গৈলা স্কুল ১৩০ বছরে

অজয় দাশগুপ্ত
প্রকাশ : ২৩ জানুয়ারি ২০২২, ১৫: ০১

বরিশালের ঐতিহ্যবাহী গৈলা হাই ইংলিশ স্কুলের যাত্রা শুরু ১৮৯৩ সালের ২৩ জানুয়ারি; কালের বিবর্তনে যা এখন সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যাত্রার প্রথম দিনেই তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী ছিল মোট ১২২ জন। যাদের বড় অংশ বরিশালের ঐতিহ্যবাহী ব্রজমোহন বিদ্যালয় থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে এসেছিল। পরের বছর থেকেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গৈলা স্কুলের ১২ জন শিক্ষার্থীকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসার অনুমতি দেয়। ৫০ বছর পূর্ণ না হতেই এই স্কুল থেকে ১ হাজার ৫ জন ছাত্রছাত্রী এন্ট্রান্স ও ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়।

গৈলা সে সময় ‘৩৬০ ঘর জমিদার-তালুকদারের’ জন্য পরিচিত ছিল। তাঁদেরই একটি অংশ দাশের বাড়ির চারটি হিস্যার মালিকেরা নামমাত্র পাট্টায় স্কুলকে কয়েক একর জমি হস্তান্তর করেন। বিদ্যালয়ের নিজস্ব ঘর স্থাপনের আগে এই দাশের বাড়িতেই (লেখক অজয় দাশগুপ্তের বাড়ি) নেওয়া হতো ক্লাস।

এ গ্রামেই ৫০০ বছরের বেশি আগে মনসামঙ্গল কাব্য রচনা করেছিলেন কবি বিজয় গুপ্ত। যেখানে গড়ে ওঠা মন্দির ও নাটমন্দির এখন আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। এ বিদ্যালয় কার্যক্রম শুরুর আগেই গৈলার কবীন্দ্র বাড়িতে (খ্যাতিমান সাহিত্যিক মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়ি) চালু ছিল সংস্কৃত কলেজ, যেখানে এমএর সমপর্যায়ের ডিগ্রি দেওয়া হতো। ১৮৮৫ থেকে ১৮৯২ সাল পর্যন্ত গৈলা থেকে ১৪ জন শিক্ষার্থী স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। প্রথম প্রধান শিক্ষক হয়ে আসেন কৈলাশ চন্দ্র সেন। যিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর উচ্চপদে সরকারি চাকরির সুযোগ পরিত্যাগ করে শিক্ষকতা পেশার সম্মানকে বড় করে দেখেছিলেন। গৈলা স্কুলে ছাত্রছাত্রীরা শুধু মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই তুষ্ট থাকেনি। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এই বিদ্যালয়ের ১৭ জন শিক্ষার্থী এমএ-এমএসসি পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ওই সময় ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পেয়েছেন ৫ জন, ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন ৪০, মেডিকেল স্নাতক ছিলেন ৩৩ ও প্রকৌশলী হয়েছেন ৪৩ জন।

এ সময়ে ডক্টরেটসহ সমমানের ডিগ্রি বাদে এমএ-এমএসসি পাস নারী ছিলেন ৪৭ জন এবং সাধারণ গ্র্যাজুয়েট ছিলেন ২৪ জন। এ সময়ে গ্রামে নারী শিক্ষার জন্য পৃথক প্রাথমিক বিদ্যালয়ও চালু হয়েছিল। গৈলা স্কুল চালুর আগে ছাত্রছাত্রীরা ৪০ কিলোমিটার দূরের বরিশাল শহরে কিংবা তিন-চার দিনের পথ নৌকা ও ট্রেনে পাড়ি দিয়ে কলকাতা শহর অথবা ৮-১০ দিন নৌকায় প্রমত্ত পদ্ম-মেঘনা পাড়ি দিয়ে ঢাকায় পড়তে যেতেন। একটি গ্রামে শিক্ষার প্রতি এমন আগ্রহ ভারতবর্ষের আর কোথাও দেখা যায়নি।

সমৃদ্ধ জনপদ গৈলা। এখানে রয়েছে ২০০ বছরের বেশি পুরাতন বাজার, আধুনিক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও সাবপোস্ট অফিস (কলকাতা, ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় শহর থেকে চাকরিজীবীরা নিয়মিত অর্থ প্রেরণের কারণে যা মানি অর্ডার পোস্ট অফিস নামে সুপরিচিত ছিল) এবং কামার, কুমার, পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ বহুবিধ পেশাজীবীর বসবাস। 
বিদ্যালয়ে ১৯৭১ সালে অধ্যয়নরত ও প্রাক্তন ছাত্র মিলিয়ে অন্তত ১০০ জন মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। সে সময় বিদ্যালয়টি ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দুর্ভেদ্য ঘাঁটি।

এ বিদ্যালয়েই আজ থেকে ৫৪ বছর আগে ১৯৬৮ সালে নির্মিত হয় ভাষা আন্দোলনের অমর স্মৃতিতে শহীদ মিনার। এ বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ১৯৯৩ সালে বিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে নিজেদের অর্থে নির্মাণ করে শতবর্ষ ভবন। দুই দশকের বেশি সময় ধরে চালু রয়েছে ‘সৈয়দ আবুল হোসেন বৃত্তি’। প্রতিটি শ্রেণির সেরা শিক্ষার্থীরা যেখান থেকে প্রতিবছর এ বৃত্তি পায়।

সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিদ্যালয়টি পরিচালিত হলেও এলাকার প্রতিটি মানুষ তাঁদের প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান উন্নয়নে সচেষ্ট। উপজেলার অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মর্যাদায় আসীন গৈলা স্কুল থেকে প্রতিবছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেয় ২০০-এর বেশি ছাত্রছাত্রী। প্রতিষ্ঠানটি জ্ঞানচর্চায় বরাবরের মতো অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। সর্বোপরি প্রিয় মাতৃভূমির উন্নতি ও কল্যাণে আজীবন নিয়োজিত থাকবে, ১৩০ বছরের যাত্রালগ্নে-এটাই কাম্য।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত