মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
আগামী নির্বাচনে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ নিয়ে বিরোধিতা ও বিতর্ক লক্ষ করা যাচ্ছে। যাঁরা এই বিতর্ক ও বিরোধিতায় অংশ নিচ্ছেন, তাঁদের প্রায় সবাই ইভিএম বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন। অল্প কিছুসংখ্যক কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ নির্বাচন কমিশনের ব্যবহৃত ইভিএমে কিছু ত্রুটি আছে বলে দাবি করছেন। অন্যদিকে যাঁরা এই ইভিএম তৈরি ও পর্যবেক্ষণ করেছেন, তেমন অনেক বিশেষজ্ঞ এই ইভিএমকে প্রায় ত্রুটিমুক্ত বলে অভিহিত করেছেন। অল্প কিছুসংখ্যক বিশেষজ্ঞ আঙুলের ছাপ মেলানোর ক্ষেত্রে ১ শতাংশ ভোটারের ভোটদানে সমস্যার কথা জানিয়েছেন। সে কারণে নির্বাচন কমিশন সেই সব ভোটারের ভোট গ্রহণের ব্যাপারে বিকল্প চিন্তা করছে বলে জানা গেছে।
ইভিএম নিয়ে সামগ্রিকভাবে বিএনপি ও এর জোট সদস্য দলগুলো বিরোধিতা করে আসছে। তারা নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টিকে কারচুপির আয়োজন বলে অভিহিত করছে। সুজনসহ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা ইভিএমের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তবে এটিও বিশেষজ্ঞদের ইভিএম যাচাই-বাছাইয়ের অভিজ্ঞতার ফলাফল কি না, তা স্পষ্ট নয়। অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও ১৪ দল নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সপক্ষে তাদের যুক্তি তুলে ধরে বলেছে, একদিকে প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে ভোট গ্রহণ ও ফলাফল প্রদানে সময় ও ঝামেলা কমে যাবে, অন্যদিকে ব্যালট পেপারে ভোট গ্রহণ ও ফলাফলে যথেষ্ট সময় ও ঝুঁকি রয়েছে, ব্যালট পেপারের অতীত অভিজ্ঞতাও ভালো নয়।
ইভিএম বিশেষ প্রযুক্তি, যা নিজে কাউকে নির্বাচনে জিতিয়ে আনতে কিংবা পরাজিত হতে ভূমিকা রাখে না। তবে আমাদের দেশে উদ্ভাবিত ইভিএম যদি শতভাগের কাছাকাছি ত্রুটিমুক্ত রাখার নিশ্চয়তা দিতে পারে, তাহলে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নির্বাচন করা অনেক বেশি শ্রেয় হতে পারে। কিন্তু সেটি অংশীজনদের আস্থা অর্জনের মাধ্যমেই কেবল হতে পারে। আস্থা অর্জনের জন্য প্রয়োজন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ইভিএম প্রযুক্তির সব কারিগরি দিক যাচাই-বাছাই করে নেওয়া। ১ শতাংশের নিচে ত্রুটিও সারিয়ে তোলার যদি সুযোগ থাকে, তাহলে সেই উদ্যোগ নেওয়া দরকার। সেটি না করা গেলে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে অংশীজনদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হলে নির্বাচন কমিশন বিবেচনায় নিতে পারে।
কিন্তু বাংলাদেশে ইভিএম নিয়ে যে ধরনের বিতর্ক চলছে, তাকে বিতর্ক না বলে বিরোধিতা এবং রাজনৈতিক মল্লযুদ্ধের কোনো কৌশল কি না, তেমন প্রশ্ন করা যেতেই পারে। ইভিএম একটি উচ্চতর প্রযুক্তি, যার সম্পর্কে একমাত্র এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দ্বারা মতামত রাখার বিষয়। তাদের বাইরে গিয়ে আমরা যাঁরা ননটেকনিক্যাল, তাঁদের এ বিষয়ে মতামত দেওয়া, বিতর্কে জড়িয়ে পড়া, পক্ষে বা বিপক্ষে মত দেওয়া, বিরোধিতা করা কিংবা পক্ষে অবস্থান নেওয়া মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়। এটি চূড়ান্তভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই করে টেকনিক্যাল ব্যক্তিরাই এর পক্ষে বা বিপক্ষে চূড়ান্ত মতামত দিতে পারেন। যদি টেকনিক্যাল ব্যক্তিরা এর পক্ষে মতামত দেন, তাহলে এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত করা উচিত নয়। সেটি নির্বাচন কমিশন সব অংশীজনকে জানাতে পারে; তাহলেই ইভিএম সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
কিন্তু এ পর্যন্ত ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক রশি টানাটানি বেশি হচ্ছে। একপক্ষ সর্বশক্তি দিয়ে ইভিএমের বিরোধিতা করছে; অপরপক্ষ নির্বাচন কমিশন যতসংখ্যক আসনে ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন করা সম্ভব হবে, তাতে তাদের কোনো আপত্তি থাকবে না। অর্থাৎ, ইভিএম ও ব্যালট পেপার উভয় পন্থায়ই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনের অবস্থানের পক্ষে তাদের মত দিয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশন যদি সব আসনে ব্যালট পেপারের মাধ্যমে নির্বাচন গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিত, তাহলে বিএনপি কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক দল সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিত কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
কারণ, তাদের আরও অনেক দাবি আছে, যেগুলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের রাজনৈতিকভাবে মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত আগামী নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ কিংবা অংশগ্রহণবিহীন অবস্থান হবে কি না, সেটিও এখনো অনিশ্চিত। কিন্তু ইভিএম নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, তা আগামী নির্বাচনে বিরোধিতাকারীদের অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে আদৌ কোনো ভূমিকা রাখবে কি না, সেটিও এখনো বলা যাচ্ছে না। অথচ বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজের একটি অংশ ইভিএম নিয়ে যার যার অবস্থান থেকে কথা বলেই যাচ্ছে। তাদের এই বক্তব্য অনেকটাই যুক্তিকে অগ্রাহ্য করেও বলা হচ্ছে। ফলে নাগরিক সমাজের বক্তব্যও রাজনৈতিকভাবে ইভিএমের বিরোধিতাকারীদের অবস্থানের সঙ্গে একাকার হচ্ছে। এ কারণে অনেকেই তাদের সন্দেহ এবং অবিশ্বাস করছে। এর দায় তাদেরই নিতে হবে।
নাগরিক সমাজের সবারই অবস্থান ইভিএমের ত্রুটিহীনতা ও ত্রুটির সম্ভাব্যতা সম্পর্কে প্রযুক্তিবিদদের মতামত কিংবা পরামর্শ শোনা এবং তার ভিত্তিতে বক্তব্য দেওয়া। কিন্তু কোনো কোনো নাগরিক সংগঠনের কর্তাব্যক্তিরা নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে যেসব কথা বলেন, তা কখনো কখনো শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সে কারণে ইভিএম নিয়ে অবিশেষজ্ঞ যেকোনো ব্যক্তি ও সংগঠনের বক্তব্য, বিবৃতি ও লেখালেখি দেশে বিভ্রান্তি ছড়াতে বেশি ভূমিকা রাখছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের প্রতিবারের নির্বাচন উপলক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে এমন কারও কারও মতামত শুনতে হয়, যা শেষ বিচারে খুব কমই গুরুত্ব পায়।
আমাদের নিকট অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিভিন্ন উপনির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বর্তমান কমিশনের অধীন ৩১ জুলাই ২০২২ পর্যন্ত ২৩১টি নির্বাচন ইভিএমে সম্পন্ন হয়েছে। ২০১২ ও ২০১৭ সালের কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন ইভিএমের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সব নির্বাচনে কোনো ধরনের কারচুপির অভিযোগ ওঠেনি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিরোধী প্রার্থীরা বিজয়ীও হয়েছেন। ফলে ইভিএম নিয়ে বিতর্ক যাঁরা করছেন, তাঁদের বিরোধিতার যৌক্তিকতা স্পষ্ট নয়। বিগত নির্বাচন কমিশনগুলো যেসব ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচনের আয়োজন করেছেন, সেগুলোর চেয়ে সর্বশেষ ইভিএম নির্বাচন কমিশন বিশেষজ্ঞদের যাচাই-বাছাইয়ের জন্য উপস্থাপন করেছে। বিশেষজ্ঞরা প্রয়োজনে সেগুলো আরও যাচাই-বাছাই করে দেখতে পারেন।
আমাদের জানামতে, জাতীয় সংসদের প্রায় ৭৫টি নির্বাচনী আসনে ভোট নেওয়ার মতো উচ্চতর প্রযুক্তিসম্পন্ন ইভিএম এখন নির্বাচন কমিশনের হাতে আছে। নির্বাচন কমিশন মোট দেড় শ আসনের নির্বাচন ইভিএমে করার জন্য যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, সেটার জন্য আরও ৭৫টি আসনের ইভিএম কেনার প্রয়োজন হবে। এর জন্য ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। এই অর্থ বরাদ্দের জন্য নির্বাচন কমিশনের সুপারিশের কথা শুনে অনেকেই ইভিএম থেকে সরে যাওয়ার দাবি করছেন, কিন্তু ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচন করতে গেলে নির্বাচন কমিশনের মোট বাজেট কত হতে পারে, সেটি বোধ হয় জানা দরকার ছিল। সম্ভবত নির্বাচনী ব্যালট পেপার, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, সিল, লোকবল ইত্যাদি মিলিয়ে খরচ অনেক বেশি হতে পারে। তার পরও ইভিএম নিয়ে যদি কোনো ত্রুটি থাকে, তাহলে ভিন্ন কথা।
কিন্তু ত্রুটি না থাকলে কিংবা ত্রুটি সারিয়ে শতভাগ ভোটারের ত্রুটিমুক্ত ভোটদান নিশ্চিত করা গেলে বাকি ৭০-৭৫টি আসনের ইভিএম কেনার ব্যাপারে খুব বেশি রক্ষণশীল হওয়ার যুক্তি থাকতে পারে না। তার পরও নির্বাচন কমিশন যদি প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না পায়, তাহলে মোট ১০০ আসনের জন্য প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত ইভিএম সংগ্রহ করতে পারে। একই সঙ্গে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত কেবল শহরগুলোর জন্যই নির্ধারণ করা যেতে পারে। শহরের ভোটাররা ইভিএমে ভোটদানে এরই মধ্যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তার পরও ইভিএমের পাশাপাশি ২-৩ শতাংশ ভোটার, যাঁদের আঙুলের ছাপ না মেলার কারণে ভোটদানে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে, জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে তাঁদের উপস্থিত পোলিং এজেন্ট ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের সম্মতিতে বিশেষ ব্যালটে ভোটদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এর জন্য ইভিএমের আসনগুলোতে ১-২ শতাংশ ব্যালট পেপার ও ব্যালট বক্স রাখা যেতে পারে। এই ব্যালট পেপারের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, ভোটদান ও পরবর্তী গণনায় মিলিয়ে দেখার ব্যবস্থা থাকতে হবে। কোনো অবস্থাতেই অন্য কোনো ভোটারকে এ ধরনের ব্যালট পেপারে ভোট দেওয়ার সুযোগ দেওয়া যাবে না। সে ধরনের পরিস্থিতিতে যে কয়টি আসনে ইভিএমের মাধ্যমে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সেগুলোর ভোটার উপস্থিতি, ভোটদান, ভোটের পরিবেশ, ইভিএমের কার্যকারিতা ইত্যাদির সঙ্গে বাকি ব্যালট পেপারে অনুষ্ঠিত ভোটকেন্দ্রে তুলনামূলক একটি বাস্তবতার চিত্র পাওয়া যাবে। তখনই ইভিএম নাকি ব্যালট পেপারের নির্বাচন আমাদের দেশে অধিকতর সুষ্ঠু ও ত্রুটিমুক্তভাবে অনুষ্ঠিত করা যাবে, সেটি প্রমাণিত বা নিশ্চিত হওয়া যাবে।
আমরা প্রযুক্তির যুগে বসবাস করছি, কিন্তু প্রযুক্তি ব্যবহারের বিরোধিতা করে। কতটা নির্ভুল বা ভুল করছি, তখনই সেটি প্রমাণিত হবে। আমার ধারণা, ব্যালট পেপারের চেয়ে ত্রুটিহীন ইভিএম ব্যবহারের মাধ্যমে নির্বাচন অধিকতর গ্রহণযোগ্য করা সম্ভব হতে পারে।বিষয়গুলো অংশীজনদের গভীরভাবে যাচাই-বাছাই এবং আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন। নিজেদের ঢালাওভাবে অভিযোগকারী হিসেবে চিহ্নিত করা বর্তমান আধুনিক বিশ্বের কাছে মোটেও গ্রহণযোগ্য হবে না।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
আগামী নির্বাচনে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ নিয়ে বিরোধিতা ও বিতর্ক লক্ষ করা যাচ্ছে। যাঁরা এই বিতর্ক ও বিরোধিতায় অংশ নিচ্ছেন, তাঁদের প্রায় সবাই ইভিএম বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন। অল্প কিছুসংখ্যক কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ নির্বাচন কমিশনের ব্যবহৃত ইভিএমে কিছু ত্রুটি আছে বলে দাবি করছেন। অন্যদিকে যাঁরা এই ইভিএম তৈরি ও পর্যবেক্ষণ করেছেন, তেমন অনেক বিশেষজ্ঞ এই ইভিএমকে প্রায় ত্রুটিমুক্ত বলে অভিহিত করেছেন। অল্প কিছুসংখ্যক বিশেষজ্ঞ আঙুলের ছাপ মেলানোর ক্ষেত্রে ১ শতাংশ ভোটারের ভোটদানে সমস্যার কথা জানিয়েছেন। সে কারণে নির্বাচন কমিশন সেই সব ভোটারের ভোট গ্রহণের ব্যাপারে বিকল্প চিন্তা করছে বলে জানা গেছে।
ইভিএম নিয়ে সামগ্রিকভাবে বিএনপি ও এর জোট সদস্য দলগুলো বিরোধিতা করে আসছে। তারা নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টিকে কারচুপির আয়োজন বলে অভিহিত করছে। সুজনসহ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা ইভিএমের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তবে এটিও বিশেষজ্ঞদের ইভিএম যাচাই-বাছাইয়ের অভিজ্ঞতার ফলাফল কি না, তা স্পষ্ট নয়। অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও ১৪ দল নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সপক্ষে তাদের যুক্তি তুলে ধরে বলেছে, একদিকে প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে ভোট গ্রহণ ও ফলাফল প্রদানে সময় ও ঝামেলা কমে যাবে, অন্যদিকে ব্যালট পেপারে ভোট গ্রহণ ও ফলাফলে যথেষ্ট সময় ও ঝুঁকি রয়েছে, ব্যালট পেপারের অতীত অভিজ্ঞতাও ভালো নয়।
ইভিএম বিশেষ প্রযুক্তি, যা নিজে কাউকে নির্বাচনে জিতিয়ে আনতে কিংবা পরাজিত হতে ভূমিকা রাখে না। তবে আমাদের দেশে উদ্ভাবিত ইভিএম যদি শতভাগের কাছাকাছি ত্রুটিমুক্ত রাখার নিশ্চয়তা দিতে পারে, তাহলে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নির্বাচন করা অনেক বেশি শ্রেয় হতে পারে। কিন্তু সেটি অংশীজনদের আস্থা অর্জনের মাধ্যমেই কেবল হতে পারে। আস্থা অর্জনের জন্য প্রয়োজন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ইভিএম প্রযুক্তির সব কারিগরি দিক যাচাই-বাছাই করে নেওয়া। ১ শতাংশের নিচে ত্রুটিও সারিয়ে তোলার যদি সুযোগ থাকে, তাহলে সেই উদ্যোগ নেওয়া দরকার। সেটি না করা গেলে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে অংশীজনদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হলে নির্বাচন কমিশন বিবেচনায় নিতে পারে।
কিন্তু বাংলাদেশে ইভিএম নিয়ে যে ধরনের বিতর্ক চলছে, তাকে বিতর্ক না বলে বিরোধিতা এবং রাজনৈতিক মল্লযুদ্ধের কোনো কৌশল কি না, তেমন প্রশ্ন করা যেতেই পারে। ইভিএম একটি উচ্চতর প্রযুক্তি, যার সম্পর্কে একমাত্র এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দ্বারা মতামত রাখার বিষয়। তাদের বাইরে গিয়ে আমরা যাঁরা ননটেকনিক্যাল, তাঁদের এ বিষয়ে মতামত দেওয়া, বিতর্কে জড়িয়ে পড়া, পক্ষে বা বিপক্ষে মত দেওয়া, বিরোধিতা করা কিংবা পক্ষে অবস্থান নেওয়া মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়। এটি চূড়ান্তভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই করে টেকনিক্যাল ব্যক্তিরাই এর পক্ষে বা বিপক্ষে চূড়ান্ত মতামত দিতে পারেন। যদি টেকনিক্যাল ব্যক্তিরা এর পক্ষে মতামত দেন, তাহলে এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত করা উচিত নয়। সেটি নির্বাচন কমিশন সব অংশীজনকে জানাতে পারে; তাহলেই ইভিএম সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
কিন্তু এ পর্যন্ত ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক রশি টানাটানি বেশি হচ্ছে। একপক্ষ সর্বশক্তি দিয়ে ইভিএমের বিরোধিতা করছে; অপরপক্ষ নির্বাচন কমিশন যতসংখ্যক আসনে ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন করা সম্ভব হবে, তাতে তাদের কোনো আপত্তি থাকবে না। অর্থাৎ, ইভিএম ও ব্যালট পেপার উভয় পন্থায়ই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনের অবস্থানের পক্ষে তাদের মত দিয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশন যদি সব আসনে ব্যালট পেপারের মাধ্যমে নির্বাচন গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিত, তাহলে বিএনপি কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক দল সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিত কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
কারণ, তাদের আরও অনেক দাবি আছে, যেগুলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের রাজনৈতিকভাবে মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত আগামী নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ কিংবা অংশগ্রহণবিহীন অবস্থান হবে কি না, সেটিও এখনো অনিশ্চিত। কিন্তু ইভিএম নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, তা আগামী নির্বাচনে বিরোধিতাকারীদের অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে আদৌ কোনো ভূমিকা রাখবে কি না, সেটিও এখনো বলা যাচ্ছে না। অথচ বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজের একটি অংশ ইভিএম নিয়ে যার যার অবস্থান থেকে কথা বলেই যাচ্ছে। তাদের এই বক্তব্য অনেকটাই যুক্তিকে অগ্রাহ্য করেও বলা হচ্ছে। ফলে নাগরিক সমাজের বক্তব্যও রাজনৈতিকভাবে ইভিএমের বিরোধিতাকারীদের অবস্থানের সঙ্গে একাকার হচ্ছে। এ কারণে অনেকেই তাদের সন্দেহ এবং অবিশ্বাস করছে। এর দায় তাদেরই নিতে হবে।
নাগরিক সমাজের সবারই অবস্থান ইভিএমের ত্রুটিহীনতা ও ত্রুটির সম্ভাব্যতা সম্পর্কে প্রযুক্তিবিদদের মতামত কিংবা পরামর্শ শোনা এবং তার ভিত্তিতে বক্তব্য দেওয়া। কিন্তু কোনো কোনো নাগরিক সংগঠনের কর্তাব্যক্তিরা নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে যেসব কথা বলেন, তা কখনো কখনো শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সে কারণে ইভিএম নিয়ে অবিশেষজ্ঞ যেকোনো ব্যক্তি ও সংগঠনের বক্তব্য, বিবৃতি ও লেখালেখি দেশে বিভ্রান্তি ছড়াতে বেশি ভূমিকা রাখছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের প্রতিবারের নির্বাচন উপলক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে এমন কারও কারও মতামত শুনতে হয়, যা শেষ বিচারে খুব কমই গুরুত্ব পায়।
আমাদের নিকট অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিভিন্ন উপনির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বর্তমান কমিশনের অধীন ৩১ জুলাই ২০২২ পর্যন্ত ২৩১টি নির্বাচন ইভিএমে সম্পন্ন হয়েছে। ২০১২ ও ২০১৭ সালের কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন ইভিএমের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সব নির্বাচনে কোনো ধরনের কারচুপির অভিযোগ ওঠেনি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিরোধী প্রার্থীরা বিজয়ীও হয়েছেন। ফলে ইভিএম নিয়ে বিতর্ক যাঁরা করছেন, তাঁদের বিরোধিতার যৌক্তিকতা স্পষ্ট নয়। বিগত নির্বাচন কমিশনগুলো যেসব ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচনের আয়োজন করেছেন, সেগুলোর চেয়ে সর্বশেষ ইভিএম নির্বাচন কমিশন বিশেষজ্ঞদের যাচাই-বাছাইয়ের জন্য উপস্থাপন করেছে। বিশেষজ্ঞরা প্রয়োজনে সেগুলো আরও যাচাই-বাছাই করে দেখতে পারেন।
আমাদের জানামতে, জাতীয় সংসদের প্রায় ৭৫টি নির্বাচনী আসনে ভোট নেওয়ার মতো উচ্চতর প্রযুক্তিসম্পন্ন ইভিএম এখন নির্বাচন কমিশনের হাতে আছে। নির্বাচন কমিশন মোট দেড় শ আসনের নির্বাচন ইভিএমে করার জন্য যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, সেটার জন্য আরও ৭৫টি আসনের ইভিএম কেনার প্রয়োজন হবে। এর জন্য ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। এই অর্থ বরাদ্দের জন্য নির্বাচন কমিশনের সুপারিশের কথা শুনে অনেকেই ইভিএম থেকে সরে যাওয়ার দাবি করছেন, কিন্তু ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচন করতে গেলে নির্বাচন কমিশনের মোট বাজেট কত হতে পারে, সেটি বোধ হয় জানা দরকার ছিল। সম্ভবত নির্বাচনী ব্যালট পেপার, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, সিল, লোকবল ইত্যাদি মিলিয়ে খরচ অনেক বেশি হতে পারে। তার পরও ইভিএম নিয়ে যদি কোনো ত্রুটি থাকে, তাহলে ভিন্ন কথা।
কিন্তু ত্রুটি না থাকলে কিংবা ত্রুটি সারিয়ে শতভাগ ভোটারের ত্রুটিমুক্ত ভোটদান নিশ্চিত করা গেলে বাকি ৭০-৭৫টি আসনের ইভিএম কেনার ব্যাপারে খুব বেশি রক্ষণশীল হওয়ার যুক্তি থাকতে পারে না। তার পরও নির্বাচন কমিশন যদি প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না পায়, তাহলে মোট ১০০ আসনের জন্য প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত ইভিএম সংগ্রহ করতে পারে। একই সঙ্গে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত কেবল শহরগুলোর জন্যই নির্ধারণ করা যেতে পারে। শহরের ভোটাররা ইভিএমে ভোটদানে এরই মধ্যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তার পরও ইভিএমের পাশাপাশি ২-৩ শতাংশ ভোটার, যাঁদের আঙুলের ছাপ না মেলার কারণে ভোটদানে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে, জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে তাঁদের উপস্থিত পোলিং এজেন্ট ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের সম্মতিতে বিশেষ ব্যালটে ভোটদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এর জন্য ইভিএমের আসনগুলোতে ১-২ শতাংশ ব্যালট পেপার ও ব্যালট বক্স রাখা যেতে পারে। এই ব্যালট পেপারের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, ভোটদান ও পরবর্তী গণনায় মিলিয়ে দেখার ব্যবস্থা থাকতে হবে। কোনো অবস্থাতেই অন্য কোনো ভোটারকে এ ধরনের ব্যালট পেপারে ভোট দেওয়ার সুযোগ দেওয়া যাবে না। সে ধরনের পরিস্থিতিতে যে কয়টি আসনে ইভিএমের মাধ্যমে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সেগুলোর ভোটার উপস্থিতি, ভোটদান, ভোটের পরিবেশ, ইভিএমের কার্যকারিতা ইত্যাদির সঙ্গে বাকি ব্যালট পেপারে অনুষ্ঠিত ভোটকেন্দ্রে তুলনামূলক একটি বাস্তবতার চিত্র পাওয়া যাবে। তখনই ইভিএম নাকি ব্যালট পেপারের নির্বাচন আমাদের দেশে অধিকতর সুষ্ঠু ও ত্রুটিমুক্তভাবে অনুষ্ঠিত করা যাবে, সেটি প্রমাণিত বা নিশ্চিত হওয়া যাবে।
আমরা প্রযুক্তির যুগে বসবাস করছি, কিন্তু প্রযুক্তি ব্যবহারের বিরোধিতা করে। কতটা নির্ভুল বা ভুল করছি, তখনই সেটি প্রমাণিত হবে। আমার ধারণা, ব্যালট পেপারের চেয়ে ত্রুটিহীন ইভিএম ব্যবহারের মাধ্যমে নির্বাচন অধিকতর গ্রহণযোগ্য করা সম্ভব হতে পারে।বিষয়গুলো অংশীজনদের গভীরভাবে যাচাই-বাছাই এবং আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন। নিজেদের ঢালাওভাবে অভিযোগকারী হিসেবে চিহ্নিত করা বর্তমান আধুনিক বিশ্বের কাছে মোটেও গ্রহণযোগ্য হবে না।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে