শাকেরা তাসনীম ইরা
আফগানিস্তান নিয়ে কথা হোক কিংবা তালেবান শাসন নিয়ে, সবার আগে যে প্রসঙ্গটি উঠে আসে সেটি হলো ‘নারী’। কেমন আছে আফগানের নারীরা অথবা কেমন ছিল তারা? কতটা অমিল একাল কিংবা সেকালে, সেসব নিয়ে আলোচনার অন্ত নেই অন্তর্জালে। প্রগতিশীল জীবনযাপন থেকে আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢেকে যাওয়ার সময় পর্যন্ত কী কী ঘটেছে আফগান নারীদের জীবনে, তার গল্প যেন আরব্য রজনীর ইতিহাসের চেয়েও চমকপ্রদ।
আফগানিস্তানে তালেবান শাসন যে একেবারেই নতুন, তা কিন্তু নয়। ১৬ আগস্ট, ২০২১ সালে কাবুল দখল নেওয়ার পর আফগানিস্তানে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতার দখল নিয়েছে তালেবানরা। যদিও পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সঙ্গে তালেবানের দুই দশকের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এমনতর পলায়ন এবং এত অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে, প্রায় বিনা প্রতিরোধে তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে, তা অনেকের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল।
আফগানিস্তানের জাতিগত আলোচনা প্রসঙ্গে বরাবরই বেশ জোরেশোরে আওয়াজ ওঠানো হয়েছে আফগান নারীদের অধস্তনতা এবং নারী অধিকার আদায়ের ব্যাপারে। কিন্তু আফগানিস্তান দখল-পুনর্দখলের রাজনৈতিক খেলায় নারীর অবস্থান সব সময়ই ছিল গৌণ। আরও খোলাসা করে বললে, আফগান ক্ষমতা দখলের খেলায় নারীদের নিয়ে আলোচনায় মিডিয়া যতটা সরব ছিল, ততটাই নিশ্চুপ ছিল প্রকৃত অর্থে নারী মুক্তির আলোচনায়।
আফগান নারীদের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ঐতিহ্যগতভাবে নিজেদের এই গৃহবন্দী অবস্থান আফগান নারীরা মেনে নিয়েছিল। মূলত বয়ঃসন্ধিকালেই নারীরা ঘরের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যেত, এরপর ‘দাদি’ হয়ে তারা কখনো কখনো বের হয়ে আসত। তুলনামূলকভাবে উদার কাবুলের বিপরীতে আফগানের অন্যান্য অঞ্চলে তালেবানের শাসন ছাড়াও ঐতিহ্যগতভাবে নারীরা অনাত্মীয় পুরুষদের সঙ্গে কথা বলত না। ব্যক্তিগত এবং জনজীবন এখানে ছিল তীব্রভাবে বিভক্ত। কোনো নারী যখন ঘর থেকে বের হতো, তখন সে বোরকার নির্জনতায় নিজেকে আবদ্ধ করে রাখত। তালেবানদের উত্থানের শত শত বছর আগে থেকে সেখানে এই ব্যবস্থা চলে আসছে। ১৯৭৯ সালে কমিউনিস্টরা যখন কাবুলে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তখন ধর্মীয় এবং সংস্কৃতিগত দিক থেকে আফগানের নারীদের সুরক্ষিত রাখার এই ঐতিহ্যবাহী জীবনধারা রাতারাতি ভেঙে পড়ে। প্রবীণ ও পুরুষেরা কমিউনিস্টদের এই অনধিকার চর্চা মেনে নেয়নি কোনো দিনও। যদিও আফগান নারীরা আসলে কী চেয়েছিল সেটাও পরিষ্কার করে বলা সম্ভব নয়। কেননা জন্ম থেকেই সমাজের নির্ধারণ করে দেওয়া গৃহবন্দী থাকার চিন্তা ও মনন তাদের নিজেদের অধিকার আদায়ের কিংবা মুক্ত করার স্বাভাবিক চিন্তার সুযোগই হয়তো দেয়নি।
কমিউনিস্ট শাসনামলে আফগানের হেলমন্দ প্রদেশে একটি নারী সাক্ষরতা কর্মসূচি চালু করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু গোত্রীয় প্রবীণ নেতা ও জমিদারেরা তাদের এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। কারণ আফগান সংস্কৃতি মেয়েদের ঘরের বাইরে স্কুলে পাঠানোর অনুমতি দেয় না। দাদা–বাবার পরম্পরায় এই সংস্কৃতিই চলে আসছে। এর ফলাফল হিসেবে কর্তৃপক্ষ যখন মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে মেয়েদের স্কুলে নিয়ে যায় তখন বিদ্রোহের সূচনা হয়। বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয় নিজেদের মুজাহিদীন বলে পরিচয় দেওয়া একদল সশস্ত্র লোক। তাদের প্রথম অপারেশনে তারা উপত্যকার সকল স্কুলশিক্ষককে অপহরণ করে নিয়ে যায় এবং জবাই করে হত্যা করে।
গ্রামাঞ্চলে যুবকেরা মেয়েদের স্কুল এবং ভূমি সংস্কারসহ নতুন পদ্ধতির জীবনযাত্রা আরোপ করার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে মৃত্যুকে বরণ করতেও দ্বিধা করেনি, যদিও এই পুরো বিদ্রোহে নারীর কোনো অংশগ্রহণ কখনোই ছিল কি না তা তর্ক সাপেক্ষ। অন্যদিকে শহরে মেয়েরা রেকর্ড সংখ্যায় স্কুলে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় এবং আশির দশকের শুরুর দিকে নারীরা সংসদীয় আসনে, এমনকি উপ-রাষ্ট্রপতি পদেও নিজের জায়গা দখল করে নেয়। এভাবেই আফগানিস্তানের নারীরা একই মুদ্রার সম্পূর্ণ বিপরীত দুই পিঠের মতো তাদের জীবন যাপন করতে থাকে।
আবার ১৯৮৯ সালে সোভিয়েতরা যখন পরাজিত হয়ে ফিরে যায় তখন আফগানে প্রতিদ্বন্দ্বী মুজাহিদীন গ্রুপগুলো নিজেদের মধ্যে দেশ ভাগাভাগি করে নেওয়ার চেষ্টা করে। সেই সঙ্গে তারা তাদের গ্রামাঞ্চলের রীতিনীতি রাজধানীতে নিয়ে আসে। তারা ফরমান জারি করে যে, ‘নারীরা একেবারেই প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হতে পারবে না। অতি জরুরি প্রয়োজনে যখন বের হবে, তখনো নিজেদের সম্পূর্ণরূপে ঢেকে রাখতে হবে।’ একইভাবে নারীদের ‘সুন্দরভাবে বা গর্বের সঙ্গে হাঁটা’ও নিষিদ্ধ করা হয়। ধর্মীয় পুলিশ শহরের রাস্তায় টহল দিতে শুরু করে। তারা নারীদের গ্রেপ্তার করে এবং অডিও-ভিডিও ক্যাসেট আগুনে পুড়িয়ে দেয়। তবে গৃহযুদ্ধকালীন সময়ে আমির দাদোর এবং নাইনটি থার্ড ডিভিশন নামে আরও দুটি গ্রুপের উত্থান ঘটে।
এরপর ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে তালেবানরা হামলা করলে প্রত্যুত্তরে মার্কিনরাও আফগানিস্তান আক্রমণ করে এবং তালেবান সরকারকে উৎখাত করে। ২০০৩ সালের দিকে পূর্বে মুজাহিদীন গ্রুপের সঙ্গে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যাওয়া আমির দাদো পুনরায় সুসংগঠিত হয়ে মার্কিনদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে এবং কাবুলে হামিদ কারজাইয়ের সরকার গঠন করে। ২০০৬ সালে যুক্তরাজ্যও এতে যুক্ত হয়। মূলত আফগান নারী রক্ষার মহান সাইনবোর্ড গলায় ঝুলিয়ে পশ্চিমা পৃথিবী বরাবরের মতোই সাম্রাজ্য দখলের খেলায় মত্ত হয়ে ওঠে। আফগানিস্তানের ‘নারী রক্ষা’র নামে সৃষ্টি হওয়া যুদ্ধাবস্থায় সবচেয়ে অনিরাপদ অবস্থানে জীবনযাপন করতে থাকে আফগান নারীরাই।
প্রায় ২০ বছরের যুদ্ধাবস্থা শেষে আফগান নারীদের অনিরাপদ বা পুরুষতন্ত্রের হাতে বন্দী রেখেই যুক্তরাষ্ট্র ‘মহান ব্রতে’র সাইনবোর্ড পেছনে ফেলে যত দিনে পিছু হটে এসেছে, তত দিনে আফগানিস্তানের নারীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এদের এক ভাগ রাজধানী কাবুলে বসবাসরত গত ২০-৩০ বছরে জন্ম নেওয়া প্রগতিশীল শিক্ষিত নারী, অন্য ভাগ চিরাচরিত আফগান সংস্কৃতির অন্যতম ধারক হিসেবে জীবনযাপন করা গ্রামাঞ্চলের নারী। তবে বর্তমানে বেশি অনিরাপদ এবং অনিশ্চিত জীবন যাপন করছে আফগানের প্রগতিশীল ও শিক্ষিত নারীরা। কারণ তালেবানরা ক্ষমতা দখলের পর বন্ধ হয়ে গেছে নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া, এমনকি সেকেন্ডারি স্কুলও। সরকারি চাকরিতে কর্মরত নারীদের দেওয়া হয়েছে অব্যাহতি। ঘরের বাইরে বের হওয়াতেও দেওয়া হয়েছে নানান সীমারেখা। নারীদের জন্য পোশাক থেকে শুরু করে আচরণ পর্যন্ত ঠিক করে দেওয়া হয়েছে তালেবান শাসকদের পক্ষ থেকে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ২ দশমিক ২৬ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হওয়া সন্ত্রাসী নির্মূল, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং নারী অধিকার রক্ষার ব্যর্থ মিশনের ফলাফল স্বরূপ আফগান নারীরা আরও ভয়াবহভাবে ফিরে গেছে অন্ধকার জগতেই। দুই দশকের আগ্রাসনের পর তালেবানদের সঙ্গে শান্তি চুক্তির নামে দর-কষাকষি শেষে যুক্তরাষ্ট্রের ফিরে যাওয়াকে আফগান নারীদের জীবনে ঘটা সবচেয়ে বড় প্রতারণা বললেও বোধ হয় কম বলা হয়।
মূলত সাম্রাজ্য দখলের সাহেব-বিবি-গোলামের খেলায় প্রয়োজনের সময় অতিরিক্ত তাসের মতো নারী ব্যবহৃত হয়েছে মার্কিন বনাম তালেবানের খেলায়।
নৃবিজ্ঞানী লীলা আবু লুঘোদ দেখিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই মুসলমান নারীদের রক্ষাকারী ইমেজ উপনিবেশবাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত, যেখানে মনে করা হয় মুসলমান নারীমাত্রই অসহায়, অক্ষম এবং মুসলমান পুরুষের হাতের পুতুল মাত্র। পশ্চিমা সমাজের শেকড় থেকে তৈরি হওয়া কাঠামোগত লিঙ্গবৈষম্যের প্রতি নির্বিকার থেকে মুসলমান নারীদের প্রতি করুণা এবং তাদের রক্ষা করার এই আগ্রহ মূলত পশ্চিমা শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের একটা উপায় মাত্র, যার কাঁধে ভর করে সাম্রাজ্য বিস্তার করা সম্ভব।
আফগানিস্তানে গত ষাট বছরে ক্ষমতার রদবদল হয়েছে অসংখ্যবার। প্রতিবারের রদবদলে প্রথম হোক কিংবা শেষ, সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছে নারীর ওপরই। কখনো বন্দী করে রাখা কিংবা কখনো মুক্ত করার প্রলোভন দেখিয়ে আরও অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার এই বাড়াবাড়ি আফগান নারীদের আরও বিপজ্জনক অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তবে যেহেতু মানুষ জন্মগতভাবে আশাবাদী এবং যেকারণেই হোক কিছুটা শিক্ষার আলো আফগান নারীদের একটা অংশ ধারণ করতে পেরেছে, তাই তাদের অনেকেই তালেবান সরকারের কঠোর নিয়মের মধ্যে নিজেদের জীবনকে মানিয়ে নিতে গিয়ে ধীরে হলেও ফুঁসে উঠছে। শহুরে শিক্ষিত নারীরা খাঁচায় বন্দী হয়ে থাকতে চায় না। তাই অনেকেই পালিয়ে গেছে। অনেকে এখনো আশায় বুক বেঁধে আছে। ছোট ছোট দলে হলেও অনেকেই সাহসের সঙ্গে প্রতিবাদ করছে। দেশটির প্রত্যন্ত অঞ্চলের অশিক্ষিত নারীরাও এখন বন্দী জীবন নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করছে।
নারীদের মুক্তি অন্যের হাতে নয় বরং আসা উচিত নিজেদের হাত ধরেই। কারও করুণা করে দেওয়া স্বাধীনতা নয় বরং আফগান নারীদের প্রয়োজন নিজের অধিকার নিজেই বুঝে নেওয়া। সেই সম্ভাবনাই যেন বর্তমানে দূরের তারার আলোর মতো উঁকি দিচ্ছে আফগান শহরগুলোতে। আর এ কারণেই হয়তো আফগান নারীদের মুক্তির ক্ষীণ আশা নতুন করে দেখা দিচ্ছে পৃথিবীর সকল নারীদের মধ্যে।
আফগানিস্তান নিয়ে কথা হোক কিংবা তালেবান শাসন নিয়ে, সবার আগে যে প্রসঙ্গটি উঠে আসে সেটি হলো ‘নারী’। কেমন আছে আফগানের নারীরা অথবা কেমন ছিল তারা? কতটা অমিল একাল কিংবা সেকালে, সেসব নিয়ে আলোচনার অন্ত নেই অন্তর্জালে। প্রগতিশীল জীবনযাপন থেকে আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢেকে যাওয়ার সময় পর্যন্ত কী কী ঘটেছে আফগান নারীদের জীবনে, তার গল্প যেন আরব্য রজনীর ইতিহাসের চেয়েও চমকপ্রদ।
আফগানিস্তানে তালেবান শাসন যে একেবারেই নতুন, তা কিন্তু নয়। ১৬ আগস্ট, ২০২১ সালে কাবুল দখল নেওয়ার পর আফগানিস্তানে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতার দখল নিয়েছে তালেবানরা। যদিও পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সঙ্গে তালেবানের দুই দশকের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এমনতর পলায়ন এবং এত অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে, প্রায় বিনা প্রতিরোধে তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে, তা অনেকের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল।
আফগানিস্তানের জাতিগত আলোচনা প্রসঙ্গে বরাবরই বেশ জোরেশোরে আওয়াজ ওঠানো হয়েছে আফগান নারীদের অধস্তনতা এবং নারী অধিকার আদায়ের ব্যাপারে। কিন্তু আফগানিস্তান দখল-পুনর্দখলের রাজনৈতিক খেলায় নারীর অবস্থান সব সময়ই ছিল গৌণ। আরও খোলাসা করে বললে, আফগান ক্ষমতা দখলের খেলায় নারীদের নিয়ে আলোচনায় মিডিয়া যতটা সরব ছিল, ততটাই নিশ্চুপ ছিল প্রকৃত অর্থে নারী মুক্তির আলোচনায়।
আফগান নারীদের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ঐতিহ্যগতভাবে নিজেদের এই গৃহবন্দী অবস্থান আফগান নারীরা মেনে নিয়েছিল। মূলত বয়ঃসন্ধিকালেই নারীরা ঘরের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যেত, এরপর ‘দাদি’ হয়ে তারা কখনো কখনো বের হয়ে আসত। তুলনামূলকভাবে উদার কাবুলের বিপরীতে আফগানের অন্যান্য অঞ্চলে তালেবানের শাসন ছাড়াও ঐতিহ্যগতভাবে নারীরা অনাত্মীয় পুরুষদের সঙ্গে কথা বলত না। ব্যক্তিগত এবং জনজীবন এখানে ছিল তীব্রভাবে বিভক্ত। কোনো নারী যখন ঘর থেকে বের হতো, তখন সে বোরকার নির্জনতায় নিজেকে আবদ্ধ করে রাখত। তালেবানদের উত্থানের শত শত বছর আগে থেকে সেখানে এই ব্যবস্থা চলে আসছে। ১৯৭৯ সালে কমিউনিস্টরা যখন কাবুলে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তখন ধর্মীয় এবং সংস্কৃতিগত দিক থেকে আফগানের নারীদের সুরক্ষিত রাখার এই ঐতিহ্যবাহী জীবনধারা রাতারাতি ভেঙে পড়ে। প্রবীণ ও পুরুষেরা কমিউনিস্টদের এই অনধিকার চর্চা মেনে নেয়নি কোনো দিনও। যদিও আফগান নারীরা আসলে কী চেয়েছিল সেটাও পরিষ্কার করে বলা সম্ভব নয়। কেননা জন্ম থেকেই সমাজের নির্ধারণ করে দেওয়া গৃহবন্দী থাকার চিন্তা ও মনন তাদের নিজেদের অধিকার আদায়ের কিংবা মুক্ত করার স্বাভাবিক চিন্তার সুযোগই হয়তো দেয়নি।
কমিউনিস্ট শাসনামলে আফগানের হেলমন্দ প্রদেশে একটি নারী সাক্ষরতা কর্মসূচি চালু করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু গোত্রীয় প্রবীণ নেতা ও জমিদারেরা তাদের এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। কারণ আফগান সংস্কৃতি মেয়েদের ঘরের বাইরে স্কুলে পাঠানোর অনুমতি দেয় না। দাদা–বাবার পরম্পরায় এই সংস্কৃতিই চলে আসছে। এর ফলাফল হিসেবে কর্তৃপক্ষ যখন মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে মেয়েদের স্কুলে নিয়ে যায় তখন বিদ্রোহের সূচনা হয়। বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয় নিজেদের মুজাহিদীন বলে পরিচয় দেওয়া একদল সশস্ত্র লোক। তাদের প্রথম অপারেশনে তারা উপত্যকার সকল স্কুলশিক্ষককে অপহরণ করে নিয়ে যায় এবং জবাই করে হত্যা করে।
গ্রামাঞ্চলে যুবকেরা মেয়েদের স্কুল এবং ভূমি সংস্কারসহ নতুন পদ্ধতির জীবনযাত্রা আরোপ করার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে মৃত্যুকে বরণ করতেও দ্বিধা করেনি, যদিও এই পুরো বিদ্রোহে নারীর কোনো অংশগ্রহণ কখনোই ছিল কি না তা তর্ক সাপেক্ষ। অন্যদিকে শহরে মেয়েরা রেকর্ড সংখ্যায় স্কুলে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় এবং আশির দশকের শুরুর দিকে নারীরা সংসদীয় আসনে, এমনকি উপ-রাষ্ট্রপতি পদেও নিজের জায়গা দখল করে নেয়। এভাবেই আফগানিস্তানের নারীরা একই মুদ্রার সম্পূর্ণ বিপরীত দুই পিঠের মতো তাদের জীবন যাপন করতে থাকে।
আবার ১৯৮৯ সালে সোভিয়েতরা যখন পরাজিত হয়ে ফিরে যায় তখন আফগানে প্রতিদ্বন্দ্বী মুজাহিদীন গ্রুপগুলো নিজেদের মধ্যে দেশ ভাগাভাগি করে নেওয়ার চেষ্টা করে। সেই সঙ্গে তারা তাদের গ্রামাঞ্চলের রীতিনীতি রাজধানীতে নিয়ে আসে। তারা ফরমান জারি করে যে, ‘নারীরা একেবারেই প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হতে পারবে না। অতি জরুরি প্রয়োজনে যখন বের হবে, তখনো নিজেদের সম্পূর্ণরূপে ঢেকে রাখতে হবে।’ একইভাবে নারীদের ‘সুন্দরভাবে বা গর্বের সঙ্গে হাঁটা’ও নিষিদ্ধ করা হয়। ধর্মীয় পুলিশ শহরের রাস্তায় টহল দিতে শুরু করে। তারা নারীদের গ্রেপ্তার করে এবং অডিও-ভিডিও ক্যাসেট আগুনে পুড়িয়ে দেয়। তবে গৃহযুদ্ধকালীন সময়ে আমির দাদোর এবং নাইনটি থার্ড ডিভিশন নামে আরও দুটি গ্রুপের উত্থান ঘটে।
এরপর ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে তালেবানরা হামলা করলে প্রত্যুত্তরে মার্কিনরাও আফগানিস্তান আক্রমণ করে এবং তালেবান সরকারকে উৎখাত করে। ২০০৩ সালের দিকে পূর্বে মুজাহিদীন গ্রুপের সঙ্গে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যাওয়া আমির দাদো পুনরায় সুসংগঠিত হয়ে মার্কিনদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে এবং কাবুলে হামিদ কারজাইয়ের সরকার গঠন করে। ২০০৬ সালে যুক্তরাজ্যও এতে যুক্ত হয়। মূলত আফগান নারী রক্ষার মহান সাইনবোর্ড গলায় ঝুলিয়ে পশ্চিমা পৃথিবী বরাবরের মতোই সাম্রাজ্য দখলের খেলায় মত্ত হয়ে ওঠে। আফগানিস্তানের ‘নারী রক্ষা’র নামে সৃষ্টি হওয়া যুদ্ধাবস্থায় সবচেয়ে অনিরাপদ অবস্থানে জীবনযাপন করতে থাকে আফগান নারীরাই।
প্রায় ২০ বছরের যুদ্ধাবস্থা শেষে আফগান নারীদের অনিরাপদ বা পুরুষতন্ত্রের হাতে বন্দী রেখেই যুক্তরাষ্ট্র ‘মহান ব্রতে’র সাইনবোর্ড পেছনে ফেলে যত দিনে পিছু হটে এসেছে, তত দিনে আফগানিস্তানের নারীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এদের এক ভাগ রাজধানী কাবুলে বসবাসরত গত ২০-৩০ বছরে জন্ম নেওয়া প্রগতিশীল শিক্ষিত নারী, অন্য ভাগ চিরাচরিত আফগান সংস্কৃতির অন্যতম ধারক হিসেবে জীবনযাপন করা গ্রামাঞ্চলের নারী। তবে বর্তমানে বেশি অনিরাপদ এবং অনিশ্চিত জীবন যাপন করছে আফগানের প্রগতিশীল ও শিক্ষিত নারীরা। কারণ তালেবানরা ক্ষমতা দখলের পর বন্ধ হয়ে গেছে নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া, এমনকি সেকেন্ডারি স্কুলও। সরকারি চাকরিতে কর্মরত নারীদের দেওয়া হয়েছে অব্যাহতি। ঘরের বাইরে বের হওয়াতেও দেওয়া হয়েছে নানান সীমারেখা। নারীদের জন্য পোশাক থেকে শুরু করে আচরণ পর্যন্ত ঠিক করে দেওয়া হয়েছে তালেবান শাসকদের পক্ষ থেকে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ২ দশমিক ২৬ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হওয়া সন্ত্রাসী নির্মূল, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং নারী অধিকার রক্ষার ব্যর্থ মিশনের ফলাফল স্বরূপ আফগান নারীরা আরও ভয়াবহভাবে ফিরে গেছে অন্ধকার জগতেই। দুই দশকের আগ্রাসনের পর তালেবানদের সঙ্গে শান্তি চুক্তির নামে দর-কষাকষি শেষে যুক্তরাষ্ট্রের ফিরে যাওয়াকে আফগান নারীদের জীবনে ঘটা সবচেয়ে বড় প্রতারণা বললেও বোধ হয় কম বলা হয়।
মূলত সাম্রাজ্য দখলের সাহেব-বিবি-গোলামের খেলায় প্রয়োজনের সময় অতিরিক্ত তাসের মতো নারী ব্যবহৃত হয়েছে মার্কিন বনাম তালেবানের খেলায়।
নৃবিজ্ঞানী লীলা আবু লুঘোদ দেখিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই মুসলমান নারীদের রক্ষাকারী ইমেজ উপনিবেশবাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত, যেখানে মনে করা হয় মুসলমান নারীমাত্রই অসহায়, অক্ষম এবং মুসলমান পুরুষের হাতের পুতুল মাত্র। পশ্চিমা সমাজের শেকড় থেকে তৈরি হওয়া কাঠামোগত লিঙ্গবৈষম্যের প্রতি নির্বিকার থেকে মুসলমান নারীদের প্রতি করুণা এবং তাদের রক্ষা করার এই আগ্রহ মূলত পশ্চিমা শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের একটা উপায় মাত্র, যার কাঁধে ভর করে সাম্রাজ্য বিস্তার করা সম্ভব।
আফগানিস্তানে গত ষাট বছরে ক্ষমতার রদবদল হয়েছে অসংখ্যবার। প্রতিবারের রদবদলে প্রথম হোক কিংবা শেষ, সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছে নারীর ওপরই। কখনো বন্দী করে রাখা কিংবা কখনো মুক্ত করার প্রলোভন দেখিয়ে আরও অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার এই বাড়াবাড়ি আফগান নারীদের আরও বিপজ্জনক অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তবে যেহেতু মানুষ জন্মগতভাবে আশাবাদী এবং যেকারণেই হোক কিছুটা শিক্ষার আলো আফগান নারীদের একটা অংশ ধারণ করতে পেরেছে, তাই তাদের অনেকেই তালেবান সরকারের কঠোর নিয়মের মধ্যে নিজেদের জীবনকে মানিয়ে নিতে গিয়ে ধীরে হলেও ফুঁসে উঠছে। শহুরে শিক্ষিত নারীরা খাঁচায় বন্দী হয়ে থাকতে চায় না। তাই অনেকেই পালিয়ে গেছে। অনেকে এখনো আশায় বুক বেঁধে আছে। ছোট ছোট দলে হলেও অনেকেই সাহসের সঙ্গে প্রতিবাদ করছে। দেশটির প্রত্যন্ত অঞ্চলের অশিক্ষিত নারীরাও এখন বন্দী জীবন নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করছে।
নারীদের মুক্তি অন্যের হাতে নয় বরং আসা উচিত নিজেদের হাত ধরেই। কারও করুণা করে দেওয়া স্বাধীনতা নয় বরং আফগান নারীদের প্রয়োজন নিজের অধিকার নিজেই বুঝে নেওয়া। সেই সম্ভাবনাই যেন বর্তমানে দূরের তারার আলোর মতো উঁকি দিচ্ছে আফগান শহরগুলোতে। আর এ কারণেই হয়তো আফগান নারীদের মুক্তির ক্ষীণ আশা নতুন করে দেখা দিচ্ছে পৃথিবীর সকল নারীদের মধ্যে।
ডেস্কে বসে কপের খবর নেওয়া আর আকাশের চাঁদ ছোঁয়ার মধ্যে যেন তেমন কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ল আনিকা তাবাসসুমের কথা। এই মুহূর্তে তিনি আছেন আজারবাইজানের বাকুতে। এত এত অ্যাপের দুনিয়ায় তাঁকে ধরা কি খুব কঠিন? চেষ্টা করতেই তাঁর কাছ থেকে পাওয়া গেল উত্তর। আমরাও চটপট কথা বলে ফেললাম আনিকার সঙ্গে।
২ দিন আগেবাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতে ৩৩ লাখ ১৭ হাজার ৩৯৭ জন শ্রমিক কাজ করছেন এখন। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) বায়োমেট্রিক ডেটাবেইস থেকে পাওয়া গেছে এ তথ্য। এই বিশালসংখ্যক শ্রমিকের মধ্যে ১৭ লাখ ৩৪ হাজার ৪৫৯ জন বা ৫২ দশমিক ২৮ শতাংশ নারী...
২ দিন আগেআরব অঞ্চলের দেশগুলোর ঐতিহ্যবাহী খেলা উটের দৌড়। একসময় আমাদের দেশে যেমন ঘোড়দৌড় হতো, বিষয়টি তেমনই। সেখানে শুধু ঘোড়ার বদলে থাকে উট। সে উট যাঁরা চালনা করেন, তাঁরা হলেন জকি। এত দিন জকি হিসেবে সৌদি আরবে ছিল পুরুষদের দাপট। দেশটিতে সেই প্রচলিত প্রথা অবশ্য ভেঙেছে ২০২২ সালে...
২ দিন আগেঅ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে পেনিসিলিনের আবিষ্কার মানবজাতিকে স্বস্তি দিয়েছিল। তারপর আবিষ্কৃত হয় ছত্রাকজনিত রোগের বিরুদ্ধে কর্মক্ষম অ্যান্টিবায়োটিক নাইস্ট্যাটিন। এটির সঙ্গে যুক্ত আছে রাচেল ফুলার ব্রাউন এবং তাঁর সহযোগী এলিজাবেথ হ্যাজেনের নাম। এই দুজনের আবিষ্কারটি ছিল ছত্রাকজনিত রোগের বিরুদ্ধে প্রথম কার্যকর
২ দিন আগে