গবেষণা কেন্দ্রের সুফল দেখছেন না চিংড়িচাষিরা

রাশেদ নিজাম ও  সোহান শেখ, বাগেরহাট থেকে
প্রকাশ : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০: ৫০
আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০: ৫৫

দেশের একমাত্র চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য বলছে, ১২ বছরে ২০০টি প্রশিক্ষণে প্রায় সাড়ে আট হাজার ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাগেরহাটের তিন-চার উপজেলায় কয়েকটি ঘের ঘুরে এমন প্রশিক্ষণ পাওয়া কারও খোঁজ মিলল না। কেন্দ্রটির দাবি, তারা ১১টির মতো বিষয়ে গবেষণা করে নানা পর্যায়ে সাফল্য পেয়েছে। তবে চাষিরা বলছেন, এর সুফল তাঁদের ঘেরে নেই।

বাগেরহাটে ভৈরব নদের গা-ঘেঁষা বেমরতা ইউনিয়নের বৈটপুর গ্রামে এই চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্র। যাত্রা শুরু ২০১১ সালের ১৫ মার্চ। কিন্তু কেন্দ্র নিয়ে চাষিদের না আছে অভিযোগ আর ক্ষোভ। তবে কেন্দ্রটি বলছে জনবল, বাজেট ও স্থানসংকটের কথা। মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার (সিএসও) বদলে তিন বছর ধরে কেন্দ্র চলছে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (পিএসও) দিয়ে।

জেলা মৎস্য কার্যালয়ের ওয়েবসাইট বলছে, এই জনপদে সাদা সোনাখ্যাত বাগদা ও গলদা চিংড়ির ঘের আছে যথাক্রমে ৩৫ হাজার ৭৩৪ এবং ৪২ হাজার ৯৭৫টি। চিংড়ি চাষ হয় ৭২ হাজার হেক্টর জমিতে। এ ছাড়া ৩ হাজার ৩১১টি কাঁকড়া ঘের রয়েছে। ৩৫টি গ্রামে মৎস্যজীবীর সংখ্যা ৪০ হাজার।

চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য বলছে, চিংড়িতে সংক্রামক রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাব ও করণীয়, উন্নত চিংড়ি ও মৎস্য চাষ ব্যবস্থাপনা, উন্নত চিংড়ি চাষে মাটি ও পানির গুণাগুণ ব্যবস্থাপনা, তরুণ উদ্যোক্তাদের উন্নত চিংড়ি চাষবিষয়ক প্রশিক্ষণসহ ১২ বছরে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মশালা করেছে তারা।

তবে মাঠের চিত্র ভিন্ন। প্রায় দেড় যুগ ধরে সদর উপজেলার রাধাবল্লভে ১৩ একরের তিনটি ঘেরে চিংড়ি চাষ করছেন আল আমিন খান সুমন। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘গবেষণা কেন্দ্র নিয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। চিংড়ি চাষে নানা সমস্যায় পড়লেও প্রতিকার পাচ্ছি না।’

চিতলমারী উপজেলার দেবাশীষ বিশ্বাস বলেন, চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্রের কথা শুনেছেন। তবে চাষি হিসেবে উপজেলা মৎস্য অফিসের লোক ছাড়া সরকারি অন্য কোনো লোককে তাঁরা দেখেননি।

ফকিরহাট উপজেলার বারাশিয়া গ্রামের চিংড়িচাষি এস কে এম মনিরুজ্জামানের মোল্লাহাট উপজেলার কেন্দুয়া বিলে ঘের রয়েছে। তিনিও জানান, ১০ বছরে তিনি কোনো প্রশিক্ষণ পাননি। তাঁর জানামতে, ওই এলাকারও কেউ পায়নি। 

এ বিষয়ে চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্র বলছে, সরাসরি কৃষকের সঙ্গে কেন্দ্রের কোনো কাজ নেই। মৎস্য ইনস্টিটিউট থেকে তালিকার পরেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মাঝেমধ্যে কর্মশালাও করা হয়। ইনস্টিটিউট থেকে পাঠানো বিভিন্ন চিংড়ি, পানি, মাটিসহ নানা বিষয়ে পরীক্ষা করে সেখানেই প্রতিবেদন পাঠানো হয়।

এক যুগে যেসব গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এইচ এম রাকিবুল ইসলাম বলেন, ১২ বছরে ১১টির মতো বিষয়ে গবেষণা করে নানা পর্যায়ে সাফল্য পেয়েছেন তাঁরা। সর্বাগ্রে আছে পিসিআর পদ্ধতিতে বাগদা ও গলদা চিংড়ির রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু শনাক্ত এবং শতভাগ রোগ নিরূপণ সক্ষমতা অর্জন।

কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. হারুনুর রশিদ বলেন, ‘চিংড়ির রোগ সৃষ্টিকারী ১১টি জীবাণুই শনাক্ত করা হয়েছে। চলমান গবেষণাগুলোর ফলাফল এলে চিংড়ির মৃত্যুহার কমানো এবং উৎপাদন বাড়ানোতে সেসব সহায়ক হবে।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সিএসও পদের কর্মকর্তাই ছিলেন কেন্দ্রের প্রধান। বর্তমানে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (ডিজি) ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান ছিলেন। ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাই (পিএসও) কেন্দ্রের প্রধান। বর্তমান প্রধানও ভারপ্রাপ্ত। মোট জনবলের মধ্যে পদ ফাঁকা রয়েছে তিনটি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা মৎস্য সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, চিংড়িশিল্পের উন্নয়নে তাঁদের তেমন কোনো প্রায়োগিক গবেষণা নেই। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে আট মাসের বেশি সময় মৎস্য ঘেরে পানি কম থাকে। কম পানিতে ও অতিরিক্ত তাপমাত্রায় কীভাবে চিংড়ি চাষ করা যায়, সে বিষয়ে গবেষণা কোথায়? 
বাগেরহাট জেলা চিংড়ি চাষি সমিতির সভাপতি ফকির মুহিতুর রহমান সুমন বলেন, চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্র অন্যান্য বিষয় নিয়ে বেশি গবেষণা করে। এই অঞ্চলে চিংড়ি উৎপাদন কীভাবে বৃদ্ধি পাবে এবং চাষিরা কীভাবে লাভবান হবেন, এই গবেষণা প্রয়োজন।

মৎস্য সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জেলায় চিংড়ি (গলদা, বাগদা, হরিণা, চামিসহ) উৎপাদন ছিল ৩৩ হাজার ১৯২ দশমিক ৬৩ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়ে হয়েছে ৪০ হাজার টন। তবে অভিযোগ আছে, নিজের দায়িত্ব পালনকালে উৎপাদন বৃদ্ধি প্রমাণ করতে জেলা মৎস্য কর্মকর্তারা আগের বছরের চেয়ে বাড়িয়ে দেখান। যার কিছুটা আভাস মেলে রপ্তানির তথ্যে।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৫ হাজার ৫৩০ টন চিংড়ি রপ্তানি হয়। পরের বছরগুলোতে যথাক্রমে ২৪ হাজার ৪১৩, ২৩ হাজার ৬৮, ২৩ হাজার ৩৬৭ এবং সবশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৪ হাজার ১০৪ টন চিংড়ি রপ্তানি হয়।

চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্রের বিষয়ে প্রত্যাশিত সাফল্য আসতে আরও সময় লাগবে বলে জানান বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, এক যুগে চিংড়ির উন্নয়নে অনেক কাজ হয়েছে। তবে আরও অনেক কাজ বাকি। লোকবলও কম।

গবেষণা বরাদ্দ আগের তুলনায় বেড়েছে উল্লেখ করে ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, ‘চাষিরা যেসব অভিযোগ করছেন, তা কেন্দ্রের ওপর চাপালে হবে না। আমরা প্রযুক্তিগুলো তাঁদের ঘেরে সরাসরি দিতে পারি না। তাঁরা প্রশিক্ষণ নেন, কিন্তু পরামর্শ শোনেন না। নিজেদের মতো করে চাষ করেন। রাতারাতি তো আর সব সমস্যা সমাধান করা যাবে না। আমরা চেষ্টা করছি। আরও কিছু সময় লাগবে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত