চিররঞ্জন সরকার
অনেক প্রতীক্ষার দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন শেষ হয়েছে বড় ধরনের সহিংসতা ছাড়াই। আমাদের দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এবারের নির্বাচনকে যথেষ্ট ভালো বলতে হবে। মোটাদাগে নির্বাচন সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অবাধ হয়েছে। এবার প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনার একটা গ্রহণযোগ্য ভালো নির্বাচনই উপহার দিয়েছে।
একশ্রেণির মানুষ এই নির্বাচনকে যতই ‘তামাশার নির্বাচন’, ‘প্রহসনের নির্বাচন’, ‘একতরফা নির্বাচন’ ইত্যাদি অভিধা দিক না কেন, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য এই নির্বাচন অনিবার্য ছিল। যারা এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি, সেটা তাদের নিজস্ব বিবেচনা।কিন্তু নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে নির্বাচন ছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা পরিবর্তনের অন্য কোনো পথ খোলা নেই।
হ্যাঁ, আওয়ামী লীগ হয়তো দেশের অন্যতম জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানোর ব্যাপারে খুব বেশি আন্তরিক ছিল না। কিন্তু একটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব কৌশল বিবেচনায় নিলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে বড় বেশি দোষ দেওয়া যায় না। কারণ, কোনো রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্যই হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়া, ক্ষমতায় গিয়ে দলের নীতি-কর্মসূচি-আদর্শ ইত্যাদি বাস্তবায়ন করা। বিএনপির দাবি মেনে যদি আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিত, তাহলে তাদের নিশ্চিত বিজয় অর্জন সম্ভব হতো না। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ চাইবে, বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করে ফেলার এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ক্ষমতায় থাকার।
আওয়ামী লীগ সে কাজটিই করেছে। এতে বিএনপির সমর্থকেরা নাখোশ হতে পারেন, কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে এ জন্য খুব বেশি দোষারোপ করার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। কারণ রাজনীতি শেষ বিচারে কৌশলেরই খেলা। এই কৌশলের খেলায় আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে। অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সুযোগ থাকলে এই কৌশলই প্রয়োগ করত।
২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন তারা ক্ষমতায় থাকার জন্য হেন কোনো কৌশল নেই যা প্রয়োগ করেনি। তারা আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যা করতেও সচেষ্ট হয়েছে। খালেদা জিয়া ও তাঁর পুত্র তারেক রহমান সবকিছু জেনেও এই নৃশংস ঘটনাকে আড়াল করতে চেয়েছেন। শেখ হাসিনার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে গ্রেনেড বের হয়েছে বলেও তাঁরা মন্তব্য করেছেন। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়েও তাঁরা সীমাহীন চালাকির খেলা খেলেছেন।
প্রথমে সংবিধান সংশোধন করে পছন্দের ব্যক্তি বিচারপতি কে এম হাসান যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হতে পারেন, সে জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়স বাড়ানো হয়। এর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সোচ্চার হলে সব ধরনের নিয়মনীতি অগ্রাহ্য করে বিএনপি দলীয় রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বানিয়ে পুরো ব্যবস্থার বারোটা বাজাতে এককভাবে অবদান রেখেছে।
ক্ষমতায় থাকার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা এবং বিভিন্ন গণবিরোধী উদ্যোগের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ তীব্র গণ-আন্দোলন গড়ে তুললে সেই সময় রাজনৈতিক সংঘাত দেখা দেয়। সেই সংঘাতের জের ধরে দেশে ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের নেতৃত্বে সেনানিয়ন্ত্রিত বিশেষ সরকার ক্ষমতাসীন হয়। সেই সময় রাজনীতিতে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ বাস্তবায়নেরও চেষ্টা করা হয়। দেশের প্রধান দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে তখন জেলে অন্তরীণ রাখা হয়।
শেষ পর্যন্ত ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের সরকার রাজনৈতিক বিক্ষোভের চাপে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ থেকে সরে আসে। দুই নেত্রীকে মুক্তি দিয়ে অবশেষে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সব দলের অংশগ্রহণে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হন। এরপর থেকে দেশে চলছে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার নিজস্ব কৌশল প্রয়োগের রাজনীতি। এই রাজনীতি ভালো না খারাপ, সেই মূল্যায়নে না গিয়েও বলা যায়, রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি ১৫ বছরে আওয়ামী লীগকে কাবু করার মতো কোনো কর্মসূচি এখনো দিতে পারেনি; বরং আওয়ামী লীগ নানা কৌশলে বিএনপির রাজনীতিকে প্রায় ছন্নছাড়া বানিয়ে ফেলেছে। আদালতের দণ্ড নিয়ে বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়া অন্তরীণ অবস্থায় নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছেন। পক্ষান্তরে খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান একাধিক মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ নিয়ে ফেরার আসামি হিসেবে লন্ডনে আছেন।
১৫ বছরে বিএনপি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অনেক ‘শক্ত’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধ অসহযোগ, গণকারফিউসহ নানা কর্মসূচি দিয়েছে। কিন্তু তারা আওয়ামী লীগকে ‘ধাক্কা’ দেওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো সৃষ্টি করতে পারেনি; বরং আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে দলটি ক্রমেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়েছে।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা আছে। এর অনেকগুলো নিঃসন্দেহে গুরুতর। কিন্তু দল হিসেবে বিএনপি আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার প্রতি যে আচরণ করেছে, তার তুলনায় আওয়ামী লীগের সব কৌশলই তুচ্ছ। আওয়ামী লীগ আর যা কিছুই করুক না কেন, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে প্রাণে মেরে ফেলার চেষ্টা করেনি। কখনো গ্রেনেড কিংবা বোমা মেরে খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমানকে খতম করার জন্য কাউকে লেলিয়ে দেয়নি। বিএনপির আজকের পরিণতির জন্য তাদের শীর্ষ নেতৃত্বই দায়ী। এ জন্য শুধু আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করা যায় না।
যা-ই হোক, দ্বাদশ নির্বাচনের দিকে মনোনিবেশ করা যাক। এবারের জাতীয় নির্বাচনটি নানা দিক থেকেই বিশিষ্ট। এবারের নির্বাচনে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে সদিচ্ছা থাকলে দলীয় সরকারের অধীনেও একটা ভালো নির্বাচন করা যায়। নানা রকম প্রতিকূলতার কারণে এবার ভোটার উপস্থিতির পরিমাণ হয়তো কিছুটা কম হয়েছে, কিন্তু নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে, এটা জোর দিয়েই বলা যায়। কিছু অনিয়ম ও সহিংসতার ঘটনা ঘটলেও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের খুব বেশি সমালোচনা নেই। যেটুকু যা অনিয়ম হয়েছে, ১২ কোটি ভোটারের দেশে, তা খুবই সামান্য।
দ্বাদশ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি শিকার করেছে। তারা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পৃথক প্রতীক নিয়ে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিয়ে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করেছে। আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভরশীল সমমনা দলগুলোকে সমঝোতার ভিত্তিতে কিছু আসন বরাদ্দ করলেও নির্বাচনে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিরুদ্ধে লড়ে জিতে আসার চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়ে তাদের শক্তিমত্তার পরীক্ষা নিয়েছে। এই শক্তি পরীক্ষায় জোটের শরিকেরা ডাহা ফেল করেছেন। ইনু-বাদশার মতো নেতারা আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে পরাজিত হয়েছেন। যেসব নেতা আওয়ামী লীগের ‘বদান্যতার’ আশায় নির্বাচনে ভিড়েছিলেন, সেই শমশের মুবিন চৌধুরী, তৈমূর আলম খন্দকার, কাদের সিদ্দিকী, মেজর (অব.) আখতারুজ্জামানের মতো নেতারা আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের কাছে গো-হারা হেরেছেন।
সবচেয়ে উচিত শিক্ষা পেয়েছে জাতীয় পার্টি। স্বৈরশাসক এরশাদ-সৃষ্ট এই সুবিধাবাদী দলটি এবার মাত্র কয়েকটি আসনে বিজয়ী হয়ে নিজেদের করুণ অস্তিত্ব নতুন করে বুঝে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। বড় বড় বুলি উচ্চারণে দক্ষ এ দলটি এবার বিরোধী দলের আসন লাভের সুযোগটিও হারিয়েছে।
আওয়ামী লীগের সুবিধা গ্রহণ করে ভিন্ন একটা সাইনবোর্ড নিয়ে টিকে থাকা যে সম্ভব নয়, এটা এবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীনেরা শরিকদের ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। ১৫ বছর ধরে যাঁরা আওয়ামী লীগের অনুগ্রহে এমপি ছিলেন, তাঁরা যে নিজ নির্বাচনী আসনে সাধারণ মানুষের সমর্থন অর্জন করতে পারেননি, এবারের নির্বাচনে তা স্পষ্ট হয়েছে।
এবারের নির্বাচনে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ আরও বেশি সংহত হয়েছে। তাঁরা এটাও বুঝেছেন যে কেন্দ্রীয়ভাবে যাঁদের দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়, তা সব ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। তাই তো দলীয় নৌকা প্রতীক নিয়েও অনেকে জিততে পারেননি। জিতেছেন ভিন্ন প্রতীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। ভবিষ্যতে জনপ্রিয়তা যাচাই করে প্রার্থী মনোনয়ন দিলে দল ভালো করবে, এটাও আওয়ামী লীগের জন্য একটা শিক্ষা।
এবারের নির্বাচনে বিদেশিদের পক্ষ থেকে একটা বড় চাপ ছিল। এই চাপ শিগগিরই কাটবে বলে মনে হয় না। হয়তো নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞাও আসবে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতির দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুনভাবে এগোতে হবে। হ্যাঁ, বিদেশি শক্তির কাছে মাথা বিকিয়ে দেওয়া নয়, কিন্তু তাদের চটিয়ে দেশের কল্যাণ সব সময় সম্ভব নয়।
এখানে প্রয়োজন কূটনৈতিক দূরদৃষ্টির। বিরোধ-বিসংবাদ, হিংসা-হানাহানির পথ পরিহার করতে হবে। দুর্নীতি, হুন্ডি, বিদেশে অর্থ পাচারের মতো গুরুতর অনিয়মগুলো দূর করার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।
মনে রাখতে হবে, বিএনপির পাপের কারণে ক্ষমতাসীনদের সব কৌশলই হয়তো মানুষ মেনে নিচ্ছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের পাপ যদি বিএনপির পাপের বোঝাকেও ছাড়িয়ে যায়, তাহলে মানুষের বিদ্রোহ করা ছাড়া অন্য কোনো পথ থাকবে না। সেই বিদ্রোহের ফল ক্ষমতাসীনদের জন্য মোটেও শুভ হবে না।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
অনেক প্রতীক্ষার দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন শেষ হয়েছে বড় ধরনের সহিংসতা ছাড়াই। আমাদের দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এবারের নির্বাচনকে যথেষ্ট ভালো বলতে হবে। মোটাদাগে নির্বাচন সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অবাধ হয়েছে। এবার প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনার একটা গ্রহণযোগ্য ভালো নির্বাচনই উপহার দিয়েছে।
একশ্রেণির মানুষ এই নির্বাচনকে যতই ‘তামাশার নির্বাচন’, ‘প্রহসনের নির্বাচন’, ‘একতরফা নির্বাচন’ ইত্যাদি অভিধা দিক না কেন, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য এই নির্বাচন অনিবার্য ছিল। যারা এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি, সেটা তাদের নিজস্ব বিবেচনা।কিন্তু নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে নির্বাচন ছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা পরিবর্তনের অন্য কোনো পথ খোলা নেই।
হ্যাঁ, আওয়ামী লীগ হয়তো দেশের অন্যতম জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানোর ব্যাপারে খুব বেশি আন্তরিক ছিল না। কিন্তু একটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব কৌশল বিবেচনায় নিলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে বড় বেশি দোষ দেওয়া যায় না। কারণ, কোনো রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্যই হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়া, ক্ষমতায় গিয়ে দলের নীতি-কর্মসূচি-আদর্শ ইত্যাদি বাস্তবায়ন করা। বিএনপির দাবি মেনে যদি আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিত, তাহলে তাদের নিশ্চিত বিজয় অর্জন সম্ভব হতো না। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ চাইবে, বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করে ফেলার এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ক্ষমতায় থাকার।
আওয়ামী লীগ সে কাজটিই করেছে। এতে বিএনপির সমর্থকেরা নাখোশ হতে পারেন, কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে এ জন্য খুব বেশি দোষারোপ করার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। কারণ রাজনীতি শেষ বিচারে কৌশলেরই খেলা। এই কৌশলের খেলায় আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে। অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সুযোগ থাকলে এই কৌশলই প্রয়োগ করত।
২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন তারা ক্ষমতায় থাকার জন্য হেন কোনো কৌশল নেই যা প্রয়োগ করেনি। তারা আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যা করতেও সচেষ্ট হয়েছে। খালেদা জিয়া ও তাঁর পুত্র তারেক রহমান সবকিছু জেনেও এই নৃশংস ঘটনাকে আড়াল করতে চেয়েছেন। শেখ হাসিনার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে গ্রেনেড বের হয়েছে বলেও তাঁরা মন্তব্য করেছেন। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়েও তাঁরা সীমাহীন চালাকির খেলা খেলেছেন।
প্রথমে সংবিধান সংশোধন করে পছন্দের ব্যক্তি বিচারপতি কে এম হাসান যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হতে পারেন, সে জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়স বাড়ানো হয়। এর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সোচ্চার হলে সব ধরনের নিয়মনীতি অগ্রাহ্য করে বিএনপি দলীয় রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বানিয়ে পুরো ব্যবস্থার বারোটা বাজাতে এককভাবে অবদান রেখেছে।
ক্ষমতায় থাকার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা এবং বিভিন্ন গণবিরোধী উদ্যোগের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ তীব্র গণ-আন্দোলন গড়ে তুললে সেই সময় রাজনৈতিক সংঘাত দেখা দেয়। সেই সংঘাতের জের ধরে দেশে ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের নেতৃত্বে সেনানিয়ন্ত্রিত বিশেষ সরকার ক্ষমতাসীন হয়। সেই সময় রাজনীতিতে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ বাস্তবায়নেরও চেষ্টা করা হয়। দেশের প্রধান দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে তখন জেলে অন্তরীণ রাখা হয়।
শেষ পর্যন্ত ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের সরকার রাজনৈতিক বিক্ষোভের চাপে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ থেকে সরে আসে। দুই নেত্রীকে মুক্তি দিয়ে অবশেষে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সব দলের অংশগ্রহণে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হন। এরপর থেকে দেশে চলছে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার নিজস্ব কৌশল প্রয়োগের রাজনীতি। এই রাজনীতি ভালো না খারাপ, সেই মূল্যায়নে না গিয়েও বলা যায়, রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি ১৫ বছরে আওয়ামী লীগকে কাবু করার মতো কোনো কর্মসূচি এখনো দিতে পারেনি; বরং আওয়ামী লীগ নানা কৌশলে বিএনপির রাজনীতিকে প্রায় ছন্নছাড়া বানিয়ে ফেলেছে। আদালতের দণ্ড নিয়ে বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়া অন্তরীণ অবস্থায় নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছেন। পক্ষান্তরে খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান একাধিক মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ নিয়ে ফেরার আসামি হিসেবে লন্ডনে আছেন।
১৫ বছরে বিএনপি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অনেক ‘শক্ত’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধ অসহযোগ, গণকারফিউসহ নানা কর্মসূচি দিয়েছে। কিন্তু তারা আওয়ামী লীগকে ‘ধাক্কা’ দেওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো সৃষ্টি করতে পারেনি; বরং আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে দলটি ক্রমেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়েছে।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা আছে। এর অনেকগুলো নিঃসন্দেহে গুরুতর। কিন্তু দল হিসেবে বিএনপি আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার প্রতি যে আচরণ করেছে, তার তুলনায় আওয়ামী লীগের সব কৌশলই তুচ্ছ। আওয়ামী লীগ আর যা কিছুই করুক না কেন, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে প্রাণে মেরে ফেলার চেষ্টা করেনি। কখনো গ্রেনেড কিংবা বোমা মেরে খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমানকে খতম করার জন্য কাউকে লেলিয়ে দেয়নি। বিএনপির আজকের পরিণতির জন্য তাদের শীর্ষ নেতৃত্বই দায়ী। এ জন্য শুধু আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করা যায় না।
যা-ই হোক, দ্বাদশ নির্বাচনের দিকে মনোনিবেশ করা যাক। এবারের জাতীয় নির্বাচনটি নানা দিক থেকেই বিশিষ্ট। এবারের নির্বাচনে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে সদিচ্ছা থাকলে দলীয় সরকারের অধীনেও একটা ভালো নির্বাচন করা যায়। নানা রকম প্রতিকূলতার কারণে এবার ভোটার উপস্থিতির পরিমাণ হয়তো কিছুটা কম হয়েছে, কিন্তু নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে, এটা জোর দিয়েই বলা যায়। কিছু অনিয়ম ও সহিংসতার ঘটনা ঘটলেও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের খুব বেশি সমালোচনা নেই। যেটুকু যা অনিয়ম হয়েছে, ১২ কোটি ভোটারের দেশে, তা খুবই সামান্য।
দ্বাদশ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি শিকার করেছে। তারা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পৃথক প্রতীক নিয়ে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিয়ে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করেছে। আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভরশীল সমমনা দলগুলোকে সমঝোতার ভিত্তিতে কিছু আসন বরাদ্দ করলেও নির্বাচনে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিরুদ্ধে লড়ে জিতে আসার চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়ে তাদের শক্তিমত্তার পরীক্ষা নিয়েছে। এই শক্তি পরীক্ষায় জোটের শরিকেরা ডাহা ফেল করেছেন। ইনু-বাদশার মতো নেতারা আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে পরাজিত হয়েছেন। যেসব নেতা আওয়ামী লীগের ‘বদান্যতার’ আশায় নির্বাচনে ভিড়েছিলেন, সেই শমশের মুবিন চৌধুরী, তৈমূর আলম খন্দকার, কাদের সিদ্দিকী, মেজর (অব.) আখতারুজ্জামানের মতো নেতারা আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের কাছে গো-হারা হেরেছেন।
সবচেয়ে উচিত শিক্ষা পেয়েছে জাতীয় পার্টি। স্বৈরশাসক এরশাদ-সৃষ্ট এই সুবিধাবাদী দলটি এবার মাত্র কয়েকটি আসনে বিজয়ী হয়ে নিজেদের করুণ অস্তিত্ব নতুন করে বুঝে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। বড় বড় বুলি উচ্চারণে দক্ষ এ দলটি এবার বিরোধী দলের আসন লাভের সুযোগটিও হারিয়েছে।
আওয়ামী লীগের সুবিধা গ্রহণ করে ভিন্ন একটা সাইনবোর্ড নিয়ে টিকে থাকা যে সম্ভব নয়, এটা এবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীনেরা শরিকদের ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। ১৫ বছর ধরে যাঁরা আওয়ামী লীগের অনুগ্রহে এমপি ছিলেন, তাঁরা যে নিজ নির্বাচনী আসনে সাধারণ মানুষের সমর্থন অর্জন করতে পারেননি, এবারের নির্বাচনে তা স্পষ্ট হয়েছে।
এবারের নির্বাচনে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ আরও বেশি সংহত হয়েছে। তাঁরা এটাও বুঝেছেন যে কেন্দ্রীয়ভাবে যাঁদের দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়, তা সব ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। তাই তো দলীয় নৌকা প্রতীক নিয়েও অনেকে জিততে পারেননি। জিতেছেন ভিন্ন প্রতীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। ভবিষ্যতে জনপ্রিয়তা যাচাই করে প্রার্থী মনোনয়ন দিলে দল ভালো করবে, এটাও আওয়ামী লীগের জন্য একটা শিক্ষা।
এবারের নির্বাচনে বিদেশিদের পক্ষ থেকে একটা বড় চাপ ছিল। এই চাপ শিগগিরই কাটবে বলে মনে হয় না। হয়তো নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞাও আসবে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতির দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুনভাবে এগোতে হবে। হ্যাঁ, বিদেশি শক্তির কাছে মাথা বিকিয়ে দেওয়া নয়, কিন্তু তাদের চটিয়ে দেশের কল্যাণ সব সময় সম্ভব নয়।
এখানে প্রয়োজন কূটনৈতিক দূরদৃষ্টির। বিরোধ-বিসংবাদ, হিংসা-হানাহানির পথ পরিহার করতে হবে। দুর্নীতি, হুন্ডি, বিদেশে অর্থ পাচারের মতো গুরুতর অনিয়মগুলো দূর করার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।
মনে রাখতে হবে, বিএনপির পাপের কারণে ক্ষমতাসীনদের সব কৌশলই হয়তো মানুষ মেনে নিচ্ছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের পাপ যদি বিএনপির পাপের বোঝাকেও ছাড়িয়ে যায়, তাহলে মানুষের বিদ্রোহ করা ছাড়া অন্য কোনো পথ থাকবে না। সেই বিদ্রোহের ফল ক্ষমতাসীনদের জন্য মোটেও শুভ হবে না।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
১ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৫ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৫ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৫ দিন আগে