মোজাম্মেল হোসেন, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
হারিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ঝাপসা চোখে দেখা যায় দূরে, বহু দূরে, মিলিয়ে যাচ্ছে। ওকে ফিরিয়ে আনতে হবে। হঠাৎ কেউ গুম করেনি। অপহরণ করে কেউ নিয়ে যাচ্ছে না। খুনই করতে চেয়েছিল শত্রুরা, পারেনি। বাংলা মায়ের দেশপ্রেমী সন্তানেরা, বাংলার জনগণ, দীর্ঘদিন নানা রকম লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে ক্ষতবিক্ষত দেশমাতাকে শত্রুর কবল থেকে রক্ষা করেছে, আগলে রাখছে। কিন্তু এ এক কঠিন সংগ্রাম। বিজয়ের মধ্যে চুপিসারে কখন পরাজয় ঢুকে পড়ে। রক্ষা পাওয়ার জন্যই আপস করতে হয়। যে মায়ের অপরূপ রূপ দেখে আমাদের আঁখি ফেরে না, তাকে মলিন বেশে দেখতে কি আমাদের সয়? কিন্তু এ এক কঠিন সংগ্রাম। সংগ্রাম করতে করতে আমাদের মধ্যেই অনেকে বদলে যায়। বুঝতেও পারে না তারা বদলে যাচ্ছে। একসময় তারা অনেকে মায়ের কুপুত্রে পরিণত হয়। সুপুত্রদের তখন তাদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়। অবিরাম লড়াই।
পাঠকদের নিশ্চয়ই ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে। রূপক ছেড়ে সোজা কথায় আসি। ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৩, আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৫২তম বার্ষিকী উদ্যাপন করছি। অর্ধশতাব্দীর বেশি আমাদের দেশ স্বাধীন। স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরা অনেক কিছু পেয়েছি। জাতীয় পরিচয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের একটি জায়গা হয়েছে, যা পাকিস্তানের অধীনে থাকলে ছিল না, পেতাম না। সেদিক থেকে জাতি হিসেবে বিকশিত হচ্ছি। মাথাপিছু আয়, প্রবৃদ্ধি, ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়নে বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ দিয়ে নিজ খরচে পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেল, উড়ালসড়ক, বিরতিহীন মহাসড়ক প্রভৃতি গর্ব করে বলার মতো বেশ কিছু বিষয় আছে। বিশ্বের দৃষ্টি কাড়ছি। ক্রিকেট খেলায় আন্তর্জাতিক মানে। এভাবে দেশের চেহারা তো ভালোর দিকেই বদলে যাচ্ছে। তাহলে বাংলাদেশ কোথায় হারাল?
হারিয়েছে। হারাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক আদর্শ, স্বপ্ন, চেতনা, অঙ্গীকার হারাচ্ছি। ফিকে হয়ে আসছে। বৈষয়িক জীবনমান উন্নত করা, দারিদ্র্য কমিয়ে আনা নিশ্চয়ই স্বাধীনতা চাওয়ার পেছনে বড় কারণ ছিল। কিন্তু শুধু এ জন্যই মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। অর্থনৈতিক-বৈষয়িক উন্নতি, রাস্তাঘাট পাকিস্তান আমলের নিকৃষ্ট স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের সময় হয়েছে, বাংলাদেশের নিকৃষ্ট স্বৈরশাসক এরশাদের সময় হয়েছে, দেশের আমজনতা তা-ই বলে। এই রাস্তাটা আইয়ুব খানের সময়, ওই রাস্তাটা এরশাদের সময় ইত্যাদি এখনো শুনবেন গ্রামাঞ্চলে। কিন্তু ওই দুই নিকৃষ্ট সামরিক স্বৈরশাসককেই দেশের মানুষ আন্দোলন করে হটিয়ে দিয়েছে এবং তা নিয়ে আনন্দ-উল্লাস করেছে। হ্যাঁ, ভবিষ্যতে আমরা আরও বড় বড় উন্নয়নের কথা বলব যে এই মহাসড়ক, এই মহা সেতু, এই গভীর সমুদ্রবন্দর, মহাকাশে উপগ্রহ—সব শেখ হাসিনার আমলে হয়েছে।
স্বাধীনতা চাওয়ার আরও এক পটভূমি ছিল পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য। পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ, অবহেলা, বাঙালির বঞ্চনা। তবে আঞ্চলিক বৈষম্যের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে মানুষে-মানুষে বৈষম্য কমিয়ে আনার স্বপ্নও দেখেছি। সমতার অর্থনীতি, সাম্যের সমাজের স্বপ্নও দেখেছি। কিন্তু এখন প্রবৃদ্ধি যতই হোক, দারিদ্র্য কিছু কমলেও, মানুষে-মানুষে, শ্রেণিতে-শ্রেণিতে ধনবৈষম্য আরও বেড়েছে। এখানেই স্বাধীনতার আদর্শের বিপরীতে যাত্রা। শুধু বৈষম্য বাড়েনি, বেড়েছে দুর্নীতি, আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম ও লুটপাট, দেশ থেকে টাকা পাচার বেধড়ক, বেড়েছে দলে-দলে, গোষ্ঠীতে-গোষ্ঠীতে ব্যবধান, ঘৃণা, সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে সম্প্রীতির পরিবেশের অবনতি, সামাজিক অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা, মানবিক মূল্যবোধ কমে যাওয়া, নাগরিকের প্রাপ্য সরকারি সেবা ও বিচার পেতে শতরকম হয়রানি ইত্যাদি বহু রকম নেতিবাচকতা। বৈষয়িক উন্নতির বিপরীতে নৈতিকতা, সংস্কৃতি ও মননশীলতার অবনতি। দেশের এত চোখধাঁধানো উন্নয়ন সত্ত্বেও তরুণসমাজের মধ্যে স্পষ্টত হতাশা লক্ষণীয়। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, ১৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সী শতকরা ৪৩ ভাগ ছাত্রছাত্রী, তরুণ-তরুণী দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যেতে চান। এটি একটি আতঙ্কজনক পরিসংখ্যান। কারণ এই বয়সের তরুণেরাই না দেশের ভবিষ্যৎ! তাহলে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ও স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরে দেশ কেমন ভবিষ্যতের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে?
আমাদের শাসক ও মূলধারার রাজনীতিবিদেরা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনের স্বপ্নগুলো কথাগুলো ভুলিয়ে দিতে চাইছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এ ব্যাপারে শৈথিল্য দেখা দেয়। তবে উল্টোযাত্রা সুস্পষ্টভাবে শুরু হয় একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধীরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার পর থেকে। সে কথাই নিবন্ধের শুরুতে বলেছি শত্রুরা বাংলাদেশকে হত্যা করতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি, তবে দেশকে বিকলাঙ্গ করতে পেরেছে। স্বাধীনতাসংগ্রাম পরিচালনাকারী মূল দল আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একুশ বছর পরে ক্ষমতায় এসে দেশকে সমূহ সর্বনাশ থেকে বাঁচায়। কিন্তু এই বিজয়ের অন্তরালে পরাজয় যে হামাগুড়ি দিয়ে আসে তা হচ্ছে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ক্ষেত্রে আপস করে চলা, ছাড় দিয়ে চলা। আওয়ামী লীগ এখানেই জনগণকে রাজনৈতিকভাবে পুনঃসংগঠিত ও শিক্ষিত করার চেষ্টা করল না। এখন শুধু আওয়ামী লীগ বা ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি’র ক্ষমতায় থাকাকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিজয় বলে প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া হচ্ছে। আর অব্যাহত ক্ষমতার সঙ্গে রয়েছে অব্যাহত দুর্নীতি।
পরিসরের কারণে একটি কথা সংক্ষেপে বলে লেখাটি শেষ করতে হচ্ছে। বলা হয়, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আমরা দেশ গড়ছি। কথাটা কি সত্য? বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনব্যাপী সংগ্রামে বাঙালি জাতির মুক্তি, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, মানুষের মর্যাদায় বাঁচা, তাঁর রেখে যাওয়া ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র পাতায় পাতায় স্বপ্ন ও আদর্শিক ধারণার কথা, স্বাধীনতার পরে অসংখ্য উপদেশমূলক ভাষণ, সংবিধানের খসড়া ব্যাখ্যা করে সংসদে ভাষণ ইত্যাদি বিস্তৃত পরিসর রেখে এককথায় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের নির্যাস বলতে যদি তাঁরই নির্দেশনায় রচিত বাংলাদেশের সংবিধানের মূল চার নীতি—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ধরি, তাহলে এর প্রতিটিকেই কি খণ্ডিত, বিকৃত ও গোঁজামিল দেওয়া দেখতে পাই না? বাকশাল গঠনের সময় আর্থসামাজিক ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ ব্যাখ্যা করে জীবনের শেষ ভাষণগুলোতে তিনি বলেছিলেন সমতার লক্ষ্যে আমরা করব মিশ্র অর্থনীতি, যাতে রাষ্ট্রীয় খাত ও ব্যক্তি খাত থাকবে এবং সমবায় খাতে প্রাধান্য দেওয়া হবে।
আছে এগুলো? আমরা কি মিশ্র অর্থনীতির বদলে কল্যাণমুখী ও উদারতার দিকগুলো বাদ দিয়ে নিকৃষ্ট ধনতন্ত্রের ধ্বজা উড়িয়ে চলছি না? বঙ্গবন্ধুর নামে জয়ধ্বনি দিয়ে, ছবি ঊর্ধ্বে তুলে ধরে, ভাস্কর্য নির্মাণ করে তাঁর আদর্শ ছেড়ে দিলে বাংলাদেশ তো হারিয়ে যাবেই। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এ জন্য নবায়িত অঙ্গীকার প্রয়োজন আমাদের রাজনীতিতে।
হারিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ঝাপসা চোখে দেখা যায় দূরে, বহু দূরে, মিলিয়ে যাচ্ছে। ওকে ফিরিয়ে আনতে হবে। হঠাৎ কেউ গুম করেনি। অপহরণ করে কেউ নিয়ে যাচ্ছে না। খুনই করতে চেয়েছিল শত্রুরা, পারেনি। বাংলা মায়ের দেশপ্রেমী সন্তানেরা, বাংলার জনগণ, দীর্ঘদিন নানা রকম লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে ক্ষতবিক্ষত দেশমাতাকে শত্রুর কবল থেকে রক্ষা করেছে, আগলে রাখছে। কিন্তু এ এক কঠিন সংগ্রাম। বিজয়ের মধ্যে চুপিসারে কখন পরাজয় ঢুকে পড়ে। রক্ষা পাওয়ার জন্যই আপস করতে হয়। যে মায়ের অপরূপ রূপ দেখে আমাদের আঁখি ফেরে না, তাকে মলিন বেশে দেখতে কি আমাদের সয়? কিন্তু এ এক কঠিন সংগ্রাম। সংগ্রাম করতে করতে আমাদের মধ্যেই অনেকে বদলে যায়। বুঝতেও পারে না তারা বদলে যাচ্ছে। একসময় তারা অনেকে মায়ের কুপুত্রে পরিণত হয়। সুপুত্রদের তখন তাদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়। অবিরাম লড়াই।
পাঠকদের নিশ্চয়ই ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে। রূপক ছেড়ে সোজা কথায় আসি। ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৩, আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৫২তম বার্ষিকী উদ্যাপন করছি। অর্ধশতাব্দীর বেশি আমাদের দেশ স্বাধীন। স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরা অনেক কিছু পেয়েছি। জাতীয় পরিচয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের একটি জায়গা হয়েছে, যা পাকিস্তানের অধীনে থাকলে ছিল না, পেতাম না। সেদিক থেকে জাতি হিসেবে বিকশিত হচ্ছি। মাথাপিছু আয়, প্রবৃদ্ধি, ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়নে বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ দিয়ে নিজ খরচে পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেল, উড়ালসড়ক, বিরতিহীন মহাসড়ক প্রভৃতি গর্ব করে বলার মতো বেশ কিছু বিষয় আছে। বিশ্বের দৃষ্টি কাড়ছি। ক্রিকেট খেলায় আন্তর্জাতিক মানে। এভাবে দেশের চেহারা তো ভালোর দিকেই বদলে যাচ্ছে। তাহলে বাংলাদেশ কোথায় হারাল?
হারিয়েছে। হারাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক আদর্শ, স্বপ্ন, চেতনা, অঙ্গীকার হারাচ্ছি। ফিকে হয়ে আসছে। বৈষয়িক জীবনমান উন্নত করা, দারিদ্র্য কমিয়ে আনা নিশ্চয়ই স্বাধীনতা চাওয়ার পেছনে বড় কারণ ছিল। কিন্তু শুধু এ জন্যই মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। অর্থনৈতিক-বৈষয়িক উন্নতি, রাস্তাঘাট পাকিস্তান আমলের নিকৃষ্ট স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের সময় হয়েছে, বাংলাদেশের নিকৃষ্ট স্বৈরশাসক এরশাদের সময় হয়েছে, দেশের আমজনতা তা-ই বলে। এই রাস্তাটা আইয়ুব খানের সময়, ওই রাস্তাটা এরশাদের সময় ইত্যাদি এখনো শুনবেন গ্রামাঞ্চলে। কিন্তু ওই দুই নিকৃষ্ট সামরিক স্বৈরশাসককেই দেশের মানুষ আন্দোলন করে হটিয়ে দিয়েছে এবং তা নিয়ে আনন্দ-উল্লাস করেছে। হ্যাঁ, ভবিষ্যতে আমরা আরও বড় বড় উন্নয়নের কথা বলব যে এই মহাসড়ক, এই মহা সেতু, এই গভীর সমুদ্রবন্দর, মহাকাশে উপগ্রহ—সব শেখ হাসিনার আমলে হয়েছে।
স্বাধীনতা চাওয়ার আরও এক পটভূমি ছিল পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য। পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ, অবহেলা, বাঙালির বঞ্চনা। তবে আঞ্চলিক বৈষম্যের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে মানুষে-মানুষে বৈষম্য কমিয়ে আনার স্বপ্নও দেখেছি। সমতার অর্থনীতি, সাম্যের সমাজের স্বপ্নও দেখেছি। কিন্তু এখন প্রবৃদ্ধি যতই হোক, দারিদ্র্য কিছু কমলেও, মানুষে-মানুষে, শ্রেণিতে-শ্রেণিতে ধনবৈষম্য আরও বেড়েছে। এখানেই স্বাধীনতার আদর্শের বিপরীতে যাত্রা। শুধু বৈষম্য বাড়েনি, বেড়েছে দুর্নীতি, আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম ও লুটপাট, দেশ থেকে টাকা পাচার বেধড়ক, বেড়েছে দলে-দলে, গোষ্ঠীতে-গোষ্ঠীতে ব্যবধান, ঘৃণা, সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে সম্প্রীতির পরিবেশের অবনতি, সামাজিক অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা, মানবিক মূল্যবোধ কমে যাওয়া, নাগরিকের প্রাপ্য সরকারি সেবা ও বিচার পেতে শতরকম হয়রানি ইত্যাদি বহু রকম নেতিবাচকতা। বৈষয়িক উন্নতির বিপরীতে নৈতিকতা, সংস্কৃতি ও মননশীলতার অবনতি। দেশের এত চোখধাঁধানো উন্নয়ন সত্ত্বেও তরুণসমাজের মধ্যে স্পষ্টত হতাশা লক্ষণীয়। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, ১৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সী শতকরা ৪৩ ভাগ ছাত্রছাত্রী, তরুণ-তরুণী দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যেতে চান। এটি একটি আতঙ্কজনক পরিসংখ্যান। কারণ এই বয়সের তরুণেরাই না দেশের ভবিষ্যৎ! তাহলে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ও স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরে দেশ কেমন ভবিষ্যতের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে?
আমাদের শাসক ও মূলধারার রাজনীতিবিদেরা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনের স্বপ্নগুলো কথাগুলো ভুলিয়ে দিতে চাইছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এ ব্যাপারে শৈথিল্য দেখা দেয়। তবে উল্টোযাত্রা সুস্পষ্টভাবে শুরু হয় একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধীরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার পর থেকে। সে কথাই নিবন্ধের শুরুতে বলেছি শত্রুরা বাংলাদেশকে হত্যা করতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি, তবে দেশকে বিকলাঙ্গ করতে পেরেছে। স্বাধীনতাসংগ্রাম পরিচালনাকারী মূল দল আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একুশ বছর পরে ক্ষমতায় এসে দেশকে সমূহ সর্বনাশ থেকে বাঁচায়। কিন্তু এই বিজয়ের অন্তরালে পরাজয় যে হামাগুড়ি দিয়ে আসে তা হচ্ছে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ক্ষেত্রে আপস করে চলা, ছাড় দিয়ে চলা। আওয়ামী লীগ এখানেই জনগণকে রাজনৈতিকভাবে পুনঃসংগঠিত ও শিক্ষিত করার চেষ্টা করল না। এখন শুধু আওয়ামী লীগ বা ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি’র ক্ষমতায় থাকাকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিজয় বলে প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া হচ্ছে। আর অব্যাহত ক্ষমতার সঙ্গে রয়েছে অব্যাহত দুর্নীতি।
পরিসরের কারণে একটি কথা সংক্ষেপে বলে লেখাটি শেষ করতে হচ্ছে। বলা হয়, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আমরা দেশ গড়ছি। কথাটা কি সত্য? বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনব্যাপী সংগ্রামে বাঙালি জাতির মুক্তি, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, মানুষের মর্যাদায় বাঁচা, তাঁর রেখে যাওয়া ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র পাতায় পাতায় স্বপ্ন ও আদর্শিক ধারণার কথা, স্বাধীনতার পরে অসংখ্য উপদেশমূলক ভাষণ, সংবিধানের খসড়া ব্যাখ্যা করে সংসদে ভাষণ ইত্যাদি বিস্তৃত পরিসর রেখে এককথায় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের নির্যাস বলতে যদি তাঁরই নির্দেশনায় রচিত বাংলাদেশের সংবিধানের মূল চার নীতি—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ধরি, তাহলে এর প্রতিটিকেই কি খণ্ডিত, বিকৃত ও গোঁজামিল দেওয়া দেখতে পাই না? বাকশাল গঠনের সময় আর্থসামাজিক ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ ব্যাখ্যা করে জীবনের শেষ ভাষণগুলোতে তিনি বলেছিলেন সমতার লক্ষ্যে আমরা করব মিশ্র অর্থনীতি, যাতে রাষ্ট্রীয় খাত ও ব্যক্তি খাত থাকবে এবং সমবায় খাতে প্রাধান্য দেওয়া হবে।
আছে এগুলো? আমরা কি মিশ্র অর্থনীতির বদলে কল্যাণমুখী ও উদারতার দিকগুলো বাদ দিয়ে নিকৃষ্ট ধনতন্ত্রের ধ্বজা উড়িয়ে চলছি না? বঙ্গবন্ধুর নামে জয়ধ্বনি দিয়ে, ছবি ঊর্ধ্বে তুলে ধরে, ভাস্কর্য নির্মাণ করে তাঁর আদর্শ ছেড়ে দিলে বাংলাদেশ তো হারিয়ে যাবেই। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এ জন্য নবায়িত অঙ্গীকার প্রয়োজন আমাদের রাজনীতিতে।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪