আপসেই শেষ হচ্ছে মানব পাচার মামলা

শাহরিয়ার হাসান, ঢাকা
আপডেট : ২১ মার্চ ২০২৪, ০৮: ৩১
Thumbnail image

রাজধানীর ফকিরাপুলের ওয়ার্ল্ড ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস নামের একটি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে ইতালি গিয়েছিলেন শরীয়তপুরের ছয়জন যুবক। প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচ করে সেখানে গিয়ে প্রত্যাশিত কাজ পাওয়া দূরের কথা, উল্টো নির্যাতনের শিকার হন তাঁরা। জীবন বাঁচাতে আরও এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে তিন মাসের মাথায় কোনোরকমে ফিরে আসেন দেশে। মানব পাচারের এই ঘটনায় দেশে ফিরেই সংশ্লিষ্ট এজেন্সির মালিকসহ দুই দালালের নামে মামলা করেন ভুক্তভোগীরা। কিন্তু সেই মামলা বিচার পর্যন্ত গড়ায়নি। তার আগেই জনপ্রতি লাখ টাকা দিয়ে ভুক্তভোগীদের আপসে এনে রেহাই পান অভিযুক্তরা।

মানব পাচারের মামলায় এ রকম আপস-মীমাংসার কয়েক ডজন উদাহরণ উঠে এসেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) এক প্রতিবেদনে। মানব পাচার মামলার সাজা কম হওয়ার কারণ অনুসন্ধানে নেমে ওই প্রতিবেদন তৈরি করেছে সিআইডি। সেখানে উঠে এসেছে কীভাবে মানব পাচার মামলায় আসামিরা খালাস পেয়ে যান, সে তথ্য।

জানতে চাইলে সিআইডির প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক মোহাম্মাদ আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, মানব পাচারের মামলাগুলোর সাজা আসলে শূন্য। অনেক মামলা বিচার পর্যন্ত চলে না। তার আগেই বাদী ও বিবাদী আপস-মীমাংসা করে ফেলেন। আর যে মামলা বিচার পর্যন্ত পৌঁছায়, সেখানে এমন তথ্যপ্রমাণ আর সাক্ষ্য দেওয়া হয়, যেগুলোতে আসামিকে শাস্তি দেওয়ার মতো প্রমাণ থাকে না।

ইতালি যেতে চেয়ে মানব পাচার চক্রের খপ্পরে পড়েছিলেন পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার বাসিন্দা হাফিজুর রহমান। চক্রটি তাঁকে ইতালির কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে জিম্মি করে। এক বছর পর জিম্মিদশায় থাকার পর দেশে ফিরে ২০১৯ সালে মতিঝিল থানায় চারজনকে আসামি করে একটি মানব পাচারের মামলা করেন হাফিজুর। মামলার চার বছর পর ২০২৩ সালের নভেম্বরে মামলাটি আর চালাবেন না বলে তিনি নিজেই আদালতকে জানিয়ে দেন।

হাফিজুর জানান, তিনি নিজের নিযুক্ত আইনজীবীর মাধ্যমেই দুই লাখ টাকায় আসামিদের সঙ্গে আপস করেন। যদিও বিদেশ যেতে চক্রটিকে সাত লাখ টাকা দিয়েছিলেন তিনি।

আপস কেন করেছেন—এ প্রশ্নের উত্তরে ভুক্তভোগী হাফিজুর আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘পাচারকারীদের শাস্তি দিতে বিচার চেয়ে মামলা করেছিলাম। কিন্তু মামলার পর ভুক্তভোগী হিসেবে কারও সহযোগিতা পাইনি। উল্টো আরও ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ি।’

মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২-এ সংঘবদ্ধ মানব পাচারের অপরাধে সর্বোচ্চ সাজার বিধান আছে। এই আইনের ৭ নম্বর ধারায় বলা আছে, সংঘবদ্ধ মানব পাচারের অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড বা অন্যূন সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং অন্যূন পাঁচ বছর অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এমন কঠোর আইন থাকার পরেও আপস-মীমাংসার কারণে বেঁচে যাচ্ছে অপরাধী।

পুলিশ ও আদালত সূত্র বলছে, মানব পাচারের মামলার বিচারের জন্য গত বছরের মার্চে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর ও বরিশালে আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর ট্রাইব্যুনালগুলোয় সাড়ে তিন হাজারের বেশি মানব পাচারের মামলা চলছে।

২০২৩ সালের মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকার মানব পাচার ট্রাইব্যুনালে ২১৮টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১৩ মামলায় আসামির সাজা হয়েছে। খালাস পেয়েছে ১৪১টি মামলার আসামি। আর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে ৬৪ মামলার আসামিদের।

মামলায় সাজার হার এত কম হওয়ার পেছনে অন্যতম একটি কারণ বাদী-বিবাদীর আপস। এ ছাড়া সঠিক সময়ে মামলা না করা, পুলিশের তদন্তে সঠিক তথ্য উঠে না আসা, সাক্ষী হাজির করতে না পারাসহ আরও বেশ কিছু কারণ রয়েছে, যা মামলাকে দুর্বল করে দেয়।

আপস-মীমাংসা নিয়ে সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, যাঁরা মানব পাচারের শিকার হন, তাঁরা আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন। জীবন নিয়ে দেশে ফিরে আসার পর তাঁরা ক্ষতিপূরণ আদায়ের কৌশল হিসেবেই মামলার আশ্রয় নেন। এরপর তদন্ত চলা অবস্থাতেই আসামিপক্ষের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ নিয়ে মামলা পরিচালনা ছেড়ে দেন। তবে যে টাকার বিনিময়ে এই আপস হয়, সেটার অঙ্কও বড় নয়। মূলত মামলা চলার কিছুদিনের মধ্যে ধৈর্যহারা হয়ে এক-দুই লাখ টাকায় আপস করে ফেলেন ভুক্তভোগীরা।

এ বিষয়ে ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান আজকের পত্রিকাকে বলেন, সমস্যা হচ্ছে—যাঁরা প্রতারণার শিকার হন, মামলার পর সেই ভুক্তভোগীকেই সব জায়গায় দৌড়াতে হয়। এ জন্য তাঁরা কারও কাছ থেকে কোনো সহায়তা পান না, মামলা আদালতে ওঠার পর সাক্ষীও আনতে পারেন না। তদন্তকারীরাও মামলার পক্ষে প্রমাণ হাজির করতে পারেন না। এসব প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে অনবরত আপস করার জন্য চাপ দেওয়া হয় ভুক্তভোগীকে। এই পরিস্থিতি অনেকে আপস করে ফেলেন।

কয়েক শ মামলায় চূড়ান্ত রিপোর্ট

সিআইডি সূত্র বলছে, গত চার বছরে সারা দেশে মানব পাচারসংক্রান্ত মামলা হয়েছে ৩ হাজার ৩৩৫টি। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ২০২১ সালে—৯৬৫টি। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছে ১২ হাজার ২৭ জন আসামি। মামলাগুলো তদন্ত করতে গিয়ে আসামিদের সংশ্লিষ্টতার তথ্য ও প্রমাণ পেয়ে ২ হাজার ১৩৫টি মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। আর তথ্য-প্রমাণ না থাকায় কয়েক শ মামলায় চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে।

সাক্ষী আনা যখন চ্যালেঞ্জ

মানব পাচার মামলায় আসামি খালাস পাওয়ার অন্যতম কারণ আদালতে সাক্ষী হাজির করতে না পারা। সম্প্রতি পুলিশ বাদী হয়ে করা মানব পাচার মামলাতেও এই সমস্যা দেখা যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরের অপরাধ পর্যালোচনা সভাতেও।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপরাধ ও অপারেশন) আনোয়ার হোসেন (পদোন্নতিপ্রাপ্ত অতিরিক্ত আইজিপি) বলেন, ‘সাক্ষী হাজির করার জন্য আমাদের প্রসিকিউশন বিভাগে যোগাযোগ করা হয়। মামলায় যারা পুলিশ সাক্ষী, তারা আদালতে সাক্ষ্য দিতে হাজির হয়। সাধারণ মানুষ যেখানে সাক্ষী, সেখানে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য তাদের প্রতি সমন জারি করা হয়। এ ছাড়া কিছু সাক্ষী ভ্রাম্যমাণ থাকায় তাদের বিরুদ্ধে সমন জারি করার পরও খুঁজে পাওয়া যায় না।’

ময়নাতদন্তে ঝুলে আছে পাঁচ শতাধিক মামলা

মানব পাচার চক্রের খপ্পরে পড়ে ভূমধ্যসাগরে ডুবে প্রাণ হারিয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। অনেকে আবার পাচারকারীদের নির্যাতনেও মারা যান। মারা যাওয়া এই ব্যক্তিদের লাশ পর্যন্ত ফেরত পায় না পরিবার। এ ধরনের ঘটনায় স্বজনেরা মামলা করলে জটিলতা দেখা দেয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে। সিআইডি সূত্র বলছে, কয়েক বছর ধরে বিদেশে থাকা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষায় পাঁচ শতাধিক মামলা ঝুলে রয়েছে। কোনো কূলকিনারা না পেয়ে চাঞ্চল্যকর কয়েকটি মামলায় ওই প্রতিবেদন ছাড়াই অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না আজকের পত্রিকাকে বলেন, মানব পাচার মামলায় দেশে যে বিদ্যমান আইন রয়েছে, তার সঠিক বা কঠোর প্রয়োগ কখনো হয় না। এর পেছনে প্রথম কারণটি হলো—বিলম্বিত মামলা ও বিচার। পাঁচ বছর আগের ঘটনা পরে মামলা করলে সঠিক দিন-তারিখ মনে রাখা সম্ভব হয় না। বিবাদী সেই যুক্তিতে সেখানেই এগিয়ে যায়। দ্বিতীয়টি হলো বিচার হয় পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনেরও ওপর। কিন্তু মানব পাচারকারীরা এত প্রভাবশালী যে তদন্তকারী কর্মকর্তারা যেকোনোভাবে তাঁর পক্ষে চলে যান।

মানব পাচারের মামলা টেকানোর জন্য জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী বেশ কয়েকটি পরামর্শও দিয়েছেন। তা হলো—সঠিক সময়ে মামলা করা, পুলিশের তদন্তে সত্য তথ্য দেওয়া, বিবাদীর প্রভাবমুক্ত থাকা ও সাক্ষীদের হাজির করা। তাহলেই বিচার নিশ্চিত করা যেতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত