প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি, কারোরই দায় এড়ানোর সুযোগ নেই

প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২৪, ০৭: ৪৩
আপডেট : ১০ মার্চ ২০২৪, ০৭: ৪৩

স্থপতি তানউইর নওয়াজ তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি এবং বর্তমান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগ থেকে ১৯৬৭ সালে পাস করে রকফেলার বৃত্তি নিয়ে আমেরিকার টেক্সাস ইউনিভার্সিটি থেকে এমআর ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশে ফিরে কিছুদিন বুয়েটে শিক্ষকতা করেন। এরপর প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চিফ হিসেবে কাজ করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকার মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান এবং স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানের সঙ্গে যুক্ত আছেন। ২০০৪ সাল থেকে মেট্রোরেলসহ সড়ক প্রকল্পের পরিকল্পনার সঙ্গেও যুক্ত আছেন তিনি। সম্প্রতি রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজে আগুনের ঘটনা নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা

আজকের পত্রিকা: বেইলি রোডের একটি ভবনে আগুন লেগে ৪৬ জন মানুষ মারা গেল। এই দুর্ঘটনার দায় কার?
তানউইর নওয়াজ: এই দুর্ঘটনার দায় অনেকগুলো সংস্থার ওপর বর্তায়। যাঁরা ভবনের মালিক ছিলেন, যাঁরা ডিজাইন করেছেন, যে প্রতিষ্ঠান পরিকল্পনা পাস করেছে, যারা এর ব্যবহার পরিবর্তন করেছে—এই দুর্ঘটনায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি, কারোরই দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। আমি এককভাবে কাউকে দোষ দেব না। এ ঘটনায় সামষ্টিকভাবে দায় এড়ানোর ব্যাপার আছে। যে রিয়েল এস্টেট কোম্পানি এই ভবনটা নির্মাণ করেছে, তাদের দায় প্রথম। যে স্থপতিরা এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদেরও দায় ছিল। একটা বাণিজ্যিক ভবন এমনভাবে নকশা করেছে যে কোম্পানি, যেখানে চারদিকে সিঁড়িটা খোলা ছিল, কোনো কারণে আগুন লাগার পর আগুনের কুণ্ডলীটি পেঁচিয়ে ওপরে উঠে যায়। এভাবে প্রতিটি তলায় এটা ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে ধোঁয়া নাকের মধ্য দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে অসংখ্য মানুষ মারা গেছে।

প্রধান দায় কিন্তু রাজউকের। তারা ভবন ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। হয়তোবা সেটা বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে ব্যবহার না করে মালিকপক্ষ অ্যাসেম্বলি বিল্ডিং হিসেবে ব্যবহার করেছে। দুটির ব্যবহার কিন্তু দুই রকম। দুটির প্ল্যানিং এবং রেগুলেশনে অনেক পার্থক্য। অ্যাসেম্বলি হচ্ছে, যেখানে অনেক বেশি লোক কাজ করে, আর বাণিজ্যিক বা কমার্শিয়ালে অল্পসংখ্যক লোক কাজ করে। সেখানে হয়তো একটা সিঁড়ি হলেই চলত। অ্যাসেম্বলি বিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে অনেক বেশি লোকের সমাবেশ হয়। এ ধরনের ভবনে যখন আগুন লাগে, তখন সেটা বিপজ্জনক অবস্থার মধ্যে চলে যায়।

আগুন লাগা ভবনটির নকশায় সমস্যা ছিল। ওই ভবনে একটিই সিঁড়ি ছিল। সেই সিঁড়িতে আবার দাহ্য পদার্থ রাখা ছিল। সিঁড়িতে এসব যদি না রাখা হতো, তাহলে আগুন ওপরে উঠে পড়ত না। হয়তোবা এতগুলো মানুষের জীবনও চলে যেত না। 

আজকের পত্রিকা: প্রতিবার আগুন লাগার পর ভবনের অনুমতি ছিল না বলে কি রাজউক দায় এড়াতে পারে?
তানউইর নওয়াজ: কোনোভাবেই তারা দায় এড়াতে পারে না। শুধু ছিল না বললে তো হবে না। অকুপেন্সি সার্টিফিকেট বলে একটা বিষয় আছে। ভবন নির্মাণের পরে রাজউকের কাছ থেকে অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নিতে হয়। একটা নির্দিষ্ট কাজের ব্যবহারের জন্য এই সনদ তারা দিয়ে থাকে। আমার কাছে মনে হয়, সে সময় এই সার্টিফিকেটটা কমার্শিয়াল বিল্ডিং হিসেবে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এটাকে অ্যাসেম্বলি বিল্ডিং হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সমস্যাটা আসলে সেখানেই। সেখানে প্রচুর লোক ছিল। ভবনের প্রতি তলায় কমপক্ষে ১০০ থেকে ১৫০ জন লোক ছিল। সে হিসাবে পুরো ভবনে এক বা দুই হাজার লোকের সমাবেশ ঘটেছিল।

ভবনের অনুমোদন দেওয়ার পর রাজউক কি কোনো দিন তদারকি করেছে? তারা কি বলেছে, ‘তোমরা এসব করতে পারবে না? তোমাদের অপরাধের জন্য অবজেকশন সার্টিফিকেট দেওয়া হলো।’ আমার জানামতে, কখনোই রাজউক সেটা করেনি। সুতরাং রাজউক তো কোনোভাবেই তাদের দায় এড়াতে পারে না।

আজকের পত্রিকা: এর আগের সব দুর্ঘটনায় রাজউকের দায় এড়ানোর জন্য সরকার তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়নি?
তানউইর নওয়াজ: আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না। কারণ সরকার কেন ব্যবস্থা নেয়নি, সেটা তাদের ব্যাপার।

আজকের পত্রিকা: আমাদের পুরো ব্যবস্থায় গলদ আর অনিয়ম। বাংলাদেশে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা আছে। এরপরও কেন তা মানা হচ্ছে না?
তানউইর নওয়াজ: অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ডিজাইনার বা ওনার কোম্পানি যেভাবে ভবনের পরিকল্পনা করে দেয়, রাজউক অনুমোদন দিয়ে দেয়। এরপর ভবন নির্মাণের সময় সেই অনুযায়ী কাজ করা হয় না। এখন ভবন নির্মাণের সময় যে পরিমাণ নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া উচিত, সেটা করা হচ্ছে না। কিন্তু এই অনিয়ম তখনই ধরা পড়বে, যখন রাজউক নিয়মিত পরিদর্শন করে বলবে, এখানে তোমার এ কাজটা ঠিকভাবে হচ্ছে না বা এ কাজটা ঠিকমতো হয়নি—তারা তো এসব বলে না। ইচ্ছে করলে তারা স্টাফ অর্ডার করতে পারে। ইচ্ছে করলে তারা অকুপেন্সি সার্টিফিকেট বন্ধ করে দিতে পারে। 

আজকের পত্রিকা: এই যে নিয়ম মানা হয়নি, এর দায় কার?
তানউইর নওয়াজ: এসব দেখার দায়িত্ব সমষ্টিগতভাবে সবার। প্রাথমিকভাবে এসব দেখার দায়িত্ব রাজউকের। তারপর ঢাকা সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের। অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের দায়িত্বের ব্যাপারটা সবার শেষে পড়ে। কিন্তু প্রধান দায়িত্বটা রাজউকের ওপর বর্তায়। তারাই নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বটা পালন করে।

আজকের পত্রিকা: কিন্তু রাজউক তো কোনো দায় নেয় না।
তানউইর নওয়াজ: আমার মতে, সরকার একটা নিরপেক্ষ এক্সপার্ট কমিটি করতে পারে। তবে এ কমিটিতে রাজউকের কেউ থাকতে পারবে না। প্রকৌশলী, স্থপতি, প্ল্যানার এবং টেকনিক্যাল আরও কিছু লোক দিয়ে কমিটিটা গঠন হতে পারে। এ বিষয়ে যাঁরা দক্ষ, তাঁরা সব ধরনের অভিযুক্ত প্রকল্পগুলো যাচাই-বাছাই করে রিভিউ করবেন এবং একটা রিপোর্ট তৈরি করবেন। এই রিপোর্ট আবার সর্বসাধারণের কাছে প্রকাশ করবেন তাঁরা। রিপোর্ট তাঁরা রাজউককে দিতে পারেন, কিন্তু শুধু তাঁদের কাছে সেটা সীমাবদ্ধ থাকবে না। এ কমিটি সরকারকে বলবে, আমরা এই এই ত্রুটি পেয়েছি। তখন সরকার সিদ্ধান্ত নেবে, এই ত্রুটি রাজউক নতুবা ভবনমালিক অথবা অন্য কোনো সংস্থা দিয়ে সমাধান করবে। তাই এটা একটা নিরপেক্ষ ও এক্সপার্ট কমিটি দ্বারা করা যেতে পারে।

আজকের পত্রিকা: আর কী করা যেতে পারে?
তানউইর নওয়াজ: অবশ্যই ভবিষ্যতে নতুন ভবন নির্মাণ এবং নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হবে, তখন যেন এ ধরনের কোনো সমস্যা তৈরি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ভবন নির্মাণের জন্য স্বচ্ছ একটা পদ্ধতি মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে—এই এই কাজগুলো না করলে ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়া ঠিক হবে না। বিল্ডিং পারমিট এবং অকুপেন্সি সার্টিফিকেটও দেওয়া হবে না। আর এক কাজের জন্য ভবন ব্যবহারের সনদ নিয়ে অন্য কাজ করলে আরও বড় শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে বাধ্য করতে হবে।

আমি ভবন নির্মাণের ব্যাপারে বলতে চাই, কমার্শিয়াল বা অ্যাসেম্বলি বিল্ডিং নির্মাণ করার সময় যেন অবশ্যই নিচতলা থেকে একটা অগ্নিনিরাপত্তা রাস্তার ব্যবস্থা করা হয়। সেটাকে আমরা ফায়ার এক্সিট ও ফায়ার স্টেয়ার বলি। যেকোনো বহুতল ভবন, মানে ছয়তলার ঊর্ধ্বে নির্মাণ করা হলে এবং সেটা কমার্শিয়াল বা অ্যাসেম্বলি বিল্ডিং যেটাই হোক না কেন, সেটার জন্য কমপক্ষে দুটি ফায়ার স্টেয়ার ও ফায়ার এক্সিট থাকতে হবে। কিন্তু বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের ভবনে সেটা ছিল না। একটা মাত্র খোলা সিঁড়ি ছিল সেই ভবনে।

এ ধরনের ভবনের অনুমোদন দেওয়া কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। অনুমোদন দেওয়ার পরেও পরবর্তী সময়ে এই ত্রুটির কারণে সেটা বন্ধ করে দেওয়া উচিত ছিল। এ ধরনের ভবনের অনুমতি দেওয়ার আগে অন্তত দুটি ফায়ার স্টেয়ার ও ফায়ার এক্সিট থাকতেই হবে। কারণ ভবনে আগুন লাগলে মানুষজন যাতে খুব সহজেই নিচে নেমে আসতে পারে। কোনো তলায় যেন আগুন ও ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেটা এই ব্যবস্থা করলে আর কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। 

আজকের পত্রিকা: বাংলাদেশে একটা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা আছে। এটা কীভাবে কার্যকর করা যেতে পারে?
তানউইর নওয়াজ: নতুন ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা পাস করার পর একজন স্থপতির মাধ্যমে যেন সব ধরনের নিয়ম মেনে করা হয়, সেটা তাঁকে বলতে হবে। নিয়মটা হচ্ছে, রাজউকের ইমারত নির্মাণের যে বিধিমালা, মানে জাতীয় বিল্ডিং কোড আছে, সেই অনুযায়ী ভবন নির্মাণ করতে হবে। এভাবে রাজউকের অনুমতি নিলে আর দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকবে না। আর যার এ বিষয়ে কোনো ধারণা নেই, তাকে দিয়ে যদি কাজ করানো হয়, তাহলে নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনা হবে।

আজকের পত্রিকা: প্রতিটি দুর্ঘটনার পর একাধিক তদন্ত কমিটি হয়। কিন্তু সেই কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে না। এ জন্য কী করণীয়? 
তানউইর নওয়াজ: এটা তো আমাদের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। দুর্ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করল না এবং জনগণও কিছু জানতে পারল না—এ দায় তো সরকারের অবশ্যই আছে। রিপোর্ট কেন প্রকাশ করা হবে না? আমরা তো তা দেখতে চাই। রিপোর্টটা কেন দেখতে পাব না? আমরা তো একটা গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক। তাই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অবশ্যই প্রকাশ করতে হবে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত