অভিনয়ের ৫০ বছরে আলমগীর

প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২২, ০৭: ৪২
আপডেট : ২৪ জুন ২০২২, ১১: ৫৩

যেভাবে হলো শুরু
পরিচালক আলমগীর কুমকুমের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা একটি ফটোস্টুডিওতে। আমি ছবি আনতে গিয়েছিলাম। আমার ছবি দেখে তিনি জানতে চাইলেন, সিনেমায় কাজ করতে চাই কি না। আমি কোনো উত্তর না দিয়েই চলে আসি। দ্বিতীয়বার যখন দেখা হয়, তিনি বাসাভাড়া নিতে এসেছিলেন আমাদের ওখানে, সেখানে একটি চলচ্চিত্রের অফিস করতে চান। আমি চলচ্চিত্রের অফিস শুনে ভাড়া দেব না বলে দিই। তখন তিনি আমাকে আবারও চলচ্চিত্রে কাজ করতে বলেন। 
এবার বিষয়টি নিয়ে আমি পরিবারের সঙ্গে কথা বলি। মুক্তিযুদ্ধের সিনেমার কথা শুনে সম্মতি পেলাম পরিবার থেকে। একদিন তেজগাঁওয়ে উনার অফিসে গিয়ে কথা বললাম। কিছুক্ষণ কথা বলার পর জানালেন, আমাকে দিয়ে হবে না। কারণ আমার উচ্চারণে আঞ্চলিক টান আছে। উচ্চারণ ঠিক করে পরের সপ্তাহে আবার যাই। এক সপ্তাহের চেষ্টার পর আমার উচ্চারণ শুনে আলমগীর কুমকুম হেসে বলেন, ‘এক সপ্তাহের চেষ্টায় যে ভাষা চেঞ্জ করতে পারে, সে অবশ্যই চলচ্চিত্রের জন্য উপযুক্ত।’

প্রথম শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা 
প্রথমে শুটিং করতে যাই মহেরায়। সেখানে নায়করাজ একটি রুম পেলেন থাকার জন্য। কবরী ম্যাডাম রুম পেলেন, সবাই সবার মতো জায়গা নিয়ে শুয়ে পড়লেন। আমি আর ক্যামেরাম্যান মাহফুজ কোনো থাকার জায়গা পেলাম না। তখন ম্যানেজার গিয়ে কুমকুম স্যারকে বিষয়টি জানালে আমাদের দুজনকে বারান্দায় খড় বিছিয়ে শুতে দেওয়া হলো। আমরা সেখানেই ঘুমিয়েছিলাম। কবরী ম্যাডাম কুমকুম স্যারের কাছে জানতে চাইলেন কেন আমাদের বারান্দায় শুতে দিলেন! উত্তরে তিনি বলেন, এভাবে কষ্ট করে যদি চলচ্চিত্রে কাজ করতে পারে তাহলে থাকুক, নাহয় চলে যাক। যদি থাকতে পারে, তবেই চলচ্চিত্রের জন্য কিছু করতে পারবে। আমি চলচ্চিত্রের জন্য কী করতে পেরেছি জানি না, কিন্তু আমি মানুষ হতে পেরেছি। এখানে কাজ করতে না পারলে হয়তো অন্য কোনো কাজ করতাম, কিন্তু মানুষ হতে পারতাম কি না; জানি না।

সাফল্যের সূত্র
যেকোনো ক্ষেত্রে সফলতা পেতে সাধনার বিকল্প নেই। কাজ করতে হবে সিনসিয়ারলি। ছোটবেলা থেকে একটি জিনিস জেনেছি, আর তা হলো—গাছ যত বড় হয়, গাছের ডালপালা তত ঝুঁকে যায়। সাধনা হলো সাফল্যের সবচেয়ে বড় সোপান। সাধনা, একাগ্রতা, নিষ্ঠা—এ সবকিছু মিলিয়ে হলো সাফল্য।

রাশভারী নই
সবাই মনে করে আমি খুব রাশভারী লোক। আসলে তা নই। সময়োপযোগী একজন মানুষ। যখন যেখানে যেমন পরিস্থিতি থাকে, আমি সেই পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি। মানুষের সঙ্গে সহজে মিশে যেতে পারি। আমার সম্মানবোধ অনেক বেশি। যেখানে আমার সম্মান থাকবে না মনে হয়, সেখান থেকে সব সময় দূরে থাকি।

নতুন প্রজন্মের প্রতি
নতুন প্রজন্মকে বলব, তোমরা সাধনা করো। চলচ্চিত্রকে আগে ভালোবাসো আর নিজের মধ্যে ধারণ করো। চলচ্চিত্র এমন একটি জায়গা, যেখানে অর্থের পেছনে ছুটলে নিজে এবং চলচ্চিত্র ধ্বংস হবে। আর চলচ্চিত্রকে সাধনা ও ভালোবাসা দিয়ে ধারণ করলে অর্থ তোমাদের পেছনে ছুটবে। এতে তোমাদের ও চলচ্চিত্রের উন্নয়ন হবে।

জানা-অজানা

  • ১৯৫০ সালের ৩ এপ্রিল ঢাকায় জন্ম আলমগীরের। বাবা কলিম উদ্দিন আহম্মেদ ওরফে দুদু মিয়া ছিলেন ঢালিউডের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এর অন্যতম প্রযোজক।
  • আলমগীরের পুরো নাম মহিউদ্দিন আহমেদ আলমগীর। ব্যক্তিজীবনে তাঁরা ৩ ভাই ২ বোন।
  • মোবাইল ফোনের ওয়ালপেপারে সব সময়ই প্রথম সিনেমা ‘আমার জন্মভূমি’র স্থিরচিত্র রেখে দেন তিনি।
  • প্রথম সিনেমা মুক্তির আগেই ‘দস্যুরানী’, ‘অতিথি’, ‘মমতা’ ও ‘হীরা’ সিনেমায় কাজ শুরু করেন।
  • ১৯৭৩ সালের ২৪ অক্টোবর, ঈদের দিন বড় পর্দায় অভিষেক হয় তাঁর। একসঙ্গে দুটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল—‘আমার জন্মভূমি’ ও ‘দস্যুরানী’।
  • মাত্র ২২ বছর বয়সে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন আলমগীর।
  • ১৯৮৫ সালে ‘মা ও ছেলে’ চলচ্চিত্রের জন্য প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
  • দেশের অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে ৯ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ আজীবন সম্মাননা পদক পাওয়ার রেকর্ড একমাত্র তাঁরই রয়েছে।
  • ১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ টানা চার বছর শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়ে নতুন এক রেকর্ড গড়েছিলেন তিনি, যা আজও ভাঙতে পারেননি কেউ।
  • আলমগীর ছয়টি সিনেমা পরিচালনা করেছেন। তাঁর পরিচালিত সিনেমাগুলোর মধ্যে ‘নির্মম’, ‘নিষ্পাপ’, ‘বউ মা’, ‘মায়ের দোয়া’ উল্লেখযোগ্য।
  • প্রযোজনাও করেন আলমগীর। তাঁর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নাম আইকন এন্টারটেইনমেন্ট।
  • বাংলাদেশে জুটি হিসেবে আলমগীর-শাবানা সবচেয়ে বেশি (১০৬টি) সিনেমায় অভিনয় করেছেন।
  • সিনেমায় রোমান্টিক দৃশ্যে অভিনয় করলেও বাস্তব জীবনে শাবানা ও আলমগীর দুজন দুজনকে ‘আপনি’ করে সম্বোধন করেন।
  • দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর পরিচালনায় সর্বাধিক সংখ্যক (৩০টিরও বেশি) সিনেমায় অভিনয় করেছেন আলমগীর।

রুনা লায়লাঅভিনয়ে তাঁর এখনো প্রবল আগ্রহ
রুনা লায়লা, সংগীতশিল্পী ও আলমগীরের জীবনসঙ্গী

আলমগীর সাহেব ওয়ান অব দ্য ফাইনেস্ট অ্যাক্টর অব বাংলাদেশ। শুরু থেকেই আমি তাঁর অভিনয়ের ভীষণ ভক্ত। তিনি খুব ন্যাচারাল অ্যাক্টিং করেন। পুরোনো সিনেমাগুলো এখনো যখন দেখি, আমার কাছে তাঁর অভিনয় ফ্রেশ মনে হয়। আমার মনে হয়, এখনো ভালো স্ক্রিপ্ট পেলে, তিনি ভালো করবেন। কারণ অভিনয়ে তাঁর এখনো প্রবল আগ্রহ। 
একদিন ঢাকার একটি সিগন্যালে গাড়ি থামার পর আমার কাছে এসে একটি ছেলে সালাম দিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, আমি একসময় ভিক্ষা করতাম। কিন্তু একদিন স্যার আমাকে পথে পেয়ে কিছু টাকা দিয়েছিলেন। সেটা দিয়ে ভিক্ষা ছেড়ে আমি এখন টুকটাক ব্যবসা করছি। স্যার আমার জীবন বদলে দিয়েছেন।’ এই ঘটনা আমি আগে জানতাম না। আমি চাই, মানুষ হিসেবে তাঁর সঠিক মূল্যায়ন হোক, অভিনেতা হিসেবে তাঁকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো হোক।

ববিতামানুষ হিসেবে আলমগীর ভাই অপূর্ব
ববিতা, অভিনেত্রী

অভিনয়ে ৫০ বছর পূর্ণ করা একজন শিল্পীর জন্য বিরাট ব্যাপার। কিছুদিন আগে আমার জীবনেও এ সময়টি এসেছিল। মানুষ হিসেবে আলমগীর ভাই অপূর্ব। সব সময়ই শিল্পীদের খোঁজখবর রাখেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর প্রযোজিত ‘ঝুমকা’ ও ‘নির্দোষ’ সিনেমায় অভিনয় করার। বেশ কিছু সিনেমায় আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। আমার প্রযোজিত ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ সিনেমায় অভিনয় করে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। অথচ এই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য তিনি কোনো সম্মানী নেননি। বরং আমার সিনেমাটি যাতে ভালোভাবে শেষ হয়, সে জন্য নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। এমন মহান মানুষের অভিনয়জীবনের সুবর্ণজয়ন্তীতে আমার শ্রদ্ধা, সম্মান, শুভেচ্ছা।

আঁখি আলমগীরআমার বাবাই সেরা নায়ক
আঁখি আলমগীর, সংগীতশিল্পী ও আলমগীরের মেয়ে

বাবা হিসেবে তাঁকে যখন যেভাবে প্রয়োজন, সেভাবেই পেয়েছি। ছোটবেলায় তিনি খুব কঠোর ছিলেন আর এখন বন্ধুর মতো। ছোটবেলায় আমাদের তিন ভাইবোনের আস্থার জায়গা ছিলেন আমাদের বাবা। এত সৎমানুষ জীবনে খুব কম দেখেছি। তাঁকে কখনো কাউকে নিয়ে হিংসা করতে দেখিনি। কাউকে নিয়ে নিন্দা, মন্দ সমালোচনা—এসব থেকে আব্বু দূরে থাকার চেষ্টা করেন। নায়ক হিসেবে আমি কারও সঙ্গেই তুলনা তাঁর করব না। আমি বলব, আমার বাবাই সেরা নায়ক। তবে দর্শক হিসেবে আমার একটি অভিযোগ আছে—বাবার মতো এমন একজন শক্তিমান অভিনেতাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না, এটা এক অর্থে দর্শকদের ঠকানো হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত