নেত্রকোনায় পাহাড়ে পানির জন্য হাহাকার

দুর্গাপুর (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি
আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৪: ৪০
Thumbnail image

নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী উপজেলায় দুর্গাপুরের পাহাড়ি গ্রামগুলোতে পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। পাহাড়ে প্রায় প্রতিটি ঘরে চলছে পানির জন্য হাহাকার। পাহাড়ি ঝরনার ছড়ার ময়লাযুক্ত পানি ও পুকুরের ঘোলা পানিই এখন তাঁদের একমাত্র ভরসা। 

দুর্গাপুরের সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে দুর্গাপুর সদর ইউনিয়ন ও কুল্লাগড়া ইউনিয়ন ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা পাহাড়ি অঞ্চল। সেখানকার ১০ থেকে ১২টি গ্রামে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের বসবাস। তবে তাদের কষ্টের অপর নাম পানি। পাহাড়ি ঝরনার ছড়া ও পুকুরের দূষিত পানি দিয়ে করতে হচ্ছে রান্না, গোসলসহ সব ধরনের কাজ। খেতেও হচ্ছে সেই পানি। এতে দেখা দিয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। বর্তমানে ওই সব গ্রামের কয়েক হাজার মানুষের কষ্ট এখন চরম আকার ধারণ করেছে। 

সদর ইউনিয়নের গোপালপুর, ভবানীপুর, ফান্দা, বারমারী, ভরতপুর, গাজিকোনা গ্রামসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, সাধারণ নলকূপ দিয়ে পানি আসে না। এর জন্য তারা বাধ্য হয়ে পুকুর বা পাহাড়ি ছড়ার পানি খাচ্ছে। এতে পেটের অসুখ, চর্মরোগসহ নানান রোগে আক্রান্ত হয়েছে অনেকে। ওই গ্রামগুলোতে হতদরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সংখ্যা বেশি থাকায় তাঁদের পক্ষে গভীর নলকূপ বসানো কিংবা গভীর কুয়া তৈরি করাও সম্ভব নয়। গ্রামে দু-একজন অধিক অর্থ ব্যয় করে সাবমারসিবল বসালেও বেশির ভাগ মানুষের ভাগ্যে জুটছে না বিশুদ্ধ পানি।  

গ্রামবাসী জানায়, পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় ও শুকনো মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে তাদের পানির জন্য খুবই কষ্ট করতে হচ্ছে। পাহাড়ি ছড়ার পানি আর পুকুরের ঘোলা পানিই এখন খেতে হচ্ছে। তা-ও দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পানি সংগ্রহ করতে হয়। সরকারিভাবেও কোনো রকম সহযোগিতা পাচ্ছে না। 

দুর্গাপুর সদর ইউনিয়নের ভরতপুর গ্রামের আদিবাসী নারী বুবু মারাক। অতিদরিদ্র এই নারীর বাড়িতে নেই নলকূপ। ফলে পানির জন্য সারা বছরই কষ্ট করতে হয়। তিনি বলেন, ‘আমরার কল (টিউবওয়েল) নাই। আমরা অনেক আগে থাইকা পাহাড়ের ঝরনার যে ছড়ার পানি আছে ওইডাই খাই। রান্নাবান্নাসহ সব কাজ করি। খালি আমি না, সবারই এই অবস্থা।’   

একই এলাকার প্রবন্দ হাজং বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন পাহাড়ি ছড়ার পানি ব্যবহার করেছি। এই পানি খেয়ে অসুস্থ হতে হয়েছে অনেকবার। এখন একটু ভালো পানি খাওয়ার জন্য ৪০ হাজার টাকা ঋণ করে বাড়ির সামনে সাবমারসিবল বসিয়েছি।’ 

পাহাড়ি ছড়া থেকে এক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারী পানি সংগ্রহ করছেন। ছবি: আজকের পত্রিকাএদিকে গত কয়েক বছর ধরে পানি পেতে হতদরিদ্র পরিবারগুলো তিন চাকের রিং বসিয়ে অগভীর কুয়া তৈরি করে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করলেও শুকনো মৌসুমে সেখানে পানি থাকে না। কোনো কোনোটায় পানি থাকলেও তা খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। সুপেয় পানি খেতে হলে দূর-দূরান্ত থেকে কাঁধে করে বয়ে আনতে হয়। 

বারোমারি গ্রামের হারিজ উদ্দিন বলেন, ‘আমার বাড়িতে একটি নলকূপ আছে, কিন্তু তাতে পানি আসে না। বাধ্য হয়ে প্রতিদিন পুকুরের পানি ছাঁকনি করে তা দিয়েই রান্না, খাবারসহ সব চলে। পানির জন্য খুবই কষ্ট করতে হচ্ছে।’ 

স্থানীয় পল্লি চিকিৎসক রেগুলার মানকিন বলেন, ‘আমাদের পানির খুবই অভাব। পাহাড়ি ছড়ায় গর্ত করে সে জায়গা থেকেই পানি সংগ্রহ করি সবাই। কিন্তু এই পানি বিশুদ্ধ না হওয়ায় নানা ধরনের রোগের দেখা দেয়। আমাদের বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।’ 

সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য রীতা নকরেক বলেন, ‘আমাদের গ্রামে পানির তীব্র সংকট। পানির অভাবে গোসল, রান্না, কাপড় পরিষ্কারসহ নিত্যদিনের কাজে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। একদিকে যেমন পানির অভাব, অন্যদিকে এবারের প্রচণ্ড গরমের কারণে পাহাড়ি ছড়া বা পুকুরের পানি দিনের বেলায় অনেক গরম হয়ে থাকায় রাতে আনতে হয়। সরকারিভাবে গভীর নলকূপ স্থাপন করা হলে এলাকার মানুষের উপকার হতো।’ 

সদর ইউপির চেয়ারম্যান সাদেকুল ইসলাম বলেন, সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে গভীর টিউবওয়েল বসাতে হলে পাথর সরিয়ে প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ ফুট নিচে পর্যন্ত যেতে হয়। এটি ব্যয়বহুল, যা সেখানকার মানুষের জন্য কষ্টকর। তবে বিকল্প হিসেবে গভীর রিং টিউবওয়েল বসানো যায়। তাহলে আদিবাসীদের সুপেয় পানির সমস্যা কিছুটা দূর হবে। 

তিন চাকের রিং বসিয়ে তৈরি করা অগভীর কুয়া। ছবি: আজকের পত্রিকাএ বিষয়ে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘পাহাড়ি এলাকায় পাথরের জন্য গভীর নলকূপ বসানো সম্ভব হয় না। পাহাড়ি এলাকায় পানির সংকট নিরসনে আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা এই পানির সংকট দূর করতে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ করতে চাইছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছি।’ 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এম. রকিবুল হাসান বলেন, ‘পানিসংকটের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। ওই গ্রামগুলোতে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা রয়েছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত