Ajker Patrika

পরিপ্রেক্ষিত: চলমান শিক্ষক আন্দোলন

মাসুদ উর রহমান
পরিপ্রেক্ষিত: চলমান শিক্ষক আন্দোলন

গত ১১ জুলাই থেকে শিক্ষকেরা রাস্তায় আন্দোলন করছেন। কেন করছেন? কারণ তাঁরা কর্মক্ষেত্রে অবহেলিত, বঞ্চিত, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ম্যানেজিং কমিটি দ্বারা লাঞ্ছিত। সরকার এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মূল স্কেলের শতভাগ বেতন দেয়। এর বাইরে দেয় বাড়িভাড়া ১ হাজার টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা এবং ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি নিয়ে বাকি সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার দায়িত্ব সরকার দিয়েছে ম্যানেজিং কমিটিকে। ব্যতিক্রম বাদ দিলে কোনো ম্যানেজিং কমিটিই শিক্ষকদের সেই পাওনা পরিশোধ করে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষকেরা চাইছেন জাতীয়করণ।

তাঁরা হিসাব করে দেখিয়েছেন জাতীয়করণ করে সরকার যদি শিক্ষার্থীপ্রতি মাত্র ২০ টাকা টিউশন ফি নেয়, তাহলেই শিক্ষকদের সব দাবিদাওয়া পূরণ করা সম্ভব। তাতে উপকৃত হবেন শুধু যে ৫ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী তা কিন্তু নয়, সরাসরি উপকৃত হবেন অন্তত ৫ কোটি অভিভাবক। এই দুর্মূল্যের বাজারে মাত্র ২০ টাকা বেতন দিয়ে অভিভাবকদের তাঁদের সন্তানদের প্রতিষ্ঠান-ব্যয় নির্বাহ করতে পারার মতো সহজ হিসাবটি সরকার বুঝতে চাইছে না। কেন চাইছে না? তাহলে কি বলা যায় না, শিক্ষার্থীপ্রতি দু-চার-পাঁচ শ বা তারও বেশি টিউশন ফি নিয়ে যারা লাভবান হচ্ছে তাদের গুরুত্ব, শিক্ষক অভিভাবকদের চেয়ে সরকারের কাছে অনেক বেশি!

এবার আসি একজন মাননীয়ের উক্তি প্রসঙ্গে। তাঁর কথায়, এ দেশের বেসরকারি শিক্ষকেরা ঘটনাক্রমে শিক্ষক। এ কথায় তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন? শিক্ষকেরা অযোগ্য। ফলে সরকারি শিক্ষকদের মতো সুবিধা পাওয়ার অধিকার তাঁদের নেই, তাই তো? 
তাহলে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাখা কেন? 

দেশের ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থীকে এই অযোগ্যদের দিয়ে শিক্ষাদান যুগের পর যুগ চালিয়ে যাওয়া তামাশা নয় কি? সার্টিফিকেট বিবেচনায় সবাই কিন্তু যোগ্য। তাহলে এই অযোগ্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেটগুলো কে দিল?

মাননীয়, আপনি হয়তো বলবেন এর দায় আপনার পূর্বসূরিদের! আচ্ছা, আপনারা তাঁদের যোগ্য করতে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) ব্যবস্থাপনায় তীব্র প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে যেভাবে শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছেন, সেটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে প্রকারান্তরে নিজেরাই কি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছেন না? নাকি অযোগ্য আখ্যা দিয়ে বেতন কম এবং সুযোগ-সুবিধা না দিলেও চলে—এই আপনাদের অভিপ্রায়?

আপনাদের পূর্বসূরি শিক্ষকদের মাত্র তিন দিনের ট্রেনিং দিয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করেছিলেন। সেই সৃজনশীল শিক্ষার্থীদের এমন সৃজন করে তুলল যে আগে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করে ফেল করত ৭০ শতাংশ আর এখন না পড়েই পাস করতে পারে ৭০ শতাংশ! সৃজনশীল পদ্ধতিই নাকি সব নষ্টের মূল, তথা গলার কাঁটা। আর সেই গলার কাঁটা সরাতে আপনারা নিয়ে এলেন আরও চমকপ্রদ কারিকুলাম! এখন নাকি ফেল করারই ব্যবস্থা নেই। শ্রেণি-উত্তীর্ণ হবে ত্রিভুজ, বৃত্ত বা চতুর্ভুজ নিয়ে।

অবশ্য শিক্ষকদের যোগ্য করতে ট্রেনিং এবার দুই দিন বেড়ে হলো পাঁচ দিন। আপনাদের বিবেচনায় পাঁচ দিনেই শিক্ষকেরা যোগ্য হয়ে গেছেন ভেবেই কিন্তু তড়িঘড়ি করে নতুন কারিকুলাম তাঁদের হাতে তুলে দিলেন। এখনো কি বলবেন তাঁরা ঘটনাক্রমে শিক্ষক? কেন এত তাড়াহুড়ো? এই কারিকুলামও যে টেকসই হবে তার কোনো লক্ষণও তো দেখা যাচ্ছে না; বরং অনেক শিক্ষাবিদই এই তাড়াহুড়োতে উষ্মা প্রকাশ করেছেন।

এখন পাবলিক পরীক্ষায় গড় পাসের হার প্রায় ৯০ শতাংশ! মাননীয়, একবার মনে করে দেখুন তো আপনি যখন এসএসসি পাস করেছিলেন, তখন গড় পাসের হার ছিল ৩০ শতাংশের আশপাশে। তবে কি বলব আপনাদের শিক্ষকেরা ছিলেন আরও বেশি অযোগ্য? লাখ টাকার প্রশ্ন—শিক্ষকেরা যদি এত অযোগ্য হয়ে থাকেন, তাহলে পাসের হার, জিপিএ-৫ বাড়াচ্ছে কারা? কোন অভিপ্রায়ে?

তারপরও মেনে নিলাম—বেসরকারি শিক্ষকেরা সব অযোগ্য। আচ্ছা, অযোগ্যরা তো অন্তত মানুষ! এত মানুষ আজ ২০-২২ দিন ধরে রাস্তায় বসে খেয়ে না-খেয়ে রোদ-বৃষ্টিতে, গরমে-ঘামে বিধ্বস্ত বিচলিত হয়ে সময় পার করছেন। মাননীয়, আপনার সরকার তাঁদের দাবিকে কোনো প্রকার গ্রাহ্য না করে উল্টো চতুরতার আশ্রয় নিয়ে নতুন কারিকুলাম ও পরীক্ষাকে অজুহাত বানিয়ে পূর্বনির্ধারিত ছুটি বাতিল করে তাঁদের ক্লাসে ফেরত পাঠাল। এটি যে শিক্ষকদের ঘরে ফেরানোর কূটকৌশল, সেটি বুঝতে কি বিজ্ঞানী হওয়ার দরকার পড়ে?

শিক্ষক বাদ দিলাম, ছুটির প্রস্তুতি নিয়ে রাখা কোমলপ্রাণ শিক্ষার্থীদের ছুটি বাতিল করে শ্রেণিকক্ষে পাঠানোটা যে তাদের মনঃকষ্টের কারণ, সেটি বোঝার ক্ষমতাও কি আপনাদের নেই? শুধু তা-ই না, শিক্ষকদের হয়রানি-অপদস্থ করতে ম্যানেজিং কমিটি নামক খাই-খাই কমিটিকে নজরদারি বাড়াতেও নির্দেশ দিলেন। এ কেমন মনুষ্যত্ব! একবার ভাবুন, অন্য কোনো পেশাজীবীদের আন্দোলনের ক্ষেত্রে এতটা উদাসীনতা দেখানো বা অবহেলা করা কি সম্ভব হতো? আপনাদের এহেন আচরণে শিক্ষকদের সামাজিক সম্মান যে বাড়ে না, বরং কমে, সেই বোধও কি আপনাদের নেই?

শেষ করছি আরেকজন মাননীয়ের উক্তি দিয়ে। তিনি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার। তাঁর কথায়, ‘সামাজিক সম্মান বড় শিক্ষকের জন্মভূমি। একটা জাতি যখন তার শিক্ষকদের এই মর্যাদাটুকু দেয়, তখনই সেই জাতির ভেতর বড় শিক্ষক জন্মায়।’ এই জাতি কি সেই সম্মান দিতে প্রস্তুত?

লেখক: কলেজশিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হলেন ক্যালিফোর্নিয়ার পরিবহন বিশেষজ্ঞ

‘তল্লাশির’ জন্য উসকানি দিয়েছে গুলশানের ওই বাসার সাবেক কেয়ারটেকার: প্রেস উইং

প্রধান উপদেষ্টার আরও দুই বিশেষ সহকারী নিয়োগ

তানভীর ইমামের বাড়ি ভেবে গুলশানের একটি বাসায় মধ্যরাতে শতাধিক ব্যক্তির অনুপ্রবেশ, তছনছ

৬ জ্যান্ত হাতি নিয়ে রাশিয়ায় মিয়ানমারের জান্তাপ্রধান, উচ্ছ্বসিত পুতিন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত