সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন
বাতাসে ভেজা মাটির চেনা গন্ধ। ভোরে বৃষ্টি হয়েছিল, তাই এমন ভেজা রূপে সেজেছে চারদিক। এমন দিনে বসে আড্ডাটা ভালোই জমে; তা যদি হয় কবিতা আর গানের, তবে তো কথাই নেই! আর বুকের ভেতর যদি জাগে একাত্তরের শিহরণ? সেদিন গান, কবিতা আর একাত্তরের আড্ডায় মনে হচ্ছিল এখনই রণক্ষেত্রে নেমে যাই, গুঁড়িয়ে দিই রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের! মনে হবে না কেন, সাহস আর প্রেরণা হয়ে যে সামনে ছিলেন কাজী রোজী স্বয়ং। তিনি কবি এবং আরও অনেক কিছু। বলছি ২০১৪ সালের জুন মাসের একদিনের কথা। সেদিন প্রথমবারের মতো কবির সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। সাংবাদিকতার শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী আমি। ক্লাস অ্যাসাইনমেন্টের জন্যই ছিল সেদিনের আয়োজন।
আজ সেই দিনের কথা খুব মনে পড়ছে। না, বয়স ও বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ুষ্কাল বিচারে তাঁর চলে যাওয়াকে ‘অবেলায়’ শব্দ দিয়ে ঠিক বাঁধা যাবে না। তবে কিছু মানুষ তো থাকেন, যাঁদের প্রস্থান মাত্রই ‘অবেলার ডাক’ বলে মনে হয়। মন বিষণ্ন হয়ে যায়। আর কী আশ্চর্য, সেই প্রথম সাক্ষাতের মতো তাঁর এই চলে যাওয়া দিনও কেমন মেদুর হয়ে আছে বৃষ্টির ছাঁটে। বসন্তের এই বৃষ্টি প্রস্তুতিহীন তো বটেই। তবু প্রশ্ন জাগে, এ কী কবি কাজী রোজীর প্রস্থানকে বিশেষ করে তুলতে প্রকৃতির কোনো আয়োজনও? সে যা-ই হোক, তাঁর প্রস্থান ও প্রথম সাক্ষাতের সঙ্গে এই সময়ের এমন মিলে যাওয়া—মনকে কেমন বিষাদে ভরিয়ে দেয়। সে বিষাদে ডুব দিয়ে মনে মনে খুঁড়ে চলি স্মৃতির প্রান্তর।
সেদিন সকালে ভেজা প্রকৃতির রূপ দেখতে দেখতে উপস্থিত হয়েছিলাম কাজী রোজীর ধানমন্ডির বাসায়। দেখে চিনতে পারলেন না। না চেনারই কথা। আগে কোনো দিন পরিচয় হয়নি তো! পরিচয় দিতেই খুশি হয়ে বললেন, ‘জানো, তোমাদের বয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গল্প করতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। মনে হয় আমিও সেই তরুণ বয়সে আছি।’
মানুষটাকে দেখেই বোঝা যায় যে কত ঝড়-তুফানের মোকাবিলা করে কত কঠিন একটা ব্যক্তিত্ব নিজের মধ্যে ধারণ করেছেন। অথচ হৃদয়টা যেন একদম শিশুর মতো। অল্প সময়ের মধ্যেই এমনভাবে আপন করে নিয়েছিলেন, যেন আমি তাঁর কত দিনের চেনা বন্ধু। এর মধ্যে কিছুটা মান-অভিমানের পর্বও সেরে নিয়েছিলেন। কেননা তাঁর পরিবেশন করা নাশতা খেতে দেরি করছিলাম!
যা হোক, গল্প শুরু করেছিলেন তাঁর জীবনের কঠোর সংগ্রাম দিয়ে। ‘জন্মের পর মায়ের বুকের দুধ খেতে পারিনি, সেই থেকে আমার সংগ্রাম শুরু। আমি একাত্তরে সংগ্রাম করেছি, যুদ্ধ করেছি। কিন্তু অস্ত্র হাতে নিয়ে নয়। এ নিয়ে কিছুটা আক্ষেপ আছে। তবে আমি ছিলাম শব্দসৈনিক। স্বাধীন বাংলা বেতারে আবৃত্তি করতাম। বেলাল মাহমুদের হাত ধরেই সেখানে যাওয়া। কিছু গান, কবিতা আর নাটকও লিখেছি।’
এভাবে নতুন করে নিজের পরিচয় দিয়ে চলে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ভয়াল স্মৃতিতে—‘যুদ্ধ শুরুর আগের কিছু কথা বলে নিই। আমরা থাকতাম মিরপুরে। আমার প্রতিবেশী ও বন্ধু ছিল মেহেরুন্নেসা। মিরপুরে ছিল বিহারিদের আস্তানা। সেখানে উর্দুভাষী অবাঙালিরা বাস করত। তারা বাঙালিদের ওপর অত্যাচার করত। কারও ডিমের খাঁচা ভেঙে ফেলত, কারও পান-সিগারেটের দোকান ভেঙে ফেলত, এমনকি শিশু ও মেয়েদেরও ধরে নিয়ে যেত। আমার চোখের সামনেই ঘটত এসব ঘটনা। আগে ভেবেছিলাম এদের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করব। কিন্তু না, পরে চিন্তা করলাম এদের সঙ্গে ঠিকভাবে বসবাস হবে না। কারণ, আমরা বাঙালি, বাংলায় কথা বলি। আর ওদের ভাষা উর্দু। তখন আমরা কয়েকজন তরুণ এসবের প্রতিবাদ করতাম। আমাদের সঙ্গে বন্ধু মেহেরুন্নেসাও ছিল।’
সেসব স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতেই চলে এলেন অবধারিত সেই কালরাতে, যেখানে তাঁর প্রজন্মের সবাইকেই অন্তত একবার দাঁড়াতে হয় চুপচাপ, থমকে যেতে হয়, টানতে হয় দীর্ঘশ্বাস। বলতে থাকলেন, ‘২৫ মার্চ বিকেলে খবর পেলাম আমার বাসায় হামলা হবে। আমাকে মেরে ফেলা হবে। তখনো জানি না সেই রাত হতে চলেছে ভয়ংকর কালরাত। এর আগেও আমাকে বিহারিরা হত্যা করতে এসেছিল। কিন্তু পারেনি। আমাদের এক মামা ছিলেন। পাড়ার সবাই তাঁকে শহীদ মামা ডাকত। সেই শহীদ মামা আমাকে সেদিন বাঁচিয়েছিলেন। নইলে এই কাজী রোজীকে তোমরা দেখতে পেতে না।’
বিপদ টের পেয়ে রোজী চলে যান কলাবাগানে। বন্ধু মেহেরুন্নেসাকেও অন্য কোথাও চলে যেতে বলেছিলেন। তিনি শোনেননি। রোজী বলছেন, ‘মেহেরকেও বলেছিলাম যে এখান (মিরপুর) থেকে অন্য কোথাও চলে যাও। কিন্তু ও বলেছিল, “কোথায় যাব, আমার তো পরিবার ছেড়ে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। ” সেদিন আমি চলে গিয়েছিলাম কলাবাগানে আমার খালার বাসায়। এর দুদিন পর ২৭ মার্চ খবর পাই মেহেরুন্নেসাকে সপরিবারে কাদের মোল্লার নির্দেশে পাকিস্তানের দোসররা জবাই করে হত্যা করেছে। আমি ওঁকে বাঁচাতে পারলাম না।’
কবি বন্ধু মেহেরুন্নেসার কথা বলতে বলতে কাজী রোজীর বুক থেকে বেরিয়ে আসে অবধারিত দীর্ঘশ্বাস। পরক্ষণেই চোখে মুখে সতেজ হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘আমি কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে সংগ্রাম করেছি। আমি সাক্ষ্য দিয়েছি। আমি কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি। ২০১১ সালে ট্রাইব্যুনালে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে বলেছি আমি এ কথা। ওরা বারবার বলেছে, আপনি তো দেখেননি। আর আমি বারবার বলেছি, হ্যাঁ আমি দেখিনি, শুনেছি। কিন্তু আমি জানি কাদের মোল্লা কী করতে পারে।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেওয়ার পর যখন ২০১২ সালে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়, তখন বেশ হতাশ হয়েছিলেন। কিন্তু আশা ছাড়েননি কখনো। এ নিয়ে বলছিলেন, ‘সব টেলিভিশন চ্যানেল আর পত্রিকা আমার প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিল। আমি বলেছি, এই রায় আমার নয়, জনগণের নয়, দেশের নয়। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি আপিল হবে, রায় হবে। ঠিকই আপিল হয়েছে, ফাঁসির রায় হয়েছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লৌহমানবের মতো সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন বলেই এই রায় কার্যকর হয়েছে।’ বলেই একটা স্বস্তির নিশ্বাস নিয়েছিলেন, যেন কত বছরের ঋণ বহু কষ্টে শোধ করতে পারলেন। তার পর একটা প্রশান্তির হাসি হাসলেন।
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে অনেক হুমকির সম্মুখীন হতে হয়েছে কাজী রোজীকে। কিন্তু তিনি কোনো কিছুরই পরোয়া করেননি। এমনকি সরকারের কাছ থেকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তাও নিতে চাননি।
২০০৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য অধিদপ্তর থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে অবসর গ্রহণের পর আবার ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে সংসদের নির্বাচিত সদস্য হিসেবে যোগ দেন। অভিভূত কবি রোজী জানিয়েছিলেন, ‘আমি সংসদে যেতে পেরে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিরকৃতজ্ঞ।’ সংসদে তিনি বাজেট নিয়ে নিজের লেখা কবিতাও আবৃত্তি করেছেন। বললেন, প্রধানমন্ত্রী নাকি আবদার করেছেন তাঁর কাছে, সব সময় যেন তিনি কবিতা লিখে যান।
বয়সী কিন্তু তারুণ্যদীপ্ত প্রাণোচ্ছল এই মানুষটিকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে, তিনি তখন ২১ বছর ধরে ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে ছিলেন। তাঁর ভাষায় বলি, ‘আমাকে দেখলে কি মনে হয় আমার ক্যানসার? আমি তো দিব্যি ভালো আছি।’ এভাবে ভালো থাকতে কেমন করে মানসিক শক্তি পাওয়া যায়, তা জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে সব সময়। একা একা খারাপ লাগলে দৌড়ে পাশের বাড়িতে চলে যাবে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে গল্প করবে। এর চেয়ে আর বড় ওষুধ নাই।’ তিনিও নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন সাহিত্যে আর সংসদে, কখনো প্রতিবন্ধীদের মাঝে, আবার কখনো আদিবাসীদের সঙ্গে। এটাই ছিল তাঁর ক্যানসারের বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার প্রেরণা।
আর কবি পরিচয়, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে কণ্ঠে শাণিত শব্দ নিয়ে যে যুদ্ধ, তার কথা এ সবের উল্লেখ এখন তো বাতুলতা। স্বাধীন বাংলা বেতারে কবিতা আবৃত্তি করে কত শত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষদের সাহস জুগিয়েছেন তিনি! লিখেছেন গান, কবিতা, নাটক, আর জীবনী। কত যে লিখেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘পথ ঘাট মানুষের নাম’, ‘নষ্ট জোয়ার’, ‘ভালোবাসার কবিতা’, ‘প্রেমের কবিতা’, ‘মানুষের গল্প’, ‘খানিকটা গল্প তোমার’, ‘আমার পিরানের কোন মাপ নেই’, ‘লড়াই’, ‘শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা’ ইত্যাদি। পেয়েছেন বহু সম্মাননা। আর ভালোবাসা, ভালোবাসা। সে ভালোবাসার জোরেই পাকিস্তানের দোসরদের শাস্তির দাবিতে সংগ্রাম করেছেন বহুদিন। বন্ধু কবি মেহেরুন্নেসাকে হত্যার দায়ে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। অনেক বছর কাজ করেছেন প্রতিবন্ধীদের নিয়ে। যুক্ত ছিলেন ডিজেবল রাইটস গ্রুপ, সাবা, লারা, জাতীয় কবিতা পরিষদের সঙ্গে। বহু বছর কাজ করেছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিবাসীদের নিয়েও।
সেদিনের আলাপে তরুণদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘স্বপ্নের পথে বাধা আসবেই, হোঁচট খাবেই। কিন্তু কখনো মুখ থুবড়ে পড়ে যেও না। কোনো পথই সরল নয়। পথে কাঁটা থাকবেই। সেই কাঁটা সরিয়ে সরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’ এ যেন নিজের চলার পথেরই এক সারসংক্ষেপ তুলে ধরলেন তিনি মাত্র কয়েকটি শব্দে। মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম এই মহিরুহের বচন-বুলি। আরও মুগ্ধ হয়ে গেলাম যখন আড্ডার শেষ মুহূর্তে এসে স্বাধীন বাংলা বেতারের এই শব্দ সৈনিকের ভরাট কণ্ঠে শুনছিলাম প্রতিবন্ধীদের নিয়ে লেখা নিজের একটি কবিতা। এখনো কানে বাজছে শেষ তিনটি বাক্য—
‘আমি: বাবা, রঙের শরীরে আলাদা গন্ধ থাকে। সে তো মানুষের চেয়ে কঠিন নয়!
বাবা: তুই ঠিক বলেছিস-মানুষ ভয়াবহ কঠিন।
আমি: আমি কঠিনেরে ভালোবাসিলাম বাবা।’
বাতাসে ভেজা মাটির চেনা গন্ধ। ভোরে বৃষ্টি হয়েছিল, তাই এমন ভেজা রূপে সেজেছে চারদিক। এমন দিনে বসে আড্ডাটা ভালোই জমে; তা যদি হয় কবিতা আর গানের, তবে তো কথাই নেই! আর বুকের ভেতর যদি জাগে একাত্তরের শিহরণ? সেদিন গান, কবিতা আর একাত্তরের আড্ডায় মনে হচ্ছিল এখনই রণক্ষেত্রে নেমে যাই, গুঁড়িয়ে দিই রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের! মনে হবে না কেন, সাহস আর প্রেরণা হয়ে যে সামনে ছিলেন কাজী রোজী স্বয়ং। তিনি কবি এবং আরও অনেক কিছু। বলছি ২০১৪ সালের জুন মাসের একদিনের কথা। সেদিন প্রথমবারের মতো কবির সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। সাংবাদিকতার শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী আমি। ক্লাস অ্যাসাইনমেন্টের জন্যই ছিল সেদিনের আয়োজন।
আজ সেই দিনের কথা খুব মনে পড়ছে। না, বয়স ও বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ুষ্কাল বিচারে তাঁর চলে যাওয়াকে ‘অবেলায়’ শব্দ দিয়ে ঠিক বাঁধা যাবে না। তবে কিছু মানুষ তো থাকেন, যাঁদের প্রস্থান মাত্রই ‘অবেলার ডাক’ বলে মনে হয়। মন বিষণ্ন হয়ে যায়। আর কী আশ্চর্য, সেই প্রথম সাক্ষাতের মতো তাঁর এই চলে যাওয়া দিনও কেমন মেদুর হয়ে আছে বৃষ্টির ছাঁটে। বসন্তের এই বৃষ্টি প্রস্তুতিহীন তো বটেই। তবু প্রশ্ন জাগে, এ কী কবি কাজী রোজীর প্রস্থানকে বিশেষ করে তুলতে প্রকৃতির কোনো আয়োজনও? সে যা-ই হোক, তাঁর প্রস্থান ও প্রথম সাক্ষাতের সঙ্গে এই সময়ের এমন মিলে যাওয়া—মনকে কেমন বিষাদে ভরিয়ে দেয়। সে বিষাদে ডুব দিয়ে মনে মনে খুঁড়ে চলি স্মৃতির প্রান্তর।
সেদিন সকালে ভেজা প্রকৃতির রূপ দেখতে দেখতে উপস্থিত হয়েছিলাম কাজী রোজীর ধানমন্ডির বাসায়। দেখে চিনতে পারলেন না। না চেনারই কথা। আগে কোনো দিন পরিচয় হয়নি তো! পরিচয় দিতেই খুশি হয়ে বললেন, ‘জানো, তোমাদের বয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গল্প করতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। মনে হয় আমিও সেই তরুণ বয়সে আছি।’
মানুষটাকে দেখেই বোঝা যায় যে কত ঝড়-তুফানের মোকাবিলা করে কত কঠিন একটা ব্যক্তিত্ব নিজের মধ্যে ধারণ করেছেন। অথচ হৃদয়টা যেন একদম শিশুর মতো। অল্প সময়ের মধ্যেই এমনভাবে আপন করে নিয়েছিলেন, যেন আমি তাঁর কত দিনের চেনা বন্ধু। এর মধ্যে কিছুটা মান-অভিমানের পর্বও সেরে নিয়েছিলেন। কেননা তাঁর পরিবেশন করা নাশতা খেতে দেরি করছিলাম!
যা হোক, গল্প শুরু করেছিলেন তাঁর জীবনের কঠোর সংগ্রাম দিয়ে। ‘জন্মের পর মায়ের বুকের দুধ খেতে পারিনি, সেই থেকে আমার সংগ্রাম শুরু। আমি একাত্তরে সংগ্রাম করেছি, যুদ্ধ করেছি। কিন্তু অস্ত্র হাতে নিয়ে নয়। এ নিয়ে কিছুটা আক্ষেপ আছে। তবে আমি ছিলাম শব্দসৈনিক। স্বাধীন বাংলা বেতারে আবৃত্তি করতাম। বেলাল মাহমুদের হাত ধরেই সেখানে যাওয়া। কিছু গান, কবিতা আর নাটকও লিখেছি।’
এভাবে নতুন করে নিজের পরিচয় দিয়ে চলে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ভয়াল স্মৃতিতে—‘যুদ্ধ শুরুর আগের কিছু কথা বলে নিই। আমরা থাকতাম মিরপুরে। আমার প্রতিবেশী ও বন্ধু ছিল মেহেরুন্নেসা। মিরপুরে ছিল বিহারিদের আস্তানা। সেখানে উর্দুভাষী অবাঙালিরা বাস করত। তারা বাঙালিদের ওপর অত্যাচার করত। কারও ডিমের খাঁচা ভেঙে ফেলত, কারও পান-সিগারেটের দোকান ভেঙে ফেলত, এমনকি শিশু ও মেয়েদেরও ধরে নিয়ে যেত। আমার চোখের সামনেই ঘটত এসব ঘটনা। আগে ভেবেছিলাম এদের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করব। কিন্তু না, পরে চিন্তা করলাম এদের সঙ্গে ঠিকভাবে বসবাস হবে না। কারণ, আমরা বাঙালি, বাংলায় কথা বলি। আর ওদের ভাষা উর্দু। তখন আমরা কয়েকজন তরুণ এসবের প্রতিবাদ করতাম। আমাদের সঙ্গে বন্ধু মেহেরুন্নেসাও ছিল।’
সেসব স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতেই চলে এলেন অবধারিত সেই কালরাতে, যেখানে তাঁর প্রজন্মের সবাইকেই অন্তত একবার দাঁড়াতে হয় চুপচাপ, থমকে যেতে হয়, টানতে হয় দীর্ঘশ্বাস। বলতে থাকলেন, ‘২৫ মার্চ বিকেলে খবর পেলাম আমার বাসায় হামলা হবে। আমাকে মেরে ফেলা হবে। তখনো জানি না সেই রাত হতে চলেছে ভয়ংকর কালরাত। এর আগেও আমাকে বিহারিরা হত্যা করতে এসেছিল। কিন্তু পারেনি। আমাদের এক মামা ছিলেন। পাড়ার সবাই তাঁকে শহীদ মামা ডাকত। সেই শহীদ মামা আমাকে সেদিন বাঁচিয়েছিলেন। নইলে এই কাজী রোজীকে তোমরা দেখতে পেতে না।’
বিপদ টের পেয়ে রোজী চলে যান কলাবাগানে। বন্ধু মেহেরুন্নেসাকেও অন্য কোথাও চলে যেতে বলেছিলেন। তিনি শোনেননি। রোজী বলছেন, ‘মেহেরকেও বলেছিলাম যে এখান (মিরপুর) থেকে অন্য কোথাও চলে যাও। কিন্তু ও বলেছিল, “কোথায় যাব, আমার তো পরিবার ছেড়ে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। ” সেদিন আমি চলে গিয়েছিলাম কলাবাগানে আমার খালার বাসায়। এর দুদিন পর ২৭ মার্চ খবর পাই মেহেরুন্নেসাকে সপরিবারে কাদের মোল্লার নির্দেশে পাকিস্তানের দোসররা জবাই করে হত্যা করেছে। আমি ওঁকে বাঁচাতে পারলাম না।’
কবি বন্ধু মেহেরুন্নেসার কথা বলতে বলতে কাজী রোজীর বুক থেকে বেরিয়ে আসে অবধারিত দীর্ঘশ্বাস। পরক্ষণেই চোখে মুখে সতেজ হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘আমি কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে সংগ্রাম করেছি। আমি সাক্ষ্য দিয়েছি। আমি কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি। ২০১১ সালে ট্রাইব্যুনালে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে বলেছি আমি এ কথা। ওরা বারবার বলেছে, আপনি তো দেখেননি। আর আমি বারবার বলেছি, হ্যাঁ আমি দেখিনি, শুনেছি। কিন্তু আমি জানি কাদের মোল্লা কী করতে পারে।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেওয়ার পর যখন ২০১২ সালে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়, তখন বেশ হতাশ হয়েছিলেন। কিন্তু আশা ছাড়েননি কখনো। এ নিয়ে বলছিলেন, ‘সব টেলিভিশন চ্যানেল আর পত্রিকা আমার প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিল। আমি বলেছি, এই রায় আমার নয়, জনগণের নয়, দেশের নয়। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি আপিল হবে, রায় হবে। ঠিকই আপিল হয়েছে, ফাঁসির রায় হয়েছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লৌহমানবের মতো সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন বলেই এই রায় কার্যকর হয়েছে।’ বলেই একটা স্বস্তির নিশ্বাস নিয়েছিলেন, যেন কত বছরের ঋণ বহু কষ্টে শোধ করতে পারলেন। তার পর একটা প্রশান্তির হাসি হাসলেন।
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে অনেক হুমকির সম্মুখীন হতে হয়েছে কাজী রোজীকে। কিন্তু তিনি কোনো কিছুরই পরোয়া করেননি। এমনকি সরকারের কাছ থেকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তাও নিতে চাননি।
২০০৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য অধিদপ্তর থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে অবসর গ্রহণের পর আবার ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে সংসদের নির্বাচিত সদস্য হিসেবে যোগ দেন। অভিভূত কবি রোজী জানিয়েছিলেন, ‘আমি সংসদে যেতে পেরে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিরকৃতজ্ঞ।’ সংসদে তিনি বাজেট নিয়ে নিজের লেখা কবিতাও আবৃত্তি করেছেন। বললেন, প্রধানমন্ত্রী নাকি আবদার করেছেন তাঁর কাছে, সব সময় যেন তিনি কবিতা লিখে যান।
বয়সী কিন্তু তারুণ্যদীপ্ত প্রাণোচ্ছল এই মানুষটিকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে, তিনি তখন ২১ বছর ধরে ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে ছিলেন। তাঁর ভাষায় বলি, ‘আমাকে দেখলে কি মনে হয় আমার ক্যানসার? আমি তো দিব্যি ভালো আছি।’ এভাবে ভালো থাকতে কেমন করে মানসিক শক্তি পাওয়া যায়, তা জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে সব সময়। একা একা খারাপ লাগলে দৌড়ে পাশের বাড়িতে চলে যাবে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে গল্প করবে। এর চেয়ে আর বড় ওষুধ নাই।’ তিনিও নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন সাহিত্যে আর সংসদে, কখনো প্রতিবন্ধীদের মাঝে, আবার কখনো আদিবাসীদের সঙ্গে। এটাই ছিল তাঁর ক্যানসারের বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার প্রেরণা।
আর কবি পরিচয়, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে কণ্ঠে শাণিত শব্দ নিয়ে যে যুদ্ধ, তার কথা এ সবের উল্লেখ এখন তো বাতুলতা। স্বাধীন বাংলা বেতারে কবিতা আবৃত্তি করে কত শত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষদের সাহস জুগিয়েছেন তিনি! লিখেছেন গান, কবিতা, নাটক, আর জীবনী। কত যে লিখেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘পথ ঘাট মানুষের নাম’, ‘নষ্ট জোয়ার’, ‘ভালোবাসার কবিতা’, ‘প্রেমের কবিতা’, ‘মানুষের গল্প’, ‘খানিকটা গল্প তোমার’, ‘আমার পিরানের কোন মাপ নেই’, ‘লড়াই’, ‘শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা’ ইত্যাদি। পেয়েছেন বহু সম্মাননা। আর ভালোবাসা, ভালোবাসা। সে ভালোবাসার জোরেই পাকিস্তানের দোসরদের শাস্তির দাবিতে সংগ্রাম করেছেন বহুদিন। বন্ধু কবি মেহেরুন্নেসাকে হত্যার দায়ে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। অনেক বছর কাজ করেছেন প্রতিবন্ধীদের নিয়ে। যুক্ত ছিলেন ডিজেবল রাইটস গ্রুপ, সাবা, লারা, জাতীয় কবিতা পরিষদের সঙ্গে। বহু বছর কাজ করেছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিবাসীদের নিয়েও।
সেদিনের আলাপে তরুণদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘স্বপ্নের পথে বাধা আসবেই, হোঁচট খাবেই। কিন্তু কখনো মুখ থুবড়ে পড়ে যেও না। কোনো পথই সরল নয়। পথে কাঁটা থাকবেই। সেই কাঁটা সরিয়ে সরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’ এ যেন নিজের চলার পথেরই এক সারসংক্ষেপ তুলে ধরলেন তিনি মাত্র কয়েকটি শব্দে। মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম এই মহিরুহের বচন-বুলি। আরও মুগ্ধ হয়ে গেলাম যখন আড্ডার শেষ মুহূর্তে এসে স্বাধীন বাংলা বেতারের এই শব্দ সৈনিকের ভরাট কণ্ঠে শুনছিলাম প্রতিবন্ধীদের নিয়ে লেখা নিজের একটি কবিতা। এখনো কানে বাজছে শেষ তিনটি বাক্য—
‘আমি: বাবা, রঙের শরীরে আলাদা গন্ধ থাকে। সে তো মানুষের চেয়ে কঠিন নয়!
বাবা: তুই ঠিক বলেছিস-মানুষ ভয়াবহ কঠিন।
আমি: আমি কঠিনেরে ভালোবাসিলাম বাবা।’
ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম রোমান্টিক কবি ছিলেন জন কিটস। কবিতা ছাড়া কিটস কোনো গদ্য লেখার চেষ্টা করেননি। তাঁর কাব্যজীবন ছিল মাত্র ছয় বছরের। অর্থাৎ উনিশ থেকে চব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত। মৃত্যুর মাত্র চার বছর আগে তাঁর কবিতাগুলো প্রকাশিত হয়। তৎকালীন সমালোচকদের দ্বারা কিটসের কবিতা খুব একটা আলোচিত হয়নি। তবে মৃত্য
৪ ঘণ্টা আগেত্রিশের দশকের রবীন্দ্রকাব্যধারাবিরোধী পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে অন্যতম একজন কবি ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর জন্ম ১৯০১ সালের ৩০ অক্টোবর কলকাতার হাতীবাগানে। তাঁর পিতা হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন একজন দার্শনিক। আর স্ত্রী ছিলেন প্রসিদ্ধ গায়িকা রাজেশ্বরী বাসুদেব।
১ দিন আগেসিলভিয়া প্লাথ ছিলেন একজন মার্কিন কবি, ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার। তিনি নারীবাদী কবি হিসেবেও পরিচিত। পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে এবং নারীর পরিচয়-সংকট নিয়ে তিনি তাঁর কবিতায় সাজিয়েছেন স্পষ্টভাবে।
৪ দিন আগেবিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার। তিনি কৌতুকমিশ্রিত গল্পের জন্য জনপ্রিয় ছিলেন। নামের মিল থাকলেও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আর তিনি কিন্তু আলাদা ব্যক্তি।
৭ দিন আগে