জাহীদ রেজা নূর
বেশ কিছুকাল আগের কথা। আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে স্কুলের শিক্ষার্থীরা কতটা জানে, এ রকম একটি প্রশ্ন নিয়ে কেউ কেউ গিয়েছিল বিভিন্ন স্কুলে। পড়ুয়ারা চমকে দিয়েছিল তাদের স্বাধীন উত্তর দিয়ে। স্বাধীন দেশে বসবাস করে বলে ইতিহাস জ্ঞানেও তারা নিয়েছিল স্বাধীনতা। ফলে তাদের উত্তরে ১৪ ডিসেম্বর যদি হয়ে যায় শহীদ দিবস, ২৬ মার্চ হয়ে যায় বিজয় দিবস আর ১৬ ডিসেম্বর হয়ে যায় স্বাধীনতা দিবস, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। শিশুরা জানে না, নাকি তাদের জানানোর কোনো উপায় নেই, সেটাই বিবেচ্য।
কেন এই অসময়ে এ প্রসঙ্গটি নিয়ে কথা বলছি? বলছি এ কারণে যে, পুরো শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চা নিয়ে যে সংকটটি সৃষ্টি হয়েছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে বহু আগেই। এই অবিশ্বাস্য ইতিহাসবিমুখতা আমাদের টনক নড়ায়নি। আমরা এতটাই পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে নিজেদের সঁপে দিয়েছি এবং সেই বিদ্যার সব কৃতিত্ব অর্পণ করেছি কোচিং সেন্টার বা নোটবুকের ওপর যে, এ রকম একটি জরুরি বিষয়ে কথা বলাটাও এখন উলু বনে মুক্তো ছড়ানোর মতো হয়ে যাবে কি না, সে চিন্তায় আছি।
দুই. তার আগে একটা প্রশ্ন আসবে—শিশুদের জন্য ইতিহাস জানা কি এতটাই জরুরি? এ প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর হয় না। শুধু বলা যায়, পৃথিবীর সব দেশই তাদের ইতিহাসের একটা বয়ানকে মান্য করে। স্কুলে পড়ানোর সময় সে কথাগুলো উচ্চারণ করেন শিক্ষক এবং তার মাধ্যমে দেশপ্রেমের জন্ম হয় শিশুর মনে।
শিশুকালে এই বোধের জন্ম হলে পরবর্তীকালে সে এই অঙ্কুরিত বোধের আলোকে আরও জানতে চায়। তখন প্রয়োজন হয় ইতিহাসের বইয়ের। যে বইগুলো থেকে সে জ্ঞান আহরণ করতে পারবে। বিভিন্ন বয়ানের মধ্য থেকে সে বেছে নিতে পারবে সত্য। জানতে পারবে ইতিহাসের কোন পর্যায়ে কার কোন ভূমিকা ছিল।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের নির্মোহ ইতিহাস রচনা হয়নি বললেই চলে। স্বাভাবিকভাবেই যে মানুষ যে আদর্শ নিয়ে চলে, সে তার মতো করেই ইতিহাসকে দেখবে, ফলে সেটাও হবে খণ্ডিত এক দেখা। সময় এসেছে, যখন নির্মোহ ইতিহাসের বই রচনার বিকল্প নেই। একটি জাতি ইতিহাসহীন হয়ে কিংবা খণ্ডিত ইতিহাসের শিক্ষায় বেড়ে উঠলে স্বাধীনতা দিবসটাই হয়ে উঠতে পারে বিজয় দিবস, আর বিজয় দিবস হয়ে উঠতে পারে শহীদ দিবস।
তিন. বর্তমান বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করতে হলে বায়ান্ন আর একাত্তর নিয়েই কথা হয় বেশি। সংগতভাবেই এই দুটি সাল আমাদের জীবনে গভীর রেখাপাত করেছে। কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই যে কারও কাছে পরিষ্কার হবে, বায়ান্ন সালের বীজ রোপিত আছে ইতিহাসের আরও অনেক গভীরে, যেমন একাত্তরের খোঁজে গেলে বায়ান্নর পথ ধরেই পঞ্চাশ ও ষাটের দশকজুড়ে সংস্কৃতি, জাতীয়তাবাদ ও স্বাধিকারের খোঁজ করতে হবে।
কিন্তু কীভাবে পাওয়া যাবে তার হদিস?
চাইছি না, কেউ হতাশ হয়ে পড়ুক। আলোর দিশা একেবারে নেই, তা তো নয়। আশার আলো জ্বালাতে পারে, এ রকম কিছু বই-পুস্তকের কথাই আজ বলব। এই বইগুলো বা সমধর্মী বইয়ের সাহচর্যে ইতিহাসের ঠিকানায় পৌঁছে যেতে পারি আমরা।
চার. মহান একুশের সুবর্ণজয়ন্তীতে একটি বিশাল স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করেছিল অ্যাডর্ন পাবলিকেশন। বিশাল তার কলেবর। কবিতা দিয়ে শুরু হয়েছে বইটি। এরপর তার নানা পর্বে এক একটি বিষয়কে ধরে এগিয়েছে আলোচনা। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে যাঁরা ভাষা নিয়ে লিখেছেন, ভাষার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করেছেন, বাংলা মুদ্রণশিল্প নিয়ে আলোকপাত করেছেন, তাঁদের রচনায় সমৃদ্ধ হয়েছে বইটি। যাঁরা এতটা গভীরে যেতে চাইবেন না, তাঁরা চলে আসতে পারেন ভাষা বিতর্ক পর্বে। বাংলা, উর্দু, হিন্দি ইত্যাদি আলোচনার আলোকে কেন বাংলাই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, সেটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। এটা যে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য বলা নয়, বাংলা তার স্বভাবগুণেই রাষ্ট্রভাষা হওয়ার দাবিদার, সেটা বোঝা সহজ হবে এই পর্বটি পড়লে। বায়ান্নর একুশ নিয়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি লেখা, রয়েছে পত্র-পত্রিকায় কীভাবে একুশ প্রতিফলিত হয়েছিল, তার বিশ্লেষণ। ভাষাসংগ্রামীদের স্মৃতিকথায় জানা যাবে সেই আন্দোলনের নানা দিক। ভাষা আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ, ভাষাশহীদ, বিভিন্ন জেলায় ভাষা আন্দোলন, শহীদ মিনার, বিদেশে বাংলা ভাষার চর্চা ইত্যাদির দিকেও দৃষ্টি যাবে মনোযোগী পাঠকের। ভাষা সংস্কার, বাংলাচর্চা ও ব্যবহার, বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎসহ আরও অনেক বিষয়েই আলোকপাত করা হয়েছে বইটিতে।
এ বইটি থেকে মূলত বাংলা ভাষা ও বাঙালির যাত্রাপথের একটি দিশা পাওয়া যাবে। আগ্রহী পাঠক নিজের বিবেচনা থেকে এর পরের ভ্রমণ শুরু করতে পারেন।
তবে বলে রাখা দরকার, যে তিনটি ধারা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল, তমদ্দুন মজলিশ, বামধারা ও জাতীয়তাবাদী ধারা, এর মধ্যে প্রথম দুটি ধারা নিয়ে আলোচনা হয়েছে অনেক, কিন্তু জাতীয়তাবাদী ধারাটি বহুদিন পর্যন্ত ছিল উপেক্ষিত। এমনকি এই ধারার একজন সোচ্চার কণ্ঠস্বর শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানকেও খাটো করার প্রয়াস আমরা দেখেছি। ইতিহাসের স্বার্থে এ তিনটি ধারার সঠিক মূল্যায়ন জরুরি।
‘সংবাদপত্রে ভাষা আন্দোলন’ নামে আরেকটি বই প্রকাশিত হয়েছে এম আর মাহবুবের সম্পাদনায়। তিনি নিজেই এটির সংকলন করেছেন। একটু অগোছালো হলেও ইতিহাসের অনেক দুষ্প্রাপ্য দলিল রয়েছে বইটিতে। বইটি প্রকাশিত হয়েছে গৌরব প্রকাশন থেকে।
বদরুদ্দীন উমরের ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ ও বশীর আল হেলাল রচিত ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ বই দুটির কথাও স্মরণযোগ্য। আহমদ রফিক ও আবদুল মতিন মিলে ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও তাৎপর্য’ নামে যে বইটি লিখেছেন, তাতেও রয়েছে চিন্তার খোরাক।
অর্থাৎ ভাষা আন্দোলন নিয়ে কাজ করতে চাইলে এই বইগুলোকে প্রাথমিক ধরে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন। সম্প্রতি গবেষক এম আবদুল আলীমও ভাষা আন্দোলন নিয়ে কাজ করছেন, যেখানে ভাষা আন্দোলনে জাতীয়তাবাদীদের ভূমিকা প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছে।
পাঁচ. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র ১৫ খণ্ড সুবিন্যস্ত একটি প্রয়াস। এতে পটভূমি হিসেবে দুটি খণ্ড, মুজিবনগর নিয়ে চারটি খণ্ড, পাকিস্তানি দলিল নিয়ে একটি খণ্ড, গণহত্যা, শরণার্থীশিবির ও প্রাথমিক ঘটনা নিয়ে একটি খণ্ড, সশস্ত্র সংগ্রাম নিয়ে তিনটি খণ্ড, বিদেশি প্রতিক্রিয়া ও ভারত নিয়ে একটি খণ্ড, জাতিসংঘ ও বিদেশি রাষ্ট্র নিয়ে একটি খণ্ড, বিশ্ব জনমত নিয়ে একটি খণ্ড এবং সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে আরেকটি খণ্ড। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত এই আকরগ্রন্থটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে বুঝতে সাহায্য করবে।
তবে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরও বিশদ আলোচনা হওয়া উচিত। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জীবনে বিগত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশক ছিল সবচেয়ে বৈচিত্র্যময়, সবচেয়ে আন্দোলনমুখর। নানা দিক থেকে মুক্তির সংগ্রামকে দেখা দরকার। বামপন্থী ধারা আর ইসলামি ধারাকে পরাজিত করে কীভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারার উন্মেষ ও বিজয় ঘটল, সে আলোচনাটি এখনো হয়নি। যাঁরাই আলোচনা করেছেন, তাঁদের অধিকাংশের আলোচনাই পক্ষপাতমূলক। এই জায়গা থেকে ইতিহাসকে বের করে আনা সময়ের দাবি।
বামপন্থার প্রতি সমর্থন থাকলেও কেন এ দেশে বামপন্থীরা রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে পারেনি, কেন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পৌঁছেছিল স্বর্ণশিখরে, তার গভীর বিশ্লেষণ হওয়া দরকার।
ছয়. স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য নিশ্চয়ই এই আলোচনাটা করা হলো না। স্কুলের শিক্ষার্থীদের যাঁরা ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত করাবেন, তাঁদের জন্যই বলা হলো। এই তালিকায় শুধু শিক্ষক রয়েছেন ভাবলে ভুল করা হবে। রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, চিকিৎসক, সমাজকর্মী, তথা যাঁরাই শিশুদের সংস্পর্শে আসেন এবং তাকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন, তাঁদের সবার জন্যই সঠিক ইতিহাস জানা ও তা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা থাকা জরুরি।
আমরা দেখেছি, মেঠো বক্তৃতায় অনেকেই ভাষা আন্দোলনের পটভূমির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলে থাকেন, উর্দুকে হটিয়ে দিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রাম ছিল এটি। এই ভুল তথ্য যদি শিশুর মনে প্রথিত হয়, তাহলে তার পরের প্রতিটি পদক্ষেপই হবে ভুল।
আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব, সেকালেও ধর্মব্যবসা ছিল। ধর্মকে রাজনীতির বর্ম বানিয়ে একদল মানুষ সে সময়ও রাজনীতি করে গেছে। তারা বাংলায় কখনোই পাত্তা পায়নি। পাত্তা না পাওয়ার একটা বড় কারণ হলো, তাদের আজগুবি তত্ত্বের প্রতি আস্থা রাখার চেয়ে জাতীয় চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার মন্ত্রেই দীক্ষিত হতে চেয়েছিল জনতা। এখন যে প্রশ্নটি খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে তা হলো, জাতীয় চেতনার ভেতরে যদি খাদ ঢুকতে থাকে, তাহলে মানুষ সেই চেতনা থেকে ভালো কিছু পাবে না। তখন বিকল্প খুঁজবে মানুষ। সেই বিকল্প যদি কাছেধারে না থাকে, তখন সে ঝুঁকে পড়ে এমন কোনো মতবাদের দিকে, যেটি দেখাতে পারে উগ্রতার পথ।
সঠিক ইতিহাসচর্চা ও সঠিক চেতনার বিকাশ না হলে একটি দেশে কীভাবে সাম্প্রদায়িকতা ও রক্ষণশীলতা জায়গা করে নেয়, তা তো আমরা প্রতিনিয়তই টের পাচ্ছি।
জাহীদ রেজা নূর, উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
বেশ কিছুকাল আগের কথা। আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে স্কুলের শিক্ষার্থীরা কতটা জানে, এ রকম একটি প্রশ্ন নিয়ে কেউ কেউ গিয়েছিল বিভিন্ন স্কুলে। পড়ুয়ারা চমকে দিয়েছিল তাদের স্বাধীন উত্তর দিয়ে। স্বাধীন দেশে বসবাস করে বলে ইতিহাস জ্ঞানেও তারা নিয়েছিল স্বাধীনতা। ফলে তাদের উত্তরে ১৪ ডিসেম্বর যদি হয়ে যায় শহীদ দিবস, ২৬ মার্চ হয়ে যায় বিজয় দিবস আর ১৬ ডিসেম্বর হয়ে যায় স্বাধীনতা দিবস, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। শিশুরা জানে না, নাকি তাদের জানানোর কোনো উপায় নেই, সেটাই বিবেচ্য।
কেন এই অসময়ে এ প্রসঙ্গটি নিয়ে কথা বলছি? বলছি এ কারণে যে, পুরো শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চা নিয়ে যে সংকটটি সৃষ্টি হয়েছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে বহু আগেই। এই অবিশ্বাস্য ইতিহাসবিমুখতা আমাদের টনক নড়ায়নি। আমরা এতটাই পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে নিজেদের সঁপে দিয়েছি এবং সেই বিদ্যার সব কৃতিত্ব অর্পণ করেছি কোচিং সেন্টার বা নোটবুকের ওপর যে, এ রকম একটি জরুরি বিষয়ে কথা বলাটাও এখন উলু বনে মুক্তো ছড়ানোর মতো হয়ে যাবে কি না, সে চিন্তায় আছি।
দুই. তার আগে একটা প্রশ্ন আসবে—শিশুদের জন্য ইতিহাস জানা কি এতটাই জরুরি? এ প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর হয় না। শুধু বলা যায়, পৃথিবীর সব দেশই তাদের ইতিহাসের একটা বয়ানকে মান্য করে। স্কুলে পড়ানোর সময় সে কথাগুলো উচ্চারণ করেন শিক্ষক এবং তার মাধ্যমে দেশপ্রেমের জন্ম হয় শিশুর মনে।
শিশুকালে এই বোধের জন্ম হলে পরবর্তীকালে সে এই অঙ্কুরিত বোধের আলোকে আরও জানতে চায়। তখন প্রয়োজন হয় ইতিহাসের বইয়ের। যে বইগুলো থেকে সে জ্ঞান আহরণ করতে পারবে। বিভিন্ন বয়ানের মধ্য থেকে সে বেছে নিতে পারবে সত্য। জানতে পারবে ইতিহাসের কোন পর্যায়ে কার কোন ভূমিকা ছিল।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের নির্মোহ ইতিহাস রচনা হয়নি বললেই চলে। স্বাভাবিকভাবেই যে মানুষ যে আদর্শ নিয়ে চলে, সে তার মতো করেই ইতিহাসকে দেখবে, ফলে সেটাও হবে খণ্ডিত এক দেখা। সময় এসেছে, যখন নির্মোহ ইতিহাসের বই রচনার বিকল্প নেই। একটি জাতি ইতিহাসহীন হয়ে কিংবা খণ্ডিত ইতিহাসের শিক্ষায় বেড়ে উঠলে স্বাধীনতা দিবসটাই হয়ে উঠতে পারে বিজয় দিবস, আর বিজয় দিবস হয়ে উঠতে পারে শহীদ দিবস।
তিন. বর্তমান বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করতে হলে বায়ান্ন আর একাত্তর নিয়েই কথা হয় বেশি। সংগতভাবেই এই দুটি সাল আমাদের জীবনে গভীর রেখাপাত করেছে। কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই যে কারও কাছে পরিষ্কার হবে, বায়ান্ন সালের বীজ রোপিত আছে ইতিহাসের আরও অনেক গভীরে, যেমন একাত্তরের খোঁজে গেলে বায়ান্নর পথ ধরেই পঞ্চাশ ও ষাটের দশকজুড়ে সংস্কৃতি, জাতীয়তাবাদ ও স্বাধিকারের খোঁজ করতে হবে।
কিন্তু কীভাবে পাওয়া যাবে তার হদিস?
চাইছি না, কেউ হতাশ হয়ে পড়ুক। আলোর দিশা একেবারে নেই, তা তো নয়। আশার আলো জ্বালাতে পারে, এ রকম কিছু বই-পুস্তকের কথাই আজ বলব। এই বইগুলো বা সমধর্মী বইয়ের সাহচর্যে ইতিহাসের ঠিকানায় পৌঁছে যেতে পারি আমরা।
চার. মহান একুশের সুবর্ণজয়ন্তীতে একটি বিশাল স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করেছিল অ্যাডর্ন পাবলিকেশন। বিশাল তার কলেবর। কবিতা দিয়ে শুরু হয়েছে বইটি। এরপর তার নানা পর্বে এক একটি বিষয়কে ধরে এগিয়েছে আলোচনা। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে যাঁরা ভাষা নিয়ে লিখেছেন, ভাষার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করেছেন, বাংলা মুদ্রণশিল্প নিয়ে আলোকপাত করেছেন, তাঁদের রচনায় সমৃদ্ধ হয়েছে বইটি। যাঁরা এতটা গভীরে যেতে চাইবেন না, তাঁরা চলে আসতে পারেন ভাষা বিতর্ক পর্বে। বাংলা, উর্দু, হিন্দি ইত্যাদি আলোচনার আলোকে কেন বাংলাই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, সেটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। এটা যে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য বলা নয়, বাংলা তার স্বভাবগুণেই রাষ্ট্রভাষা হওয়ার দাবিদার, সেটা বোঝা সহজ হবে এই পর্বটি পড়লে। বায়ান্নর একুশ নিয়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি লেখা, রয়েছে পত্র-পত্রিকায় কীভাবে একুশ প্রতিফলিত হয়েছিল, তার বিশ্লেষণ। ভাষাসংগ্রামীদের স্মৃতিকথায় জানা যাবে সেই আন্দোলনের নানা দিক। ভাষা আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ, ভাষাশহীদ, বিভিন্ন জেলায় ভাষা আন্দোলন, শহীদ মিনার, বিদেশে বাংলা ভাষার চর্চা ইত্যাদির দিকেও দৃষ্টি যাবে মনোযোগী পাঠকের। ভাষা সংস্কার, বাংলাচর্চা ও ব্যবহার, বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎসহ আরও অনেক বিষয়েই আলোকপাত করা হয়েছে বইটিতে।
এ বইটি থেকে মূলত বাংলা ভাষা ও বাঙালির যাত্রাপথের একটি দিশা পাওয়া যাবে। আগ্রহী পাঠক নিজের বিবেচনা থেকে এর পরের ভ্রমণ শুরু করতে পারেন।
তবে বলে রাখা দরকার, যে তিনটি ধারা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল, তমদ্দুন মজলিশ, বামধারা ও জাতীয়তাবাদী ধারা, এর মধ্যে প্রথম দুটি ধারা নিয়ে আলোচনা হয়েছে অনেক, কিন্তু জাতীয়তাবাদী ধারাটি বহুদিন পর্যন্ত ছিল উপেক্ষিত। এমনকি এই ধারার একজন সোচ্চার কণ্ঠস্বর শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানকেও খাটো করার প্রয়াস আমরা দেখেছি। ইতিহাসের স্বার্থে এ তিনটি ধারার সঠিক মূল্যায়ন জরুরি।
‘সংবাদপত্রে ভাষা আন্দোলন’ নামে আরেকটি বই প্রকাশিত হয়েছে এম আর মাহবুবের সম্পাদনায়। তিনি নিজেই এটির সংকলন করেছেন। একটু অগোছালো হলেও ইতিহাসের অনেক দুষ্প্রাপ্য দলিল রয়েছে বইটিতে। বইটি প্রকাশিত হয়েছে গৌরব প্রকাশন থেকে।
বদরুদ্দীন উমরের ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ ও বশীর আল হেলাল রচিত ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ বই দুটির কথাও স্মরণযোগ্য। আহমদ রফিক ও আবদুল মতিন মিলে ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও তাৎপর্য’ নামে যে বইটি লিখেছেন, তাতেও রয়েছে চিন্তার খোরাক।
অর্থাৎ ভাষা আন্দোলন নিয়ে কাজ করতে চাইলে এই বইগুলোকে প্রাথমিক ধরে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন। সম্প্রতি গবেষক এম আবদুল আলীমও ভাষা আন্দোলন নিয়ে কাজ করছেন, যেখানে ভাষা আন্দোলনে জাতীয়তাবাদীদের ভূমিকা প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছে।
পাঁচ. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র ১৫ খণ্ড সুবিন্যস্ত একটি প্রয়াস। এতে পটভূমি হিসেবে দুটি খণ্ড, মুজিবনগর নিয়ে চারটি খণ্ড, পাকিস্তানি দলিল নিয়ে একটি খণ্ড, গণহত্যা, শরণার্থীশিবির ও প্রাথমিক ঘটনা নিয়ে একটি খণ্ড, সশস্ত্র সংগ্রাম নিয়ে তিনটি খণ্ড, বিদেশি প্রতিক্রিয়া ও ভারত নিয়ে একটি খণ্ড, জাতিসংঘ ও বিদেশি রাষ্ট্র নিয়ে একটি খণ্ড, বিশ্ব জনমত নিয়ে একটি খণ্ড এবং সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে আরেকটি খণ্ড। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত এই আকরগ্রন্থটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে বুঝতে সাহায্য করবে।
তবে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরও বিশদ আলোচনা হওয়া উচিত। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জীবনে বিগত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশক ছিল সবচেয়ে বৈচিত্র্যময়, সবচেয়ে আন্দোলনমুখর। নানা দিক থেকে মুক্তির সংগ্রামকে দেখা দরকার। বামপন্থী ধারা আর ইসলামি ধারাকে পরাজিত করে কীভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারার উন্মেষ ও বিজয় ঘটল, সে আলোচনাটি এখনো হয়নি। যাঁরাই আলোচনা করেছেন, তাঁদের অধিকাংশের আলোচনাই পক্ষপাতমূলক। এই জায়গা থেকে ইতিহাসকে বের করে আনা সময়ের দাবি।
বামপন্থার প্রতি সমর্থন থাকলেও কেন এ দেশে বামপন্থীরা রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে পারেনি, কেন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পৌঁছেছিল স্বর্ণশিখরে, তার গভীর বিশ্লেষণ হওয়া দরকার।
ছয়. স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য নিশ্চয়ই এই আলোচনাটা করা হলো না। স্কুলের শিক্ষার্থীদের যাঁরা ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত করাবেন, তাঁদের জন্যই বলা হলো। এই তালিকায় শুধু শিক্ষক রয়েছেন ভাবলে ভুল করা হবে। রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, চিকিৎসক, সমাজকর্মী, তথা যাঁরাই শিশুদের সংস্পর্শে আসেন এবং তাকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন, তাঁদের সবার জন্যই সঠিক ইতিহাস জানা ও তা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা থাকা জরুরি।
আমরা দেখেছি, মেঠো বক্তৃতায় অনেকেই ভাষা আন্দোলনের পটভূমির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলে থাকেন, উর্দুকে হটিয়ে দিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রাম ছিল এটি। এই ভুল তথ্য যদি শিশুর মনে প্রথিত হয়, তাহলে তার পরের প্রতিটি পদক্ষেপই হবে ভুল।
আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব, সেকালেও ধর্মব্যবসা ছিল। ধর্মকে রাজনীতির বর্ম বানিয়ে একদল মানুষ সে সময়ও রাজনীতি করে গেছে। তারা বাংলায় কখনোই পাত্তা পায়নি। পাত্তা না পাওয়ার একটা বড় কারণ হলো, তাদের আজগুবি তত্ত্বের প্রতি আস্থা রাখার চেয়ে জাতীয় চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার মন্ত্রেই দীক্ষিত হতে চেয়েছিল জনতা। এখন যে প্রশ্নটি খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে তা হলো, জাতীয় চেতনার ভেতরে যদি খাদ ঢুকতে থাকে, তাহলে মানুষ সেই চেতনা থেকে ভালো কিছু পাবে না। তখন বিকল্প খুঁজবে মানুষ। সেই বিকল্প যদি কাছেধারে না থাকে, তখন সে ঝুঁকে পড়ে এমন কোনো মতবাদের দিকে, যেটি দেখাতে পারে উগ্রতার পথ।
সঠিক ইতিহাসচর্চা ও সঠিক চেতনার বিকাশ না হলে একটি দেশে কীভাবে সাম্প্রদায়িকতা ও রক্ষণশীলতা জায়গা করে নেয়, তা তো আমরা প্রতিনিয়তই টের পাচ্ছি।
জাহীদ রেজা নূর, উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
পর্দার নায়িকারা নিজেদের বয়স আড়ালে রাখা পছন্দ করেন। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আজমেরী হক বাঁধন। প্রতিবছর নিজের জন্মদিনে জানান দেন তাঁর বয়স। গতকাল ছিল বাঁধনের ৪১তম জন্মদিন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেই জানালেন এই তথ্য।
২ দিন আগে১০ বছরের বেশি সময় ধরে শোবিজে কাজ করছেন অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া। নাটকের পাশাপাশি ওটিটিতে দেখা গেছে তাঁকে। সরকারি অনুদানের ‘দেবী’ নামের একটি সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন। প্রশংসিত হলেও সিনেমায় আর দেখা মেলেনি তাঁর। ছোট পর্দাতেও অনেক দিন ধরে অনিয়মিত তিনি। এবার শবনম ফারিয়া হাজির হচ্ছেন নতুন পরিচয়ে। কমেডি রিয়েলিটি
২ দিন আগেআমাদের লোকসংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য যাত্রাপালা। গণমানুষের সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত এই যাত্রাপালা নিয়ে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করছে ‘যাত্রা উৎসব-২০২৪’। আগামী ১ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে শুরু হবে ৭ দিনব্যাপী এই উৎসব।
২ দিন আগে‘বঙ্গবন্ধু’ পদবি বিলীন হবে না। হতে পারে না। যেমনটি ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাশের পদবি বিলীন হয়নি। ইতিহাসে এসব পদবি অম্লান ও অক্ষয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব ছিল অনন্যসাধারণ। আপনজনকে তো অবশ্যই, শত্রুপক্ষের লোকেরাও ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উচ্চপদের
২ দিন আগে