Ajker Patrika

ধর্ষণ তাহলে অপ্রতিরোধ্য?

তাপস মজুমদার
ধর্ষণ তাহলে অপ্রতিরোধ্য?

শিক্ষা মানুষকে জ্ঞান দান করে, অনুসন্ধিৎসু ও উদার করে। কথায় বলে শিক্ষা যখন মন বেয়ে উঠতে থাকে, তখন সংকীর্ণতা পালিয়ে যায়।
সারা দেশে যে ধর্ষণ ও নির্যাতন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে, তা বোঝা যাচ্ছে। নারীর নিরাপত্তার প্রতি অবজ্ঞা তাহলে অনিবার্য আমাদের সমাজে? সুস্থ সমাজ গঠন তাহলে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে? অন্য সব দূরে থাকুক।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ কী হচ্ছে? আজকের পত্রিকার ৩ ফেব্রুয়ারির খবর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ। পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের কারণে বহিষ্কৃত এক ছাত্রীকে কারণ দর্শাতে শিক্ষক তাঁর কক্ষে ডেকে নিয়ে তাঁকে যৌন নির্যাতন করেন।

পরের দিনের খবর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ করেন ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীসহ বহিরাগত একজন। এসব ট্র্যাজেডি রাখার জায়গা কই?

কিছুদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন চিকিৎসক কর্তৃক এক শিক্ষকের ১৩ বছরের কন্যাকে যৌন নির্যাতনের খবর এখন এলাকায় মুখে মুখে (রাজু নামের ওই ডাক্তারকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাময়িকভাবে বরখাস্ত করার আগে মানববন্ধন, স্মারকলিপি পেশ ইত্যাদি আয়োজন করতে হয়েছে)।

খবরের কাগজে এ রকম লজ্জাকর খবর নেই—এমন কোনো একটি দিন পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার গৃহবধূ, বিয়ের আশ্বাসে ধর্ষণ, শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীকে, নানান প্রতারণার ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ—নৈমিত্তিক খবর এখন। পাশাপাশি মেয়ের শ্লীলতাহানির বিচার না পেয়ে বাবার আত্মহত্যা (পঞ্চগড়ের মাগুরা ইউনিয়নের একটি গ্রামে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনা)।

কয়েক মাস আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক কর্তৃক অপর একজন নারী শিক্ষকের প্রতি কটু বাক্যবর্ষণ, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শনসহ যৌন হুমকি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বিভাগের সভাপতি মাহবুবা কানিজ কেয়া এই অপমানজনক অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে প্রতিকারের জন্য উপাচার্য বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। যে বর্ণনা একজন নারীকে করতে হয়েছে ওই পত্রে, তা শুনলে বা দেখলে যেকোনো বিবেকবান মানুষের মাথা নত হবে, মন সংকুচিত হবে। অনেক দাবিদাওয়ার পরে তাঁর বিরুদ্ধে যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা অপরাধের তুলনায় নগণ্য।

কিছুদিন আগে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে একজন নারী ইউপি সদস্যের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কর্তৃক ‘জুতাপেটা করার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। ফৌজদারি অপরাধ তো ঘটেছেই। কিন্তু চরম রুচিহীনতার পরিচয় দিয়েছেন একজন জনপ্রতিনিধি।

মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা প্রায় প্রতিদিন দেখছি নারী ও মেয়েশিশুর ওপর সহিংসতার নিষ্ঠুর খবর। নারী নির্যাতন ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। বাংলাদেশে নারী নির্যাতনবিরোধী অনেক আইন আছে। ধর্ষণের শাস্তি সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও সহিংসতার হার হ্রাস পাচ্ছে না; বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাহলে কি আইনের প্রয়োগে ঘাটতি রয়েছে?

পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের মতে, নারী নির্যাতনসংক্রান্ত মামলার ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করার আইনি বিধান রয়েছে। কিন্তু সেটা পরিপালন করা হচ্ছে না। এ ছাড়া আরও কিছু বাধার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেটা মূলত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির ওপরে অঙ্গুলিনির্দেশ করে।

প্রশ্ন হলো, আমাদের সমাজে, প্রশাসনে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে, সাধারণ্যে জেন্ডার সংবেদনশীলতার অভাব কেন থাকবে? নারীকে তথা তাঁর কর্মক্ষমতা ও যোগ্যতাকে কেন হেয় করা হবে? কেন নারী নির্যাতন বিষয়ে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করা হবে? নারীর প্রতি সহিংসতাবিষয়ক ঘটনাগুলো যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে কেন বিবেচনা করা হবে না? সর্বোপরি নারীর প্রতি সর্বোচ্চ সুবিচার করার ক্ষেত্রে ব্যাপকভিত্তিক সচেতনতা তৈরির কোনো ব্যবস্থা কেন থাকবে না?

খেয়ে-পরে আয়-রোজগারে খুব ভালো থাকা লোকগুলোও এ দেশে চুরি করে। ঘুষ খায়। মানুষ ঠকায়। বিদেশে টাকা পাচার করে। মিথ্যা বলে টাকা অর্জন করে। তাদের অনেকের কাছেই নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ তাই রুচিহীন, জঘন্য বা নির্মম বলে মনে হয় না। ওটা তাদের কাছে বিনোদন।

ধর্ষণ যেমন একটি ফৌজদারি অপরাধ, তেমনি একটি নৈতিক অপরাধও বটে। ধর্ষণ প্রমাণ করা সহজ নয়। রিপোর্ট বলে—ধর্ষণের মামলায় ৩ শতাংশের বিচার ও শাস্তি হয়। বাকি ৯৭ শতাংশ আসামি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পেয়ে যায়। খালাস পাওয়ার অর্থ অবশ্যই এই নয় যে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে নিরপরাধ।

একটি উদাহরণ সামনে আনা যাক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসির এক উপপরিচালক শিশু ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত। ২০২০ সালে এই অভিযোগ দায়ের হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ সেল তদন্ত করে এর সত্যতা পেয়েছে। এই একই অভিযোগে এই ব্যক্তিকে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং এই অভিযোগের মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে কোর্টে চার্জশিট দাখিল হয়েছে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে।

এত কিছু সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে অন্তত সাময়িকভাবে বরখাস্ত পর্যন্ত করেনি। তিনি বহাল তবিয়তে চাকরি করে যাচ্ছেন। উপরন্তু জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাঁকে দিয়ে জাতীয়সংগীত গাওয়ানো হয়েছে। এ রকম উদাহরণ যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে অবলীলায় বিরাজ করে, তাহলে ধর্ষণ বৃদ্ধি না পেয়ে হ্রাস পাওয়ার কি কোনো সম্ভাবনা থাকে?

কেন প্রতিকার হচ্ছে না? কেন মানুষ ধর্ষণে উৎসাহিত হচ্ছে? শিক্ষিত মানুষ, ছাত্ররাজনীতি করা মানুষ, চাকুরে মানুষ, বাস-ট্রাকের ড্রাইভার-কন্ডাক্টর মানুষ! ধর্ম-কর্ম করা মানুষ—সবাই।

নৈতিক শিক্ষা বলে কিছু নেই। পরিবার, স্কুল, সমাজ সব ঘৃণা ও হিংসার জন্ম দিচ্ছে। রাজনীতির দিকে লক্ষ করুন! নিরপেক্ষ ও নির্মোহভাবে বিচার করতে শেখার শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে কি? আদালতের শাস্তি না হোক! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নৈতিক শাস্তিটা কি দিতে পারে না?

সেখান থেকেই কি কঠোরতার চর্চা শুরু হতে পারে না? সব হচ্ছে—সময়মতো ও যথাযথ শাস্তি হচ্ছে না। কলসে পানি দিচ্ছি। কলস ভরছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, কড়াকড়িভাবে ৬০ দিনের মধ্যে সব অভিযোগের নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে নির্দেশ আসুক সরকার থেকে। শুরুটা এভাবেই হোক।

লেখক: সংস্কৃতিকর্মী ও সাবেক ব্যাংকার

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

চার মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের সেবা ডিজিটাইজ করার নির্দেশ দিল সরকার

গত দশ বছর ভিসা না পাওয়ার কারণে বাংলাদেশে আসতে পারিনি: মাইলাম

মাগুরার শিশুটি এখনো অচেতন, চিকিৎসার দায়িত্ব নিলেন তারেক রহমান

ঈদে পুলিশের সহযোগী ফোর্স হবে বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মী, পাবে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা

তিন নারী আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ: তারেক রহমান

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত