গরু-মহিষের জন্মনিবন্ধনে কমেছে সীমান্ত হত্যা

রিমন রহমান, রাজশাহী
প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯: ০৪

এক যুগ আগেও রাজশাহীর বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে অসংখ্য ভারতীয় গরু-মহিষ আসত। অবৈধভাবে পশু আনতে গিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে প্রাণহানিও ঘটত। তবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) একটি উদ্যোগ গত এক দশকে বদলে দিয়েছে এই চিত্র।

বিজিবির নেওয়া সীমান্ত এলাকায় গরু-মহিষের ‘জন্মনিবন্ধনের’ এই উদ্যোগ শুধু পশু চোরাচালানই কমায়নি, একই সঙ্গে কমিয়েছে সীমান্ত হত্যাও। এখন রাজশাহী সীমান্তে বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটি গুলিবিদ্ধের যে ঘটনা ঘটে, এর বেশির ভাগই মাদক চোরাচালানসংশ্লিষ্ট।

বিজিবি ও সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গেছে, চোরাচালান কমাতে বিজিবি সীমান্ত এলাকার সব বাড়ির গরু-মহিষের হিসাব রাখছে। ফলে সীমান্তের ওপার থেকে আনা গরু-মহিষ নিজের বলে চালানোর সুযোগ নেই। এখন সীমান্ত এলাকার কোনো বাড়িতে গরু-মহিষের বাচ্চার জন্ম হলেই বিজিবির সীমান্ত ফাঁড়িতে গিয়ে সেই তথ্য খাতায় লিখে আসতে হয়। এই জন্মনিবন্ধন খাতার একটি থাকে মালিকের কাছেও। মালিকের কাছে থাকা দলিলের মতো। দুই খাতার তথ্যই সব সময় মিল রাখতে হয়। গরু-মহিষ মারা গেলে তা খাতায় লিখতে হয়। আবার বিক্রি করতে চাইলেও লাগবে এই খাতা।

বিজিবি জানায়, প্রায় ১০ বছর আগে এই নিয়ম চালু করা হয়েছে। এর আগে সীমান্তের লোকজন চোরাই পথে গরু-মহিষ এনে বাড়িতে ঢুকিয়েই দাবি করতেন, এগুলো তাঁর বাড়িতে পালিত। তখন আলাদা করার উপায় থাকত না। তাই কার বাড়িতে কয়টি গরু-মহিষ আছে, তা জানতেই এই নিয়ম চালু করা হয়। এতে গরু-মহিষ পাচার বন্ধ হয়েছে। সীমান্ত হত্যা কমেছে। গরু-মহিষের জন্য হুন্ডিতে টাকা পাচারও বন্ধ হয়েছে। আবার ভারতীয় গরু-মহিষ অবৈধভাবে আসা বন্ধ হওয়ায় কৃষক তাঁর পশুর ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন।

রাজশাহী শহরের পদ্মার ওপারে পবা উপজেলার মাজারদিয়াড় গ্রাম। গ্রামটির তিন পাশেই ভারত। এই গ্রামের সবার বাড়িতে গরু-মহিষ আছে। আছে জন্মনিবন্ধন খাতাও। গ্রামের বাসিন্দা রেজাউল ইসলামের কাছে থাকা এই খাতায় দুটি মহিষের তথ্য লেখা আছে। তিনি বলেন, ‘গরু-মহিষের বাচ্চা হলে কিংবা কিনে আনলে বিজিবির খাতায় লিখে আনতে হয়। আগে তো বাড়ির গরু-মহিষ বিক্রি করতে গেলেও ওপারের বলে ধরত, এখন আর ধরে না। এখন প্রশাসনই জানে, আমি কয়টা গরু-মহিষের মালিক।’

চর মাজারদিয়ায় বিজিবির সীমান্ত ফাঁড়ির পাশেই কৃষক মো. মন্টুর বাড়ি। তিনিও বাড়ি থেকে খাতা বের করে এনে দেখালেন। তিনি বলেন, ‘এই খাতা দলিলের মতো। গরু-মহিষ বেচতে গেলেও খাতা লাগবে।’ কৃষক ময়নুল হাসান লিটনের বাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে ভারতীয় সীমান্ত। লিটনের স্ত্রী নিলুফা খাতুন তাঁদের খাতা বের করে দেখালেন। দেখা গেল, গরুর বাচ্চা হওয়ার তারিখ খাতায় লেখা আছে। লেখা আছে বিক্রির তথ্যও। সংখ্যা লিখে সেখানে সিল-সই দিয়েছেন বিজিবির সীমান্ত ফাঁড়ির কর্মকর্তা। নিলুফা বলেন, চরে এখন গরু-মহিষ চুরিও হয় না। কারণ, গরু-মহিষ বাড়িতে রাখলে কিংবা নদী পার করে নিয়ে যেতে হলে খাতা লাগবে। চোরের তো আর খাতা থাকবে না। বিজিবির সিল-সইও থাকবে না।

বিজিবির রাজশাহীর ১ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাব্বির আহমেদ বলেন, প্রায় ১০ বছর ধরে রাজশাহীর প্রতিটি সীমান্তের গ্রামেই এমন ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এই খাতার কারণে সীমান্ত দিয়ে গরু-মহিষ আসছে না। দেশের টাকা বিদেশে যাচ্ছে না। কৃষক গরু-মহিষের ভালো দাম পাচ্ছেন। আবার গরু-মহিষ পাচার বন্ধ হওয়ায় সীমান্তের মৃত্যুও থেমেছে। খাতার কারণে চোরও গরু-মহিষ চুরি করে না। এর নানা রকম উপকারিতা আছে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত