মুড়ি মুড়কি নিমকি মোয়া

রাতুল মণ্ডল, শ্রীপুর (গাজীপুর) 
প্রকাশ : ১৯ ডিসেম্বর ২০২২, ০৯: ৪৬

মুড়ি-মুড়কি-নাড়ু-মোয়া-নিমকির মতো লোকায়ত খাবারগুলো যখন পাত থেকে উবে যাচ্ছে, লোহাই হাটে তখন এসব খাবারের জমজমাট বিকিকিনি। হাটের এক দিকে সারি সারি দোকান। সেই সব দোকানে বিক্রি হচ্ছে মুড়ি-মুড়কিসহ অন্যান্য লোকায়ত খাবার। বছরের পর বছর লোকজন সেসব কিনে খাচ্ছে। গুণগত মানের কমতি হলেই নিয়মিত ক্রেতারা হইচই করে উঠছেন বিক্রেতাদের সঙ্গে!

শতাধিক বছর আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের লোহাই বাজারের যাত্রা শুরু হয় বলে জানা যায়। উপজেলার আশপাশের হাজার হাজার মানুষ এখানে আসে সপ্তাহে দুই দিন—শুক্র ও সোমবার।

তবে এমন মনে করার কারণ নেই যে লোহাই হাটে শুধুই মুড়ি-মুড়কি বিক্রি হয়; বরং গাজীপুরের এ পুরোনো হাটটি দেশীয় মাছের বড় আড়ত। এ ছাড়া সব ধরনের নিত্যপণ্য পাওয়া যায় এখানে। সেসব পণ্যের একটি এসব লোকায়ত খাবার।

ঐতিহাসিক এ হাটের প্রসিদ্ধ খাবার মুড়ি-মুড়কি। শতাধিক দোকান আখের গুড়ের মুড়ি-মুড়কির পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা।আশপাশের ৫০টিরও বেশি গ্রামের মানুষ এ হাটে আসে। মুড়ি-মুড়কির পাশাপাশি এ হাটে পাওয়া যায় মুড়ির তৈরি বিভিন্ন রকমের মোয়া।এ ছাড়া প্রসিদ্ধ খাবারের তালিকায় রয়েছে—নিমকি, চেপটি, মুড়ালি, চানাচুর, গজা, চমচম, খাগড়াই, কদমা-মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা, লাল গুড়ের জিলাপি, বাদাম, চিড়ার মোয়া।

সম্প্রতি এক শুক্রবার লোহাই বাজারে গিয়ে উপস্থিত হই। দেখা যায়, বাজারের বেশ বড় অংশ নিয়ে দোকান সাজিয়ে বিক্রি হচ্ছে মুড়ি-মুড়কি। সেসব দোকানে সাদা খইয়ে গুড় মাখানো মুড়কি খেতে বসেছে বিভিন্ন বয়সী মানুষ। কাঠের টুলে বসে আয়েশি ভঙ্গিতে মজা করে লোকজন খেয়ে চলেছে মুড়ি-মুড়কি। অনেকেই আবার খেয়ে বাড়ির জন্য কিনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি দোকানে বিকিকিনি চলছে দেদার। শুধু যে স্থানীয়রাই এসব খাবার খেয়ে থাকে, তা নয়। দূর-দূরান্ত থেকে হাটে আসা শত শত মানুষ এসব খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করে। দিনের চেয়ে বরং সন্ধ্যার পর থেকে দোকানে বেচাকেনার ধুম পড়ে বলে জানিয়েছেন মুড়ি-মুড়কি বিক্রেতারা।

প্রতি শুক্রবার লোহাই বাজারে আসেন টাঙ্গাইলের গরু ব্যবসায়ী ইজ্জত আলী। একটি দোকানে কাঠের টুলে বসে মুড়ির মোয়া খাচ্ছিলেন তিনি। কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি জানান, বিশ বছর ধরে লোহাই হাটে আসেন তিনি। আর হাটে এলেই সময়-সুযোগ করে মুড়ি-মুড়কি খেয়ে নেন। রাতে গরু কেনাবেচা শেষে বাড়ির জন্যও কিনে নিয়ে যান।

ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার উড়াহাটি গ্রামের রমিজ উদ্দিন। তিনি সপ্তাহে দুই দিন এই হাটে মাছ বিক্রি করতে আসেন। বাজারে এসে মুড়ি-মুড়কির দোকানে এক বেলা হাজিরা দেন নিয়মিত। ভাতের কাজ মুড়ি-মুড়কি দিয়ে চালিয়ে দেন। এই হাটের মুড়ি-মুড়কির স্বাদ দারুণ বলে জানান রমিজ উদ্দিন।

স্থানীয় একটি পোশাক কারখানার কর্মকর্তা রুহুল আমিন গাজী হাটে আসেন মাছ-মাংস কিনতে। হাটে এলে প্রথমে শিশুসন্তানের দেওয়া বায়না পূরণ করতে যান মুড়ি-মুড়কি মহলে। সেখান থেকে পছন্দমতো মুড়ি-মুড়কি কিনে ফিরতে হয় তাঁকে। এ হাট থেকে মুড়ি-মুড়কি কেনা নিয়মিত কাজ বলে জানিয়েছেন তিনি।

বাহারি মুড়ি-মুড়কির দোকান সাজিয়ে বসেছেন রঞ্জিত রায়। সপ্তাহে দুই দিন আসেন এ হাটে। ৩০টি আইটেমের রুচিসম্মত মুড়ি-মুড়কি রয়েছে তাঁর দোকানে। দুপুরের পর থেকে বেচাকেনার ধুম পড়ে, চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। বেচাকেনার কোনো সময় কমতি হয়নি এই হাটে।

দুই যুগের বেশি সময় ধরে এখানে মুড়ি-মুড়কি বিক্রি করছেন লাল মিয়া। তিনি জানান, আখের গুড় দিয়ে মানসম্মতভাবে তৈরি করা হয় এসব খাবার। সারা রাত ধরে নিমকি, চেপটি মুড়লি, তক্তি তৈরি হয়। সকালে হাটে এসে এগুলো সুন্দরভাবে বাঁশের তৈরি ডালার মধ্যে সারি দিয়ে সাজানো হয়।

তেলিহাটি ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য তারেক হাসান বাচ্চু বলেন, `ছোটবেলা থেকে দেখছি, এ হাট একটি ঐতিহাসিক হাট। এই হাটে মুড়ি-মুড়কি কম করে হলেও শতাধিক দোকান রয়েছে, হরেক রকমের মুড়ি-মুড়কি সাজানো হয় দোকানগুলোতে। বাজারে আসা বেশির ভাগ মানুষ মুড়ি-মুড়কির দোকানে বসে। বাসাবাড়ির জন্যও কিনে নিয়ে যায়। এ হাটে হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত