ফারজানা লিজা
স্বপ্নটা ঠিক ২০১৮ সাল থেকেই দেখে আসছিলাম, যখন আমার কাছের এক বন্ধু ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশন হিসেবে ভারত ভ্রমণ করে আসে। ফিরে এসে নানা গল্প শুনিয়েছে, আমিও অনেক প্রশ্ন করেছি, সবশেষে বন্ধু আমার একটা কথাই বলল, ডেলিগেশন হিসেবে না গেলে কখনোই এর আনন্দটা অনুভব করতে পারবি না।
সেই ২০১৮ সাল থেকে অপেক্ষা করে আসছিলাম একটা সুযোগের জন্য। ২০১৯ সালে কবে পার হয়ে গেল খেয়ালই রাখিনি, ২০২০ ও ২০২১ করোনা মহামারির জন্য বন্ধ ছিল। দুই বছর পর আবার ২০২২ সালে ইন্ডিয়া হাইকমিশন ও বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশনের যৌথ আয়োজনে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশন ২০২২।
তবে এবারের আবেদনের প্রক্রিয়া ভিন্ন রকমের। ইন্ডিয়া হাইকমিশনের ওয়েবসাইটে গিয়ে আবেদন করার পাশাপাশি দুই মিনিটের একটি ভিডিও আপলোড করতে হবে, তা-ও আবার নিজের ফেসবুক ওয়ালে পাবলিক পোস্ট। ভীষণ দ্বিধায় পড়ে গেলাম, কিছু বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে সাহায্য চাইলাম। দুঃখজনক হলো, কোনো রকম সাহায্য পাইনি। নিজে নিজে সারা রাত ধরে রিসার্চ করে ইয়ুথ ডেলিগেশনের তথ্য খুঁজে বের করলাম। সমস্যা কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। নিজের বলার মতো কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সবাই সবার কত কত প্রতিভার কথা তুলে ধরেছেন। দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে শেষের দিকে চলে এসেছে, আমি এখনো ভিডিও বানাইনি।
এক বিকেলে চিন্তা করলাম, ভিডিওটা বানাব। ক্যামেরার সামনে গিয়ে কথা বলার অভ্যাস আমার একদমই নেই, তার পরও স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে সব আপত্তি রেখে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালাম। বারবার ভুল করছিলাম, রুমমেটরা বেশ হাসাহাসি করছিল, আমার জন্য বেশ আপত্তিকর একটা অবস্থা। রেগে গিয়ে ভিডিও বানানো বন্ধ করে দিলাম। কিছুক্ষণ চিন্তা করে দেখলাম যে স্বপ্নটা পূরণের জন্য এত দিন অপেক্ষা করে এলাম, এখন সুযোগ পেয়ে কীভাবে হাতছাড়া করে দিই!
আমি হারতে শিখিনি। শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যেতে চাই। এত সহজে হাল ছাড়ার মানুষ আমি নই। সবশেষে ভিডিওটা বানানো হলো, এডিট করে রাতে আপলোড করলাম, একের পর এক লাইক-কমেন্ট আসছিল। মনের মধ্যে সংশয়—শত শত মানুষ ভিডিওটা দেখছে, যদি সিলেক্ট না হই, ভীষণ লজ্জার ব্যাপার হবে।
নানা কাজের ব্যস্ততায় একদম শেষ দিনে আবেদন করি। তার পর থেকেই দিন গুনছিলাম ইন্ডিয়া হাইকমিশনারের উত্তরের আশায়। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে গত ২৪ জুলাই বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশন থেকে প্রথম সিলেকশন প্রসেসের মেইল আসে। মেইলটা দেখামাত্রই নিজের মধ্যে একধরনের আশার প্রদীপ জ্বলার মতো আনন্দ লাগছিল, ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টার গুলশান, আগামী ৯ আগস্ট অডিশন। সেই মুহূর্তে আমি স্টুডেন্টের বাসায় ছিলাম। বিষয়টা স্টুডেন্টের সঙ্গে শেয়ার করলাম। সে ভীষণ খুশি শুনে, আর আমাকে বেশ অনুপ্রাণিত করেছিল, মনে অনেক সাহস জুগিয়েছিল।
আস্তে আস্তে অডিশনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম। ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিভাগে অডিশন হচ্ছে। তিনটা বিভাগে কত হাজার হাজার মানুষ অডিশন দিচ্ছে। ইয়ুথ ডেলিগেশনের পেইজে শুধু আপডেট দেখছিলাম—চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সবশেষে ঢাকা বিভাগের অডিশন। অনির্দিষ্ট কারণবশত ঢাকা অডিশনের তারিখটা একটু পরিবর্তন করে ১১ জুলাই দেওয়া হয়। অডিশনের দিন সকাল সকাল চলে গেলাম ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টার, গুলশান ২ নম্বরে। অনেকে বাইরে অপেক্ষা করছিল, আস্তে আস্তে সবার সঙ্গে পরিচিত হতে লাগলাম। প্রথমে পরিচিত হলাম নাহিদা খান সুর্মী, স্নাতক চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। হবিগঞ্জ জেলা থেকে এসেছে, পেশায় একজন আবৃত্তিশিল্পী, ২০২১ সালে অমর একুশে বইমেলায় তার একটি স্বরচিত কবিতার বই প্রকাশিত হয়। বেশ হাসিখুশি একটা মেয়ে। সেই সঙ্গে কাজ করছে হবিগঞ্জ জেলার শিল্পকলা একাডেমিতে আবৃত্তি শিক্ষক হিসেবে।
পরিচিত হলাম নীল নন্দিতা রিছিল আপুর সঙ্গে। তিনি একজন গারো আদিবাসী। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। তিনি চান তাঁর গারো ভাষাকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করে প্রসার বিস্তার করতে। নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে এর থেকে ভালো উদ্যোগ হয়তো আর নেই।
সকাল ১০টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টারের ভেতরে প্রবেশের সুযোগ দিল। সবাই সারিবদ্ধ হয়ে ভেতরে গিয় রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আসন গ্রহণ করেছি। ফটোগ্রাফার, ভিডিওগ্রাফার বিভিন্ন সাইট থেকে ফুটেজ ও ছবি নিচ্ছে। ক্যামেরার শাটারের ষাট ষাট শব্দ কানে আসছে। অডিশনে বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন জনপ্রিয় তরুণ অভিনেতা আরিফিন শুভ এবং আমাদের দেশের গর্ব, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় জাহানারা আলম। কালচারাল সেন্টারের ভেতরে একটা উন্মুক্ত জায়গায় সবার সঙ্গে পরিচিত হন এবং মতবিনিময় করেন। আরও উপস্থিত ছিলেন ইন্ডিয়া হাইকমিশন ও বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশনের সম্মানিত পদস্থ কর্মীরা। বাংলাদেশ ও ভারতের শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি, ভ্রমণসহ নানাবিদ বিষয় নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হলো। আশপাশের সবাই নিজেকে অবহিত করতে হাত বাড়িয়ে মাইক্রোফোন দিয়ে কথা বলছেন। নিজেকে সবার মাঝে তুলে ধরছেন। এ এক অন্যরকম অনুভূতি।
আমি শুধু চুপ করে বসে থেকে শুনছিলাম আর অনুধাবন করছিলাম। কেন জানি আমার কথা বলার থেকে শুনতে বেশি ভালো লাগে। হয়তো অন্যদের থেকে নতুন কিছু শিখতে পারব, জানতে পারব।
ঘণ্টাখানেক আলাপ-আলোচনা শেষে আমাদের আবার হলরুমের ভেতরে নিয়ে আসা হলো। শুরু হলো কালচারাল ও পারফরম্যান্স প্রোগ্রাম। যে যার খুশিমতো পারফরম্যান্স করছে, কেউ গান গাইছে, নাচ করছে, আবৃত্তি করছে, কেউবা কৌতুকের মজায় সবাইকে হাসির স্রোতে ভাসিয়ে দিচ্ছে। একেকজন নিজের দক্ষতার নিপুণ পরিচয় দিচ্ছিল। সবাই সবাইকে প্রসারিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে অনেকে ভাইবা দিতে চলে গেছে। যারা ভাইভা দিয়ে ফিরে এসেছে, তাদের সবাই মৌমাছির মতো চারপাশ দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে। কী কী প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছে, ভেতরে পরিবেশ কেমন ছিল, জাজেসরা কি আন্তরিক, নাকি কঠোর—নানা প্রশ্ন করছে। আমি আর আমার পাশে থাকা সুর্মি ও নন্দিতা মৌমাছির ভিড়ে না গিয়ে বসে বসে পারফরম্যান্স উপভোগ করছিলাম।
অনেক সময় বাদে আমার ভাইবার সিরিয়াল এল, একধরনের ভীতি কাজ করছিল। সবাইকে লাইন করে ভাইবা বোর্ডের সামনে বসিয়ে রাখা হলো, একেকজন করে ঢুকছে। পাশে দাঁড়ানো এক কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করলাম ভেতরের অবস্থা কেমন। যিনি ভাইভা নিচ্ছেন, উনি কেমন। তারা জানালেন, উনি ইন্ডিয়ান, তবে বেশ নরম স্বভাবের মানুষ। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি ভাষা নিয়ে একধরনের সংশয় কাজ করছে। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার জন্য দোয়া পড়তে থাকলাম।
খানিক বাদে আমার পালা এল। নম্রভাবে একটা সালাম দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। প্রথমে আমাকে পরিচিত করার জন্য বলা হলো, ভাইবা হচ্ছিল সম্পূর্ণ ইংরেজিতে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পূর্ণ করার পরেও ইংরেজিতে একটা বড় ধরনের ভীতি রয়ে গেছে। চিন্তা করলাম, আমার নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে এটাই শেষ এবং উত্তম সুযোগ। যেভাবেই হোক, আমাকে সর্বোচ্চ প্রদর্শন করতে হবে। নিজের ভাষায় যতটা প্রাণবন্তভাবে কথা বলা যায়, অন্য ভাষায় সেটা কখনোই সম্ভব নয়। স্যারক বললাম, ‘স্যার, আমি কি বাংলায় কথা বলতে পারি?’ স্যার বেশ বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘হ্যাঁ শিওর, আমি বাংলা বুঝি।’ মুহূর্তে আমার মাঝে একধরনের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন চলে এল। নিজের মাঝে বেশ আত্মবিশ্বাস অনুভব করতে লাগলাম। একটু নড়েচড়ে বসলাম, অনেকটা গোল টেবিলে আড্ডার মতো। এখন আপনি যা-ই প্রশ্ন করুন, আমি প্রস্তুত আছি। আমার শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন, যে জায়গায় অবস্থান করছি—নানা বিষয় নিয়ে আমাকে অনেক প্রশ্ন করা হলো। সব প্রশ্নের উত্তর বেশ সাবলীলভাবে দিয়েছি। বাবা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরি করার সুবাদে সেনাবাহিনী সম্পর্কিত বেশ প্রশ্ন করা হলো।
মজার বিষয় হলো, আমার আউটলুক, কথাবার্তা ও ভাবভঙ্গি দেখে উনি মনে করেছিলেন আমি হয়তো সেনাবাহিনীতে চাকরি করছি। ছোটবেলা থেকে আর্মি প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করার সুবাদে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যে আর্মি মনোভাব প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব আদায়ে সহযোগী সংবাদমাধ্যমে কাজ করার সুবাদে বাংলাদেশ ও ভারতের রাজস্ব বিষয় নিয়ে বেশ কিছু আলাপ-আলোচনা হলো। বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশন ও ইন্ডিয়া হাইকমিশন নিয়ে অনেক কথাবার্তা হলো, সবশেষে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমার ভাইবা পর্ব শেষ হলো।
ভাইবা বোর্ড থেকে বের হয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে বেশ স্বাভাবিক অনুভব করছিলাম। বাইরে আসার সঙ্গে সঙ্গে মৌমাছির মতো চারপাশ থেকে আঁকড়ে ধরেছে। এত সময় কী কথা বললাম, কী কী প্রশ্ন করল—নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম। আসলে ভাইভা বিষয়টি একটা নির্ভরশীল ব্যাপার। আমাকে যা প্রশ্ন করেছে, আপনাকে সেগুলো না-ও করতে পারে, আপনাকে হয়তো আপনার পছন্দের জায়গা থেকে প্রশ্ন করা হবে। যেখান থেকেই করুক না কেন, সব সময় নিজের ভেতরে আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে, নিজেকে প্রমাণ করার জন্য নিজে চেষ্টা করতে হবে। এই নশ্বর প্রতিযোগী পৃথিবীতে কেউই আপনার সহযোগী নয়, সবাই প্রতিযোগী।
তারপর কালচারাল প্রোগ্রাম কিছু সময় দেখে বাড়ির পথে রওনা হলাম। গুলশান এরিয়া ভালো করে চেনা-জানা নেই, নন্দিতা আমাকে বারিধারা পর্যন্ত এগিয়ে দিল। বাকি পথ নিজেই চলে এসেছি। শুরু হয়ে গেল আরেক অপেক্ষার দিবস।
হোস্টেলে এসে চিন্তা করতে লাগলাম, যারা অডিশন দিতে এসেছে, সবাই সেরা। এখান থেকে ১০০ জন নেওয়া হবে। হয়তো আমি পারব না, নিজের মাঝে অসাধারণ কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পড়াতে এসে স্টুডেন্টের সঙ্গে আজকের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলাম। সে বেশ এক্সাইটেড, স্টুডেন্ট ও আন্টি দুজনই বেশ অনুপ্রেরণা দিয়েছে এবং বুঝিয়েছে যে নিজেকে কখনোই ছোট মনে করা উচিত নয়। প্রতিটা মানুষের ভেতরে অসীম সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে, শুধু বিকশিত করার অপেক্ষা। সেই সঙ্গে শুরু হলো আমার সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক্ষা।
(চলবে)
স্বপ্নটা ঠিক ২০১৮ সাল থেকেই দেখে আসছিলাম, যখন আমার কাছের এক বন্ধু ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশন হিসেবে ভারত ভ্রমণ করে আসে। ফিরে এসে নানা গল্প শুনিয়েছে, আমিও অনেক প্রশ্ন করেছি, সবশেষে বন্ধু আমার একটা কথাই বলল, ডেলিগেশন হিসেবে না গেলে কখনোই এর আনন্দটা অনুভব করতে পারবি না।
সেই ২০১৮ সাল থেকে অপেক্ষা করে আসছিলাম একটা সুযোগের জন্য। ২০১৯ সালে কবে পার হয়ে গেল খেয়ালই রাখিনি, ২০২০ ও ২০২১ করোনা মহামারির জন্য বন্ধ ছিল। দুই বছর পর আবার ২০২২ সালে ইন্ডিয়া হাইকমিশন ও বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশনের যৌথ আয়োজনে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশন ২০২২।
তবে এবারের আবেদনের প্রক্রিয়া ভিন্ন রকমের। ইন্ডিয়া হাইকমিশনের ওয়েবসাইটে গিয়ে আবেদন করার পাশাপাশি দুই মিনিটের একটি ভিডিও আপলোড করতে হবে, তা-ও আবার নিজের ফেসবুক ওয়ালে পাবলিক পোস্ট। ভীষণ দ্বিধায় পড়ে গেলাম, কিছু বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে সাহায্য চাইলাম। দুঃখজনক হলো, কোনো রকম সাহায্য পাইনি। নিজে নিজে সারা রাত ধরে রিসার্চ করে ইয়ুথ ডেলিগেশনের তথ্য খুঁজে বের করলাম। সমস্যা কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। নিজের বলার মতো কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সবাই সবার কত কত প্রতিভার কথা তুলে ধরেছেন। দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে শেষের দিকে চলে এসেছে, আমি এখনো ভিডিও বানাইনি।
এক বিকেলে চিন্তা করলাম, ভিডিওটা বানাব। ক্যামেরার সামনে গিয়ে কথা বলার অভ্যাস আমার একদমই নেই, তার পরও স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে সব আপত্তি রেখে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালাম। বারবার ভুল করছিলাম, রুমমেটরা বেশ হাসাহাসি করছিল, আমার জন্য বেশ আপত্তিকর একটা অবস্থা। রেগে গিয়ে ভিডিও বানানো বন্ধ করে দিলাম। কিছুক্ষণ চিন্তা করে দেখলাম যে স্বপ্নটা পূরণের জন্য এত দিন অপেক্ষা করে এলাম, এখন সুযোগ পেয়ে কীভাবে হাতছাড়া করে দিই!
আমি হারতে শিখিনি। শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যেতে চাই। এত সহজে হাল ছাড়ার মানুষ আমি নই। সবশেষে ভিডিওটা বানানো হলো, এডিট করে রাতে আপলোড করলাম, একের পর এক লাইক-কমেন্ট আসছিল। মনের মধ্যে সংশয়—শত শত মানুষ ভিডিওটা দেখছে, যদি সিলেক্ট না হই, ভীষণ লজ্জার ব্যাপার হবে।
নানা কাজের ব্যস্ততায় একদম শেষ দিনে আবেদন করি। তার পর থেকেই দিন গুনছিলাম ইন্ডিয়া হাইকমিশনারের উত্তরের আশায়। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে গত ২৪ জুলাই বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশন থেকে প্রথম সিলেকশন প্রসেসের মেইল আসে। মেইলটা দেখামাত্রই নিজের মধ্যে একধরনের আশার প্রদীপ জ্বলার মতো আনন্দ লাগছিল, ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টার গুলশান, আগামী ৯ আগস্ট অডিশন। সেই মুহূর্তে আমি স্টুডেন্টের বাসায় ছিলাম। বিষয়টা স্টুডেন্টের সঙ্গে শেয়ার করলাম। সে ভীষণ খুশি শুনে, আর আমাকে বেশ অনুপ্রাণিত করেছিল, মনে অনেক সাহস জুগিয়েছিল।
আস্তে আস্তে অডিশনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম। ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিভাগে অডিশন হচ্ছে। তিনটা বিভাগে কত হাজার হাজার মানুষ অডিশন দিচ্ছে। ইয়ুথ ডেলিগেশনের পেইজে শুধু আপডেট দেখছিলাম—চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সবশেষে ঢাকা বিভাগের অডিশন। অনির্দিষ্ট কারণবশত ঢাকা অডিশনের তারিখটা একটু পরিবর্তন করে ১১ জুলাই দেওয়া হয়। অডিশনের দিন সকাল সকাল চলে গেলাম ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টার, গুলশান ২ নম্বরে। অনেকে বাইরে অপেক্ষা করছিল, আস্তে আস্তে সবার সঙ্গে পরিচিত হতে লাগলাম। প্রথমে পরিচিত হলাম নাহিদা খান সুর্মী, স্নাতক চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। হবিগঞ্জ জেলা থেকে এসেছে, পেশায় একজন আবৃত্তিশিল্পী, ২০২১ সালে অমর একুশে বইমেলায় তার একটি স্বরচিত কবিতার বই প্রকাশিত হয়। বেশ হাসিখুশি একটা মেয়ে। সেই সঙ্গে কাজ করছে হবিগঞ্জ জেলার শিল্পকলা একাডেমিতে আবৃত্তি শিক্ষক হিসেবে।
পরিচিত হলাম নীল নন্দিতা রিছিল আপুর সঙ্গে। তিনি একজন গারো আদিবাসী। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। তিনি চান তাঁর গারো ভাষাকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করে প্রসার বিস্তার করতে। নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে এর থেকে ভালো উদ্যোগ হয়তো আর নেই।
সকাল ১০টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টারের ভেতরে প্রবেশের সুযোগ দিল। সবাই সারিবদ্ধ হয়ে ভেতরে গিয় রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আসন গ্রহণ করেছি। ফটোগ্রাফার, ভিডিওগ্রাফার বিভিন্ন সাইট থেকে ফুটেজ ও ছবি নিচ্ছে। ক্যামেরার শাটারের ষাট ষাট শব্দ কানে আসছে। অডিশনে বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন জনপ্রিয় তরুণ অভিনেতা আরিফিন শুভ এবং আমাদের দেশের গর্ব, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় জাহানারা আলম। কালচারাল সেন্টারের ভেতরে একটা উন্মুক্ত জায়গায় সবার সঙ্গে পরিচিত হন এবং মতবিনিময় করেন। আরও উপস্থিত ছিলেন ইন্ডিয়া হাইকমিশন ও বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশনের সম্মানিত পদস্থ কর্মীরা। বাংলাদেশ ও ভারতের শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি, ভ্রমণসহ নানাবিদ বিষয় নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হলো। আশপাশের সবাই নিজেকে অবহিত করতে হাত বাড়িয়ে মাইক্রোফোন দিয়ে কথা বলছেন। নিজেকে সবার মাঝে তুলে ধরছেন। এ এক অন্যরকম অনুভূতি।
আমি শুধু চুপ করে বসে থেকে শুনছিলাম আর অনুধাবন করছিলাম। কেন জানি আমার কথা বলার থেকে শুনতে বেশি ভালো লাগে। হয়তো অন্যদের থেকে নতুন কিছু শিখতে পারব, জানতে পারব।
ঘণ্টাখানেক আলাপ-আলোচনা শেষে আমাদের আবার হলরুমের ভেতরে নিয়ে আসা হলো। শুরু হলো কালচারাল ও পারফরম্যান্স প্রোগ্রাম। যে যার খুশিমতো পারফরম্যান্স করছে, কেউ গান গাইছে, নাচ করছে, আবৃত্তি করছে, কেউবা কৌতুকের মজায় সবাইকে হাসির স্রোতে ভাসিয়ে দিচ্ছে। একেকজন নিজের দক্ষতার নিপুণ পরিচয় দিচ্ছিল। সবাই সবাইকে প্রসারিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে অনেকে ভাইবা দিতে চলে গেছে। যারা ভাইভা দিয়ে ফিরে এসেছে, তাদের সবাই মৌমাছির মতো চারপাশ দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে। কী কী প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছে, ভেতরে পরিবেশ কেমন ছিল, জাজেসরা কি আন্তরিক, নাকি কঠোর—নানা প্রশ্ন করছে। আমি আর আমার পাশে থাকা সুর্মি ও নন্দিতা মৌমাছির ভিড়ে না গিয়ে বসে বসে পারফরম্যান্স উপভোগ করছিলাম।
অনেক সময় বাদে আমার ভাইবার সিরিয়াল এল, একধরনের ভীতি কাজ করছিল। সবাইকে লাইন করে ভাইবা বোর্ডের সামনে বসিয়ে রাখা হলো, একেকজন করে ঢুকছে। পাশে দাঁড়ানো এক কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করলাম ভেতরের অবস্থা কেমন। যিনি ভাইভা নিচ্ছেন, উনি কেমন। তারা জানালেন, উনি ইন্ডিয়ান, তবে বেশ নরম স্বভাবের মানুষ। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি ভাষা নিয়ে একধরনের সংশয় কাজ করছে। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার জন্য দোয়া পড়তে থাকলাম।
খানিক বাদে আমার পালা এল। নম্রভাবে একটা সালাম দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। প্রথমে আমাকে পরিচিত করার জন্য বলা হলো, ভাইবা হচ্ছিল সম্পূর্ণ ইংরেজিতে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পূর্ণ করার পরেও ইংরেজিতে একটা বড় ধরনের ভীতি রয়ে গেছে। চিন্তা করলাম, আমার নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে এটাই শেষ এবং উত্তম সুযোগ। যেভাবেই হোক, আমাকে সর্বোচ্চ প্রদর্শন করতে হবে। নিজের ভাষায় যতটা প্রাণবন্তভাবে কথা বলা যায়, অন্য ভাষায় সেটা কখনোই সম্ভব নয়। স্যারক বললাম, ‘স্যার, আমি কি বাংলায় কথা বলতে পারি?’ স্যার বেশ বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘হ্যাঁ শিওর, আমি বাংলা বুঝি।’ মুহূর্তে আমার মাঝে একধরনের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন চলে এল। নিজের মাঝে বেশ আত্মবিশ্বাস অনুভব করতে লাগলাম। একটু নড়েচড়ে বসলাম, অনেকটা গোল টেবিলে আড্ডার মতো। এখন আপনি যা-ই প্রশ্ন করুন, আমি প্রস্তুত আছি। আমার শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন, যে জায়গায় অবস্থান করছি—নানা বিষয় নিয়ে আমাকে অনেক প্রশ্ন করা হলো। সব প্রশ্নের উত্তর বেশ সাবলীলভাবে দিয়েছি। বাবা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরি করার সুবাদে সেনাবাহিনী সম্পর্কিত বেশ প্রশ্ন করা হলো।
মজার বিষয় হলো, আমার আউটলুক, কথাবার্তা ও ভাবভঙ্গি দেখে উনি মনে করেছিলেন আমি হয়তো সেনাবাহিনীতে চাকরি করছি। ছোটবেলা থেকে আর্মি প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করার সুবাদে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যে আর্মি মনোভাব প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব আদায়ে সহযোগী সংবাদমাধ্যমে কাজ করার সুবাদে বাংলাদেশ ও ভারতের রাজস্ব বিষয় নিয়ে বেশ কিছু আলাপ-আলোচনা হলো। বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশন ও ইন্ডিয়া হাইকমিশন নিয়ে অনেক কথাবার্তা হলো, সবশেষে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমার ভাইবা পর্ব শেষ হলো।
ভাইবা বোর্ড থেকে বের হয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে বেশ স্বাভাবিক অনুভব করছিলাম। বাইরে আসার সঙ্গে সঙ্গে মৌমাছির মতো চারপাশ থেকে আঁকড়ে ধরেছে। এত সময় কী কথা বললাম, কী কী প্রশ্ন করল—নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম। আসলে ভাইভা বিষয়টি একটা নির্ভরশীল ব্যাপার। আমাকে যা প্রশ্ন করেছে, আপনাকে সেগুলো না-ও করতে পারে, আপনাকে হয়তো আপনার পছন্দের জায়গা থেকে প্রশ্ন করা হবে। যেখান থেকেই করুক না কেন, সব সময় নিজের ভেতরে আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে, নিজেকে প্রমাণ করার জন্য নিজে চেষ্টা করতে হবে। এই নশ্বর প্রতিযোগী পৃথিবীতে কেউই আপনার সহযোগী নয়, সবাই প্রতিযোগী।
তারপর কালচারাল প্রোগ্রাম কিছু সময় দেখে বাড়ির পথে রওনা হলাম। গুলশান এরিয়া ভালো করে চেনা-জানা নেই, নন্দিতা আমাকে বারিধারা পর্যন্ত এগিয়ে দিল। বাকি পথ নিজেই চলে এসেছি। শুরু হয়ে গেল আরেক অপেক্ষার দিবস।
হোস্টেলে এসে চিন্তা করতে লাগলাম, যারা অডিশন দিতে এসেছে, সবাই সেরা। এখান থেকে ১০০ জন নেওয়া হবে। হয়তো আমি পারব না, নিজের মাঝে অসাধারণ কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পড়াতে এসে স্টুডেন্টের সঙ্গে আজকের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলাম। সে বেশ এক্সাইটেড, স্টুডেন্ট ও আন্টি দুজনই বেশ অনুপ্রেরণা দিয়েছে এবং বুঝিয়েছে যে নিজেকে কখনোই ছোট মনে করা উচিত নয়। প্রতিটা মানুষের ভেতরে অসীম সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে, শুধু বিকশিত করার অপেক্ষা। সেই সঙ্গে শুরু হলো আমার সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক্ষা।
(চলবে)
আকাশি রঙের বাড়ি। দোতলায় দুটি কক্ষে আলো জ্বলছে। সন্ধ্যার আবছা আঁধারে ছেয়ে আছে বাড়িটির চারদিকের গাছগুলো। সন্ধ্যার নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় জলাশয়ে প্রকৃতির এই মোহনীয় ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।
২ দিন আগেচারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
১৩ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
২০ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
২০ দিন আগে