ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
ময়মনসিংহের মসূয়া গ্রামের সৃষ্টিশীল রায়চৌধুরী পরিবার। বংশানুক্রমে ছেলেপুলের হাতে সাহিত্য সৃষ্টির ব্যাটন ধরিয়ে দিয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। রবিঠাকুরের রাজর্ষি উপন্যাসের দুটি চরিত্র হাসি ও তাতার নামানুসারে তাঁর বড় মেয়ে এবং বড় ছেলের ডাকনাম রেখেছিলেন সুখলতা ও সুকুমার। এই তাতা বা আমাদের প্রিয় সুকুমার রায়ের শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয়ের ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ে (সেখানে তখন ছেলে ও মেয়ে উভয়েই পড়তে পারত) প্রাথমিক শিক্ষা আর সেখান থেকে সোজা সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে স্নাতক হওয়া। এরপর মুদ্রণবিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড যাত্রা। এরোবিয়া স্টিমারে চড়ে। তার মাঝে গুরুপ্রসন্ন বৃত্তিলাভ আর লন্ডনের স্কুল অব ফটো এনগ্রেভিং অ্যান্ড লিথোগ্রাফিতে ভর্তি হওয়া। ফেলো অব দ্য রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটি উপাধি নিয়ে দুবছর বাদে কলকাতায় ফিরে ফটোগ্রাফার, লিথোগ্রাফার ও মুদ্রণশিল্পী হিসেবে কাজ শুরু। কেমন করে বাংলার ছাপাখানার উন্নতিসাধন করা যায় আর সেই সঙ্গে মুদ্রণশিল্পের চর্চার ফাঁকে ফাঁকে নিজের সাহিত্যচর্চায় একান্ত মনোনিবেশ। বিলেত থেকে ফেরার দুবছরের মধ্যেই বাবা উপেন্দ্রকিশোর মারা গেলেন। ব্যাটন পাস অন করেছেন পুত্রের হাতে। পিতার যোগ্য উত্তরসূরি পুত্র সুকুমারের ঘাড়ে তখন ‘সন্দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনার কাজও এসে পড়ল। যে পত্রিকার নাম সন্দেশ, তার সম্পাদক যে উপাদেয় এই মিষ্টান্নের খোঁজখবর দেবেন, তা বলাই বাহুল্য। আর নিজের গুরুগম্ভীর সব কাজকর্মের ফাঁকে তাঁর নিরলস সাহিত্য সৃষ্টি ছিল মনের খোরাক, যেখানে আবার পেটের খোরাকের প্রসঙ্গও যে বানভাসি, তা সুকুমার সাহিত্য পাঠ করলেই বোঝা যায়। কিন্তু মাত্র ৩৬টা বছর। ফুরিয়ে গেল খুব তাড়াতাড়ি। শেষ রক্ষে হয়েও হলো না যেন। ছড়া, ছবি, ধাঁধা, গান, নাটক, গল্প, প্রবন্ধ, ফটোগ্রাফি—সবের মধ্যেই রয়ে গেল সুকুমার ইম্প্রেশন। কাগজে-কলমে, ছবিতে-ছড়ায় তাঁর নতুন নতুন আজব সব সৃষ্টি—কুমড়োপটাশ, হুঁকোমুখো হ্যাংলা, হ্যাংলাথোরিয়াম, গোমড়াথোরিয়াম, হাঁসজারু, বকচ্ছপ, কাতুকুতুবুড়ো, হিজবিজবিজ, কাকেশ্বর কুচকুচে, রামগরুড়ের ছানা, পাগলা দাশু বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ননসেন্সিক্যাল ক্যারেক্টার হয়ে আজও রসে টইটুম্বুর।
প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় থেকেই রসেবশে সুকুমারের মস্তিষ্কপ্রসূত ননসেন্স ক্লাবের সূচনা। ক্লাবে হাতে লেখা একটি পত্রিকাও বের হতো তখন। যার নাম ‘সাড়ে বত্রিশভাজা’। পত্রিকার লোগোতে ছিল বত্রিশ রকমের ভাজাভুজির ওপরে আধখানি লঙ্কা। সেখানেও সেই ক্রিস্পি আর ক্রাঞ্চি একটা ভাব। শুনেই নোলা শকশক করে ওঠে তা পড়ার জন্য। সেই পত্রিকার সম্পাদকের পাতার শিরোনাম ছিল ‘পঞ্চতক্তিপাঁচন’। নাম শুনে নাক সিটকালেও খাবার শুরু করার আগে খালি পেটে নিমপাতা বা কালমেঘের মতো সম্পাদকীয় গলাধঃকরণ করে নিয়ে তবেই না বত্রিশভাজায় কামড়।
এরপর বিলেত থেকে ফিরে তাঁদের গড়পার রোডের বাড়িতে প্রতি সোমবার সুকুমার রায় আসর বসাতেন ‘মানডে ক্লাব’-এর, যার মূল আকর্ষণই ছিল খাওয়াদাওয়া। তা দেখে কেউ কেউ আবার ক্লাবের নাম দিয়েছিলেন মণ্ডা ক্লাব। নাম শুনলেই মণ্ডা-মিঠাইয়ের কথা মনে পড়তে বাধ্য।
‘‘যত কিছু খাওয়া লেখে বাঙালির ভাষাতে,
জড়ো করে আনি সব—থাকো সেই আশাতে’
ঠিকই তো। যিনি অবাক জলপানের কল খুলে দিয়ে হাস্যরসে ভাসিয়ে দেন তাঁর যে শয়নে, স্বপনে জাগরণে খাওয়াদাওয়ার ভাবনাচিন্তা থাকবে না, তা তো আর হয় না। বাংলা ভাষার তপ্তখোলায় ‘তাতা’র সৃষ্ট সুকুমার সাহিত্য তো রসেবশে, খাদ্যরসে বানভাসি এক্কেবারে। সেই উত্তপ্ত বালি খোলায় আমরা না হয় সেই মুচমুচে স্বাদ নিয়েই ফেলি তবে।
বিশিষ্ট খাদ্যরসিকদের তালিকায় সুকুমার রায়ও যে ছিলেন, তা বলাই বাহুল্য। তাঁর পদ্যে গদ্যে এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি। তিনি পাতি বাঙালির মতো করেই যেন রান্নার কথা ফলাও করে বলেছেন খাইখাই কবিতায়। আর পাঠক সেই ফাঁকে খুঁজে নেন তার গূঢ় অর্থ। তিনি যে খুলে দিয়েছিলেন খেয়াল খাতার পাতা। মেলে ধরেছিলেন খেয়াল রসের কাব্য। সেই রসের সঙ্গে রসনার রসও পর্যাপ্ত ছিল, তা যারা বোঝেননি তারা সে রসে বঞ্চিত।
‘খাই খাই কর কেন, এস বস আহারে—
খাওয়াব আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে।
যত কিছু খাওয়া লেখে বাঙালির ভাষাতে,
জড়ো করে আনি সব,—থাক সেই আশাতে।
ডাল ভাত তরকারি ফলমূল শস্য,
আমিষ ও নিরামিষ, চর্ব্য ও চোষ্য,’
সেখানে আবার রুটি-লুচি, ভাজাভুজি, টক ঝাল মিষ্টি ছাড়াও স্থান পেয়েছে ময়রা ও পাচকের সৃষ্টি থেকে ফলাহারও। সেই ফলাহার আবার শুধু চিঁড়ে-দই দিয়ে হবে না, ফল না থাকলে তা বৃথা...সে কথাও বলেছেন তিনি। সবশেষে কচুপোড়াও ঠাঁই পেয়েছে।
আবার ‘হুলোর গান’? সেখানেও ‘গালফোলা মুখে তার মালপোয়া ঠাসা’ কিংবা ‘কহ ভাই কহ রে’তে বদ্যিরা কেন কেউ আলুভাতে খায় না? কারণ হিসেবে বলেছেন,
‘লেখা আছে কাগজে আলু খেলে মগজে
ঘিলু যায় ভেস্তিয়ে বুদ্ধি গজায় না।’
সেখানেও সেই বিজ্ঞানমনস্কতা প্রকাশ পেল সে যুগেও। অত্যধিক আলুও যে স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক, তা বোধ হয় জেনেবুঝেই এমন লিখেছিলেন।
‘নিরুপায়’ কবিতাতেও ছত্রে ছত্রে মুখের রুচি ও পেটের সুখ।
‘বসি বছরের পয়লা তারিখে
মনের খাতায় রাখিলাম লিখে—
সহজ উদরে ধরিবে যেটুক্,
সেইটুকু খাব হব না পেটুক।
মাস দুই যেতে খাতা খুলে দেখি,
এরি মাঝে মন লিখিয়াছে একি!
লিখিয়াছে, যদি নেমন্তন্নে
কেঁদে ওঠে প্রাণ লুচির জন্যে,
উচিত কি হবে কাঁদান তাহারে?
কিম্বা যখন বিপুল আহারে,
তেড়ে দেয় পাতে পোলাও কালিয়া
পায়েস অথবা রাবড়ি ঢালিয়া—
তখন কি করি, আমি নিরুপায়!
তাড়াতে না পারি, বলি আয় আয়,
ঢুকে আয় মুখে দুয়ার ঠেলিয়া
উদার রয়েছি উদর মেলিয়া!’
তাঁর ‘হেঁসোরামের হুঁশিয়ারি’তে সেই কিম্ভূতকিমাকার জন্তু হ্যাংলাথেরিয়ামের খাওয়ার বর্ণনাতেও একগ্রাসে গোটা পাউরুটি, আধসের গুড় আর পাঁচ-সাতটা সেদ্ধ ডিম খোসাসুদ্ধ কড়মড় করে চিবিয়ে খেয়ে নেওয়া। আবার কাঁকড়ামতী নদীর ধারে প্রফেসর হুঁশিয়ারের শিকার করতে গিয়ে খাবারের বর্ণনাতেও তেমনি পারিপাট্য। ‘তরিতরকারি যা ছিল তা আগেই ফুরিয়েছে। টাটকা জিনিষের মধ্যে সঙ্গে কতগুলো হাঁস আর মুরগী আছে তারা রোজ কয়েকটা করে ডিম দেয়। তাছাড়া খালি বিস্কুট, জ্যাম, টিনের দুধ আর ফল, টিনের মাছ আর মাংস। এসব কয়েক সপ্তাহের মত আছে’—এর থেকেই বোঝা যায় তিনি নিজে কতটা খাদ্যপ্রেমী ছিলেন।
আবার ‘পেটুক’ গল্পে? সেখানেও সেই হরিপদ? সে কারোর ডাক শুনে সাড়াই দিতে পারে না। মুখভরা ক্ষীরের লাড্ডু যে তার। ফেলতেও পারে না, গিলতেও পারে না সে। তার ভাই শ্যামাপদও যেমন হ্যাংলা পেটুক তেমনি পেটরোগা। এহেন ভাইয়ের প্ররোচনায় হরিপদ পিসিমার খাটের তলায় একহাঁড়ি চুন থেকে এক খাবলা নিয়ে দই ভেবে মুখে তুলে সে কী চেঁচানি তার জ্বলনে। তাতেও ক্ষান্ত হয় না হরিপদ। আবারও লাড্ডু মুখে পোরে। ভাঁড়ার ঘরে ইঁদুর মারার জন্য সেঁকো বিষ দিয়ে মাখা লাড্ডুও ছাড় পায় না হরিপদের নোলার কাছে। পরে যখন তার সেই বিষমাখানো লাড্ডু খেয়ে প্রবল ব্যারাম হয়, তখন হরিপদ বুঝতে পারে সেঁকো বিষ খেয়ে সে আরেকটু হলেই মারা যাচ্ছিল।
আর সেই ‘হিংসুটি’ গল্পের হিংসুটি নামের সেই ছোট্ট মেয়েটি? যার মামা একবার তাদের বাড়িতে এসে দুই বোনকে মিঠাই খেতে দিলেন। সেখানেও তো সেই হিংসুটি খানিকক্ষণ তার দিদির খাবারের দিকে তাকিয়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে। কাঁদার কারণ জিজ্ঞেস করায় সে বলে, তার দিদির রসমুণ্ডিটা তার চাইতেও বড়। আর তাই শুনে হিংসুটির দিদি তাড়াতাড়ি নিজের রসমুণ্ডিটা বোনকে দিয়ে দেয়।
আবার ‘চীনে পটকা’ গল্পের শুরুতেই ‘আমাদের রামপদ একদিন এক হাঁড়ি মিহিদানা লইয়া স্কুলে আসিল!’
টিফিনের ছুটি হতেই সেই হাঁড়িভর্তি মিহিদানা পাগলা দাশুকে না দিয়ে তার বন্ধুরা সাবাড় করে ফেলেছিল। আর সেই মিহিদানার হাঁড়ি থেকে পটকা ফাটার বিকট শব্দ পেলেন পণ্ডিতমশাই...সেও নাকি পাগলা দাশুর মস্তিষ্কপ্রসূত এবং তা কেবল মিহিদানা থেকে রামপদ তাকে বঞ্চিত করেছিল বলেই। পাগলা দাশুর সেই মিহিদানা না খাওয়ার দুঃখে মিহিদানার হাঁড়িতে পটকা ফাটানোর পর গল্পে পরিণত হয় এরূপ:
তারপর পণ্ডিতমহাশয় ঘাড় বাঁকাইয়া গভীর গলায় হুংকার দিয়া বলিলেন, ‘কেন পটকায় আগুন দিচ্ছিলে?’ দাশু ভয় পাইবার ছেলেই নয়, সে রামপদকে দেখাইয়া বলিল, ‘ও কেন আমায় মিহিদানা দিতে চাচ্ছিল না?’ এরূপ অদ্ভুত যুক্তি শুনিয়া রামপদ বলিল, ‘আমার মিহিদানা আমি যা ইচ্ছা তাই করব।’ দাশু তৎক্ষণাৎ বলিয়া উঠিল, ‘তা হলে, আমার পটকা, আমিও যা ইচ্ছা তাই করব।’ এরূপ পাগলের সঙ্গে আর তর্ক করা চলে না। কাজেই মাস্টারেরা সকলেই কিছু কিছু ধমকধামক করিয়া যে যার ক্লাশে চলিয়া গেলেন। সে ‘পাগলা’ বলিয়া তাহার কোনো শাস্তি হইল না।
ছুটির পর আমরা সবাই মিলিয়া কত চেষ্টা করিয়া তাহাকে তাহার দোষ বুঝাইতে পারিলাম না। সে বলিল, ‘আমার পটকা রামপদর হাঁড়ি। যদি আমার দোষ হয়, তা হলে রামপদরও দোষ হয়েছে। বাস্। ওর মার খাওয়াই উচিত।’
এতসব বলার পরেও আবোল তাবোলের কথা না বললে অধরা থেকে যায় সুকুমার সাহিত্যের রসনাতৃপ্তি।
‘আবোল তাবোল’-এর ঠিকুজি কুলুজি সব নিহিত সেই ননসেন্স সাহিত্যে। অধিকাংশ কবিতায় বারেবারে এসেছে নানারকম অখাদ্য-কুখাদ্য প্রসঙ্গ। সবকিছু নিয়েই বাঁচতে চেয়েছেন সুকুমার। বড়লোকের মহার্ঘ খাদ্যের সঙ্গে গরিবের সাদামাটা আহারের পাশাপাশি স্থান পেয়েছে আরও অনেক অদ্ভূতুড়ে সব খাদ্যদ্রব্য। বিচিত্র সব খাবারদাবারের নাম। সেগুলোর মধ্যে বেশ কিছু যেমন আজগুবি মানে কবির কল্পনাপ্রসূত, আবার বেশ কিছু সুখাদ্যও বটে। খাদ্যের অনুষঙ্গ যেন কিছুতেই ছাড়েনি কবিকে।
কাঠবুড়ো হাঁড়ির মধ্যে ভিজে কাঠ সেদ্ধ করে রোদে বসে চেটে খায় সেই ভিজে কাঠ সিদ্ধ। চণ্ডীদাসের খুড়োর অদ্ভূত সেই কলে ঝুলতে থাকে মণ্ডা মিঠাই চপ্ কাট্লেট্ খাজা কিংবা লুচি। যার যেমন রুচি সেই অনুযায়ী কলের সামনে দাঁড়িয়েই পড়লেই সব খেয়ে নেওয়া যায়। আবার কুমড়োপটাশের অদ্ভূত গর্জনে ছেঁচকি শাকের ঘণ্ট বেটে মাথায় মলম মেখে রাখতে হয়। এই ছেঁচকি শাক যে আদতে কী বস্তু তা বুঝি তিনিই জানতেন স্বয়ং। তবে বাঙালির যেকোনো শাকভাজাই যে ছেঁচকির সমতুল্য, তা বোধ হয় জানতেন তিনি। তাই দুয়ে দুয়ে চার। মাঝখান থেকে বাংলা সাহিত্য সম্ভারে যোগ হলো নতুন একটু শাক। ওয়ার্ডস্মিথ বা শব্দ নিয়ে জাগলিং করেন যারা তারাই বুঝি পারেন এমন সব কেরামতি দেখাতে কাগজে ও কলমে।
কেন? ‘কাতুকুতু বুড়ো’য় কেষ্টদাসের পিসি?
‘বেচ্ত খালি কুমড়ো কচু হাঁসের ডিম আর তিসি ৷
ডিমগুলো সব লম্বা মতন, কুমড়োগুলো বাঁকা,
কচুর গায়ে রঙ-বেরঙের আল্পনা সব আঁকা ৷’
এত ফ্যান্টাসিময়তা, এত কল্পনার আলপনা তাঁর মাথার মধ্যে কিলবিল করেছে যে সেখানে আনাজপাতিও ছাড় পায়নি।
এমনকি ঝুরঝুরে পোড়ো ঘরে থুত্থুড়ে বুড়ির গালভরা হাসিমুখে চালভাজা মুড়িও বাদ পড়ে না। আবার ‘চোর ধরা’য়
টিফিনের আগে ঘুমিয়ে পড়লে খাবারের ভাগ ভয়ানক কমে যায়। কে যে সব খেয়ে যায় বুঝে উঠতে পারেন না তিনি।
সেখানে তো সব সুখাদ্যের এলাহি ফিরিস্তি।
‘পাঁচখানা কাট্লেট, লুচি তিন গণ্ডা,
গোটা দুই জিবে গজা, গুটি দুই মণ্ডা,
আরো কত ছিল পাতে আলুভাজা ঘুঙ্নি—
ঘুম থেকে উঠে দেখি পাতাখানা শূন্যি!’
‘ভালো রে ভালো’তে আবার নামীদামি সুখাদ্যের সম্ভারে এ দুনিয়ার সব ভালোকে এক ছাদের নিচে ঠাঁই দিতে গিয়ে সুকুমার ভোলেননি পোলাও, কোর্মা, মাছের পুরভরা পটোলের দোলমা আর খাস্তা লুচির পাশাপাশি মধ্যবিত্ত গেরস্তের পাউরুটি আর ঝোলাগুড়ের কথাও।
‘বাবুরাম সাপুড়ে’র শান্ত সাপেরা তো ঠান্ডা দুধ-ভাত খায় কিন্তু বোম্বাগড়ের রাজা যে ছবির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখে ভাজা আমসত্ত্ব আর রাজার পিসি কুমড়ো দিয়ে ক্রিকেট খেলে কিংবা ‘হুঁকোমুখো হ্যাংলা’ যখন কাঁচকলা চটকে খায় তখন ‘ডানপিটে’ ছেলেটি কপ কপ মাছি ধরে মুখে দেয় তুলে, তাই বা বাদ দিই কেমন করে? ‘ট্যাঁশ গরু’ আবার যেমন-তেমন গরুর মতো দানাপানি বা ঘাস পাতা বিচালি খায় না। এমনকি ছোলা ছাতু ময়দা কি পিঠালি, কিংবা আমিষেতে বা পায়েসেও রুচি নেই তার। কেবল সাবানের স্যুপ আর মোমবাতি পেলেই সে খুশি। এমনি ফ্যান্টাসির ফানুস উড়িয়েছিলেন সুকুমার রায়।
তাঁর ‘নোটবুকে’ লিখতে ভোলেননি আজব সব প্রশ্ন।
সেখানে ঝোলাগুড় কিসে দেয়? বা তেজপাতায় তেজ কেন? লঙ্কায় কেন ঝাল? এসবের মধ্যেও অদ্ভূত সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলত আমাদের শিশুমন। সত্যিই তো, এমন করে তো কেউ ভাবায়নি আমাদের।
আবার ‘পালোয়ান’ ছড়ায় পালোয়ানোচিত সব খাদ্যসম্ভার। ঠিক যেমনটি হওয়া উচিত আরকি।
‘সকালবেলার জলপানি তার তিনটি ধামা পেস্তা মেওয়া,
সঙ্গেতে তার চৌদ্দ হাঁড়ি দৈ কি মালাই মুড়্কি দেওয়া।
দুপুর হলে খাবার আসে কাতার দিয়ে ডেক্চি ভ’রে,
বরফ দেওয়া উনিশ কুঁজো সরবতে তার তৃষ্ণা হরে।
বিকাল বেলা খায় না কিছু গণ্ডা দশেক মণ্ডা ছাড়া,
সন্ধ্যা হ’লে লাগায় তেড়ে দিস্তা দিস্তা লুচির তাড়া।’
যে ছেলের ডাকনাম তাতা, তিনি যে তাঁর স্বল্প সময়ের সাহিত্যসৃষ্টিকে বিপুল খাদ্য ও অখাদ্যের সমন্বয়ে তাতিয়ে তুলবেন, এ আর এমন কথা কি?
আবোল তাবোলের সবশেষে ‘ছড়ার পাতা’য় যখন নিমগাছে শিম, হাতির মাথায় ব্যাঙের ছাতা আর কাগের বাসায় বগের ডিম ফলাচ্ছিলেন, তখনই হয়তো ঘনিয়ে এসেছিল সুকুমারের ঘুমের ঘোর। হয়তো বুঝেছিলেন যে তাঁর এ দুনিয়ায় থাকাটা ফুরিয়ে আসছে, তাই বুঝি এমন সব আবোল তাবোল ‘ভূতুড়ে খেলা’ খেলেছিলেন কাগজে আর কলমে।
‘ওরে আমার বাদলা রোদে জষ্টি মাসের বিষ্টি রে,
ওরে আমার হামান-ছেঁচা যষ্টিমধুর মিষ্টি রে ৷
ওরে আমার রান্না হাঁড়ির কান্না হাসির ফোড়নদার,
ওরে আমার জোছনা হাওয়ার স্বপ্নঘোড়ার চড়নদার।’
সুকুমার সাহিত্যে ভিজে কাঠ সেদ্ধ থেকে আমসত্ত্ব ভাজা, সাবানের স্যুপ থেকে ছেঁচকি শাকের মলম...এসব যতই সোনার পাথরবাটির মতো অলীক হোক না কেন, এসবই ননসেন্স ভার্সের অন্যতম অনুপান হয়েই রইল। অথচ ভাগ্যের এমনি পরিহাস যে মসূয়া গ্রামের জমিদারি পরিদর্শনে গিয়ে আক্রান্ত হলেন সর্বনাশা কালাজ্বরে। তাঁর নিজের খেয়ালরসের ভান্ডার ছাপার অক্ষরে দুই মলাটে দেখে যাওয়া অধরা থেকে গেল। এত এত মজার ছড়া, এত এত হাতে আঁকা ছবি, এত হাসি-মশকরা, খাবারদাবার, আজগুবি সব চরিত্রেরা বিগত ১০০ বছরের সাহিত্যের দলিল হয়ে রইল। শতবর্ষের মৃত্যুবার্ষিকীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আজও তা প্রাসঙ্গিক। কল্পসম্রাট সুকুমার চির জাগরূক আজও পাঠকের মনে। যিনি ছাঁচে ঢালা আদর্শ মানুষ গড়ার বিপরীতে হেঁটেছিলেন। আজগুবি চাল চেলে, বেঠিক, বেতালা হয়ে, সাহিত্যের মূল স্রোতের প্রতিকূলে। তাঁর খেয়ালখুশির সৃষ্টিছাড়া খ্যাপা মনটা যে ছিল কেবলি ভুলে ভরা, অসম্ভবের ছন্দে পা ফেলার একটা জগৎ।
তথ্যঋণ:
১) সুকুমার রায় জীবনকথা, হেমেন্দ্রকুমার আঢ্য
২) সুকুমার রায় রচনাসমগ্র
৩) বিভিন্ন সংবাদপত্র
ময়মনসিংহের মসূয়া গ্রামের সৃষ্টিশীল রায়চৌধুরী পরিবার। বংশানুক্রমে ছেলেপুলের হাতে সাহিত্য সৃষ্টির ব্যাটন ধরিয়ে দিয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। রবিঠাকুরের রাজর্ষি উপন্যাসের দুটি চরিত্র হাসি ও তাতার নামানুসারে তাঁর বড় মেয়ে এবং বড় ছেলের ডাকনাম রেখেছিলেন সুখলতা ও সুকুমার। এই তাতা বা আমাদের প্রিয় সুকুমার রায়ের শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয়ের ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ে (সেখানে তখন ছেলে ও মেয়ে উভয়েই পড়তে পারত) প্রাথমিক শিক্ষা আর সেখান থেকে সোজা সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে স্নাতক হওয়া। এরপর মুদ্রণবিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড যাত্রা। এরোবিয়া স্টিমারে চড়ে। তার মাঝে গুরুপ্রসন্ন বৃত্তিলাভ আর লন্ডনের স্কুল অব ফটো এনগ্রেভিং অ্যান্ড লিথোগ্রাফিতে ভর্তি হওয়া। ফেলো অব দ্য রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটি উপাধি নিয়ে দুবছর বাদে কলকাতায় ফিরে ফটোগ্রাফার, লিথোগ্রাফার ও মুদ্রণশিল্পী হিসেবে কাজ শুরু। কেমন করে বাংলার ছাপাখানার উন্নতিসাধন করা যায় আর সেই সঙ্গে মুদ্রণশিল্পের চর্চার ফাঁকে ফাঁকে নিজের সাহিত্যচর্চায় একান্ত মনোনিবেশ। বিলেত থেকে ফেরার দুবছরের মধ্যেই বাবা উপেন্দ্রকিশোর মারা গেলেন। ব্যাটন পাস অন করেছেন পুত্রের হাতে। পিতার যোগ্য উত্তরসূরি পুত্র সুকুমারের ঘাড়ে তখন ‘সন্দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনার কাজও এসে পড়ল। যে পত্রিকার নাম সন্দেশ, তার সম্পাদক যে উপাদেয় এই মিষ্টান্নের খোঁজখবর দেবেন, তা বলাই বাহুল্য। আর নিজের গুরুগম্ভীর সব কাজকর্মের ফাঁকে তাঁর নিরলস সাহিত্য সৃষ্টি ছিল মনের খোরাক, যেখানে আবার পেটের খোরাকের প্রসঙ্গও যে বানভাসি, তা সুকুমার সাহিত্য পাঠ করলেই বোঝা যায়। কিন্তু মাত্র ৩৬টা বছর। ফুরিয়ে গেল খুব তাড়াতাড়ি। শেষ রক্ষে হয়েও হলো না যেন। ছড়া, ছবি, ধাঁধা, গান, নাটক, গল্প, প্রবন্ধ, ফটোগ্রাফি—সবের মধ্যেই রয়ে গেল সুকুমার ইম্প্রেশন। কাগজে-কলমে, ছবিতে-ছড়ায় তাঁর নতুন নতুন আজব সব সৃষ্টি—কুমড়োপটাশ, হুঁকোমুখো হ্যাংলা, হ্যাংলাথোরিয়াম, গোমড়াথোরিয়াম, হাঁসজারু, বকচ্ছপ, কাতুকুতুবুড়ো, হিজবিজবিজ, কাকেশ্বর কুচকুচে, রামগরুড়ের ছানা, পাগলা দাশু বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ননসেন্সিক্যাল ক্যারেক্টার হয়ে আজও রসে টইটুম্বুর।
প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় থেকেই রসেবশে সুকুমারের মস্তিষ্কপ্রসূত ননসেন্স ক্লাবের সূচনা। ক্লাবে হাতে লেখা একটি পত্রিকাও বের হতো তখন। যার নাম ‘সাড়ে বত্রিশভাজা’। পত্রিকার লোগোতে ছিল বত্রিশ রকমের ভাজাভুজির ওপরে আধখানি লঙ্কা। সেখানেও সেই ক্রিস্পি আর ক্রাঞ্চি একটা ভাব। শুনেই নোলা শকশক করে ওঠে তা পড়ার জন্য। সেই পত্রিকার সম্পাদকের পাতার শিরোনাম ছিল ‘পঞ্চতক্তিপাঁচন’। নাম শুনে নাক সিটকালেও খাবার শুরু করার আগে খালি পেটে নিমপাতা বা কালমেঘের মতো সম্পাদকীয় গলাধঃকরণ করে নিয়ে তবেই না বত্রিশভাজায় কামড়।
এরপর বিলেত থেকে ফিরে তাঁদের গড়পার রোডের বাড়িতে প্রতি সোমবার সুকুমার রায় আসর বসাতেন ‘মানডে ক্লাব’-এর, যার মূল আকর্ষণই ছিল খাওয়াদাওয়া। তা দেখে কেউ কেউ আবার ক্লাবের নাম দিয়েছিলেন মণ্ডা ক্লাব। নাম শুনলেই মণ্ডা-মিঠাইয়ের কথা মনে পড়তে বাধ্য।
‘‘যত কিছু খাওয়া লেখে বাঙালির ভাষাতে,
জড়ো করে আনি সব—থাকো সেই আশাতে’
ঠিকই তো। যিনি অবাক জলপানের কল খুলে দিয়ে হাস্যরসে ভাসিয়ে দেন তাঁর যে শয়নে, স্বপনে জাগরণে খাওয়াদাওয়ার ভাবনাচিন্তা থাকবে না, তা তো আর হয় না। বাংলা ভাষার তপ্তখোলায় ‘তাতা’র সৃষ্ট সুকুমার সাহিত্য তো রসেবশে, খাদ্যরসে বানভাসি এক্কেবারে। সেই উত্তপ্ত বালি খোলায় আমরা না হয় সেই মুচমুচে স্বাদ নিয়েই ফেলি তবে।
বিশিষ্ট খাদ্যরসিকদের তালিকায় সুকুমার রায়ও যে ছিলেন, তা বলাই বাহুল্য। তাঁর পদ্যে গদ্যে এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি। তিনি পাতি বাঙালির মতো করেই যেন রান্নার কথা ফলাও করে বলেছেন খাইখাই কবিতায়। আর পাঠক সেই ফাঁকে খুঁজে নেন তার গূঢ় অর্থ। তিনি যে খুলে দিয়েছিলেন খেয়াল খাতার পাতা। মেলে ধরেছিলেন খেয়াল রসের কাব্য। সেই রসের সঙ্গে রসনার রসও পর্যাপ্ত ছিল, তা যারা বোঝেননি তারা সে রসে বঞ্চিত।
‘খাই খাই কর কেন, এস বস আহারে—
খাওয়াব আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে।
যত কিছু খাওয়া লেখে বাঙালির ভাষাতে,
জড়ো করে আনি সব,—থাক সেই আশাতে।
ডাল ভাত তরকারি ফলমূল শস্য,
আমিষ ও নিরামিষ, চর্ব্য ও চোষ্য,’
সেখানে আবার রুটি-লুচি, ভাজাভুজি, টক ঝাল মিষ্টি ছাড়াও স্থান পেয়েছে ময়রা ও পাচকের সৃষ্টি থেকে ফলাহারও। সেই ফলাহার আবার শুধু চিঁড়ে-দই দিয়ে হবে না, ফল না থাকলে তা বৃথা...সে কথাও বলেছেন তিনি। সবশেষে কচুপোড়াও ঠাঁই পেয়েছে।
আবার ‘হুলোর গান’? সেখানেও ‘গালফোলা মুখে তার মালপোয়া ঠাসা’ কিংবা ‘কহ ভাই কহ রে’তে বদ্যিরা কেন কেউ আলুভাতে খায় না? কারণ হিসেবে বলেছেন,
‘লেখা আছে কাগজে আলু খেলে মগজে
ঘিলু যায় ভেস্তিয়ে বুদ্ধি গজায় না।’
সেখানেও সেই বিজ্ঞানমনস্কতা প্রকাশ পেল সে যুগেও। অত্যধিক আলুও যে স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক, তা বোধ হয় জেনেবুঝেই এমন লিখেছিলেন।
‘নিরুপায়’ কবিতাতেও ছত্রে ছত্রে মুখের রুচি ও পেটের সুখ।
‘বসি বছরের পয়লা তারিখে
মনের খাতায় রাখিলাম লিখে—
সহজ উদরে ধরিবে যেটুক্,
সেইটুকু খাব হব না পেটুক।
মাস দুই যেতে খাতা খুলে দেখি,
এরি মাঝে মন লিখিয়াছে একি!
লিখিয়াছে, যদি নেমন্তন্নে
কেঁদে ওঠে প্রাণ লুচির জন্যে,
উচিত কি হবে কাঁদান তাহারে?
কিম্বা যখন বিপুল আহারে,
তেড়ে দেয় পাতে পোলাও কালিয়া
পায়েস অথবা রাবড়ি ঢালিয়া—
তখন কি করি, আমি নিরুপায়!
তাড়াতে না পারি, বলি আয় আয়,
ঢুকে আয় মুখে দুয়ার ঠেলিয়া
উদার রয়েছি উদর মেলিয়া!’
তাঁর ‘হেঁসোরামের হুঁশিয়ারি’তে সেই কিম্ভূতকিমাকার জন্তু হ্যাংলাথেরিয়ামের খাওয়ার বর্ণনাতেও একগ্রাসে গোটা পাউরুটি, আধসের গুড় আর পাঁচ-সাতটা সেদ্ধ ডিম খোসাসুদ্ধ কড়মড় করে চিবিয়ে খেয়ে নেওয়া। আবার কাঁকড়ামতী নদীর ধারে প্রফেসর হুঁশিয়ারের শিকার করতে গিয়ে খাবারের বর্ণনাতেও তেমনি পারিপাট্য। ‘তরিতরকারি যা ছিল তা আগেই ফুরিয়েছে। টাটকা জিনিষের মধ্যে সঙ্গে কতগুলো হাঁস আর মুরগী আছে তারা রোজ কয়েকটা করে ডিম দেয়। তাছাড়া খালি বিস্কুট, জ্যাম, টিনের দুধ আর ফল, টিনের মাছ আর মাংস। এসব কয়েক সপ্তাহের মত আছে’—এর থেকেই বোঝা যায় তিনি নিজে কতটা খাদ্যপ্রেমী ছিলেন।
আবার ‘পেটুক’ গল্পে? সেখানেও সেই হরিপদ? সে কারোর ডাক শুনে সাড়াই দিতে পারে না। মুখভরা ক্ষীরের লাড্ডু যে তার। ফেলতেও পারে না, গিলতেও পারে না সে। তার ভাই শ্যামাপদও যেমন হ্যাংলা পেটুক তেমনি পেটরোগা। এহেন ভাইয়ের প্ররোচনায় হরিপদ পিসিমার খাটের তলায় একহাঁড়ি চুন থেকে এক খাবলা নিয়ে দই ভেবে মুখে তুলে সে কী চেঁচানি তার জ্বলনে। তাতেও ক্ষান্ত হয় না হরিপদ। আবারও লাড্ডু মুখে পোরে। ভাঁড়ার ঘরে ইঁদুর মারার জন্য সেঁকো বিষ দিয়ে মাখা লাড্ডুও ছাড় পায় না হরিপদের নোলার কাছে। পরে যখন তার সেই বিষমাখানো লাড্ডু খেয়ে প্রবল ব্যারাম হয়, তখন হরিপদ বুঝতে পারে সেঁকো বিষ খেয়ে সে আরেকটু হলেই মারা যাচ্ছিল।
আর সেই ‘হিংসুটি’ গল্পের হিংসুটি নামের সেই ছোট্ট মেয়েটি? যার মামা একবার তাদের বাড়িতে এসে দুই বোনকে মিঠাই খেতে দিলেন। সেখানেও তো সেই হিংসুটি খানিকক্ষণ তার দিদির খাবারের দিকে তাকিয়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে। কাঁদার কারণ জিজ্ঞেস করায় সে বলে, তার দিদির রসমুণ্ডিটা তার চাইতেও বড়। আর তাই শুনে হিংসুটির দিদি তাড়াতাড়ি নিজের রসমুণ্ডিটা বোনকে দিয়ে দেয়।
আবার ‘চীনে পটকা’ গল্পের শুরুতেই ‘আমাদের রামপদ একদিন এক হাঁড়ি মিহিদানা লইয়া স্কুলে আসিল!’
টিফিনের ছুটি হতেই সেই হাঁড়িভর্তি মিহিদানা পাগলা দাশুকে না দিয়ে তার বন্ধুরা সাবাড় করে ফেলেছিল। আর সেই মিহিদানার হাঁড়ি থেকে পটকা ফাটার বিকট শব্দ পেলেন পণ্ডিতমশাই...সেও নাকি পাগলা দাশুর মস্তিষ্কপ্রসূত এবং তা কেবল মিহিদানা থেকে রামপদ তাকে বঞ্চিত করেছিল বলেই। পাগলা দাশুর সেই মিহিদানা না খাওয়ার দুঃখে মিহিদানার হাঁড়িতে পটকা ফাটানোর পর গল্পে পরিণত হয় এরূপ:
তারপর পণ্ডিতমহাশয় ঘাড় বাঁকাইয়া গভীর গলায় হুংকার দিয়া বলিলেন, ‘কেন পটকায় আগুন দিচ্ছিলে?’ দাশু ভয় পাইবার ছেলেই নয়, সে রামপদকে দেখাইয়া বলিল, ‘ও কেন আমায় মিহিদানা দিতে চাচ্ছিল না?’ এরূপ অদ্ভুত যুক্তি শুনিয়া রামপদ বলিল, ‘আমার মিহিদানা আমি যা ইচ্ছা তাই করব।’ দাশু তৎক্ষণাৎ বলিয়া উঠিল, ‘তা হলে, আমার পটকা, আমিও যা ইচ্ছা তাই করব।’ এরূপ পাগলের সঙ্গে আর তর্ক করা চলে না। কাজেই মাস্টারেরা সকলেই কিছু কিছু ধমকধামক করিয়া যে যার ক্লাশে চলিয়া গেলেন। সে ‘পাগলা’ বলিয়া তাহার কোনো শাস্তি হইল না।
ছুটির পর আমরা সবাই মিলিয়া কত চেষ্টা করিয়া তাহাকে তাহার দোষ বুঝাইতে পারিলাম না। সে বলিল, ‘আমার পটকা রামপদর হাঁড়ি। যদি আমার দোষ হয়, তা হলে রামপদরও দোষ হয়েছে। বাস্। ওর মার খাওয়াই উচিত।’
এতসব বলার পরেও আবোল তাবোলের কথা না বললে অধরা থেকে যায় সুকুমার সাহিত্যের রসনাতৃপ্তি।
‘আবোল তাবোল’-এর ঠিকুজি কুলুজি সব নিহিত সেই ননসেন্স সাহিত্যে। অধিকাংশ কবিতায় বারেবারে এসেছে নানারকম অখাদ্য-কুখাদ্য প্রসঙ্গ। সবকিছু নিয়েই বাঁচতে চেয়েছেন সুকুমার। বড়লোকের মহার্ঘ খাদ্যের সঙ্গে গরিবের সাদামাটা আহারের পাশাপাশি স্থান পেয়েছে আরও অনেক অদ্ভূতুড়ে সব খাদ্যদ্রব্য। বিচিত্র সব খাবারদাবারের নাম। সেগুলোর মধ্যে বেশ কিছু যেমন আজগুবি মানে কবির কল্পনাপ্রসূত, আবার বেশ কিছু সুখাদ্যও বটে। খাদ্যের অনুষঙ্গ যেন কিছুতেই ছাড়েনি কবিকে।
কাঠবুড়ো হাঁড়ির মধ্যে ভিজে কাঠ সেদ্ধ করে রোদে বসে চেটে খায় সেই ভিজে কাঠ সিদ্ধ। চণ্ডীদাসের খুড়োর অদ্ভূত সেই কলে ঝুলতে থাকে মণ্ডা মিঠাই চপ্ কাট্লেট্ খাজা কিংবা লুচি। যার যেমন রুচি সেই অনুযায়ী কলের সামনে দাঁড়িয়েই পড়লেই সব খেয়ে নেওয়া যায়। আবার কুমড়োপটাশের অদ্ভূত গর্জনে ছেঁচকি শাকের ঘণ্ট বেটে মাথায় মলম মেখে রাখতে হয়। এই ছেঁচকি শাক যে আদতে কী বস্তু তা বুঝি তিনিই জানতেন স্বয়ং। তবে বাঙালির যেকোনো শাকভাজাই যে ছেঁচকির সমতুল্য, তা বোধ হয় জানতেন তিনি। তাই দুয়ে দুয়ে চার। মাঝখান থেকে বাংলা সাহিত্য সম্ভারে যোগ হলো নতুন একটু শাক। ওয়ার্ডস্মিথ বা শব্দ নিয়ে জাগলিং করেন যারা তারাই বুঝি পারেন এমন সব কেরামতি দেখাতে কাগজে ও কলমে।
কেন? ‘কাতুকুতু বুড়ো’য় কেষ্টদাসের পিসি?
‘বেচ্ত খালি কুমড়ো কচু হাঁসের ডিম আর তিসি ৷
ডিমগুলো সব লম্বা মতন, কুমড়োগুলো বাঁকা,
কচুর গায়ে রঙ-বেরঙের আল্পনা সব আঁকা ৷’
এত ফ্যান্টাসিময়তা, এত কল্পনার আলপনা তাঁর মাথার মধ্যে কিলবিল করেছে যে সেখানে আনাজপাতিও ছাড় পায়নি।
এমনকি ঝুরঝুরে পোড়ো ঘরে থুত্থুড়ে বুড়ির গালভরা হাসিমুখে চালভাজা মুড়িও বাদ পড়ে না। আবার ‘চোর ধরা’য়
টিফিনের আগে ঘুমিয়ে পড়লে খাবারের ভাগ ভয়ানক কমে যায়। কে যে সব খেয়ে যায় বুঝে উঠতে পারেন না তিনি।
সেখানে তো সব সুখাদ্যের এলাহি ফিরিস্তি।
‘পাঁচখানা কাট্লেট, লুচি তিন গণ্ডা,
গোটা দুই জিবে গজা, গুটি দুই মণ্ডা,
আরো কত ছিল পাতে আলুভাজা ঘুঙ্নি—
ঘুম থেকে উঠে দেখি পাতাখানা শূন্যি!’
‘ভালো রে ভালো’তে আবার নামীদামি সুখাদ্যের সম্ভারে এ দুনিয়ার সব ভালোকে এক ছাদের নিচে ঠাঁই দিতে গিয়ে সুকুমার ভোলেননি পোলাও, কোর্মা, মাছের পুরভরা পটোলের দোলমা আর খাস্তা লুচির পাশাপাশি মধ্যবিত্ত গেরস্তের পাউরুটি আর ঝোলাগুড়ের কথাও।
‘বাবুরাম সাপুড়ে’র শান্ত সাপেরা তো ঠান্ডা দুধ-ভাত খায় কিন্তু বোম্বাগড়ের রাজা যে ছবির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখে ভাজা আমসত্ত্ব আর রাজার পিসি কুমড়ো দিয়ে ক্রিকেট খেলে কিংবা ‘হুঁকোমুখো হ্যাংলা’ যখন কাঁচকলা চটকে খায় তখন ‘ডানপিটে’ ছেলেটি কপ কপ মাছি ধরে মুখে দেয় তুলে, তাই বা বাদ দিই কেমন করে? ‘ট্যাঁশ গরু’ আবার যেমন-তেমন গরুর মতো দানাপানি বা ঘাস পাতা বিচালি খায় না। এমনকি ছোলা ছাতু ময়দা কি পিঠালি, কিংবা আমিষেতে বা পায়েসেও রুচি নেই তার। কেবল সাবানের স্যুপ আর মোমবাতি পেলেই সে খুশি। এমনি ফ্যান্টাসির ফানুস উড়িয়েছিলেন সুকুমার রায়।
তাঁর ‘নোটবুকে’ লিখতে ভোলেননি আজব সব প্রশ্ন।
সেখানে ঝোলাগুড় কিসে দেয়? বা তেজপাতায় তেজ কেন? লঙ্কায় কেন ঝাল? এসবের মধ্যেও অদ্ভূত সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলত আমাদের শিশুমন। সত্যিই তো, এমন করে তো কেউ ভাবায়নি আমাদের।
আবার ‘পালোয়ান’ ছড়ায় পালোয়ানোচিত সব খাদ্যসম্ভার। ঠিক যেমনটি হওয়া উচিত আরকি।
‘সকালবেলার জলপানি তার তিনটি ধামা পেস্তা মেওয়া,
সঙ্গেতে তার চৌদ্দ হাঁড়ি দৈ কি মালাই মুড়্কি দেওয়া।
দুপুর হলে খাবার আসে কাতার দিয়ে ডেক্চি ভ’রে,
বরফ দেওয়া উনিশ কুঁজো সরবতে তার তৃষ্ণা হরে।
বিকাল বেলা খায় না কিছু গণ্ডা দশেক মণ্ডা ছাড়া,
সন্ধ্যা হ’লে লাগায় তেড়ে দিস্তা দিস্তা লুচির তাড়া।’
যে ছেলের ডাকনাম তাতা, তিনি যে তাঁর স্বল্প সময়ের সাহিত্যসৃষ্টিকে বিপুল খাদ্য ও অখাদ্যের সমন্বয়ে তাতিয়ে তুলবেন, এ আর এমন কথা কি?
আবোল তাবোলের সবশেষে ‘ছড়ার পাতা’য় যখন নিমগাছে শিম, হাতির মাথায় ব্যাঙের ছাতা আর কাগের বাসায় বগের ডিম ফলাচ্ছিলেন, তখনই হয়তো ঘনিয়ে এসেছিল সুকুমারের ঘুমের ঘোর। হয়তো বুঝেছিলেন যে তাঁর এ দুনিয়ায় থাকাটা ফুরিয়ে আসছে, তাই বুঝি এমন সব আবোল তাবোল ‘ভূতুড়ে খেলা’ খেলেছিলেন কাগজে আর কলমে।
‘ওরে আমার বাদলা রোদে জষ্টি মাসের বিষ্টি রে,
ওরে আমার হামান-ছেঁচা যষ্টিমধুর মিষ্টি রে ৷
ওরে আমার রান্না হাঁড়ির কান্না হাসির ফোড়নদার,
ওরে আমার জোছনা হাওয়ার স্বপ্নঘোড়ার চড়নদার।’
সুকুমার সাহিত্যে ভিজে কাঠ সেদ্ধ থেকে আমসত্ত্ব ভাজা, সাবানের স্যুপ থেকে ছেঁচকি শাকের মলম...এসব যতই সোনার পাথরবাটির মতো অলীক হোক না কেন, এসবই ননসেন্স ভার্সের অন্যতম অনুপান হয়েই রইল। অথচ ভাগ্যের এমনি পরিহাস যে মসূয়া গ্রামের জমিদারি পরিদর্শনে গিয়ে আক্রান্ত হলেন সর্বনাশা কালাজ্বরে। তাঁর নিজের খেয়ালরসের ভান্ডার ছাপার অক্ষরে দুই মলাটে দেখে যাওয়া অধরা থেকে গেল। এত এত মজার ছড়া, এত এত হাতে আঁকা ছবি, এত হাসি-মশকরা, খাবারদাবার, আজগুবি সব চরিত্রেরা বিগত ১০০ বছরের সাহিত্যের দলিল হয়ে রইল। শতবর্ষের মৃত্যুবার্ষিকীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আজও তা প্রাসঙ্গিক। কল্পসম্রাট সুকুমার চির জাগরূক আজও পাঠকের মনে। যিনি ছাঁচে ঢালা আদর্শ মানুষ গড়ার বিপরীতে হেঁটেছিলেন। আজগুবি চাল চেলে, বেঠিক, বেতালা হয়ে, সাহিত্যের মূল স্রোতের প্রতিকূলে। তাঁর খেয়ালখুশির সৃষ্টিছাড়া খ্যাপা মনটা যে ছিল কেবলি ভুলে ভরা, অসম্ভবের ছন্দে পা ফেলার একটা জগৎ।
তথ্যঋণ:
১) সুকুমার রায় জীবনকথা, হেমেন্দ্রকুমার আঢ্য
২) সুকুমার রায় রচনাসমগ্র
৩) বিভিন্ন সংবাদপত্র
আকাশি রঙের বাড়ি। দোতলায় দুটি কক্ষে আলো জ্বলছে। সন্ধ্যার আবছা আঁধারে ছেয়ে আছে বাড়িটির চারদিকের গাছগুলো। সন্ধ্যার নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় জলাশয়ে প্রকৃতির এই মোহনীয় ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।
২ দিন আগেচারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
১৩ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
২০ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
২০ দিন আগে