ইন্টার্নদের হাতে মার খাওয়া সুমন ৩ হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা নিলেন মুখ ঢেকে

রিমন রহমান, রাজশাহী
প্রকাশ : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৭: ৫৮
আপডেট : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৯: ৪১

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার সুমন পারভেজ রিপন (৩০) প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ তুলেছেন। তাঁর দাবি, চিকিৎসা নেওয়ার জন্য তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার রাজশাহীর তিনটি হাসপাতাল-ক্লিনিকে গিয়েছিলেন। তবে চিকিৎসকেরা তাঁর চিকিৎসা করতে চাননি। পরে একটি সামাজিক সংগঠনের নেতার পরামর্শে মুখ ঢেকে একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন।

আজ শুক্রবার বিকেলে আজকের পত্রিকাকে এসব তথ্য জানিয়েছেন সুমন পারভেজ রিপন। তবে যে হাসপাতাল, ক্লিনিকগুলো চিকিৎসা করেনি এবং যেখানে মুখ ঢেকে চিকিৎসা করেছেন, সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম জানাতে চাননি সুমন। তিনি বলেন, ‘এমনিতেই বিপদের মধ্যে আছি। আমি সবাইকে জড়িয়ে আরও বিপদ বাড়াতে চাই না।’ তিনি বিচার দাবি করে বলেছেন, ‘আমি কোনো অন্যায় করিনি। সুষ্ঠু বিচার চাই। বিচার না পেলে হাসপাতালের সামনে গিয়ে আত্মহত্যা ছাড়া কোনো পথ থাকবে না।’ 

সুমন পারভেজ নগরীর বোসপাড়া এলাকার বাসিন্দা। তাঁর মা পিয়ারা বেগম (৬০) সিওপিডি (ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ) রোগে আক্রান্ত। এ জন্য ২ ফেব্রুয়ারি তাঁকে রামেক হাসপাতালের ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছিল। বুধবার দুপুরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট দেখাকে কেন্দ্র করে বাগ্‌বিতণ্ডার জেরে হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা তাঁদের কক্ষে ডেকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে সুমনকে বেধড়ক পেটান।

এ ঘটনার পর নিরাপত্তার সংকটে পরদিন বৃহস্পতিবার চিকিৎসা শেষ না করেই পিয়ারা বেগমকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে যান স্বজনেরা। এই ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আলমগীর হোসেন ও ফরহাদ হাসান নামে দুজন ইন্টার্ন চিকিৎসককেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। 

সুমন পারভেজ বলেন, ‘প্রায় ৩০ মিনিট ধরে তারা আমাকে বেধড়ক পিটিয়েছে। তারা ১০-১৫ জনের মতো ছিল। সবার হাত-পা চলেছে। আমার সারা শরীরে ব্যথা। বুকের ব্যথা অসহনীয়। এ জন্য চিকিৎসা দরকার। তার জন্য বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপুর এলাকার দুটি ক্লিনিক আর একটি বেসরকারি হাসপাতালে যাই। কিন্তু ডাক্তাররা আমাকে চিনতে পেরেছেন। সে জন্য তারা আমার চিকিৎসা করতে চায়নি। হাসপাতালেও ভর্তি নেওয়া হয়নি। ডাক্তারদের গ্রুপে হয়তো আমাকে চিকিৎসা না করানোর ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। 

‘পরে রাজশাহীর একটি সামাজিক সংগঠনের এক নেতার পরামর্শে মুখ ঢেকে অন্য একটি হাসপাতালে যাই। ওই নেতা নিজে সেখানকার ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেন। পরে আমাকে ভর্তি নেওয়া হয়। আমার শরীরের অবস্থা দেখেই ডাক্তার বলেছেন, “এগুলো তো মারধরের দাগ।” তখন বলেছি, পারিবারিক বিরোধে আমাকে মারধর করা হয়েছে। এভাবে মিথ্যা কথা বলে চিকিৎসা নিই। পরে মনে হলো, ডাক্তাররা আমার পরিচয় জেনে গেছেন। তাই চলে এসেছি।’ 

সুমন বলেন, গতকাল রাতে ওই হাসপাতালে ভর্তির পর এক্স-রে করা হয়েছে। এতে বুকের ডান দিকের একটি হাড় ক্ষতিগ্রস্ত বলে দেখা গেছে। এক দিনেই হাসপাতালে চার হাজার টাকা বিল হয়েছে। কয়েকজনের কাছ থেকে ধার করে এই বিল পরিশোধ করেছেন। তারপর ব্যবস্থাপত্র লিখে নিয়ে আজ দুপুরে হাসপাতাল থেকে চলে এসেছেন। 

এ ঘটনায় কোনো অভিযোগ করেছেন কি না জানতে চাইলে সুমন বলেন, ‘অভিযোগ করার জন্য থানায় গিয়েছিলাম। ওই সময়ই মাকে হাসপাতাল থেকে আনার জন্য চলে যাই। অভিযোগ করা হয়নি। এখনো আমার মা অসুস্থ। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট আছে। আজও বাসায় নেবুলাইজার দেওয়া হয়েছে। আমি নিজেও অসুস্থ। তাই অভিযোগ করতে যাওয়া হয়নি। আমি অবশ্যই অভিযোগ করতে চাই। 

‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি করেছে। আমি এ ঘটনার বিচার চাই। বিচার না পেলে হাসপাতালের সামনে গিয়ে আমি আত্মহত্যা করব। কারণ, আমি কোনো অপরাধ করিনি। সৎ সাহস থাকলে কর্তৃপক্ষ সিসি ক্যামেরার ফুটেজ প্রকাশ করুক। তারা তো এটা করছে না। আমার দোষ থাকলে তারাই ফুটেজ বের করে দিত।’ 

তিনটি হাসপাতাল-ক্লিনিকে সুমনের চিকিৎসা না করার তীব্র সমালোচনা করে সামাজিক সংগঠন রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, ‘চিকিৎসা পাওয়া মানুষের মৌলিক অধিকার। এই অধিকার থেকে চিকিৎসকেরা সুমনকে বঞ্চিত করেছেন। এই ঘটনারও যথাযথ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। যারা চিকিৎসা দেয়নি, তাদের লাইসেন্স বাতিল করা দরকার। নইলে ভবিষ্যতেও এমনটা ঘটবে। মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে।’ 

জানতে চাইলে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) রাজশাহী জেলার সভাপতি ডা. চিন্ময় কান্তি দাস আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কোন কোন হাসপাতাল-ক্লিনিক সুমনকে চিকিৎসা দেয়নি, তাদের নাম বলতে হবে। নাম না বলে এ ধরনের অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়। সুমনের সঙ্গে আসলেই কী ঘটেছে, তা আমি জানি না। তবে কেউ যদি তার চিকিৎসা না করেন, তাহলে এটা ঠিক হয়নি। কারণ, শত্রু হলেও তার চিকিৎসা করতে হবে। এটাই চিকিৎসাবিদ্যার এথিকস।’

রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এফ এম শামীম আহম্মদ বলেন, ‘বুধবার মারধরের ঘটনার পরই একজন আবাসিক সার্জনকে দিয়ে সুমনের চিকিৎসা করিয়েছি। ওটিতে নিয়ে তার ক্ষতস্থানের ড্রেসিং করে দেওয়া হয়েছিল। এক্স-রে করেও দেখা হয়েছিল। পরে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সুমনের শারীরিক অবস্থা এতটা খারাপ ছিল না যে তাকে হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা করানোর দরকার ছিল।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত