অরুণ কর্মকার
আজকের পত্রিকার এই উপসম্পাদকীয় কলামে ‘বাংলাদেশে ভূমিকম্প-বিতর্ক বনাম গবেষণার ভুল-শুদ্ধ’ শিরোনামে আমার একটি নিবন্ধ ১৫ মে প্রকাশিত হয়েছে। পরদিন মঙ্গলবার অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘এবি নিউজ ২৪ বিডি ডট কম’-এ কিছুটা সংশোধিত আকারে একই শিরোনামে নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়। এরপরের কয়েক দিনে দেশের এবং প্রবাসের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন ভূ-বিজ্ঞানী ও গবেষকের কাছ থেকে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য মন্তব্য আমার কাছে এসেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি সম্পর্কে আরও কিছু কথা বলার প্রয়োজনবোধ থেকে আজকের নিবন্ধের অবতারণা।
প্রকাশিত সেই নিবন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক মাইকেল স্টেকলার এবং তাঁর গবেষক দলের এক গবেষণা প্রতিবেদনে একটি বিশেষ আবিষ্কারের কথা উল্লেখ করেছিলাম। ২০১৬ সালে তাঁদের প্রকাশিত সেই গবেষণা প্রতিবেদনে ঢাকার তলদেশ দিয়ে প্রায় মিয়ানমার পর্যন্ত বিস্তৃত একটি অভিন্ন ভূ-চ্যুতিরেখা (মেগা থ্রাস্ট) টেনে বলা হয়, এটি ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার একটি প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের উৎস হবে। সেই ভূমিকম্প বাংলাদেশের বিস্তৃত এলাকায় প্রলয় ঘটাবে। ঢাকার ভূস্তর কাদামাটিতে পরিণত হবে। ঢাকায় কোনো স্থাপনা কিংবা মানুষজনের অস্তিত্ব থাকবে না।
মাইকেল স্টেকলার ও তাঁর গবেষক দলের এই আবিষ্কার এ দেশের গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিত হয়। ফলে মানুষ যারপরনাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এটি এমন একসময় প্রকাশিত হয় যার কাছাকাছি সময়ে ঢাকায় বিনিয়োগ সম্মেলন (বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড পলিসি সামিট) অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনের লক্ষ্য ছিল দেশি-বিদেশি বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ আকর্ষণ। যেখানে এত বড় বিপর্যয়কর ভূমিকম্পের আশঙ্কা, সেখানে বিনিয়োগকারীরা যে শিগগিরই আসতে চাইবেন না, তা প্রায় নিশ্চিত। আর আসতে চাইলেও যেসব ক্ষেত্রে বা প্রকল্পে তাঁরা বিনিয়োগ করবেন তার ব্যয় হবে অনেক বেশি।
অনেকেই ধারণা করছেন, অত্যন্ত সীমিতসংখ্যক তথ্য-উপাত্তের (ডেটা) ভিত্তিতে মাইকেল স্টেকলার ও তাঁর গবেষক দল অনেকটা তড়িঘড়ি করে এত বড় একটা প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের যে আশঙ্কা প্রকাশক করেছে, তার পেছনে বাংলাদেশে বিনিয়োগ বিঘ্নিত করার উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের দিক থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। তবে দেশে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির ঘটনাটি ঠিকই ঘটে গেছে। এখন প্রকৌশলীরা কোনো বড় স্থাপনা করার ক্ষেত্রে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীলতার কম আর ভাবেন না। তাতে প্রকল্পের ব্যয় অনেকটাই বৃদ্ধি পায়।
আমাদের দেশের এবং প্রবাসের অগ্রগণ্য ভূ-বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা মাইকেল স্টেকলারের ওই আবিষ্কারকে (মেগা থ্রাস্ট) শুরু থেকেই অলীক বলে উল্লেখ করে এসেছেন। কিন্তু গণমাধ্যম ঢাকার ভূস্তর ভূমিকম্পের ফলে কাদামাটিতে পরিণত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে এতটাই আলোড়িত ছিল যে অন্য কোনো ব্যাখ্যা বা বক্তব্য আর সেখানে স্থান করে নেওয়ার তেমন সুযোগই পায়নি। কিন্তু বিজ্ঞানীরা নিজেদের মধ্যে এবং মাইকেল স্টেকলারের সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে কথাবার্তা, মতবিনিময় চালিয়ে গেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগ স্টেকলারের গবেষণার বিষয়ে একটি সেমিনারও করেছিল। কোনো পর্যায়েই স্টেকলারের আবিষ্কৃত মেগা থ্রাস্টের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়নি। এসব খবরাখবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে খুবই কম।
ইতিমধ্যে মাইকেল স্টেকলার ও তাঁর গবেষক দল তাঁদের গবেষণার ফলাফলে কিছুটা সংশোধনী এনেছেন। তাতে তাঁদের চিত্রিত মেগা থ্রাস্ট থেকে সৃষ্ট ভূমিকম্পের সর্বোচ্চ মাত্রা রিখটার স্কেলে ৯-এর পরিবর্তে সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ২ করা হয়েছে। এরই প্রেক্ষাপটে আজকের পত্রিকার এই কলাম এবং এবি নিউজে নিবন্ধ প্রকাশের পর ভূ-বিজ্ঞানীরা আবারও কিছু মন্তব্য করেছেন, যা এখানে উল্লেখযোগ্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের প্রবীণ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বলেছেন, অধিকাংশ ভূ-বিজ্ঞানী মনে করেন বাংলাদেশের সমভূমির (বেঙ্গল প্লেইন) তলদেশে মেগা থ্রাস্ট্রের কোনো অস্তিত্ব নেই। এ রকম একটি মেগা থ্রাস্টের কল্পিত ও অনুমাননির্ভর তত্ত্ব গণমাধ্যমে প্রকাশ করা উচিত নয়। এ ধরনের বিষয়ের প্রকাশ কেবল আতঙ্ক ছড়াবে এবং উন্নয়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করবে।
দেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ভূতত্ত্ববিদদের একজন হচ্ছেন আবিদ লোদী। বর্তমানে কনসালট্যান্ট পেট্রোলিয়াম ভূতত্ত্ববিদ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত। বিতর্কিত মেগা থ্রাস্ট-সম্পর্কে তাঁর একটি বক্তব্য অধ্যাপক বদরূল ইমামের মাধ্যমে আমার হাতে এসেছে। পাঠকদের জন্য সেটি এখানে হুবহু উল্লেখ করছি। আবিদ লোদী বলেন, ‘...জেনে থাকবেন যে ভূ-ত্বকের শিলা স্তরের ফল্ট (fault) থেকেই ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়। আলোচিত মেগা থ্রাস্ট ফল্ট (megathrust fault), যা বাংলাদেশের উত্তরে শিলং পাহাড় থেকে সুনামগঞ্জ বা কিশোরগঞ্জের হাওর হয়ে মেঘনা নদী বরাবর ঢাকার নিচ দিয়ে চট্টগ্রামের উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত বলে দাবি করা হচ্ছে। গত প্রায় ৩০ বছরের কর্মজীবনে, যার সিংহভাগই বেঙ্গল বেসিনের শিলা বিন্ন্যাস ও গঠন নিয়ে অতিবাহিত, এমন একটি দাবিকৃত বিশালকায় ফল্টের অস্তিত্ব খুঁজে পাইনি। এমনকি অপরাপর কোনো ভূতত্ত্ববিদ বাংলাদেশের ভেতরে এরূপ একটি বিশালকায় ফল্টের উপস্থিতির প্রমাণ দেননি। বাংলাদেশের উত্তরে অবস্থিত ডাউকি ফল্ট (Dauki Fault) এবং দক্ষিণের সমুদ্রপ্রান্তিক ফল্টের (Coastal Fault) উপস্থিতি নিয়ে ভূবিজ্ঞানীদের মধ্যে তেমন কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু কল্পিত ও অপ্রমাণিত এবং অনেকটা সন্দেহমূলক এই বিস্তৃত মেগা থ্রাস্ট ফল্ট, যা ঢাকার নিচ দিয়ে চলে গেছে বলে দাবি করা হচ্ছে, তা নিয়েই যত বিভ্রান্তি। কল্পিত এই মেগা থ্রাস্ট ফল্ট বেঙ্গল বেসিনের প্রতিষ্ঠিত ভূতাত্ত্বিক গঠনের ও ক্রমবিকাশের সঙ্গেও অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয়। আমার জানামতে, ভিন্নমতাবলম্বীদের সন্দেহ এই যে কল্পিত ও অপ্রমাণিত এই মেগা থ্রাস্ট ফল্টের ওপর ভিত্তি করে অতি উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের ভবিষ্যদ্বাণী করা বিজ্ঞানসম্মত না। গবেষণার পরিমণ্ডলে এই মেগা থ্রাস্ট ও তার সঙ্গে সম্পৃক্ত উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের তত্ত্ব সীমাবদ্ধ থাকাটাই সমীচীন। কিন্তু একটি কাল্পনিক তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে এভাবে অতি উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের আতঙ্ক ছড়ানো সমীচীন হয়নি বলে অনেকেই মনে করেন।’
‘বিভিন্ন গণ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভূমিকম্পের এই অনাকাঙ্ক্ষিত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় বিদেশি বিনিয়োগে ভাটা পড়ার যে আশঙ্কা আপনি ব্যক্ত করেছেন, তা উদ্বেগজনক। এই ভীতিকর ও হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দেশের নীতিনির্ধারকেরা বহুল প্রচারিত মেগা থ্রাস্ট তত্ত্বের ভূ-বৈজ্ঞানিক যথার্থতা নিরূপণে অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ ভূতত্ত্ববিদগণের পরামর্শ নিতে পারেন।’
অধ্যাপক হোসেন মনসুর দেশের আরেকজন প্রবীণ ভূতত্ত্ববিদ। নিজের ফেসবুক পেজে তিনি লিখেছেন, ‘ভূমিকম্প কখন, কোথায় এবং কী মাত্রায় হবে, সে বিষয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেও এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ একটি বিশেষ মহল শিগগিরই ঢাকা মহানগরীতে ৮-৯ মাত্রার ভূমিকম্প হবে বলে সাধারণ জনগণ ও দেশি-বিদেশি শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি ও নিরুৎসাহিত করছেন এবং দেশের উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি করছেন। কল্পনাপ্রসূত এমন তথ্য পরিবেশনকারীদের সম্মুখ বিচারের আওতায় আনা উচিত বলে আমি মনে করি।’
বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের (জিএসবি) সাবেক পরিচালক মীর ফজলুল করিম বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত। মাইকেল স্টেকলারের গবেষণালব্ধ ফল সম্পর্কে প্রকাশ্যে এবং সরাসরি তিনিই প্রথম চ্যালেঞ্জ করেন। তিনি বিষয়টি নিয়ে স্টেকলারের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনাও করে চলেছেন। কিছুদিন আগে মেগা থ্রাস্টের বিষয়টি নিয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগে আয়োজিত একটি সেমিনারে উপস্থাপনা দিয়েছেন। ২২ মে জিএসবিতে আয়োজিত একটি সেমিনারেও তিনি একই বিষয়ে উপস্থাপনা দেবেন।
জিএসবির সাবেক পরিচালক মো. আসাদুজ্জামান ছাড়াও খুরশীদ আলম, খায়রুল আলমসহ আরও অনেক ভূতত্ত্ববিদ স্টেকলারের গবেষণাকে ত্রুটিপূর্ণ বলে মনে করেন। তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে আমার সরাসরি আলোচনা হয়েছে।
অরুণ কর্মকার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
আজকের পত্রিকার এই উপসম্পাদকীয় কলামে ‘বাংলাদেশে ভূমিকম্প-বিতর্ক বনাম গবেষণার ভুল-শুদ্ধ’ শিরোনামে আমার একটি নিবন্ধ ১৫ মে প্রকাশিত হয়েছে। পরদিন মঙ্গলবার অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘এবি নিউজ ২৪ বিডি ডট কম’-এ কিছুটা সংশোধিত আকারে একই শিরোনামে নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়। এরপরের কয়েক দিনে দেশের এবং প্রবাসের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন ভূ-বিজ্ঞানী ও গবেষকের কাছ থেকে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য মন্তব্য আমার কাছে এসেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি সম্পর্কে আরও কিছু কথা বলার প্রয়োজনবোধ থেকে আজকের নিবন্ধের অবতারণা।
প্রকাশিত সেই নিবন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক মাইকেল স্টেকলার এবং তাঁর গবেষক দলের এক গবেষণা প্রতিবেদনে একটি বিশেষ আবিষ্কারের কথা উল্লেখ করেছিলাম। ২০১৬ সালে তাঁদের প্রকাশিত সেই গবেষণা প্রতিবেদনে ঢাকার তলদেশ দিয়ে প্রায় মিয়ানমার পর্যন্ত বিস্তৃত একটি অভিন্ন ভূ-চ্যুতিরেখা (মেগা থ্রাস্ট) টেনে বলা হয়, এটি ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার একটি প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের উৎস হবে। সেই ভূমিকম্প বাংলাদেশের বিস্তৃত এলাকায় প্রলয় ঘটাবে। ঢাকার ভূস্তর কাদামাটিতে পরিণত হবে। ঢাকায় কোনো স্থাপনা কিংবা মানুষজনের অস্তিত্ব থাকবে না।
মাইকেল স্টেকলার ও তাঁর গবেষক দলের এই আবিষ্কার এ দেশের গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিত হয়। ফলে মানুষ যারপরনাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এটি এমন একসময় প্রকাশিত হয় যার কাছাকাছি সময়ে ঢাকায় বিনিয়োগ সম্মেলন (বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড পলিসি সামিট) অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনের লক্ষ্য ছিল দেশি-বিদেশি বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ আকর্ষণ। যেখানে এত বড় বিপর্যয়কর ভূমিকম্পের আশঙ্কা, সেখানে বিনিয়োগকারীরা যে শিগগিরই আসতে চাইবেন না, তা প্রায় নিশ্চিত। আর আসতে চাইলেও যেসব ক্ষেত্রে বা প্রকল্পে তাঁরা বিনিয়োগ করবেন তার ব্যয় হবে অনেক বেশি।
অনেকেই ধারণা করছেন, অত্যন্ত সীমিতসংখ্যক তথ্য-উপাত্তের (ডেটা) ভিত্তিতে মাইকেল স্টেকলার ও তাঁর গবেষক দল অনেকটা তড়িঘড়ি করে এত বড় একটা প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের যে আশঙ্কা প্রকাশক করেছে, তার পেছনে বাংলাদেশে বিনিয়োগ বিঘ্নিত করার উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের দিক থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। তবে দেশে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির ঘটনাটি ঠিকই ঘটে গেছে। এখন প্রকৌশলীরা কোনো বড় স্থাপনা করার ক্ষেত্রে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীলতার কম আর ভাবেন না। তাতে প্রকল্পের ব্যয় অনেকটাই বৃদ্ধি পায়।
আমাদের দেশের এবং প্রবাসের অগ্রগণ্য ভূ-বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা মাইকেল স্টেকলারের ওই আবিষ্কারকে (মেগা থ্রাস্ট) শুরু থেকেই অলীক বলে উল্লেখ করে এসেছেন। কিন্তু গণমাধ্যম ঢাকার ভূস্তর ভূমিকম্পের ফলে কাদামাটিতে পরিণত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে এতটাই আলোড়িত ছিল যে অন্য কোনো ব্যাখ্যা বা বক্তব্য আর সেখানে স্থান করে নেওয়ার তেমন সুযোগই পায়নি। কিন্তু বিজ্ঞানীরা নিজেদের মধ্যে এবং মাইকেল স্টেকলারের সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে কথাবার্তা, মতবিনিময় চালিয়ে গেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগ স্টেকলারের গবেষণার বিষয়ে একটি সেমিনারও করেছিল। কোনো পর্যায়েই স্টেকলারের আবিষ্কৃত মেগা থ্রাস্টের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়নি। এসব খবরাখবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে খুবই কম।
ইতিমধ্যে মাইকেল স্টেকলার ও তাঁর গবেষক দল তাঁদের গবেষণার ফলাফলে কিছুটা সংশোধনী এনেছেন। তাতে তাঁদের চিত্রিত মেগা থ্রাস্ট থেকে সৃষ্ট ভূমিকম্পের সর্বোচ্চ মাত্রা রিখটার স্কেলে ৯-এর পরিবর্তে সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ২ করা হয়েছে। এরই প্রেক্ষাপটে আজকের পত্রিকার এই কলাম এবং এবি নিউজে নিবন্ধ প্রকাশের পর ভূ-বিজ্ঞানীরা আবারও কিছু মন্তব্য করেছেন, যা এখানে উল্লেখযোগ্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের প্রবীণ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বলেছেন, অধিকাংশ ভূ-বিজ্ঞানী মনে করেন বাংলাদেশের সমভূমির (বেঙ্গল প্লেইন) তলদেশে মেগা থ্রাস্ট্রের কোনো অস্তিত্ব নেই। এ রকম একটি মেগা থ্রাস্টের কল্পিত ও অনুমাননির্ভর তত্ত্ব গণমাধ্যমে প্রকাশ করা উচিত নয়। এ ধরনের বিষয়ের প্রকাশ কেবল আতঙ্ক ছড়াবে এবং উন্নয়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করবে।
দেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ভূতত্ত্ববিদদের একজন হচ্ছেন আবিদ লোদী। বর্তমানে কনসালট্যান্ট পেট্রোলিয়াম ভূতত্ত্ববিদ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত। বিতর্কিত মেগা থ্রাস্ট-সম্পর্কে তাঁর একটি বক্তব্য অধ্যাপক বদরূল ইমামের মাধ্যমে আমার হাতে এসেছে। পাঠকদের জন্য সেটি এখানে হুবহু উল্লেখ করছি। আবিদ লোদী বলেন, ‘...জেনে থাকবেন যে ভূ-ত্বকের শিলা স্তরের ফল্ট (fault) থেকেই ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়। আলোচিত মেগা থ্রাস্ট ফল্ট (megathrust fault), যা বাংলাদেশের উত্তরে শিলং পাহাড় থেকে সুনামগঞ্জ বা কিশোরগঞ্জের হাওর হয়ে মেঘনা নদী বরাবর ঢাকার নিচ দিয়ে চট্টগ্রামের উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত বলে দাবি করা হচ্ছে। গত প্রায় ৩০ বছরের কর্মজীবনে, যার সিংহভাগই বেঙ্গল বেসিনের শিলা বিন্ন্যাস ও গঠন নিয়ে অতিবাহিত, এমন একটি দাবিকৃত বিশালকায় ফল্টের অস্তিত্ব খুঁজে পাইনি। এমনকি অপরাপর কোনো ভূতত্ত্ববিদ বাংলাদেশের ভেতরে এরূপ একটি বিশালকায় ফল্টের উপস্থিতির প্রমাণ দেননি। বাংলাদেশের উত্তরে অবস্থিত ডাউকি ফল্ট (Dauki Fault) এবং দক্ষিণের সমুদ্রপ্রান্তিক ফল্টের (Coastal Fault) উপস্থিতি নিয়ে ভূবিজ্ঞানীদের মধ্যে তেমন কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু কল্পিত ও অপ্রমাণিত এবং অনেকটা সন্দেহমূলক এই বিস্তৃত মেগা থ্রাস্ট ফল্ট, যা ঢাকার নিচ দিয়ে চলে গেছে বলে দাবি করা হচ্ছে, তা নিয়েই যত বিভ্রান্তি। কল্পিত এই মেগা থ্রাস্ট ফল্ট বেঙ্গল বেসিনের প্রতিষ্ঠিত ভূতাত্ত্বিক গঠনের ও ক্রমবিকাশের সঙ্গেও অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয়। আমার জানামতে, ভিন্নমতাবলম্বীদের সন্দেহ এই যে কল্পিত ও অপ্রমাণিত এই মেগা থ্রাস্ট ফল্টের ওপর ভিত্তি করে অতি উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের ভবিষ্যদ্বাণী করা বিজ্ঞানসম্মত না। গবেষণার পরিমণ্ডলে এই মেগা থ্রাস্ট ও তার সঙ্গে সম্পৃক্ত উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের তত্ত্ব সীমাবদ্ধ থাকাটাই সমীচীন। কিন্তু একটি কাল্পনিক তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে এভাবে অতি উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের আতঙ্ক ছড়ানো সমীচীন হয়নি বলে অনেকেই মনে করেন।’
‘বিভিন্ন গণ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভূমিকম্পের এই অনাকাঙ্ক্ষিত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় বিদেশি বিনিয়োগে ভাটা পড়ার যে আশঙ্কা আপনি ব্যক্ত করেছেন, তা উদ্বেগজনক। এই ভীতিকর ও হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দেশের নীতিনির্ধারকেরা বহুল প্রচারিত মেগা থ্রাস্ট তত্ত্বের ভূ-বৈজ্ঞানিক যথার্থতা নিরূপণে অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ ভূতত্ত্ববিদগণের পরামর্শ নিতে পারেন।’
অধ্যাপক হোসেন মনসুর দেশের আরেকজন প্রবীণ ভূতত্ত্ববিদ। নিজের ফেসবুক পেজে তিনি লিখেছেন, ‘ভূমিকম্প কখন, কোথায় এবং কী মাত্রায় হবে, সে বিষয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেও এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ একটি বিশেষ মহল শিগগিরই ঢাকা মহানগরীতে ৮-৯ মাত্রার ভূমিকম্প হবে বলে সাধারণ জনগণ ও দেশি-বিদেশি শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি ও নিরুৎসাহিত করছেন এবং দেশের উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি করছেন। কল্পনাপ্রসূত এমন তথ্য পরিবেশনকারীদের সম্মুখ বিচারের আওতায় আনা উচিত বলে আমি মনে করি।’
বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের (জিএসবি) সাবেক পরিচালক মীর ফজলুল করিম বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত। মাইকেল স্টেকলারের গবেষণালব্ধ ফল সম্পর্কে প্রকাশ্যে এবং সরাসরি তিনিই প্রথম চ্যালেঞ্জ করেন। তিনি বিষয়টি নিয়ে স্টেকলারের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনাও করে চলেছেন। কিছুদিন আগে মেগা থ্রাস্টের বিষয়টি নিয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগে আয়োজিত একটি সেমিনারে উপস্থাপনা দিয়েছেন। ২২ মে জিএসবিতে আয়োজিত একটি সেমিনারেও তিনি একই বিষয়ে উপস্থাপনা দেবেন।
জিএসবির সাবেক পরিচালক মো. আসাদুজ্জামান ছাড়াও খুরশীদ আলম, খায়রুল আলমসহ আরও অনেক ভূতত্ত্ববিদ স্টেকলারের গবেষণাকে ত্রুটিপূর্ণ বলে মনে করেন। তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে আমার সরাসরি আলোচনা হয়েছে।
অরুণ কর্মকার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে