জোড়াতালিতে চলছে কারা হাসপাতাল

আজাদুল আদনান, ঢাকা
প্রকাশ : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১: ১০

নানা সংকট-সীমাবদ্ধতায় ভেঙে পড়েছে দেশের কারাবন্দীদের চিকিৎসাব্যবস্থা। জটিল রোগসহ নানা কারণে কারাগারগুলোতে গত ছয় মাসে মারা গেছেন ৪০ জন। এমন পরিস্থিতিতেও চিকিৎসাব্যবস্থার অগ্রগতি নেই। দেশের কারা হাসপাতালগুলোর একটিতেও নেই পূর্ণাঙ্গ সেবা। এ অবস্থার পরিবর্তন শিগগিরই হবে না বলে কারা সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে।

বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, কারা হাসপাতালে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে দেশে প্রতিবছর গড়ে ৭০ জন বন্দীর মৃত্যু হয়। ২০২১ সালে মৃত্যু হয়েছে ৮১ জনের।

কারাগার সূত্রে জানা গেছে, বুকে ব্যথা নিয়ে গত সোমবার কাশিমপুর কারাগারে মৃত্যু হয় আবু বক্কর সিদ্দিক (৬২) ও খোকন ব্যাপারী (৪২) নামের দুই বন্দীর। একজন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত অন্যজন মাদকসহ পাঁচ মামলার আসামি। তাৎক্ষণিকভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া গেলেও সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু হয় তাঁদের। দেশের সবচেয়ে বড় বড় দাগি আসামির এই বন্দিশালার ধারণক্ষমতা ১ হাজার। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত সেখানে ২ হাজার ৬৬০ জন বন্দী ছিলেন। এর মধ্যে ফাঁসির আসামি ৯৫০ জন। ধারণক্ষমতার আড়াই গুণ বেশি বন্দীর চিকিৎসা দিচ্ছেন সপ্তাহে দুই দিন আসা সিভিল সার্জন অফিসের একজন অস্থায়ী চিকিৎসক।

জেল সুপার আবদুল জলিল আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিপুলসংখ্যক বন্দীর চিকিৎসায় এ কারাগারে স্থায়ী কোনো চিকিৎসক নেই। সবকিছু চলছে জোড়াতালি দিয়ে। সিভিল সার্জন অফিস থেকে একজনকে অস্থায়ীভাবে দেওয়া হলেও সপ্তাহে দুই দিন আসেন। নার্সই এখানে একমাত্র ভরসা। কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা চলছে আলাদা অস্থায়ী শেড তৈরি করে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার ল্যাব থাকলেও নেই টেকনিশিয়ান। আবার যে ব্যবস্থা রয়েছে সেখানেও রয়েছে অর্থের বিনিময়ে রোগী ভর্তির অভিযোগ।

সম্প্রতি কুমিল্লা কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়া নগরীর কাশারীপট্টি এলাকার আকরাম হোসেন জানান, দালালদের মাধ্যমে কারাগারে সিট পাওয়া খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়। স্বজনদের মাধ্যমে বাইরে থেকে বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠালেই সিট মেলে।

অভিযোগ নিয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার শাহজাহান আহমেদ বলেন, লোকবলসংকট থাকলেও কারাগারের রোগীদের চিকিৎসাসেবার কোনো ঘাটতি নেই। শুধু এই দুই কারাগার নয়, দেশের কোনো কারা হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। ফলে এগুলো চলছে যেনতেনভাবে। নিয়মশৃঙ্খলার ঘাটতিতে অধিকাংশ শয্যায় দালালদের মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে সুস্থ বন্দীরা থাকছেন বলে কয়েকটি কারাগার সূত্রে জানা গেছে। কারা সদর দপ্তরের তথ্যমতে, ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগারসহ ৬৮টি কারাগারে ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার ৬২৬ জনের। সেখানে গত ২১ আগস্ট পর্যন্ত বন্দী ছিল ৮৫ হাজার ৬৭৭ জন। এসব বন্দীর চিকিৎসায় স্থায়ী চিকিৎসকের ১৪১টি পদ রয়েছে। তবে কর্মরত মাত্র ৫ জন।

কারাবন্দীদের চিকিৎসাসেবা দিতে এসব হাসপাতালে সহকারী সার্জনের ৭০টি, মহিলা সহকারী সার্জনের ১২টি, প্যাথলজিস্ট ১২টিসহ মোট ১৪১ পদ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু শূন্য পদ রয়েছে ১৩৬টি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অর্ধেকের বেশি বন্দী চল্লিশোর্ধ্ব। তাঁদের বেশির ভাগই একাধিক জটিল রোগে আক্রান্ত। পরিস্থিতি সামাল দিতে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের ৯৩ জন চিকিৎসককে অস্থায়ীভাবে সংযুক্ত করা হয়েছে। তবু সংকট ৪৩ জন চিকিৎসকের।

কারা কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত চিকিৎসক-সংকটের কারণে অধিক ঝুঁকি নিয়ে দাগি আসামিদের বাইরের হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। এ জন্য প্রতিটি বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কারাগারের প্রিজন সেল রয়েছে। তবে নেই গাজীপুরে।

কারা সদর দপ্তরের সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মো. মাইন উদ্দিন ভূঁইয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সিভিল সার্জন অফিস থেকে প্রতিটি হাসপাতালে দু-একজন চিকিৎসক সংযুক্ত আছেন। তাঁরা সপ্তাহে দুই দিন কারাগারে চিকিৎসা দেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে মেডিকেল ইউনিট গঠন পূর্ণাঙ্গরূপে শেষ হলে আশা করি সব জায়গায় পর্যাপ্ত চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া যাবে।’

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১৯ সালের ২০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে এলে জানানো হয়, দেশের কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার চেয়ে কয়েক গুণ বন্দীর চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে প্রেষণে আসা অল্পসংখ্যক চিকিৎসক দিয়ে। কারা কর্তৃপক্ষ গুরুতর রোগীদের অনেকটা বাধ্য হয়ে অন্যত্র চিকিৎসা করাচ্ছে। পরে প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে আলাদা মেডিকেল ইউনিট গঠনের নির্দেশ দেন।

সাবেক ডিআইজি (প্রিজন) মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী আজকের পত্রিকাকে বলেন, কারা হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক-সংকটের বিষয়টি প্রশাসনিক জটিলতার কারণে নয়। সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে স্থায়ী চিকিৎসক নিয়োগ না হলে এ সমস্যা কাটবে না। 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত