নাজুক জ্বালানি নিরাপত্তা বনাম টেকসই উন্নয়ন

অরুণ কর্মকার
প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯: ০৩

জ্বালানি নিরাপত্তা টেকসই উন্নয়নের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বাংলাদেশ এখন একটি উচ্চমাত্রার জ্বালানি চাহিদাসম্পন্ন দেশ। দেড় দশকের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এখানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বড় বড় অবকাঠামো ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে এবং হচ্ছে। ফলে জ্বালানির চাহিদা বেড়েছে এবং ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। কিন্তু এই চাহিদা মেটানোর মতো সরবরাহ সক্ষমতা তৈরি হয়নি।

কিন্তু বাংলাদেশ জ্বালানি সম্পদহীন কোনো দেশ নয়। সমৃদ্ধ দেশের কাতারে না পড়লেও উল্লেখযোগ্য জ্বালানি সম্পদ এ দেশে রয়েছে।পৃথিবী বিখ্যাত বিদেশি ও দেশীয় প্রতিষ্ঠান এবং বিশেষজ্ঞ পেশাজীবীরা বারবার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সমীক্ষার ভিত্তিতে এ কথা বলেছেন এবং বলে চলেছেন।

তা সত্ত্বেও দেশীয় জ্বালানি সম্পদের অনুসন্ধান, আহরণ ও ব্যবহার সীমিতই রয়ে গেছে। বাড়ছে আমদানিনির্ভরতা। ফলে জ্বালানি নিরাপত্তা পরিস্থিতি যথেষ্ট নাজুক অবস্থার মধ্যে পড়েছে। উন্নয়নের গতি-প্রকৃতি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে না।

জ্বালানি তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং কয়লা আমাদের দেশের প্রধান তিনটি বাণিজ্যিক জ্বালানি। চাহিদার তুলনায় এই তিন ধরনের জ্বালানি পণ্যেরই ঘাটতি ও সংকটের কথা সবার জানা। চলমান এই সংকট ইতিমধ্যে দেশের অর্থনীতি ও জনজীবনে বড় ধরনের অস্বস্তি সৃষ্টি করেছে। উন্নয়নের ধারাকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। জ্বালানি তেল আমাদের দেশে নেই। পাওয়ার সম্ভাবনাও কম। এ ক্ষেত্রে আমরা সব সময়ই আমদানিনির্ভর। কিন্তু প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লার বিষয়টি ভিন্ন।

অনেক আগে থেকেই দেশে চাহিদার তুলনায় গ্যাসের সরবরাহ-ঘাটতি চলে এসেছে। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার গঠনের সময় দেশে গ্যাস সরবরাহ ছিল দৈনিক ১ হাজার ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট, যার সবটুকুই ছিল দেশের। তবে তখনকার চাহিদার তুলনায় তা ছিল কম। সরকার তখন গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়। ফলে ২০১২-১৩ সালনাগাদ গ্যাস উত্তোলন দৈনিক ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুটে ওঠে। কিন্তু তত দিনে দেশে গ্যাসের চাহিদা দাঁড়ায় দৈনিক ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট।

এরপর আর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন বাড়েনি। সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তেমন কোনো উদ্যোগও বাস্তবায়িত হয়নি। পাশাপাশি দেশের ক্ষেত্রগুলোতে গ্যাসের চাপ কমে আসা (রিজার্ভার প্রেশার) এবং আরও কিছু কারিগরি কারণে উৎপাদন কমেছে এবং কমছে। ফলে গ্যাসের সরবরাহ-ঘাটতি ক্রমাগতভাবে বেড়েছে।

এই ঘাটতি পূরণে সরকার দেশের গ্যাস আহরণ বৃদ্ধির পথে না গিয়ে ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করে। ফলে গ্যাসের দাম বাড়তে থাকে, যা উৎপাদন খাতের জন্য বাড়তি ব্যয়ের বোঝা সৃষ্টি করে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না; বরং অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বিঘ্নিত করার পথ তৈরি হয়ে যায়।

দেশে এখন গ্যাসের চাহিদা দৈনিক প্রায় ৪০০ কোটি ঘনফুট। সরবরাহ ২৯০ কোটি ঘনফুটের মতো। এই ঘাটতির একটা কারণ রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেন-ন্যাটো জোটের যুদ্ধজনিত বিশ্ববাজারে জ্বালানির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার সংকট। তবে আমাদের জ্বালানি ঘাটতির সবচেয়ে বড় কারণ এটি নয়। ওই যুদ্ধ না হলেও আমাদের গ্যাসের চাহিদা এমনই হতো। কিন্তু দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুটের বেশি এলএনজি আমদানির সক্ষমতা হতো না। আর দেশের ক্ষেত্রগুলোতে উৎপাদন কমার হারও এমনই থাকত।

আমাদের গ্যাস-সংকটের প্রধান কারণ ধারাবাহিকভাবে দেশের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে মনোযোগ না দেওয়া। সরকার খাদের কিনারা থেকে বিদ্যুৎ খাতকে যেভাবে তুলে এনেছে, গ্যাস খাতের উন্নয়নে তেমনটি করা হয়নি। সংকট তীব্র হওয়ার পর ২০২২ সালের শেষভাগে সরকার দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে দৈনিক প্রায় ৬২ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ শুরু করে।

যদি ধরে নিই যে এর পুরোটাই পাওয়া যাবে, বিশ্ববাজার স্বাভাবিক হবে এবং আমরা দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট করে এলএনজি আনব, তাহলেও ঘাটতি পূরণ হবে না। কারণ এই সময় বিদ্যমান কূপগুলোর উৎপাদন কমবে। ২০২৫ সালে আমাদের মোট গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা হতে পারে ৪০০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু তখন দৈনিক চাহিদা হবে অন্তত ৪৫০ কোটি ঘনফুট। এই ঘাটতি পূরণে আরও সময় লাগবে এবং ঘাটতি পূরণ হতে হতে আরও চাহিদা বাড়বে। ঘাটতিও চলতে থাকবে। এই দুষ্টচক্র থেকে শিগগিরই পরিত্রাণের সম্ভাবনা নেই।

নীতিনির্ধারকেরা বলে থাকেন যে দেশে আর বেশি গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ ক্ষেত্রে আমরা কয়েকটি অ্যাসেসমেন্টের কথা উল্লেখ করতে পারি। যেমন ইউএসজিএস এবং পেট্রোবাংলার যৌথ উদ্যোগে ২০০০ সালে করা সমীক্ষা; নরওয়েজিয়ান পেট্রোলিয়াম ডিরেক্টরেট এবং হাইড্রোকার্বন ইউনিটের ২০০১ সালের যৌথ সমীক্ষা এবং ২০১৭ সালে গুস্তাভসন অ্যাসোসিয়েটসের সমীক্ষা; ইউরোপীয় তেল-গ্যাস পরামর্শক প্রতিষ্ঠান-র্যাম্বলের সমীক্ষা।

এর প্রতিটিতে অনেক গ্যাস পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। সরকার বিদ্যুৎ খাত মহাপরিকল্পনায় (২০১৭) উল্লেখ করেছে, ইউএসজিএস-পেট্রোবাংলা সমীক্ষা (২০০১) হলো পদ্ধতিগত বিস্তৃত একটি অধ্যয়ন, যা বাংলাদেশের অনাবিষ্কৃত গ্যাস সম্পদের সম্ভাব্যতা মূল্যায়নের জন্য প্রথম দিকের এবং সর্বোত্তম অধ্যয়নের প্রতিনিধিত্ব করে। (The USGS-Petrobangla study (2001) is a systematic extensive study that represents the earlyest and best study to assess the Bangladesh’s undiscovered gas resource potential.) ফরাসি প্রতিষ্ঠান স্লামবার্জার একটি সমীক্ষায় বলেছে, বিদ্যমান ক্ষেত্রগুলোর পুরোনো কূপগুলোয় কিছু সংস্কারকাজ করে সর্বোচ্চ এক বছরের মধ্যে দৈনিক ৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন বাড়ানো যায়। সর্বশেষ নরওয়েভিত্তিক বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানি ইকুইনরের (সাবেক স্টেট অয়েল) সঙ্গে বাংলাদেশ মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি একটি গবেষণা করেছে।

প্রধানমন্ত্রীর গবেষণা তহবিলের অর্থায়নে করা এই গবেষণা বলছে, উত্তোলন বন্ধ করে রাখা ৩০টি কূপ থেকে সেকেন্ডারি রিকভারি প্রযুক্তির মাধ্যমে দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস তোলা সম্ভব।

দেশের বেঙ্গল বেসিনে গ্যাস পাওয়ার অমিত সম্ভাবনা রয়েছে। সুরমা বেসিনে অনেক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র পড়ে আছে। বিদ্যমান একাধিক ক্ষেত্রে গভীরতর কূপ খনন করে (ডিপার জোন এক্সপ্লোরেশন, ৫ হাজার মিটার+) বিপুল গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সমুদ্রবক্ষ ছাড়াই এতগুলো বিকল্প উৎস বিদ্যমান। দরকার অনুসন্ধান ও আহরণ বাড়ানো।

গ্যাস অনুসন্ধানে টাকার অভাবের কথা বলা হয়। প্রশ্ন হলো, জ্বালানি আমদানির ব্যয় মেটানোর মতো অঢেল টাকা (বৈদেশিক মুদ্রা) কি আমাদের আছে? তা ছাড়া, গ্যাস অনুসন্ধানে অর্থ সংস্থানের জন্য ২০০৮-০৯ সালে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন গ্যাস উন্নয়ন তহবিল নামে পৃথক একটি তহবিল গঠন করে রেখেছে। সেই তহবিল অন্যত্র ব্যবহার করা হচ্ছে কেন?

প্রাকৃতিক গ্যাসের আরেকটি রূপ এলপিজি (লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস)। এর চাহিদাও এখন দেশে বছরে ৩০ লাখ টন ছাড়িয়েছে। এর শতকরা ৯৯ ভাগেরও বেশি আমদানি করতে হয়। ফলে এর সঙ্গেও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।

কয়লার বিষয়টিও চমকপ্রদ। দেশে আবিষ্কৃত ৫টি কয়লাখনিতে ৭০০ কোটি (৭ হাজার মিলিয়ন) টন উন্নত মানের কয়লার মজুত রয়েছে।অথচ আমরা কয়লাভিত্তিক সবগুলো বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র করছি আমদানি করা কয়লায়। কয়লা উত্তোলনের সঙ্গে পরিবেশ এবং অতি উর্বর ফসলি জমি রক্ষার বিষয়টি জড়িত ঠিকই। কিন্তু এর গ্রহণযোগ্য সমাধান খতিয়ে দেখা সম্ভব।

টেকসই উন্নয়ন ও জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য নবায়নযোগ্য খাতও এখন গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের এ খাতটিও স্থবির। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্থাপিত ক্ষমতার ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়েছিল সরকার। ২০২২ সাল পর্যন্ত হয়েছে ৪ শতাংশের মতো।

টেকসই উন্নয়নের জন্য দেশের জ্বালানি খাতের বর্তমান অবস্থা এবং আমদানিনির্ভরতার প্রবণতা মোটেই সহায়ক নয়। উন্নয়ন স্থিতিশীল করতে হলে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে দেশের জ্বালানি সম্পদ আহরণ বাড়ানোর বিকল্প নেই।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি চাকরিজীবীরা সম্পদের হিসাব না দিলে যেসব শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন

শেখ হাসিনাকে নিয়ে যুক্তরাজ্যে এম সাখাওয়াতের বিস্ফোরক মন্তব্য, কী বলেছেন এই উপদেষ্টা

শিক্ষকের নতুন ২০ হাজার পদ, প্রাথমিকে আসছে বড় পরিবর্তন

লক্ষ্মীপুরে জামায়াত নেতাকে অতিথি করায় মাহফিল বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ

শ্রীপুরে পিকনিকের বাস বিদ্যুতায়িত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ শিক্ষার্থীর মৃত্যু, আহত ৩

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত