পূর্বাচলে বসতি কত দূর

সাইফুল মাসুম, ঢাকা
প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২২, ০৯: ৪৬

অবসরপ্রাপ্ত এক সরকারি কর্মকর্তা পূর্বাচলে ১৬ নম্বর সেক্টরে বরাদ্দ নিয়েছিলেন ১০ কাঠার একটি প্লট। বছরের পর বছর ভাড়া বাসায় কাটানো ওই কর্মকর্তার স্বপ্ন ছিল জীবনের শেষ সময়টা নিজ বাড়িতে আরামে কাটানোর। কিন্তু সেই স্বপ্ন তাঁর পূরণ হয়নি এত বছরেও। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দ পাওয়ার পর এক যুগ পেরিয়ে গেলেও বাড়ি বানাতে পারেননি তিনি। ১৫ বছর আগে অবসর নেওয়া ওই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘শেষ বয়সে কত স্বপ্ন নিয়ে রাজউক থেকে প্লট বরাদ্দ নিয়েছি। এখন তো এক পা কবরে। মনে হয়, নিজের বাড়ি দেখে মরতেও পারব না।’

একই রকম অভিযোগ হাবিব উল্যাহ, আবু সাদেক, নিয়াজ মোহাম্মদ, জমিরউদ্দিনসহ অনেক প্লটমালিকের। পূর্বাচলে বাড়ি বানাতে না পারার কারণ হিসেবে তাঁরা প্রকল্পকাজে ধীরগতি, অব্যবস্থাপনা ও প্রয়োজনীয় সুবিধাহীনতার কথা উল্লেখ করেন।

সম্প্রতি পূর্বাচল ঘুরে সীমানাপ্রাচীর ঘেরা কয়েক হাজার প্লট দেখা গেলেও জনবসতির চিহ্ন পাওয়া যায়নি। কিছু প্লটে ছোট টিনের ঘর বানিয়ে থাকেন পাহারাদারেরা। তাঁদের কেউ কেউ প্লটের খালি জায়গায় করছেন সবজি চাষ। ৭ নম্বর সেক্টরে ১০ কাঠার একটি প্লট দেখভাল করেন আজহার উদ্দিন (৬০)। তিনি বলেন, ‘দুই বছর ধরে গুলশানের এক সাহেবের প্লট পাহারা দিতেছি। পূর্বাচলে বিদ্যুৎ এলে বাড়ির কাজ ধরবেন সাহেব।’

তবে কবে নাগাদ পূর্বাচলে বিদ্যুৎ আসবে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না কেউ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পূর্বাচল প্রকল্প হাতে নেওয়ার পর তিন দশক পেরিয়ে গেলেও সেখানে কোনো নাগরিক সুবিধা নেই। তাই বসতি গড়ে ওঠেনি। রাজউকের নিষ্ক্রিয়তা, অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার চরম প্রকাশ ঘটেছে এই প্রকল্পে।

নগর-পরিকল্পনাবিদ আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘পূর্বাচল শহর প্রকল্প ১০ বছরের মধ্যে শেষ হওয়া উচিত ছিল। এত দিনেও কোনো নাগরিক সুবিধা দিতে পারেনি রাজউক। এখানে যারা বাড়ি করবে, তাদের জন্য স্কুল ও হাসপাতাল নেই। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ অতি প্রয়োজনীয় নাগরিক সেবাও নেই। এত বড় প্রকল্প হাতে নেওয়ার মতো দক্ষতা রাজউকের রয়েছে কি না, আগে যাচাই করা উচিত ছিল। রাজউক একই সঙ্গে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। দুটো তো একই সঙ্গে হয় না।’ 

নেই ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা
ঢাকা শহরের কাছে রূপগঞ্জ থানা ও কালীগঞ্জ থানা এলাকার ৬ হাজার ১৫০ একর জায়গাজুড়ে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প। এখানে ৩০টি সেক্টরে ২৬ হাজার প্লটে ২৬ হাজার আবাসিক ভবন গড়ে ওঠার কথা। প্লটগুলো ঠিকই আছে, কিন্তু নেই আধুনিক শহরের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। অনেক সেক্টরে রাস্তা ও সেতু তৈরি করা বাকি। এখনো নেই বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের কোনো সংযোগ। নিষ্কাশনব্যবস্থাও করা হয়নি। আছে নিরাপত্তার অভাব। ফলে বাড়ি বানিয়ে বসবাস করতে ভরসা পাচ্ছেন না প্লটমালিকেরা।

পূর্বাচলের ৩০ নম্বর সেক্টরে প্লট কিনে অস্থায়ী বাড়ি করেছেন হাবিব উল্যাহ। আগে কাঞ্চন ব্রিজের কাছে ছিল তাঁর বাড়ি। এখন পূর্বাচলে ১২৫ নম্বর রোডে ১১ নম্বর প্লটে আধা পাকা ঘরে পরিবারসহ থাকেন। আরও কিছু স্থানীয় মানুষও সেখানে অস্থায়ী বাড়ি বানিয়েছেন। অবৈধ সংযোগ নিয়ে তাঁরা বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। হাবিব উল্যাহ বলেন, ‘রাজউক কিছু সেক্টরে বাড়ি তৈরির অনুমতি এখনো দেয়নি। অনেক সেক্টরে রাস্তাও হয়নি। বসবাসের উপযোগী করলে মানুষ বাড়ি বানাবে। নিরাপত্তা নিয়ে স্থানীয়দের সমস্যা নেই, তবে অন্যরা আসতে ভয় পান।’

বাসাবাড়িতে নতুন করে সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক গ্যাসের সংযোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ফলে পূর্বাচলেও গ্যাসের কোনো সঞ্চালন লাইন বসবে না। তবে বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়ার বিষয়ে রাজউকের ধীরগতিকে দায়ী করেছেন ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. কাওসার আমীর আলী। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘পূর্বাচলে বিদ্যুতের লাইন দেওয়ার প্রস্তুতি আমাদের আছে, লাইন আগে করে তো লাভ নেই। বসতি যতটুকু গড়ে উঠছে, ততটুকুর কাজ করছি।’

পূর্বাচলে ঢাকা ওয়াসা পানির কোনো লাইন দেবে না বলে জানিয়েছেন সংস্থার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ) এ কে এম শহীদ উদ্দিন। তিনি বলেছেন, ‘রাজউক তো প্লট বিক্রি করে ব্যবসা করে, আমরা কেন লাইন দিতে যাব? ব্যবসার টাকা থেকে তারা নিজেরা করে নিক।’

প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল হক বলেন, ‘প্রকল্পে নিরাপত্তাব্যবস্থা বাড়াতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চারটি থানা স্থাপনের জন্য জায়গা দেওয়া হয়েছে। কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ লাইন চলে গেছে। ১, ২ ও ৩ নম্বর সেক্টরে ডিসেম্বরের মধ্যে রাজউক নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পানির লাইন বসাবে।’

এদিকে কাঞ্চন ব্রিজ-সংলগ্ন র‍্যাব অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পূর্বাচলে সবাই শুধু প্লট হাত বদল করছে, কেউ বাড়ি বানাচ্ছে না। আগে নিরাপত্তাজনিত কিছু সমস্যা ছিল। ২০১৭ সালে র‍্যাব অফিস করার পর এখন সেই সমস্যা নেই। র‍্যাব ও পার্শ্ববর্তী থানা নিয়মিত টহল দেয়। কিছু মানুষ বাড়ি তৈরি শুরু করলে অন্যরাও করবে।’

প্রকল্পের কাজে ধীরগতি
রাজউক নব্বইয়ের দশকে এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করে। বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয় ১৯৯৫ সালে। শেষ করার কথা ছিল ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। পরে পাঁচবার নকশা বদল এবং সাতবার মেয়াদ বাড়ালেও কাজ শেষ হয়নি। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। ২৬ হাজার প্লটের মধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে ২১ হাজার। এর মধ্যে বাড়ি তৈরির জন্য অনুমোদন মিলেছে ৩০০ প্লটে। প্রকল্পের অগ্রগতি ৭০ শতাংশ।

প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল হক বলেন, ‘প্রকল্পের ৩২০ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে ২৯০ কিলোমিটার হয়েছে। ৬১টি ব্রিজের মধ্যে ৩৯টির কাজ শেষ। মামলার কারণে বাকি আছে কিছু প্লট বরাদ্দ। এ ছাড়া কবরস্থান ও মসজিদের কারণে কিছু এলাকায় রাস্তা করতে অসুবিধায় পড়তে হয়েছে।’

রাজউকের নগর-পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘পূর্বাচল এলাকায় তিন শর মতো নকশা অনুমোদন করা হয়েছে। অনেক নকশার ও স্টেডিয়ামের কাজ চলমান। এমআরটি লাইন-১-এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কাজগুলো শেষ হলে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়বে।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘রাজউকের দুর্নীতি, অদক্ষতা ও চরম অব্যবস্থাপনার কারণে প্রকল্পের মেয়াদ শুধু বাড়ছে, কাজ শেষ হচ্ছে না। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পের চরিত্র পাল্টে নতুন নতুন প্লট করা হচ্ছে। মাঠসহ বড় প্লট ছোট করে সুবিধাদি বিপন্ন করেছে।’ 

রাজউক চেয়ারম্যানের আশা
কিছু চ্যালেঞ্জের কারণে প্রকল্প শেষ করতে দেরি হচ্ছে বলে জানালেন রাজউক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এত দিন ভবনের নকশা অনুমোদনের উপযোগিতা আসেনি। তাই মাত্র ৩০০ নকশার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তবে এখন সবাইকে বলছি, নকশা জমা দেন, অনুমোদন দিয়ে দেব।’ তিনি আরও বলেন, ‘আশা করি, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ের কাজ পুরোপুরি শেষ হবে। এতে যাতায়াত সহজ হবে। বাড়ি বানানোর গতিও বাড়বে। একটা বড় চ্যালেঞ্জ—নিরাপত্তা, সেটা দ্রুত সমাধানে আমরা পুলিশের সঙ্গে সভা করব। সব সুবিধা নিশ্চিত করে ২০২৫ সালের মধ্যে নতুন শহরে বসতি গড়ে তুলব।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত