশের কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে আইন আছে। তবে জনপরিসের যৌন হয়রানি নিষিদ্ধ করার আইন করেছে মাত্র ৩৯টি দেশ। এই কারণে প্রায় নারীরা কর্মস্থলে যেতে গণপরিবহন করতে পারেন না। 

শিশু যত্ন বিষয়ক আইনেও বেশিরভাগ দেশের অবস্থা ভালো না। বেশিরভাগই শিশু যত্নের কাজে নারীরা পুরুষদের চেয়ে দিনে গড়ে ২ দশমিক ৪ ঘণ্টা বেশি ব্যয় করে। শিশু যত্নের সুযোগ বাড়ায় প্রাথমিকভাবে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ প্রায় ১ শতাংশ বেড়েছে। পাঁচ বছরের মধ্যে এটি দ্বিগুণেরও বেশি হবে। এখন অর্ধেকেরও কম অর্থাৎ মাত্র ৭৮টি দেশে অল্পবয়সী শিশুর জন্য পিতামাতাদের সামান্য অর্থ সহায়তা দেয়। এক তৃতীয়াংশেরও অর্থাৎ মাত্র ৬২টি দেশে মানসম্পন্ন শিশু পরিচর্যা সেবা আছে। অথচ এই সেবা ছাড়া অল্পবয়সী শিশুর মায়েরা কাজে যেতে দুবার ভাববে। 

নারীরা অন্য ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য বাধার সম্মুখীন হন। যেমন ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রতি পাঁচটি দেশের মধ্যে মাত্র একটি সরকারি ক্রয়ে লিঙ্গ-সংবেদনশীল প্রক্রিয়া বাধ্যতামূলক করেছে। এর অর্থ হল নারীরা বছরে ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত। বেতনের ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদের প্রতি ১ ডলারের বিপরীতে মাত্র ৭৭ সেন্ট পায়। অধিকারের এই বৈষম্য অবসর পর্যন্ত প্রসারিত। ৬২টি দেশে পুরুষ ও নারীর অবসরের বয়স এক ভিন্ন। নারীরা সাধারণত পুরুষদের চেয়ে বেশি দিন বাঁচে। কিন্তু যেহেতু তারা কম বেতন পান, সন্তানধারণের সময় ছুটি নেন, আগে অবসর গ্রহণ করেন, সেই কারণে তাঁরা স্বল্প পেনশন সুবিধা পান এবং বড় আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে তাদের জীবন শেষ হয়। 

এই প্রতিবেদনের প্রধান লেখক টি ট্রম্বিক বলেন, এখন মাত্র অর্ধেক নারী বৈশ্বিক কর্মশক্তিতে অংশ নেয় অর্থাৎ প্রতি চারজন পুরুষের বিপরীতে তিনজনেরও কম। এটা শুধু অন্যায্য নয়, এটা অপচয়। অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়ানো ছাড়া নারী কণ্ঠস্বর জোরালো হবে না। নিজেরা সরাসরি প্রভাবিত হন-এমন সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতা অর্জনের মূল চাবিকাঠি এটাই। দেশগুলি কোনোভাবেই তাদের জনসংখ্যার অর্ধেককে কেবল বসিয়ে রাখতে পারে না। 

নারীদের কাজে এবং ব্যবসা শুরু ও আকার বাড়াতে সক্ষম করে তোলার জন্য আইন সংস্কারের প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করা ও নীতি প্রণয়ন করা আগের চেয়ে বেশি জরুরি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত