জাহীদ রেজা নূর
আবার আলোচনায় উঠে এসেছেন কক্সবাজারের সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদি। এবার তিনি টেকনাফ পৌর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় দলের তিন নেতাকে পিটিয়েছেন। পেটানোর কারণ মতবিরোধ। ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। তাই বদি যদি বলার চেষ্টা করেন যে তিনি মারপিট করেননি, শুধু ফুলের টোকা দিয়েছেন, তাহলে কেউই তা বিশ্বাস করবে না। আবদুর রহমান বদি প্রমাণ করেছেন, শুধু রাজনীতিতে নন, অন্য আরও অনেক কিছুতেই তিনি দক্ষ, এমনকি কুস্তি, মুষ্টিযুদ্ধ ধরনের প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলায় নাম লেখালেও তিনি ভালো করতে পারতেন।
কথাটা সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদিকে নিয়ে বলা হলেও আসলে তা শুধু বদির সমস্যা নয়। রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা যেভাবে বাড়ছে, তাতে এ ধরনের বদিতেই দিনে দিনে ভরে যাবে রাজনীতির মাঠ। রাজনীতি যে নিজের দলের লক্ষ্য ও আদর্শের সমন্বয়ে দেশ গঠনের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ, সেটা দিনদিন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক দেশের সংসদে যখন আইনজ্ঞরা উপেক্ষিত হন, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরাই হয়ে পড়েন সংখ্যাগুরু, তখন দেশের আইনকানুন তৈরিতে কাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হবে, সেটা সহজেই অনুমেয়।
দুই. সংকটটা রাজনীতির গোড়ায় ঢুকে গেছে। রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার সঙ্গে পেশিশক্তির একটা যোগাযোগ লক্ষ করা যাচ্ছে বহুদিন আগে থেকেই। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে কতটা গণতন্ত্রের চর্চা আছে, সেটা আমজনতা এখন ভালোই জানে। শুধু কি রাজনৈতিক দল? ব্যক্তিগত পর্যায়ে যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, সে রকম খুব কম প্রতিষ্ঠানেই গণতন্ত্রের দেখা পাওয়া যাবে। লিডারশিপের বদলে বসিং যদি মুখ্য হয়ে ওঠে, তাহলে ছড়ি ঘোরানোই হয়ে উঠবে চালিকাশক্তি, তাতে সন্দেহ করার কিছু থাকে না।
অনেকেই বলে থাকেন, বর্তমানে তৃণমূল পর্যায়ের রাজনীতিতেও স্বচ্ছতা নেই। সেখানেও ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন হয় না। পেশি ও অর্থশক্তিতে বলীয়ানেরাই এখন তৃণমূল রাজনীতির কান্ডারি হয়ে বসেছেন। এই নতুন ধরনের নেতৃত্বের মধ্যে যেকোনো মূল্যে পদ ধরে রাখার প্রবণতা রয়েছে। ছলে-বলে-কৌশলে এলাকায় ক্ষমতা বিস্তার করাটাই মুখ্য। দেশের যে এলাকায়ই যাওয়া হোক না কেন, যেকোনো দলের সাংগঠনিক নেতৃত্বের দিকে তাকানো হোক না কেন, এ ধরনের ভুঁইফোড় নেতৃত্ব দৃশ্যমান হবেই। পেশিশক্তি আর অর্থবলের কাছে মাঠপর্যায়ের রাজনীতিও পরাজিত হয়েছে, এ কথা স্বীকার করে নেওয়া ভালো।
তিন. আবদুর রহমান বদি একজন আঞ্চলিক নেতা। সংসদ সদস্য হওয়ার কারণে তিনি জাতীয় নেতৃত্বের স্বাদও পেয়েছেন। সুতরাং তাঁর কৃতকর্মের আলোচনা-সমালোচনা বড় ফোরামেই হবে। আমরা তাই বিভিন্ন মহল থেকে এ ঘটনার বিশ্লেষণের অপেক্ষায় থাকব এবং পাশাপাশি আরও কিছু ঘটনার উল্লেখ করব, যেখানে পেশিশক্তির মহত্ত্ব উপলব্ধি করা যাবে।
আমাদের অনেকেরই নিশ্চয় মনে পড়ে যাবে শ্যামল কান্তি ভক্তের কথা। তিনি ছিলেন পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ১৭ বছর ধরে শিক্ষকতা করে আসছিলেন। ঘটনাটা ২০১৬ সালের ১৩ মের। ধর্ম অবমাননার অভিযোগে প্রকাশ্যে তাঁকে কান ধরে ওঠবস করানো হয়েছিল। এই ‘মহা আয়োজনের’ সময় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত সাংসদ সেলিম ওসমান।
ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে যেকোনো মানুষকে নাজেহাল করার এই আপত্তিকর সংস্কৃতি আমাদের এখানে চালু হয়ে গেছে। এটা এক বেদনাদায়ক বাস্তবতা।
কিছু একটা হলেই যে কারও ধর্মীয় অনুভূতি জেগে উঠছে এখন। তার পরিণাম হচ্ছে ভয়াবহ। একজন মানুষ বা একদল মানুষকে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করার পর যখন দেখা যাচ্ছে, তিনি বা তাঁরা কোনো ধরনের ধর্মীয় অবমাননার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তখন কিন্তু সেই সব ষড়যন্ত্রকারীর বিরুদ্ধে সে রকম কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
শৈশব থেকে আমরা শিখে এসেছি, মা-বাবার পরেই শিক্ষকের অবস্থান। আমাদের রাজনীতিবিদদের বাড়াবাড়িতে শিক্ষকেরা সে অধিকার হারিয়েছেন। ধর্মীয় অবমাননা বিষয়ে এ লেখাটি নয়। আমি বলতে চাইছি, রাজনীতিকে কতটা সংকীর্ণভাবে দেখা হলে এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটিয়ে দেওয়া যেতে পারে। একজন শিক্ষককে প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠবস করানোর মধ্যে যে হিংসা, ক্রোধ, পেশিশক্তির প্রকাশ ঘটে, তা কখনোই সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়। রাজনীতিবিদ তাঁর তরিকার মধ্যে এই পেশিশক্তি ঢুকিয়ে ফেলেছেন। একজন প্রধান শিক্ষককে প্রকাশ্যে অপমান করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি পুরো শিক্ষককুলকে সেই বার্তাটি পৌঁছে দিয়েছেন যে রাজনীতির কাছে মাথা নত করে থাকো, নইলে ‘খবর’ আছে। সেই খবর ‘স্কুল কমিটি’র মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে হলেও ক্ষতি নেই।
চার. দলের ওপর মহলে যদি এই যথেচ্ছাচারের অনুমোদন থাকে, তাহলে নিচের মহলেও তা ছড়িয়ে যায়। এখন বলব ছাত্রলীগের এক আঞ্চলিক নেতার কথা। এই তো অল্প কয়েক দিন আগে শরীয়তপুরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজের শিক্ষককে মারধর করেছেন কলেজের ছাত্রলীগের সভাপতি সোহাগ ব্যাপারী। কলেজের বাংলা বিভাগে স্নাতক সম্মান (অনার্স) চতুর্থ বর্ষের মৌখিক পরীক্ষার সময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন বিশেষজ্ঞ এবং ওই কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের সংবর্ধনা ও আপ্যায়নের আয়োজন করেছিল বাংলা বিভাগ। সেই আয়োজনে কেন ছাত্রলীগ নেতাদের দাওয়াত দেওয়া হয়নি, তার জবাবদিহি চান সোহাগ ব্যাপারী। তাঁর সঙ্গে ছিলেন লীগের আরও কয়েকজন নেতা-কর্মী। তাঁরা এ সময় বাংলা বিভাগের শিক্ষক বি এম সোহেলকে মারধর করেন।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ অবশ্য ঘটনাটিকে আমলে নিয়ে শরীয়তপুর জেলা ছাত্রলীগের মাধ্যমে কলেজ কমিটি বিলুপ্ত করে দেয়।
এ বিষয়ে শরীয়তপুর জেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক মহসিন মাদবর যা বলেছেন, তা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ জাতির জনকের হাতে গড়া সংগঠন। এই সংগঠন কখনোই শৃঙ্খলাবহির্ভূত বা বিশৃঙ্খলাকে প্রশ্রয় দেয় না। তাই খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা দলীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে দিই।’
খুব ভালো কাজ করেছেন তাঁরা। কিন্তু কমিটি বিলুপ্ত করার পর আর কিছু কি করা হয়েছে? শিক্ষকদের আপ্যায়নে ছাত্রলীগের নেতাদের কেন দাওয়াত করতে হবে, তার কি ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে? শিক্ষকের শরীরে হাত তোলার জন্য কি এই বিলুপ্ত কমিটির সভাপতিকে জবাবদিহির সম্মুখীন করা হয়েছে? সারা দেশের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের কি এই বলে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে যে শিক্ষকের শরীরে হাত তোলা মহা অন্যায়, এ কাজ যেন কেউ না করে। করলে ভয়াবহ শাস্তি?
পাঁচ. খুব সুন্দর করে মহসিন মাদবর বলেছেন, ‘ছাত্রলীগ জাতির জনকের হাতে গড়া সংগঠন’। কথাটা ঠিক। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্রদের মধ্যে একটা জায়গা করে নিয়েছিল মুসলিম লীগপন্থী প্রগতিশীল ছাত্ররা। কিছুদিন পর আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে একটি বিরোধী দলের সৃষ্টিও হয়েছিল এরই ধারাবাহিকতায়। সেই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, যা এখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া এই সংগঠন, এ কথা স্বীকার করে নিলে বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কেও ছাত্রলীগের কর্মীদের জানা থাকা দরকার। বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের একটি তাৎপর্যময় দিক ছিল তাঁর সৌজন্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে খাজা নাজিমুদ্দিন ঘরানার রাজনীতিবিদ ছিলেন না, সেটা তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়লেই বোঝা যায়। সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমপন্থী প্রগতিশীল ঘরানায় ছিল তাঁর অবস্থান। ১৯৫২ সালে খাজা নাজিমুদ্দিন ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। রাজবন্দীদের মুক্তি ও একুশের ঘটনায় পুলিশের গুলিবর্ষণের তদন্ত দাবি করে শেখ মুজিব যখন খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন, তখন তিনি আক্রোশে আকীর্ণ ছিলেন না। তিনি সৌজন্যবোধ হারিয়ে ফেলেননি; বরং তিনি খাজা সাহেবের ভদ্রতার কথা লিখেছেন। খাজা নাজিমুদ্দিনও শেখ মুজিবকে ‘শরীর কেমন, কেমন আছো, কত দিন থাকবে’—এ প্রশ্নগুলো করেন। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, খাজা সাহেব জানতেন শেখ মুজিব একজন ভালো কর্মী। তিনি বঙ্গবন্ধুকে স্নেহও করতেন।
বইয়ের অন্য জায়গায় বঙ্গবন্ধু নাজিমুদ্দিনের সমালোচনা করেছেন যখন, তখন ‘তিনি দুর্বল প্রকৃতির,’ ‘কর্মদক্ষতা এবং উদ্যোগের অভাব’ রয়েছে তাঁর, এসব যখন লিখছেন, তখন পাশাপাশি তিনি যে ‘অমায়িক’ এ কথাটাও উল্লেখ করছেন।
ওপরে যে তিনটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে, তা থেকে বঙ্গবন্ধুর আচরণ কতটা আলাদা, সেটা দেখানোর জন্যই বঙ্গবন্ধু-প্রসঙ্গ তুলে আনলাম। এবার এই নেতা-পাতিনেতা-ছাত্রনেতাদের নিরিখে বঙ্গবন্ধুকে বিচার করে দেখুন। বঙ্গবন্ধু নিজেই স্বীকার করেছেন, কৈশোরে ডাকাবুকো ছিলেন তিনি। কিন্তু সেটা কোন সময়? যখন অধিকার হরণ করা হতো, তখন তিনি বৃহত্তর স্বার্থে মারপিটও করেছেন। কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করার সময় হাতাহাতি, অপমান ইত্যাদি করেছেন—এমন নজির নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সেবার প্রতি যত বেশি ঝুঁকেছেন, ততই হয়ে উঠেছেন পরমতসহিষ্ণু। যাঁরা ভিন্নমতের অধিকারী, তাঁদেরও তিনি আঘাত করেননি। স্বাধীনতার পরও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অনেককে তিনি অনুকম্পা প্রদর্শন করেছেন, যা মুজিব চরিত্রের মহৎ দিকটিকেই তুলে আনে। যদিও অনুকম্পাপ্রাপ্তরা অকৃতজ্ঞতারই পরিচয় দিয়েছে, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
শুধু ভেবে দেখতে বলি, বঙ্গবন্ধু কোনো বর্ধিত সভায় তাঁরই দলের এক নেতাকে পেটাচ্ছেন, বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে কোনো শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস করানো হচ্ছে কিংবা শিক্ষকদের আপ্যায়নে কেন তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে নিমন্ত্রণ করলেন না, তা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শিক্ষকের শরীরে হাত তুলছেন–এ রকম দৃশ্য কি কল্পনাতেও আসে?
আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, বঙ্গবন্ধু এই ধরনের দলীয় রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না। তাহলে তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশে কেন এই রাজনীতি বাড়তে থাকবে, সে প্রশ্নটি অবশ্যই করতে হবে রাজনীতিবিদদের কাছে। তাঁরা কী বলেন, তা জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করব।
জাহীদ রেজা নূর,উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আবার আলোচনায় উঠে এসেছেন কক্সবাজারের সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদি। এবার তিনি টেকনাফ পৌর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় দলের তিন নেতাকে পিটিয়েছেন। পেটানোর কারণ মতবিরোধ। ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। তাই বদি যদি বলার চেষ্টা করেন যে তিনি মারপিট করেননি, শুধু ফুলের টোকা দিয়েছেন, তাহলে কেউই তা বিশ্বাস করবে না। আবদুর রহমান বদি প্রমাণ করেছেন, শুধু রাজনীতিতে নন, অন্য আরও অনেক কিছুতেই তিনি দক্ষ, এমনকি কুস্তি, মুষ্টিযুদ্ধ ধরনের প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলায় নাম লেখালেও তিনি ভালো করতে পারতেন।
কথাটা সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদিকে নিয়ে বলা হলেও আসলে তা শুধু বদির সমস্যা নয়। রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা যেভাবে বাড়ছে, তাতে এ ধরনের বদিতেই দিনে দিনে ভরে যাবে রাজনীতির মাঠ। রাজনীতি যে নিজের দলের লক্ষ্য ও আদর্শের সমন্বয়ে দেশ গঠনের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ, সেটা দিনদিন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক দেশের সংসদে যখন আইনজ্ঞরা উপেক্ষিত হন, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরাই হয়ে পড়েন সংখ্যাগুরু, তখন দেশের আইনকানুন তৈরিতে কাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হবে, সেটা সহজেই অনুমেয়।
দুই. সংকটটা রাজনীতির গোড়ায় ঢুকে গেছে। রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার সঙ্গে পেশিশক্তির একটা যোগাযোগ লক্ষ করা যাচ্ছে বহুদিন আগে থেকেই। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে কতটা গণতন্ত্রের চর্চা আছে, সেটা আমজনতা এখন ভালোই জানে। শুধু কি রাজনৈতিক দল? ব্যক্তিগত পর্যায়ে যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, সে রকম খুব কম প্রতিষ্ঠানেই গণতন্ত্রের দেখা পাওয়া যাবে। লিডারশিপের বদলে বসিং যদি মুখ্য হয়ে ওঠে, তাহলে ছড়ি ঘোরানোই হয়ে উঠবে চালিকাশক্তি, তাতে সন্দেহ করার কিছু থাকে না।
অনেকেই বলে থাকেন, বর্তমানে তৃণমূল পর্যায়ের রাজনীতিতেও স্বচ্ছতা নেই। সেখানেও ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন হয় না। পেশি ও অর্থশক্তিতে বলীয়ানেরাই এখন তৃণমূল রাজনীতির কান্ডারি হয়ে বসেছেন। এই নতুন ধরনের নেতৃত্বের মধ্যে যেকোনো মূল্যে পদ ধরে রাখার প্রবণতা রয়েছে। ছলে-বলে-কৌশলে এলাকায় ক্ষমতা বিস্তার করাটাই মুখ্য। দেশের যে এলাকায়ই যাওয়া হোক না কেন, যেকোনো দলের সাংগঠনিক নেতৃত্বের দিকে তাকানো হোক না কেন, এ ধরনের ভুঁইফোড় নেতৃত্ব দৃশ্যমান হবেই। পেশিশক্তি আর অর্থবলের কাছে মাঠপর্যায়ের রাজনীতিও পরাজিত হয়েছে, এ কথা স্বীকার করে নেওয়া ভালো।
তিন. আবদুর রহমান বদি একজন আঞ্চলিক নেতা। সংসদ সদস্য হওয়ার কারণে তিনি জাতীয় নেতৃত্বের স্বাদও পেয়েছেন। সুতরাং তাঁর কৃতকর্মের আলোচনা-সমালোচনা বড় ফোরামেই হবে। আমরা তাই বিভিন্ন মহল থেকে এ ঘটনার বিশ্লেষণের অপেক্ষায় থাকব এবং পাশাপাশি আরও কিছু ঘটনার উল্লেখ করব, যেখানে পেশিশক্তির মহত্ত্ব উপলব্ধি করা যাবে।
আমাদের অনেকেরই নিশ্চয় মনে পড়ে যাবে শ্যামল কান্তি ভক্তের কথা। তিনি ছিলেন পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ১৭ বছর ধরে শিক্ষকতা করে আসছিলেন। ঘটনাটা ২০১৬ সালের ১৩ মের। ধর্ম অবমাননার অভিযোগে প্রকাশ্যে তাঁকে কান ধরে ওঠবস করানো হয়েছিল। এই ‘মহা আয়োজনের’ সময় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত সাংসদ সেলিম ওসমান।
ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে যেকোনো মানুষকে নাজেহাল করার এই আপত্তিকর সংস্কৃতি আমাদের এখানে চালু হয়ে গেছে। এটা এক বেদনাদায়ক বাস্তবতা।
কিছু একটা হলেই যে কারও ধর্মীয় অনুভূতি জেগে উঠছে এখন। তার পরিণাম হচ্ছে ভয়াবহ। একজন মানুষ বা একদল মানুষকে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করার পর যখন দেখা যাচ্ছে, তিনি বা তাঁরা কোনো ধরনের ধর্মীয় অবমাননার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তখন কিন্তু সেই সব ষড়যন্ত্রকারীর বিরুদ্ধে সে রকম কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
শৈশব থেকে আমরা শিখে এসেছি, মা-বাবার পরেই শিক্ষকের অবস্থান। আমাদের রাজনীতিবিদদের বাড়াবাড়িতে শিক্ষকেরা সে অধিকার হারিয়েছেন। ধর্মীয় অবমাননা বিষয়ে এ লেখাটি নয়। আমি বলতে চাইছি, রাজনীতিকে কতটা সংকীর্ণভাবে দেখা হলে এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটিয়ে দেওয়া যেতে পারে। একজন শিক্ষককে প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠবস করানোর মধ্যে যে হিংসা, ক্রোধ, পেশিশক্তির প্রকাশ ঘটে, তা কখনোই সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়। রাজনীতিবিদ তাঁর তরিকার মধ্যে এই পেশিশক্তি ঢুকিয়ে ফেলেছেন। একজন প্রধান শিক্ষককে প্রকাশ্যে অপমান করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি পুরো শিক্ষককুলকে সেই বার্তাটি পৌঁছে দিয়েছেন যে রাজনীতির কাছে মাথা নত করে থাকো, নইলে ‘খবর’ আছে। সেই খবর ‘স্কুল কমিটি’র মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে হলেও ক্ষতি নেই।
চার. দলের ওপর মহলে যদি এই যথেচ্ছাচারের অনুমোদন থাকে, তাহলে নিচের মহলেও তা ছড়িয়ে যায়। এখন বলব ছাত্রলীগের এক আঞ্চলিক নেতার কথা। এই তো অল্প কয়েক দিন আগে শরীয়তপুরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজের শিক্ষককে মারধর করেছেন কলেজের ছাত্রলীগের সভাপতি সোহাগ ব্যাপারী। কলেজের বাংলা বিভাগে স্নাতক সম্মান (অনার্স) চতুর্থ বর্ষের মৌখিক পরীক্ষার সময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন বিশেষজ্ঞ এবং ওই কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের সংবর্ধনা ও আপ্যায়নের আয়োজন করেছিল বাংলা বিভাগ। সেই আয়োজনে কেন ছাত্রলীগ নেতাদের দাওয়াত দেওয়া হয়নি, তার জবাবদিহি চান সোহাগ ব্যাপারী। তাঁর সঙ্গে ছিলেন লীগের আরও কয়েকজন নেতা-কর্মী। তাঁরা এ সময় বাংলা বিভাগের শিক্ষক বি এম সোহেলকে মারধর করেন।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ অবশ্য ঘটনাটিকে আমলে নিয়ে শরীয়তপুর জেলা ছাত্রলীগের মাধ্যমে কলেজ কমিটি বিলুপ্ত করে দেয়।
এ বিষয়ে শরীয়তপুর জেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক মহসিন মাদবর যা বলেছেন, তা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ জাতির জনকের হাতে গড়া সংগঠন। এই সংগঠন কখনোই শৃঙ্খলাবহির্ভূত বা বিশৃঙ্খলাকে প্রশ্রয় দেয় না। তাই খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা দলীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে দিই।’
খুব ভালো কাজ করেছেন তাঁরা। কিন্তু কমিটি বিলুপ্ত করার পর আর কিছু কি করা হয়েছে? শিক্ষকদের আপ্যায়নে ছাত্রলীগের নেতাদের কেন দাওয়াত করতে হবে, তার কি ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে? শিক্ষকের শরীরে হাত তোলার জন্য কি এই বিলুপ্ত কমিটির সভাপতিকে জবাবদিহির সম্মুখীন করা হয়েছে? সারা দেশের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের কি এই বলে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে যে শিক্ষকের শরীরে হাত তোলা মহা অন্যায়, এ কাজ যেন কেউ না করে। করলে ভয়াবহ শাস্তি?
পাঁচ. খুব সুন্দর করে মহসিন মাদবর বলেছেন, ‘ছাত্রলীগ জাতির জনকের হাতে গড়া সংগঠন’। কথাটা ঠিক। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্রদের মধ্যে একটা জায়গা করে নিয়েছিল মুসলিম লীগপন্থী প্রগতিশীল ছাত্ররা। কিছুদিন পর আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে একটি বিরোধী দলের সৃষ্টিও হয়েছিল এরই ধারাবাহিকতায়। সেই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, যা এখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া এই সংগঠন, এ কথা স্বীকার করে নিলে বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কেও ছাত্রলীগের কর্মীদের জানা থাকা দরকার। বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের একটি তাৎপর্যময় দিক ছিল তাঁর সৌজন্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে খাজা নাজিমুদ্দিন ঘরানার রাজনীতিবিদ ছিলেন না, সেটা তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়লেই বোঝা যায়। সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমপন্থী প্রগতিশীল ঘরানায় ছিল তাঁর অবস্থান। ১৯৫২ সালে খাজা নাজিমুদ্দিন ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। রাজবন্দীদের মুক্তি ও একুশের ঘটনায় পুলিশের গুলিবর্ষণের তদন্ত দাবি করে শেখ মুজিব যখন খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন, তখন তিনি আক্রোশে আকীর্ণ ছিলেন না। তিনি সৌজন্যবোধ হারিয়ে ফেলেননি; বরং তিনি খাজা সাহেবের ভদ্রতার কথা লিখেছেন। খাজা নাজিমুদ্দিনও শেখ মুজিবকে ‘শরীর কেমন, কেমন আছো, কত দিন থাকবে’—এ প্রশ্নগুলো করেন। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, খাজা সাহেব জানতেন শেখ মুজিব একজন ভালো কর্মী। তিনি বঙ্গবন্ধুকে স্নেহও করতেন।
বইয়ের অন্য জায়গায় বঙ্গবন্ধু নাজিমুদ্দিনের সমালোচনা করেছেন যখন, তখন ‘তিনি দুর্বল প্রকৃতির,’ ‘কর্মদক্ষতা এবং উদ্যোগের অভাব’ রয়েছে তাঁর, এসব যখন লিখছেন, তখন পাশাপাশি তিনি যে ‘অমায়িক’ এ কথাটাও উল্লেখ করছেন।
ওপরে যে তিনটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে, তা থেকে বঙ্গবন্ধুর আচরণ কতটা আলাদা, সেটা দেখানোর জন্যই বঙ্গবন্ধু-প্রসঙ্গ তুলে আনলাম। এবার এই নেতা-পাতিনেতা-ছাত্রনেতাদের নিরিখে বঙ্গবন্ধুকে বিচার করে দেখুন। বঙ্গবন্ধু নিজেই স্বীকার করেছেন, কৈশোরে ডাকাবুকো ছিলেন তিনি। কিন্তু সেটা কোন সময়? যখন অধিকার হরণ করা হতো, তখন তিনি বৃহত্তর স্বার্থে মারপিটও করেছেন। কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করার সময় হাতাহাতি, অপমান ইত্যাদি করেছেন—এমন নজির নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সেবার প্রতি যত বেশি ঝুঁকেছেন, ততই হয়ে উঠেছেন পরমতসহিষ্ণু। যাঁরা ভিন্নমতের অধিকারী, তাঁদেরও তিনি আঘাত করেননি। স্বাধীনতার পরও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অনেককে তিনি অনুকম্পা প্রদর্শন করেছেন, যা মুজিব চরিত্রের মহৎ দিকটিকেই তুলে আনে। যদিও অনুকম্পাপ্রাপ্তরা অকৃতজ্ঞতারই পরিচয় দিয়েছে, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
শুধু ভেবে দেখতে বলি, বঙ্গবন্ধু কোনো বর্ধিত সভায় তাঁরই দলের এক নেতাকে পেটাচ্ছেন, বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে কোনো শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস করানো হচ্ছে কিংবা শিক্ষকদের আপ্যায়নে কেন তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে নিমন্ত্রণ করলেন না, তা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শিক্ষকের শরীরে হাত তুলছেন–এ রকম দৃশ্য কি কল্পনাতেও আসে?
আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, বঙ্গবন্ধু এই ধরনের দলীয় রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না। তাহলে তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশে কেন এই রাজনীতি বাড়তে থাকবে, সে প্রশ্নটি অবশ্যই করতে হবে রাজনীতিবিদদের কাছে। তাঁরা কী বলেন, তা জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করব।
জাহীদ রেজা নূর,উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
পর্দার নায়িকারা নিজেদের বয়স আড়ালে রাখা পছন্দ করেন। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আজমেরী হক বাঁধন। প্রতিবছর নিজের জন্মদিনে জানান দেন তাঁর বয়স। গতকাল ছিল বাঁধনের ৪১তম জন্মদিন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেই জানালেন এই তথ্য।
২ দিন আগে১০ বছরের বেশি সময় ধরে শোবিজে কাজ করছেন অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া। নাটকের পাশাপাশি ওটিটিতে দেখা গেছে তাঁকে। সরকারি অনুদানের ‘দেবী’ নামের একটি সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন। প্রশংসিত হলেও সিনেমায় আর দেখা মেলেনি তাঁর। ছোট পর্দাতেও অনেক দিন ধরে অনিয়মিত তিনি। এবার শবনম ফারিয়া হাজির হচ্ছেন নতুন পরিচয়ে। কমেডি রিয়েলিটি
২ দিন আগেআমাদের লোকসংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য যাত্রাপালা। গণমানুষের সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত এই যাত্রাপালা নিয়ে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করছে ‘যাত্রা উৎসব-২০২৪’। আগামী ১ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে শুরু হবে ৭ দিনব্যাপী এই উৎসব।
২ দিন আগে‘বঙ্গবন্ধু’ পদবি বিলীন হবে না। হতে পারে না। যেমনটি ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাশের পদবি বিলীন হয়নি। ইতিহাসে এসব পদবি অম্লান ও অক্ষয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব ছিল অনন্যসাধারণ। আপনজনকে তো অবশ্যই, শত্রুপক্ষের লোকেরাও ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উচ্চপদের
২ দিন আগে