বদলে যাচ্ছে সুন্দরবনের প্রাণীদের খাদ্যাভ্যাস

সাইফুল মাসুম, সুন্দরবন থেকে ফিরে
প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৩, ০৮: ২২

প্রাণবৈচিত্র্যের আধার সুন্দরবন। বাঘ, হরিণ, কুমির, নানা প্রজাতির সাপ, কাঁকড়াসহ অসংখ্য প্রাণীর আবাসস্থল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই শ্বাসমূলীয় বন। এই বনের রয়েছে স্বতন্ত্র বাস্তুসংস্থান বা খাদ্যচক্র। সম্প্রতি সুন্দরবনে পর্যটকদের আনাগোনা ও বনজীবীদের উৎপাতে ভেঙে পড়ছে সেখানকার বাস্তুসংস্থান। বদলে যাচ্ছে প্রাণীদের খাদ্যাভ্যাস।

সম্প্রতি সুন্দরবন ঘুরে দেখা গেছে, বনের পর্যটন স্পটগুলোয় প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে হরিণ ও বানরের খাবার। বনের গহিনে পর্যটকদের কাছ থেকে খাবার পেতে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে শূকর ও বানরদের।

সুন্দরবনের খাদ্যচক্রের প্রাথমিক স্তরে রয়েছে উদ্ভিদকণা ও প্রাণিকণা, যা খেয়ে বেঁচে থাকে বনের ছোট মাছ, কাঁকড়া ও শামুক। আবার বড় মাছ, পাখি ও অন্যান্য প্রাণীর প্রধান খাবার ছোট মাছ। তাই নদীর পানিদূষণে উদ্ভিদকণা ও প্রাণিকণা মারা গেলে সর্বস্তরের প্রাণীর খাদ্য জোগানে টান পড়ে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ‘সুন্দরবনে অব্যবস্থাপনার কারণে বন্য প্রাণীদের খাদ্যশৃঙ্খলে আঘাত এসেছে। বিষ দিয়ে মাছ মারা হচ্ছে, ওই মাছ খেয়ে সুন্দরবন পাখিশূন্য হয়ে পড়েছে। বনের কাছে শিল্পকারখানা তৈরি এবং পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ায় জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

বনের প্রাণীদের মধ্যে হরিণ ও বানর তৃণভোজী। হরিণ বনের ঘাস ও লতাপাতা খেয়ে জীবন ধারণ করে। তার পছন্দের খাবারের মধ্যে রয়েছে কেওড়াপাতা। বানর লতাপাতা এবং বনের বিভিন্ন গাছের ফলমূল খেয়ে থাকে। এ ছাড়া ছোট পোকামাকড়ের প্রতিও বানরের বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। বাঘ ও গুইসাপ মাংসাশী প্রাণী। বাঘের খাদ্যতালিকার ওপরের দিকে রয়েছে হরিণ। সুন্দরবনে বাঘের মোট খাবারের মধ্যে ৮০ শতাংশ হরিণ, ১০ শতাংশ বন্য শূকর, ৫ শতাংশ বানর ও ৫ শতাংশ অন্যান্য প্রাণী থেকে আসে। গুইসাপ তার সামর্থ্য অনুযায়ী ছোট প্রাণী খেয়ে থাকে। সাপও মাংসাশী; তারা ব্যাঙ, মাছ খেয়ে জীবন ধারণ করে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনে পর্যটক ও বনজীবী বেড়ে যাওয়ায় বন্য প্রাণীদের খাদ্যাভ্যাসে প্রভাব পড়ছে। এতে ভেঙে পড়ছে বনের খাদ্যশৃঙ্খল; যা পরে তৃণভোজী ও মাংসাশী প্রাণীদের মধ্যেও প্রভাব ফেলছে। লোকালয়ে বেড়ে গেছে বাঘ ও অজগরের আক্রমণ। বনে কমে গেছে পাখির উপস্থিতি।

সম্প্রতি সুন্দরবনের বন্য প্রাণী নিয়ে গবেষণা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদাউসী। তাঁর গবেষণায়ও বন্য প্রাণীদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের তথ্য উঠে এসেছে। জান্নাতুল ফেরদাউসী আজকের পত্রিকাকে বলেন, বনের প্রাণীদের লোকালয়ে আসার ঘটনা বেড়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন। বন্য প্রাণীদের খাবার সাধারণত বনেই থাকে। বাইরের খাবার দিলে প্রাণীদের অভ্যস্ততা তৈরি হয়। পর্যটকেরা যখন খাবার দেয়, তখন প্রাণীদের মধ্যে নিজেদের খাবার সংগ্রহের প্রবণতা কমে যায়।

করমজলে বিক্রি হচ্ছে হরিণ ও বানরের খাবার সুন্দরবনের করমজলে রয়েছে বন্য প্রাণীর প্রজনন কেন্দ্র। সেখানে প্রকাশ্যে হরিণ ও বানরের খাবার বিক্রি করতে দেখা গেছে। যদিও প্রজনন কেন্দ্রের ভেতরে কয়েকটি ব্যানারে লেখা রয়েছে ‘বন্য প্রাণীকে খাবার দিবেন না’।

করমজলে বন্য প্রাণীর প্রজনন কেন্দ্রের হরিণের খাঁচার সামনে বসে খাবার বিক্রি করেন লাল মিয়া। চিপস, বাদাম, শাক, পানি, কোমল পানীয়সহ বেশ কিছু খাদ্যপণ্য বিক্রি করেন তিনি। এসব খাদ্যপণ্য কিনে নিয়ে বন্য প্রাণীদের খেতে দেন পর্যটকেরা।

লাল মিয়া জানান, পাঁচ বছর ধরে তিনি এভাবে খাবার বিক্রি করেন। বন বিভাগের লোকজন তাঁকে বাধা দেননি। করমজলের ওয়াচ টাওয়ারের পাশে বন্য প্রাণীর জন্য খাবার বিক্রি করেন বিলকিস বেগম। অনেকে তাঁর কাছ থেকে বাদাম ও কলা কিনে বানরকে খাওয়ায় বলে জানান এই নারী।

বাইরের খাবারের কারণে প্রজনন কেন্দ্রের বন্য প্রাণীদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের কথা স্বীকার করেছেন করমজল বন্য প্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবীর।এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বন্য প্রাণীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনা করে আমরা পর্যটকদের খাবার দিতে নিষেধ করি। সচেতনতার জন্য বনের ভেতরে সাইনবোর্ডেও এ বিষয়ে লেখা রয়েছে।

স্বতন্ত্র প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে ১৯৯৭ সালে ইউনেসকো সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বন বিভাগের ২০০৪ সালের জরিপ অনুসারে সুন্দরবনে বাঘ ছিল ৪৪০টি। ২০১৮ সালের জরিপে দেখা যায়, তা কমে হয়েছে ১১৪টি। এ ছাড়া সুন্দরবনে প্রায় দেড় লাখ হরিণ, ২০০টির মতো কুমির এবং ৫০ হাজারের বেশি বানর রয়েছে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত