‘এক শ এক রাতের গল্প’ ও কিছু কথা

সাজিদ উল হক আবির 
আপডেট : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৫: ৩২
Thumbnail image

প্রাতরাশের ব্রেড, বাটার অ্যান্ড পোচড এগ, দুপুরে গাড়ির জানালার ওপাশে বৃষ্টিস্নাত সড়ক, সন্ধ্যায় ব্যস্ত কফিশপে ধোঁয়া ওঠা কফির মগে চুমুক-তৈলচিত্রের মতো পরিপাটি আমাদের জনজীবনের নিচে চাপা পড়ে থাকা অনুক্ত, অনুচ্চারিত প্রশ্নগুলো নিয়ে কারবার যে ঔপন্যাসিকের, তিনি শাহীন আখতার। পূর্বপ্রকাশিত পাঁচটি উপন্যাসের ধারাবাহিকতায় কিছুদিন আগে তাঁর নব প্রকাশিত উপন্যাস ‘এক শ এক রাতের গল্প’ সেসব প্রশ্ন উত্থাপনের ধারাবাহিকতাই বজায় রাখল, যা আমরা এড়িয়ে চলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি সাধারণত। 

আড়াই হাজার বছর পুরোনো গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিসের ‘ইডিপাস-রেক্স’ ত্রয়ী নাটকের একটি ‘অ্যান্টিগনি’র আদলে নির্মিত শাহীন আখতারের এই উপন্যাসের মুখ্য এক চরিত্র সাফা মরিয়ম জামাল নিজের ভাইয়ের লাশের দাবি নিয়ে ঘুরে ফিরছে ঢাকা শহরের অলিগলি। তবে তার ভাইয়ের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে হয়নি। শাহরিয়ার অপু জামাল, ধনী পরিবারের আদরের দুলাল, সবার কাছেই যে নিজের মার্জিত আচরণের জন্য পরিচিত ছিল, আত্মীয়দের আসরে গান গাইত, যার কণ্ঠ ছিল শচীন দেববর্মণের মতো—এই ছেলেটিই কাছাকাছি বয়সী আরও কিছু কিশোর তরুণের সঙ্গে মিলে পরিণত হয় আত্মঘাতী ফিদায়ি-ঘাতক ইংগিমাসিতে। হোলি আর্টিজানের হামলার অনুরূপ মে ফ্লাওয়ার রেস্তোরাঁয় হামলার অভিঘাতে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর অভিযানে মারা পড়ে শাহরিয়ার এবং তার সঙ্গীরা। তার আগে তারা উপস্থিত দেশি-বিদেশি অতিথিদের রক্তের নহরে প্লাবিত করে সেই দামি রেস্টুরেন্টের মেঝে। উপন্যাসের কাহিনি এগোতে থাকে এই ঘাতক-আত্মঘাতী জঙ্গিদের কৃতকর্মের অভিঘাতে তাদের পরিবারের সদস্যদের যে অবর্ণনীয় দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তার বুননের সূত্রে। রাষ্ট্র ও সমাজের কাছ থেকে বিন্দুমাত্র সহানুভূতির আকাঙ্ক্ষা রাখাও যখন এই জঙ্গি পরিবারের জন্য বাতুলতামাত্র, তখন সাফা লড়াই করতে থাকে তার মর্গে আটক তার ঘাতক ভাইয়ের লাশ ফিরে পাওয়ার চেষ্টায়। যে ভাইয়ের ঘাতক আত্মার সঙ্গে তাদের সংযোগ না থাকলেও, তার রক্তমাংসের দেহটাকে মাটি দেওয়া একবিংশ শতকের অ্যান্টিগনিসদৃশ সাফার কাঁধে অলঙ্ঘনীয় বোঝা। 

শাহীন আখতারবর্ণনাভঙ্গিতে উত্তর-আধুনিক উপন্যাসের হাওয়ামহলীয় কানুনের অনুবর্তী এ উপন্যাস বর্ণিত হয়ে চলে পাঁচটি অনুচ্চকণ্ঠের ফিসফিসানিতে। পুরোনো মহলে যেমন বাতাসের কানাকানিতেভেসে আসে, ছুঁয়ে যায় তার ভ্রমণকারীদের-নানাবিধ আওয়াজ, শাহীন আখতারের এ উপন্যাসেও বক্তা চরিত্রগুলোর আলাপ ঠিক যেন মৃদুমন্দ হাওয়ার প্রবাহ। তারা জমাট, ভারী, যতটা না পাঠকের সঙ্গে আলাপচারিতায় আগ্রহী, তার চেয়ে অনেক বেশি মনোযোগ তাদের নিজেদের চিন্তাপ্রবাহের জট উন্মোচনে। সেই শতবর্ষী, কিন্তু এখনো আধুনিক চৈতন্যপ্রবাহ রীতিতে উপন্যাসের কথক চরিত্রগুলোর চিন্তার জাল বিছানো উপন্যাসের পাতায় পাতায়। 

অ্যালুশন বা ইঙ্গিতমানতা-শাহীন আখতারের উপন্যাসের অন্যতম শক্তি। আলোচ্য উপন্যাসটিও তার ব্যতিক্রম নয়। উপন্যাসের নামকরণ থেকেই বরং এর শুরু। আরব্য রজনীর এক হাজার এক রাতের অনুকরণে তার উপন্যাসের নাম এক শ এক রাতের গল্প। উপন্যাসের পাঁচ কথকের একজন-‘শফি মোহাম্মদ’ উজিরকন্যা শেহেরজাদের ভূমিকায়। ধর্মের নামে হত্যার শিকড় তালাশে শফির ঘোরলাগানো কণ্ঠে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে হাশিশসেবী ফিদায়ি বা আত্মঘাতী হামলাকারীদের আশ্রয় আলামুত পর্বতমালা, তাদের দীক্ষাগুরু ‘শাইখুল জাবাল’ হাসান-ই সাব্বাহ, হাসানের দোস্ত কবি উমর খৈয়ামের রুবাই, পোপের রাজনৈতিক অভিলাষের প্ররোচনায় একের পর এক ক্রুসেড যুদ্ধ, সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী, কিং রিচার্ড-দা লায়নহার্ট, কূটনীতিক ও ইতিহাসবেত্তা উসামা ইবনে মুনকিদসহ নিকট অতীতের ঐতিহাসিক ঘটনা ও চরিত্র, যেমন-কানা ক্কালবু ফিলিস্তিন, তথা ফিলিস্তিনের হৃদয় কবি মাহমুদ দারবিশ, জায়নবাদ ও ওহাবিজম, ভারতের খিলাফত আন্দোলন, সিরিয়ার শরণার্থী ক্যাম্পে নিজভূম ফিলিস্তিনে ফিরবার অপেক্ষায় থাকা এক তরুণের কাল্পনিক আখ্যান। আছে আধুনিক খিলাফতের কেন্দ্র সিরিয়ার রাকায় গিয়ে জিহাদে সংযুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় থাকা ওপর এক কাল্পনিক তরুণ আবু ইসহাকের মোহভঙ্গের ঘটনা। নিহত জঙ্গি শাহারিয়ারের সাবেক প্রেমিকা দিলরুবা মেহবুবা প্রায়ই শাহরিয়ারের প্রতি তার আকর্ষণের বর্ণনা দিতে গিয়ে উল্লেখ করে অ্যাব্রাহামিক ট্র্যাডিশনে সুবিখ্যাত ইউসুফ জুলেখার আখ্যান।

উগ্রবাদ এবং সহিংসতা কি ধর্মের সূত্রেই হয় কেবল, না এর লেবাসের আড়ালে রাজনৈতিক অভীপ্সাটা মূল? উপন্যাসে আখ্যানের ছলে এড়িয়ে যাওয়া যায় না এমন অসংখ্য প্রশ্ন আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলবে, ধাঁধায় ফেলবে। মে-ফ্লাওয়ার হামলায় আত্মঘাতী জঙ্গিদের লাশ তাদের স্বজনেরা দাফনের সুযোগ পায় কি পায় না-উপন্যাসের এ মূল প্রসঙ্গের পাশাপাশি উত্থিত অপরাপর প্রসঙ্গ ও প্রশ্ন আপনাকে এ ধারণায় উপনীত হতে সহায়তা করবে যে সহিংসতার পেছনের যোগসূত্রগুলো কর্তন করা ছাড়া এর প্রাদুর্ভাব কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। মার্ক রথকোর ছবি অবলম্বনে জাহিদুর রহিম অঞ্জনকৃত প্রচ্ছদ উপন্যাসের রক্তাক্ত প্রেক্ষাপট ও চাপা বেদনার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। বইটির প্রকাশক-প্রথমা প্রকাশনী।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত