১০৩ বছর বয়সে সম্মাননা

ঝুলন দত্ত, কাপ্তাই (রাঙামাটি)
প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২২, ০৮: ৩৯

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। কাপ্তাই সড়কের চন্দ্রঘোনা রেশমবাগান এলাকায় পাহাড়ের ওপর থেরওয়াদা বৌদ্ধবিহারে কঠিন চীবর দান উৎসব চলছে। এ উপলক্ষে হচ্ছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মঞ্চের পাশে দেখা গেল বয়োজ্যেষ্ঠ এক ব্যক্তি এলাকার ছেলেমেয়েদের পরিবেশনা উপভোগ করছেন। লাঠি হাতে পাহাড় ডিঙিয়ে অনুষ্ঠান দেখতে আসা মানুষটির নাম আপ্রুসী মারমা। বয়স ১০৩ বছর।

রেশমবাগান এলাকার সবাই তাঁকে চেনেন আপ্রুসী কার্বারি নামে। এর চেয়ে তাঁর বড় পরিচয়, তিনি একজন স্বনামধন্য যাত্রাশিল্পী। পার্বত্য অঞ্চলে যাত্রাশিল্পের অগ্রপথিকদের অন্যতম। এ বছরের ৩ জুলাই কাপ্তাই উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি তাঁকে যাত্রাশিল্পী হিসেবে সম্মাননা দিয়েছে।

কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় আপ্রুসী কার্বারির সঙ্গে। বয়সের কারণে স্মরণশক্তি কিছুটা লোপ পেয়েছে তাঁর। স্মৃতি হাতড়ে আপ্রুসী জানালেন, ১৯৬০-এর দশকে তাঁর যাত্রাপালায় অভিনয়ের হাতেখড়ি। কর্ণফুলী পেপার মিল এলাকার নাট্য পরিচালক ও স্বনামধন্য অভিনেতা শেখ মতিউর রহমান তাঁর নাট্যগুরু।

তাঁর হাত ধরেই আপ্রুসীর যাত্রাপালায় অভিনয় শুরু। তবে সেসব স্মৃতি এখন অনেকটা ধূসর হয়ে গেছে তাঁর। আপ্রুসী জানান, তিনি প্রায় ৫০০ যাত্রাপালা এবং মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছেন। তবে বেশির ভাগ যাত্রাপালায় তিনি রাজা ও সেনাপতির চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ‘আলো মতি প্রেমকুমার’, ‘রাজসিংহাসন’, ‘গরীবের মেয়ে’, ‘রূপবানের সংসার’, ‘মন্দিরে আজান’, ‘গৌরীমালা’, ‘জীবন্ত কবর’, ‘রাজমুকুট’, ‘মানুষ অমানুষ’, ‘জীবন্ত কবর’ ইত্যাদি আপ্রুসী অভিনীত জনপ্রিয় যাত্রাপালা। এসব যাত্রাপালায় রাতভর হাজারো দর্শক তাঁর প্রাণবন্ত অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছেন।

আপ্রুসী মারমা জানান, একসময় গ্রামগঞ্জে পাহাড়িদের উৎসব-পার্বণে অনেক যাত্রাপালা হতো, বিশেষ করে কাপ্তাইয়ের চিৎমরম, নোয়াপাড়া, রাইখালী, বিলাইছড়ি, কাউখালী, রাজস্থলী উপজেলা; খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি, গুইমারাসহ বিভিন্ন পাহাড়ি গ্রামে বসত যাত্রার আসর। সদলবলে মাইলের পর মাইল হেঁটে সেসব যাত্রাপালায় অভিনয় করতে যেতেন আপ্রুসী ও তাঁর দলের সদস্যরা। রাতভর বিপুলসংখ্যক লোক সেসব যাত্রাপালা উপভোগ করত। এখন সেই অবস্থা নেই। ‘বিভিন্ন কারণে এখন আর যাত্রাপালা হয় না’ বলে আফসোস করলেন নিবেদিতপ্রাণ আপ্রুসী মারমা।

কাপ্তাইয়ের নাট্যজগতের আরেকজন খ্যাতিমান অভিনেতা ও পরিচালক এস এম ইসমাইল ফরিদ তাঁর সম্পর্কে বলেন, ‘আপ্রুসী কার্বারি মঞ্চের একজন জাত শিল্পী ছিলেন। আমি ‘রাজসিংহাসন’ যাত্রাপালায় প্রথম তাঁর সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ পাই। তিনি রাজার চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন।’

কাপ্তাইয়ের আরেকজন খ্যাতিমান মঞ্চ অভিনেতা বেলাল আহমেদ জানান, আপ্রুসী কার্বারি তাঁর নাট্যগুরু। ‘তিনি মঞ্চে এলে অন্য রকম পরিবেশ সৃষ্টি হতো। তিনি মঞ্চ ছাড়াও মরহুম নাট্য পরিচালক শেখ মতিউর রহমানের সঙ্গে ‘মেঘের অনেক রং’ এবং ‘সেতু’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন।

কাপ্তাইয়ের এ সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা ও নাট্য নির্দেশক এবং কাপ্তাই উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির নাটক বিভাগের প্রধান আনিছুর রহমান বলেন, ‘আপ্রুসী কার্বারি হলো আমাদের প্রেরণার উৎস। তাঁদের দেখা পথ ধরেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত