মামুনুর রশীদ
বাবু বলে কাম কাম
সাহেব বলে ধরি আন
সরকার বলে লিবু পিঠের চাম
এ বাবুরাম ফাঁকি দিয়া
চালাইলি আসাম।
এ গান কার লেখা, কার সুর করা, আমি জানি না। তবে চা-বাগানের শ্রমিকদের নিষ্ঠুর নির্যাতন এবং কষ্টের একটি চিত্র এর মধ্য দিয়ে ভেসে ওঠে। ধূর্ততা ও লুণ্ঠন করে ইংরেজদের এক প্রতারণার শিকার ভারতবর্ষের দরিদ্র-ছিন্নমূল মানুষ। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর যখন সম্পত্তি ব্যক্তিমালিকানায় চলে গেল, তখনই তাঁদের সামনে তুলে ধরা হলো একটা প্রলোভন। বলা হলো, আসামের বাগানে ‘গাছ হিলায়গা তো পয়সা মিলেগা’। বেঁচে থাকার তাগিদে ইংরেজদের ছলনায়, রাষ্ট্রযন্ত্রের ভয়ভীতি প্রদর্শনে এবং আড়কাঠিদের (দালাল) দৌরাত্ম্যে জনমানবহীন, দুর্গম জঙ্গল আর ভয়ংকর সব জন্তুজানোয়ারে ভরা আসামের জঙ্গলে নিয়ে আসা হলো এই অসহায় গরিব কৃষকদের। আজীবন কাজের শর্তে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তাঁরা এসেছিলেন বিহার, ওডিশা, মাদ্রাজ, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও বাঁকুড়া থেকে।
এর মধ্যে তাঁরা যে বিদ্রোহ করেননি, তা নয়, কখনো বিদ্রোহ ব্যক্তি পর্যায়ে হতো। যার ফলে নিপীড়ন বেড়ে যেত অনেক গুণ। সুরমা উপত্যকায় ১৮৫৪ সালে মালনীছড়া চা-বাগানের মাধ্যমে এই অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চায়ের চাষ শুরু হয়। প্রায় এক শতাব্দী এই সব চা-শ্রমিক সব ধরনের নিপীড়ন সহ্য করে, বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে, রেললাইন বসিয়ে রাস্তাঘাট নির্মাণ করে বিভিন্ন চা-বাগানের জন্ম দেন।
এর মধ্যে একটা বড় আন্দোলন ঘটেছিল ১৯২১ সালে। পণ্ডিত গঙ্গাদয়াল দীক্ষিত এবং পণ্ডিত সেওশরনের নেতৃত্বে শুরু হয় ‘মুল্লুকে চল অভিযান’, অর্থাৎ নিজের জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার আন্দোলন। প্রায় ৩০ হাজার চা-শ্রমিক অসহযোগ আন্দোলনে সাড়া দিয়ে নেমে আসেন মুল্লুকে চল অভিযানে। শত শত মাইল পথ হেঁটে শ্রমিকেরা ১৯২১ সালের ২০ মে চাঁদপুরের মেঘনাঘাটে এসে পৌঁছান। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের নির্দেশে এই আন্দোলন চলতে থাকে।
কপর্দকহীন শ্রমিকদের কাছে কোনো পয়সা নেই। তাই জাহাজ কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের জাহাজে নিতে চাইল না। এদিকে মালিকশ্রেণি ও ব্রিটিশ সরকার ভয়ংকর গোর্খা বাহিনী দিয়ে শত শত শ্রমিককে হত্যা করে, সেই আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেয়।
এরপর কয়েক যুগ কেটে গেছে। ভারতবর্ষের মানুষেরা চা-পানে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বিপুল পরিমাণ চায়ের রপ্তানি হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। ইংরেজ মালিকদের সঙ্গে এই সময়ে কিছু দেশীয় বড়লোকেরাও চা-বাগানের মালিকানায় চলে আসেন। আসাম, পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং, শিলিগুড়ি এবং বাংলাদেশের সুরমা উপত্যকায় সিলেটে চা-বাগানের এক বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। দেশভাগের পরেও চা-শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। নামমাত্র মজুরিতে শুধু প্রাণিজগতের নিয়মে বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুই ছিল চা-শ্রমিকদের। কিন্তু অন্যদিকে দেশের রপ্তানি আয়ের দিক থেকে পাটের পরেই ছিল চায়ের স্থান। কিন্তু চা-শ্রমিকদের জীবনের মান উন্নয়নে বা স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার কোনো ব্যবস্থা আজও হয়নি। মালিক কর্তৃপক্ষের শ্রমিকদের থাকার জন্য ঘর দেওয়ার বিধান থাকলেও অধিকাংশ ঘর অস্বাস্থ্যকর এবং বসবাসের অযোগ্য। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে ৭ নম্বর ধারায় রাষ্ট্রের মূলনীতি চারটি বলে ঘোষণা করা হয়েছে। রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে মেহনতি মানুষকে এবং জনগণের অংশগ্রহণকে সকল প্রকার শোষণ থেকে মুক্তিদান করা। ১৫ (ক) ধারায় বলা হয়েছে অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক ব্যবস্থা করা হবে। ১৫ (খ)-তে যুক্তিসংগত মজুরির বিপরীতে কর্মসংস্থানের অধিকারও দেওয়ার কথা বলা আছে। এত সব ধারা সংবিধানের পাতায়ই কি শুধু থাকবে?
চা-শ্রমিকদের জন্য ১২০ টাকা মজুরি নির্ধারণ কোন যুক্তিতে হতে পারে? একদিকে চা-শ্রমিকদের মানবেতর জীবন, অন্যদিকে চা-বাগানের মালিকদের এবং তাঁদের নিয়োজিত ব্যবস্থাপকদের জন্য সুরম্য বাংলো, বছরে একবার বিলেতযাত্রা এবং সব ধরনের জীবনের বিনোদনসহ নিশ্চয়তা বিধান করা। এই স্বল্প মজুরির চা-শ্রমিকেরা অপুষ্টিতে ভুগে ভুগে অকালে মৃত্যুবরণ করছেন। জীবনের সব হতাশা নিয়ে তাঁরা আকণ্ঠ মদ্যপান করে সবকিছু ভুলতে চেয়েছেন। অপুষ্টির দেহে এই আচরণ তাঁদের মৃত্যুকেই ঘনিয়ে আনছে। চা-বাগানের মালিকেরা অবশ্য তাঁদের এসব নেশার জোগান দিয়ে আসছেন বিনা মূল্যে নয়, কখনো উচ্চমূল্যে। দিনের পর দিন টানাটানির সংসারে তাঁরা দ্রুতই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং মহাজনদের কাছে তাঁদের সর্বস্ব তুলে দেন। এর মধ্যে একটা সংগ্রামী অংশও বেড়ে উঠতে থাকে। যাঁরা তাঁদের অধিকারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে আসছেন।
এবারে চা-শ্রমিকেরা ৩০০ টাকা মজুরির জন্য আন্দোলন শুরু করেছেন। আন্দোলনকে ভাঙার জন্য মালিকপক্ষ প্রশাসন, রাজনৈতিক দল এবং আড়কাঠিদের নিয়োগ করেছে। শ্রমিকদের বিভক্ত করার জন্য নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের ফাঁদ রচনা করছে। বিভিন্ন চা-বাগানকে মালিকেরা টি রিসোর্ট হিসেবে ঘোষণা করছে এবং প্রায়ই চা-বাগানের আশপাশে বৃক্ষনিধন শুরু করেছে। চা-শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য যে স্কুল করার কথা ছিল, সেটিও তারা ঠিকমতো করেনি। এক-দুজন শিক্ষক দিয়ে কোনোমতে চালানোর চেষ্টা করছে। চিকিৎসার জন্য যেসব হাসপাতাল করার কথা ছিল, সেই প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করেনি। কোনো কোনো জায়গায় সরকারের কাছ থেকে লিজ নেওয়া চা-বাগানের জায়গা বিক্রি করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। শ্রীমঙ্গল ও মৌলভীবাজারে চা-বাগানগুলোর চারদিক ঘিরে আছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী খাসিয়াদের বসবাস। তাদের গাছপালা কেটে ন্যাশনাল পার্কের নাম করে, জমি অধিগ্রহণের ব্যবস্থা করে, তাদেরও নিপীড়ন করা হচ্ছে। হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও গাছ কাটা শেষ হয় না। খাসিয়াদের প্রধান জীবিকা হচ্ছে পান চাষ। এই পান গাছগুলোর মধ্যেই লতিয়ে বেড়ে ওঠে। যদি গাছ না থাকে তাহলে পানের অস্তিত্বও থাকবে না। বিপুল পরিমাণ খাসিয়া জনগোষ্ঠী এই পরিস্থিতিতে অসহায় হয়ে পড়েছে।
ফিরে আসি চা-শ্রমিকদের বাঁচা-মরার প্রশ্নে। এই শ্রমিকেরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছিলেন। তাঁদের ভাষা-সংস্কৃতি ছিল ভিন্ন। সেটাও ছিল তাঁদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার একটা বড় বাধা এবং মালিকপক্ষ ও ইংরেজ সরকার সেটাকে নিজেদের স্বার্থে দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে তাঁরা সেসব বাধাকে অতিক্রম করছেন, চা-শ্রমিকেরা ইউনিয়ন গড়ে তুলেছেন এবং লড়াই করার ক্ষমতা তাঁরা অর্জন করেছেন। মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা এবং সরকারের কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ টি-বোর্ড যৌথভাবে এই সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসতে পারত। কিন্তু তারা তা করেনি। জেলা প্রশাসকদের দিয়ে একটা দর-কষাকষির চেষ্টা করছে।
জানা গেল, এখন ন্যূনতম মজুরি হবে ১৪৫ টাকা। ৩০০ টাকার দাবি থেকে ১৪৫ টাকা কত দূর! যেখানে সরকারি কর্মচারীদের মজুরি বোর্ড জীবনযাপনের মান বিবেচনা করেই ১৭ হাজার ৩৬২ টাকা নির্ধারণ করেছে, জাতীয়ভাবে শ্রমিক সংগঠনগুলো ন্যূনতম ১৬ হাজার টাকা দাবি করেছে, সেখানে বর্তমানে চা-শ্রমিকদের মজুরি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৬০০ টাকা। লড়াই-সংগ্রাম করার পর যদি মাসিক বেতন দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬০০ টাকা, তাহলে চা-শ্রমিকদের মানুষ না বলে প্রাণীর সঙ্গে তুলনা করা যায়। জেলা প্রশাসক ঘোষণা করেছেন, শ্রমিকেরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছেন এবং যত দিন পর্যন্ত নির্ধারণ না হয় তত দিন ১২০ টাকা মজুরিই থাকবে। এটিও আন্দোলনকে ভেঙে দেওয়ার এক ষড়যন্ত্র এবং শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিকে উপেক্ষা করা।
জেলা প্রশাসক মহোদয় সংবিধানের ধারাগুলো কি পড়েছেন? যদি পড়ে থাকেন তাহলে অনুগ্রহ করে সংবিধানের প্রতি আপনার আনুগত্য স্বীকার করুন। ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনাকাল থেকে সুদীর্ঘ দুই শতাব্দী অতিক্রম করে চা-বাগানের শ্রমিকেরা যে দাবি করেছেন, তা অন্যান্য শ্রমিক সংগঠনের চেয়ে অত্যন্ত কম। তাঁদের এই ন্যায়সংগত দাবি শুধু মজুরির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তাঁদের শিক্ষা, চিকিৎসা এবং মানবিক জীবনযাপনের মানোন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে ও নিশ্চিত করতে হবে।
বাঙালিরা চা-প্রেমী। সকালে আমরা এক কাপ ধূমায়িত চা সামনে রেখে দিন শুরু করি এবং বারবার চা-পানে আমাদের ইন্দ্রিয় সজীব হয়ে ওঠে। আমাদের জন্যই এ দেশে নানান ধরনের চা উৎপাদন করছেন চা-শ্রমিকেরা। সেই চা-শ্রমিকদের বঞ্চনা আমাদের গায়েও এসে লাগুক। আমরা ভাবতে চাই না এই চা শ্রমিকের রক্তে ধোয়া।
বাবু বলে কাম কাম
সাহেব বলে ধরি আন
সরকার বলে লিবু পিঠের চাম
এ বাবুরাম ফাঁকি দিয়া
চালাইলি আসাম।
এ গান কার লেখা, কার সুর করা, আমি জানি না। তবে চা-বাগানের শ্রমিকদের নিষ্ঠুর নির্যাতন এবং কষ্টের একটি চিত্র এর মধ্য দিয়ে ভেসে ওঠে। ধূর্ততা ও লুণ্ঠন করে ইংরেজদের এক প্রতারণার শিকার ভারতবর্ষের দরিদ্র-ছিন্নমূল মানুষ। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর যখন সম্পত্তি ব্যক্তিমালিকানায় চলে গেল, তখনই তাঁদের সামনে তুলে ধরা হলো একটা প্রলোভন। বলা হলো, আসামের বাগানে ‘গাছ হিলায়গা তো পয়সা মিলেগা’। বেঁচে থাকার তাগিদে ইংরেজদের ছলনায়, রাষ্ট্রযন্ত্রের ভয়ভীতি প্রদর্শনে এবং আড়কাঠিদের (দালাল) দৌরাত্ম্যে জনমানবহীন, দুর্গম জঙ্গল আর ভয়ংকর সব জন্তুজানোয়ারে ভরা আসামের জঙ্গলে নিয়ে আসা হলো এই অসহায় গরিব কৃষকদের। আজীবন কাজের শর্তে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তাঁরা এসেছিলেন বিহার, ওডিশা, মাদ্রাজ, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও বাঁকুড়া থেকে।
এর মধ্যে তাঁরা যে বিদ্রোহ করেননি, তা নয়, কখনো বিদ্রোহ ব্যক্তি পর্যায়ে হতো। যার ফলে নিপীড়ন বেড়ে যেত অনেক গুণ। সুরমা উপত্যকায় ১৮৫৪ সালে মালনীছড়া চা-বাগানের মাধ্যমে এই অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চায়ের চাষ শুরু হয়। প্রায় এক শতাব্দী এই সব চা-শ্রমিক সব ধরনের নিপীড়ন সহ্য করে, বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে, রেললাইন বসিয়ে রাস্তাঘাট নির্মাণ করে বিভিন্ন চা-বাগানের জন্ম দেন।
এর মধ্যে একটা বড় আন্দোলন ঘটেছিল ১৯২১ সালে। পণ্ডিত গঙ্গাদয়াল দীক্ষিত এবং পণ্ডিত সেওশরনের নেতৃত্বে শুরু হয় ‘মুল্লুকে চল অভিযান’, অর্থাৎ নিজের জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার আন্দোলন। প্রায় ৩০ হাজার চা-শ্রমিক অসহযোগ আন্দোলনে সাড়া দিয়ে নেমে আসেন মুল্লুকে চল অভিযানে। শত শত মাইল পথ হেঁটে শ্রমিকেরা ১৯২১ সালের ২০ মে চাঁদপুরের মেঘনাঘাটে এসে পৌঁছান। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের নির্দেশে এই আন্দোলন চলতে থাকে।
কপর্দকহীন শ্রমিকদের কাছে কোনো পয়সা নেই। তাই জাহাজ কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের জাহাজে নিতে চাইল না। এদিকে মালিকশ্রেণি ও ব্রিটিশ সরকার ভয়ংকর গোর্খা বাহিনী দিয়ে শত শত শ্রমিককে হত্যা করে, সেই আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেয়।
এরপর কয়েক যুগ কেটে গেছে। ভারতবর্ষের মানুষেরা চা-পানে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বিপুল পরিমাণ চায়ের রপ্তানি হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। ইংরেজ মালিকদের সঙ্গে এই সময়ে কিছু দেশীয় বড়লোকেরাও চা-বাগানের মালিকানায় চলে আসেন। আসাম, পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং, শিলিগুড়ি এবং বাংলাদেশের সুরমা উপত্যকায় সিলেটে চা-বাগানের এক বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। দেশভাগের পরেও চা-শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। নামমাত্র মজুরিতে শুধু প্রাণিজগতের নিয়মে বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুই ছিল চা-শ্রমিকদের। কিন্তু অন্যদিকে দেশের রপ্তানি আয়ের দিক থেকে পাটের পরেই ছিল চায়ের স্থান। কিন্তু চা-শ্রমিকদের জীবনের মান উন্নয়নে বা স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার কোনো ব্যবস্থা আজও হয়নি। মালিক কর্তৃপক্ষের শ্রমিকদের থাকার জন্য ঘর দেওয়ার বিধান থাকলেও অধিকাংশ ঘর অস্বাস্থ্যকর এবং বসবাসের অযোগ্য। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে ৭ নম্বর ধারায় রাষ্ট্রের মূলনীতি চারটি বলে ঘোষণা করা হয়েছে। রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে মেহনতি মানুষকে এবং জনগণের অংশগ্রহণকে সকল প্রকার শোষণ থেকে মুক্তিদান করা। ১৫ (ক) ধারায় বলা হয়েছে অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক ব্যবস্থা করা হবে। ১৫ (খ)-তে যুক্তিসংগত মজুরির বিপরীতে কর্মসংস্থানের অধিকারও দেওয়ার কথা বলা আছে। এত সব ধারা সংবিধানের পাতায়ই কি শুধু থাকবে?
চা-শ্রমিকদের জন্য ১২০ টাকা মজুরি নির্ধারণ কোন যুক্তিতে হতে পারে? একদিকে চা-শ্রমিকদের মানবেতর জীবন, অন্যদিকে চা-বাগানের মালিকদের এবং তাঁদের নিয়োজিত ব্যবস্থাপকদের জন্য সুরম্য বাংলো, বছরে একবার বিলেতযাত্রা এবং সব ধরনের জীবনের বিনোদনসহ নিশ্চয়তা বিধান করা। এই স্বল্প মজুরির চা-শ্রমিকেরা অপুষ্টিতে ভুগে ভুগে অকালে মৃত্যুবরণ করছেন। জীবনের সব হতাশা নিয়ে তাঁরা আকণ্ঠ মদ্যপান করে সবকিছু ভুলতে চেয়েছেন। অপুষ্টির দেহে এই আচরণ তাঁদের মৃত্যুকেই ঘনিয়ে আনছে। চা-বাগানের মালিকেরা অবশ্য তাঁদের এসব নেশার জোগান দিয়ে আসছেন বিনা মূল্যে নয়, কখনো উচ্চমূল্যে। দিনের পর দিন টানাটানির সংসারে তাঁরা দ্রুতই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং মহাজনদের কাছে তাঁদের সর্বস্ব তুলে দেন। এর মধ্যে একটা সংগ্রামী অংশও বেড়ে উঠতে থাকে। যাঁরা তাঁদের অধিকারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে আসছেন।
এবারে চা-শ্রমিকেরা ৩০০ টাকা মজুরির জন্য আন্দোলন শুরু করেছেন। আন্দোলনকে ভাঙার জন্য মালিকপক্ষ প্রশাসন, রাজনৈতিক দল এবং আড়কাঠিদের নিয়োগ করেছে। শ্রমিকদের বিভক্ত করার জন্য নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের ফাঁদ রচনা করছে। বিভিন্ন চা-বাগানকে মালিকেরা টি রিসোর্ট হিসেবে ঘোষণা করছে এবং প্রায়ই চা-বাগানের আশপাশে বৃক্ষনিধন শুরু করেছে। চা-শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য যে স্কুল করার কথা ছিল, সেটিও তারা ঠিকমতো করেনি। এক-দুজন শিক্ষক দিয়ে কোনোমতে চালানোর চেষ্টা করছে। চিকিৎসার জন্য যেসব হাসপাতাল করার কথা ছিল, সেই প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করেনি। কোনো কোনো জায়গায় সরকারের কাছ থেকে লিজ নেওয়া চা-বাগানের জায়গা বিক্রি করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। শ্রীমঙ্গল ও মৌলভীবাজারে চা-বাগানগুলোর চারদিক ঘিরে আছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী খাসিয়াদের বসবাস। তাদের গাছপালা কেটে ন্যাশনাল পার্কের নাম করে, জমি অধিগ্রহণের ব্যবস্থা করে, তাদেরও নিপীড়ন করা হচ্ছে। হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও গাছ কাটা শেষ হয় না। খাসিয়াদের প্রধান জীবিকা হচ্ছে পান চাষ। এই পান গাছগুলোর মধ্যেই লতিয়ে বেড়ে ওঠে। যদি গাছ না থাকে তাহলে পানের অস্তিত্বও থাকবে না। বিপুল পরিমাণ খাসিয়া জনগোষ্ঠী এই পরিস্থিতিতে অসহায় হয়ে পড়েছে।
ফিরে আসি চা-শ্রমিকদের বাঁচা-মরার প্রশ্নে। এই শ্রমিকেরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছিলেন। তাঁদের ভাষা-সংস্কৃতি ছিল ভিন্ন। সেটাও ছিল তাঁদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার একটা বড় বাধা এবং মালিকপক্ষ ও ইংরেজ সরকার সেটাকে নিজেদের স্বার্থে দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে তাঁরা সেসব বাধাকে অতিক্রম করছেন, চা-শ্রমিকেরা ইউনিয়ন গড়ে তুলেছেন এবং লড়াই করার ক্ষমতা তাঁরা অর্জন করেছেন। মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা এবং সরকারের কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ টি-বোর্ড যৌথভাবে এই সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসতে পারত। কিন্তু তারা তা করেনি। জেলা প্রশাসকদের দিয়ে একটা দর-কষাকষির চেষ্টা করছে।
জানা গেল, এখন ন্যূনতম মজুরি হবে ১৪৫ টাকা। ৩০০ টাকার দাবি থেকে ১৪৫ টাকা কত দূর! যেখানে সরকারি কর্মচারীদের মজুরি বোর্ড জীবনযাপনের মান বিবেচনা করেই ১৭ হাজার ৩৬২ টাকা নির্ধারণ করেছে, জাতীয়ভাবে শ্রমিক সংগঠনগুলো ন্যূনতম ১৬ হাজার টাকা দাবি করেছে, সেখানে বর্তমানে চা-শ্রমিকদের মজুরি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৬০০ টাকা। লড়াই-সংগ্রাম করার পর যদি মাসিক বেতন দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬০০ টাকা, তাহলে চা-শ্রমিকদের মানুষ না বলে প্রাণীর সঙ্গে তুলনা করা যায়। জেলা প্রশাসক ঘোষণা করেছেন, শ্রমিকেরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছেন এবং যত দিন পর্যন্ত নির্ধারণ না হয় তত দিন ১২০ টাকা মজুরিই থাকবে। এটিও আন্দোলনকে ভেঙে দেওয়ার এক ষড়যন্ত্র এবং শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিকে উপেক্ষা করা।
জেলা প্রশাসক মহোদয় সংবিধানের ধারাগুলো কি পড়েছেন? যদি পড়ে থাকেন তাহলে অনুগ্রহ করে সংবিধানের প্রতি আপনার আনুগত্য স্বীকার করুন। ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনাকাল থেকে সুদীর্ঘ দুই শতাব্দী অতিক্রম করে চা-বাগানের শ্রমিকেরা যে দাবি করেছেন, তা অন্যান্য শ্রমিক সংগঠনের চেয়ে অত্যন্ত কম। তাঁদের এই ন্যায়সংগত দাবি শুধু মজুরির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তাঁদের শিক্ষা, চিকিৎসা এবং মানবিক জীবনযাপনের মানোন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে ও নিশ্চিত করতে হবে।
বাঙালিরা চা-প্রেমী। সকালে আমরা এক কাপ ধূমায়িত চা সামনে রেখে দিন শুরু করি এবং বারবার চা-পানে আমাদের ইন্দ্রিয় সজীব হয়ে ওঠে। আমাদের জন্যই এ দেশে নানান ধরনের চা উৎপাদন করছেন চা-শ্রমিকেরা। সেই চা-শ্রমিকদের বঞ্চনা আমাদের গায়েও এসে লাগুক। আমরা ভাবতে চাই না এই চা শ্রমিকের রক্তে ধোয়া।
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২০ ঘণ্টা আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৫ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৫ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৫ দিন আগে