Ajker Patrika

পড়তে পারার ঐশ্বর্য

খান মুহাম্মদ রুমেল
আপডেট : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮: ৩২
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

শীত কি চলে গেছে এবারের মতো? নগর প্রকৃতি দেখলে তাই মনে হয়। কিন্তু দূরের জনপদে, যেখানে জীবন আর প্রকৃতি মাখামাখি করে বাঁচে, সেখানে এখনো বইছে হিমেল হাওয়া। কোথাও কোথাও মাত্রাটা যেন কিছুটা বেশিই। তবে ইট-পাথরের নগরী ঢাকায় যেন বসন্তের আমেজ। ভ্যাপসা গরম নেই! একটা আরামদায়ক আবহাওয়া। হ্যাঁ, পরিবেশদূষণের বিষ আছে বাতাসে। ভয়াবহ মাত্রায়ই আছে। তবু এই আরামদায়ক উষ্ণতা বড় ভালো লাগে।

আর এসবের মাঝেই চিরায়ত নিয়মে শেষ হয়েছে খ্রিষ্টীয় ইংরেজি বছরের প্রথম মাস—জানুয়ারি। এসেছে ফেব্রুয়ারি। এই ফেব্রুয়ারির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির আবেগ, গৌরব এবং শোকস্মৃতি। মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকারের জন্য বাঙালিকে আন্দোলন করতে হয়েছে। মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশ স্লোগানে ১৪৪ ধারা ভাঙতে হয়েছে। জেল-জুলুম খাটতে হয়েছে। বুকের রক্তে রাজপথ লাল করতে হয়েছে। অবশেষে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আ-মরি বাংলা ভাষা। ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ এখন আর শুধু বাঙালির নয়; এই গৌরব এখন আন্তর্জাতিক রূপ পেয়েছে। ভাষার জন্য বাঙালির জীবনদানের দিনটি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

আরেকটি কারণে ফেব্রুয়ারি বাঙালির কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই মাসজুড়ে অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে বইমেলা। বাঙালির প্রাণের মেলা। পুরো একটি মাস বাঙালি মেতে থাকে বইয়ের গন্ধে। বিকেল থেকে রাত অবধি বইপ্রেমী মানুষের ভিড়ে মুখর হয়ে থাকে বাংলা একাডেমি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। পাঠবিমুখের তকমা পাওয়া বাঙালির বইমেলাকেন্দ্রিক এই ভিড় দেখে বড় ভালো লাগে।

পড়তে পারাটা একটা বিশাল ব্যাপার। হাজার বছর বয়সী পৃথিবীতে কত মানুষ। কত বিচিত্র রঙের জিনিস এই দুনিয়ায়। কত মানুষের কত অভিজ্ঞতা। কত কত সভ্যতা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পৃথিবীর প্রান্তরজুড়ে। এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এক ক্ষুদ্র কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি মানুষ। কিন্তু মাত্র সত্তর-আশি বছরের জীবন একেকজন মানুষের। একজীবনে কি তাই সব দেখা সম্ভব হয়? সব শোনা সম্ভব হয়? হয় না। মানুষ কি চাইলেই অতীতে ফিরে যেতে পারে? পারে না। এই যে না হওয়া, এই যে না পারা—এসব কিন্তু দূর করতে পারে বই।

ধরুন, বইয়ের মাধ্যমেই আমাদের যোগাযোগ হতে পারে সক্রেটিসের সঙ্গে। তাঁকে নিয়ে লেখা, কিংবা তাঁর লেখা একটি বই পড়ছেন—তার মানে, আমার কাছে মনে হয়, সেই প্রাচীন এথেন্সের পথ ধরে হাঁটছেন। দেখছেন কেমন ছিল তখনকার মানুষের জীবনযাপন। সমাজে বই তো তখন কেমন স্রোত। এখনকার মতো নানা নিয়ম-অনিয়মের চোরাবালিতে তখনো কি হারাত অনেক প্রতিভা? সব যেন প্রত্যক্ষ করছেন আপনি একটি বইয়ের মাধ্যমে। কিন্তু চাইলেই কি জীবনে আপনি ফিরতে পারবেন সেই হাজার হাজার বছর আগের প্রাচীন গ্রিসে?

রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা পড়ছেন মানে—তাঁর সঙ্গেই আপনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন পদ্মা নদীতে বজরায় চড়ে। একবার ভাবুন তো সেই পদ্মা নদী তো এখনো আছে, আপনার আমার চোখের সামনেই আছে। হয়তো আমি আপনি এখনো নানা কাজে পদ্মা পাড়ি দিই, কিংবা তখনো অলস বসে থাকি পদ্মাপাড়ে। কিন্তু চাইলেই কি ফিরতে পারব রবীন্দ্রনাথের সময়ে? কিন্তু একটি বই, একটি গল্প কিংবা কবিতা আমাকে-আপনাকে নিয়ে যেতে পারে শত বছর কিংবা হাজার বছর পেছনের কোনো রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে! পড়তে পারাটা তাই বিশাল সৌভাগ্যের বিষয়। যাঁরা পড়েন, তাঁদের শ্রদ্ধা করি।

একটা কথা বলি, অনেকে আমার সঙ্গে দ্বিমত করবেন জানি, তবু বলি। যাঁরা পড়তে পারেন, তাঁদের বড় একটা অংশ একাডেমিক পড়াশোনার বাইরে খুব বেশি একটা পড়েন না। যাঁরা বিশেষ জ্ঞানে জ্ঞানী, তাঁদের কথা অবশ্য আলাদা। কিন্তু সাধারণভাবে আমরা যারা এমএ, বিএ পাস করেছি, তাদের কথা বলছি। পরীক্ষা পাসের জন্য আমরা হয়তো কিছু তত্ত্ব, কিছু বর্ণনা মুখস্থ করেছি, তারপর সেগুলো পরীক্ষার খাতায় উগরে দিয়ে একের পর এক সার্টিফিকেট জোগাড় করেছি। কিন্তু সেই পড়া, পরে আমরা কতটুকু মনে রাখতে পেরেছি? আমাদের জীবন-যাপনে, আমাদের মননে, আমাদের কর্মজীবনে পরে সেই পড়া কতটা কাজে লেগেছে? কিন্তু একাডেমিক বাধ্যবাধকতার বাইরে গিয়ে মনের আনন্দে যাঁরা পড়েন, পড়েছেন—ভেবে দেখুন, তাঁরা আপনার আমার চেয়ে এগিয়ে গেছেন কি না?

আমি এক তরুণকে চিনতাম। মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। যে পরিবারে পাঠ্যবইয়ের বাইরের পড়াকে অপ্রয়োজনীয় মনে করা হয়। কিন্তু সেই ছেলেটার ছিল অদম্য পড়ার নেশা। কিন্তু পড়ার জন্য এত বই কই? পাড়ায় পাঠাগার কই? ছেলেটা তাই বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ধার নিয়ে বই পড়ে। তাতেও তাঁর পড়ার তৃষ্ণা মেটে না। সে নীলক্ষেতে যায়। পুরোনো বই কেনে। তা-ও টাকার অভাবে সব বই কিনতে পারে না। বই নেড়েচেড়ে রেখে চলে আসে। দেখেও যেন তার শান্তি। বই নাড়াচাড়া করেও যেন সে পড়ার আনন্দ পায়। সেই ছেলেটা বছরজুড়ে বাসার পুরোনো খবরের কাগজ জমিয়ে রাখে। ফেব্রুয়ারি এলে সেই কাগজ বিক্রি করে, টাকা নিয়ে বইমেলার দিকে ছোটে। ঢাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের বইমেলায় সে হেঁটে যায়। বাসে কিংবা রিকশায় গিয়ে ভাড়ার পেছনে টাকা খরচ না করে সেই টাকাও বই কেনার পেছনে খরচ করতে চায় সে। অনেক বছর পর সেই ছেলের সঙ্গে আমার দেখা। জীবনে তার অর্থনৈতিক উন্নতি কতটা হয়েছে বুঝতে পারিনি; তবে বুঝেছি, সেই ছেলেটি এখন খুব উন্নত মনের মানবিক মানুষ!

পলান সরকারের কথা নিশ্চয় মনে আছে? বাংলাদেশের উত্তরের জনপদে ঘুরে ঘুরে মানুষের মাঝে বই বিলি করতেন। আচ্ছা, পলান সরকার কেন চাইতেন আমরা পাঠক হয়ে উঠি?

আতিফ আসাদ নামের জামালপুরের সরিষাবাড়ীর এক ছেলে। রাজমিস্ত্রির কাজ করে পাঠাগার গড়ে তুলেছেন। মানুষের কাছ থেকে বই সংগ্রহ করেন, মানুষকে পড়ানোর জন্য। পাঠক বানানোর জন্য। আতিফ আসাদ কেন চান আমরা পাঠক হয়ে উঠি?

খুলনার সেলুন পাঠাগারের কথা বলা যায়। স্বল্প আয়ের মানুষ সেলুনের মালিক। নিজের সেলুনে আসা মানুষ বসে বসে আড্ডা দেয়, তিনি তাদের জন্য ব্যবস্থা করলেন বইয়ের। ছোট দোকানে শেলফে রেখে দিলেন বই। এখন লোকজন এসে বই পড়ে। তাঁর চাওয়াটা আসলে কী?

বছর ঘুরে আবার এসেছে বইমেলা। বইমেলা একটা উপলক্ষমাত্র। আসুন, এই উপলক্ষ ধরে আমরা পাঠক হয়ে উঠি। আমরা সবাই মানবিক মানুষ হই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা হলেই মেয়াদ শেষ নতুন পরিচালনা কমিটির

মুসলিম থেকে খ্রিষ্টান হওয়া ইরানি নারী এখন পানামার জঙ্গলে

ঢাবি ছাত্রীকে যৌন হেনস্তাকারীর পক্ষে নামা ‘তৌহিদী জনতার’ আড়ালে এরা কারা

এনসিপিকে চাঁদা দিচ্ছেন ধনীরা, ক্রাউডফান্ডিং করেও অর্থ সংগ্রহ করা হবে: নাহিদ ইসলাম

ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে টান, সন্তানসহ ছিটকে পড়তেই তরুণীর গালে ছুরিকাঘাত

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত