অনন্য অনন্তের পথে লুইজ গ্ল্যিক 

মুহম্মদ মজিবুর রহমান
Thumbnail image

২০২০ সালে যখন লুইজ গ্ল্যিককে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলো তখন বঙ্গ সমাজে এক ‘গেল গেল’ রব উঠল, হায় হায়, এ কাকে পুরস্কার দেওয়া হলো, আমরা তো তাঁকে চিনি না। আমাদের সবার পঠনের সীমানা বিশ্ববিস্তৃত নয়। সবাই যে সবাইকে চিনবেন, এমনও নয়। তবে আমরা না চিনলেও ইউরোপ- আমেরিকাতে লুইজ গ্ল্যিক সে সময়ই পরিচিত ছিলেন। কেননা, ইতিপূর্বে লুইজ এলিজাবেথ গ্ল্যিক মার্কিন সাহিত্য জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার পুলিৎজার পেয়েছেন (১৯৯৩) তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘দ্য ওয়াইল্ড আইরিস’-এর জন্য। ২০০৩-২০০৪ সালে তিনি আমেরিকার ‘পোয়েট লোরিয়েট’ হয়েছেন। কবিতার নিবিড় পাঠকগণ নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগেই লুইজ গ্ল্যিকের একাধিক কবিতা পাঠ করেছেন ‘দ্য নর্টন অ্যান্থোলজি অব পোয়েট্রি’ (১৯৯৬) এবং ‘দ্য রিভারসাইড অ্যান্থোলজি অব লিটারেচার’ (১৯৮৮)-এর মতো নামকরা সব কাব্য সংগ্রহের সুবাদে। আজকের এই ২০২৩ সালে এসে লুইজ গ্ল্যিক কে, তা আর চিনিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বিশ্বের সব বড় বড় সংবাদমাধ্যম লুইজ গ্ল্যিকের নামে স্মৃতিগাথা যেমন প্রকাশ করছে, তেমনি গ্ল্যিকের কবিতা এবং তাঁর কবিতা ও জীবন নিয়ে আলোচনা ছাপছে। লুইজ গ্ল্যিক ১৪ অক্টোবর ২০২৩ সালে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন।

একজন কবি, মৃত্যুদিনেই প্রমাণ করেন, তিনি মরেননি। লুইজ গ্ল্যিক তাঁর মৃত্যুদিনেই প্রমাণ করলেন তাঁকে নিয়ে আলোচনা, তাঁর সাহিত্য নিয়ে চর্চার শুরু হলো আরও গভীরতর করে। এখন আর কেউ বলতে পারবেন না, লুইজ গ্ল্যিককে তো চিনতে পারলাম না। বিশ্ব সাহিত্যের চর্চাকারীকে আজ লুইজ গ্ল্যিককে চিনে নিতে হবে। একজন কবির এটাই সবচেয়ে বড় অর্জন, যখন তাঁকে চিনে নেওয়ার দায় পাঠকের ঘাড়েই বর্তায়। কাজেই কবির মৃত্যুতে শোক নয়, কবিকে আরও নতুন করে বাঁচিয়ে রাখার দায় তৈরি হয়। কেননা, সত্যিকারের কবি তো অমর।

আজকের দিনে এসে বলা যায়, লুইজ গ্ল্যিক কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। এই প্রতিষ্ঠার কারণ কেবল তাঁর পুরস্কার নয়, এর অন্যতম কারণ, তাঁর কবিতার নিজস্ব স্বর। সেই যে জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’। সেই ‘কেউ কেউ’ হয়ে ওঠার প্রধান শর্ত হলো বিশ্ব কবিতার মানচিত্রে নিজের স্বরটি প্রবলভাবে আলাদা করে তুলে ধরা। লুইজ গ্ল্যিকের কবিতা পাঠই আপনাকে বলে দেবে, তিনি কতটা অনন্য। তাঁর কবিতার জগতে প্রবেশের আগে তাঁর জীবন ও দৃষ্টিভঙ্গিটাও খানিকটা জেনে নেওয়া যাক তবে।

সত্যিকারের লেখক, কবি এবং যথার্থ মানুষ তো প্রাকৃতিকভাবেই আলাদা। প্রকৃতি বা সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার এ এক বড় অবদান যে প্রত্যেক মানুষের জেনেটিক কোড আলাদা, চোখের ছাপ, হাতের ছাপ সব আলাদা। তবুও কবিতা লিখতে গিয়ে, ছবি আঁকতে গিয়ে আমরা কেমন একটা বাঁধাধরা ফ্রেমে আটকে যাই। আমরা পূর্বসূরিদের দ্বারা প্রভাবিত হই এবং তার চেয়েও বেশি করে একটা পূর্বধারণা মেনে নিই যে কবিতা এমন, গান এমন, চিত্রকর্ম এমন হতে হবে। এই মান ধারণা মেনে নেওয়াটাই বোধ হয় একজন শিল্পী, কবির অনন্যতার পথে সবচেয়ে বড় বাধা। লুইজ গ্ল্যিকের মতো কারও কারও কবিতা এই অনন্ত অনন্যতার পথে যাত্রা করে। তাঁর কবিতায় তিনি লিখছেন—
আমার মায়ের আর বাবার কোষ; এইবার তোমার পালা
অন্যতম হওয়া, শ্রেষ্ঠতম হওয়া। 
 (মা আর শিশু) 
প্রত্যেক মা তার এই শিশুকে এটুকু শিক্ষাই আদতে দিতে পারে, বাবা-মায়ের কোষ থেকে যে শিশুটি জন্মায়, বড় হয়, তার অন্যতম হওয়ার, শ্রেষ্ঠতম হওয়ার ধারাবাহিক দায়টা তার সেই কোষের মধ্যেই থাকে। কেননা, প্রত্যেক সন্তানই আলাদা, প্রত্যেক মানুষই আলাদা। এই আলাদা সত্তাটি ধরে রাখলেই নিজের কর্মটিও ভিড় থেকে আলাদা হয়ে নিজেকে উদ্ভাসিত করে। বিশ শতকের মহিরুহ শিল্পী পাবলো পিকাসো একবার বয়ান করেছিলেন, ‘প্রত্যেক শিশুই একজন শিল্পী। সমস্যাটা হলো সে যখন বেড়ে ওঠে, তখন সে কতটা শিল্পী রয়ে যায়, সেটুকু সুরক্ষা করা।’ নিজেকে রক্ষা করা, নিজের ভেতরের একান্ত শিল্পীকে রক্ষা করার লড়াইটা লুইজ গ্ল্যিকের কবিতায় পেয়ে যাই, বারবার—

আমি টিকে থাকার আশা করিনি, 
পৃথিবী আমাকে দমন করছিল। আমি আশা করিনি
আবার জেগে ওঠার, অনুভব করব 
যে এই স্যাঁতসেঁতে পৃথিবীতে আমার শরীর
আবার সাড়া দিতে পারবে, স্মরণ করছিলাম
বহুকাল পরে কেমন করে আবার খুলতে হয়
শীতল আলোতে
নব বসন্তকে 
 (তুষারপাত)
 
পৃথিবী যতই দমন করতে চেষ্টা করুক, কবি জেগে ওঠে। সত্যিকারের কবি, শিল্পী সাড়া দিতে পারে নববসন্তে কিংবা তুষারপাতে, এমনকি ইটের দেয়ালের মতো সম্পর্ক ভেদ করেও কবি জেগে ওঠে—

আশ্চর্যের কিছু নেই তুমি তোমার মতোই, 
রক্তে ভয় পাও, তোমার নারী
যেন একটার পর আরেকটা ইটের দেয়াল। 
 (ভালোবাসার কবিতা) 

কবিতার নিজস্বতা, কবিতার শক্তিই একজন কবিকে অনন্তের ময়দানে অমরত্ব দান করে। আমাদের জীবনানন্দ বারবার ফিরে আসেন। ধানসিড়ি নদীটির তীরে। হয়তো শঙ্খচিল, শালিকের বেশে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি করে তিনি ফিরে আসেন নিজের কবিতার মাধ্যমেই। জীবনানন্দ এই বাংলা ছেড়ে যাননি, যাবেন না। লুইজ গ্ল্যিক পৃথিবীর আরেক প্রান্তে, আরেক শতাব্দীতে মৃত্যুবরণ করেও ফিরে আসেন, জন্মাতে থাকেন, নিজের অস্তিত্বকে গাঢ়তর করে তোলেন তাঁর কবিতায়—

আমি জানি না। হয়তো আমি ফিরে আসব, 
হয়তো কোনোভাবে শেষ পর্যন্ত আমরা একত্র হব। 

আমি সেই আকাঙ্ক্ষাই করেছিলাম যা সব সময় আকাঙ্ক্ষা করি। 
আমি আরেকটা কবিতার আকাঙ্ক্ষা করেছিলাম। 
 (আকাঙ্ক্ষা) 

কাজেই, আজ, লুইজ গ্ল্যিক প্রয়াত হলেন আর আমরা এই আকাঙ্ক্ষা রাখলাম, বিশ্ব কবিতার পাঠ দরবারে তিনি ফিরে আসবেন, বারবার। কেননা, কবির প্রয়াণ নেই। কবি চলতে থাকেন অবিরাম, অনন্য অনন্তের পথ ধরে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত