শুরু থেকেই সংকটে পলাশ সার কারখানা

রাশেদ নিজাম, নরসিংদী থেকে ফিরে
প্রকাশ : ২৬ এপ্রিল ২০২৩, ১১: ২৬
আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০২৩, ১২: ০৩

বিশাল আকারের পাইপের এ-মাথা থেকে ও-মাথা দেখতে পাওয়া কঠিন। কোথাও খুটখাট শব্দ আবার কোথাও বড় মেশিন আর লরির আওয়াজ। দেশি-বিদেশি মানুষ নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। কারোর দম ফেলার ফুরসত নেই। দেশের সবচেয়ে বড় ইউরিয়া সার কারখানার নির্মাণকাজ চলছে নরসিংদীর পলাশ উপজেলায়।

২০১৮ সালে অনুমোদন পাওয়া কারখানাটির উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ছিল গত বছরের জুনে। কিন্তু কাজ শুরু হয় ধীরগতিতে। গ্যাস-সংযোগ থেকে শুরু করে কারখানা থেকে ঘোড়াশাল পর্যন্ত রেললাইন বসানো এবং কর্মীদের আবাসিক ভবন নির্মাণেও মন্থরগতির কারণে মেয়াদের সঙ্গে বেড়েছে খরচও। নতুন মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে চলতি বছরের নভেম্বর।

বর্ধিত সময়ে সব কাজ শেষ না হলে আবারও খরচ বাড়বে। এ বিষয়ে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা চলমান। যেসব বিষয়ে সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ আছে, সেগুলো দ্রুত সমাধানের চেষ্টা চলছে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা চালু করা সম্ভব হবে।’

উৎপাদন কমে যাওয়ায় ২০১৮ সালে ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড (ইউএফএফএল) ও পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড (পিইউএফএফএল) একীভূত করে ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার প্রকল্প (জিপিইউএফপি) গঠন করা হয়। শিল্প মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) অধীনে ঘোড়াশাল-পলাশ ফার্টিলাইজার পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির (জিপিএফপিএলসি) ওপর।

২০১৮ সালে অনুমোদন পাওয়া কারখানাটির উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ছিল গত বছরের জুনে। জানা যায়, দুটি কারখানা মিলিয়ে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল আড়াই লাখ টন। যদিও শেষের দিকে উৎপাদন হতো দেড় লাখ টনের মতো। একীভূত হওয়ার পর বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা হবে ৯ লাখ ২৪ হাজার টন।

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, ২০১৮ সালে ১০ হাজার ৪৬১ কোটি টাকার প্রকল্পটি অনুমোদন হয়। ২০২২ সালের জুনে মেয়াদ শেষ হলেও নানা কারণে গত বছর ৫ হাজার ৩৯ কোটি টাকা বেড়ে নতুন খরচ দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকায়। এ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে ব্যাংক অব টোকিও মিতসুবিশি ইউএফজে লিমিটেড, জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এবং দ্য হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন লিমিটেড (এইচএসবিসি)। প্রকল্পের নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান জাপানের মিতসুবিশি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ গ্রুপ এবং চীনের চায়না কনসোর্টিয়াম কোম্পানি (সিসি-সেভেন)।

ব্যয় বাড়ার বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. রাজিউর রহমান মল্লিক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের দেড় বছর চলে গেছে ঋণের বিষয়ে বহুপক্ষীয় বিনিয়োগ গ্যারান্টি এজেন্সির (এমআইজিএ) গ্যারান্টি পেতে। ২০২০ সালের মার্চে ঋণচুক্তি কার্যকর হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই কোভিড মহামারির কারণে কাজই শুরু করা যায়নি। প্রায় পাঁচ মাস পর সীমিত পরিসরে কাজ শুরু হলেও বিদেশি পরামর্শক ও প্রকৌশলীরা কাজে যোগ দেন আরও আট মাস পর। সব মিলিয়ে শুরু থেকেই নানা সংকটে পড়েছে এ প্রকল্প। তবে এখন কারখানার প্রায় ৯৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আশা করছি, নভেম্বরেই উৎপাদনে যেতে পারব।’ 
প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজার লোক কাজ করছেন পলাশে। জনবলের মধ্যে ৪ হাজার বাংলাদেশি, বাকি ৭০০ চীনা এবং ৩০০ জাপানি। কারখানা ঘুরে দেখা যায়, প্রাথমিক কাজের জন্য কিছু জায়গায় গ্যাস-সংযোগ চলছে পুরোনো কারখানা থেকে ঠিকঠাক করে।

দুটি কারখানা মিলিয়ে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল আড়াই লাখ টন।কারখানা চালুর পথে যত বাধা
সম্প্রতি শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির সভায় গ্যাসের প্রবাহ নিশ্চিত করতে নতুন রেগুলেটিং ও মিটারিং স্টেশন (আরএমএস) স্থাপন, রেলপথ নির্মাণ এবং পুরোনো ভবন ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণের বিষয়টিকে কারখানা পুরোদমে চালুর পথে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

প্রকল্প পরিচালক মো. রাজিউর রহমান মল্লিক বলেন, ‘গ্যাস নিয়ে একটি বড় সংকট রয়েছে। তিতাস কিংবা পেট্রোবাংলা থেকে গ্যাস পাওয়ার বিষয়টি এখনো সুরাহা হয়নি। আমরা কোনো নিশ্চয়তা কারও কাছ থেকে পাইনি, কোনো চুক্তিও হয়নি।’

প্রকল্পের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী গত বছরের অক্টোবর থেকে স্বল্প পরিসরে কারখানায় গ্যাস-সংযোগ দেওয়ার কথা তিতাসের। তা না হওয়ায় পুরোনো কারখানায় ব্যবহার হওয়া আরএসএম সংস্কার করে গত ডিসেম্বরে সীমিত আকারে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। সভায় প্রকল্প পরিচালক জানান, জুনের মধ্যে নতুন আরএমএস স্থাপনে দরপত্র খোলা হয়েছে।

শিল্পসচিব জাকিয়া সুলতানা আজকের পত্রিকাকে বলেন, সবশেষ তদারকি সভায় দ্রুত আরএমএস স্থাপনের কাজ শেষ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে। তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালক অপারেশন (চলতি দায়িত্ব) প্রকৌশলী মো. সেলিম মিয়া বলেন, ‘এই সার কারখানা উৎপাদনে আসবে অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে আমাদের ঘোড়াশাল সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। সেই মোতাবেক আমরা এখন বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সংযোজন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। গ্যাস সরবরাহের জন্য যেসব কাজ দরকার, তিতাস এখন সেই কাজগুলো করছে। এই সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। তবে আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি।’ 

 ২০১৮ সালে ১০ হাজার ৪৬১ কোটি টাকার প্রকল্পটি অনুমোদন হয়। রেলপথের কাজ শেষ হওয়া নিয়ে সংশয়
কারখানা থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার রেলপথ হবে ঘোড়াশাল পর্যন্ত। কিন্তু উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় বর্ধিত দামে আবার নতুন করে রেলপথ নির্মাণকাজের দরপত্র ডাকা হয়েছে আগের চেয়ে ৫০ কোটি টাকা বাড়িয়ে।

প্রকল্প পরিচালক জানান, কারখানার ভেতরের অংশে রেলপথের কাজ চলছে। তবে বাইরের অংশের কাজ নভেম্বরে শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। 

ভবন নির্মাণকাজ শুরুই হয়নি
কারখানার কর্মকর্তা ও কর্মীদের আবাসন এবং কার্যালয়ের জন্য ৬৬টি ভবন নির্মাণ করতে হবে। পলাশ ফার্টিলাইজার পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি এখনো প্রকল্পকে বুঝিয়ে না দেওয়ায় কাজ শুরু করা যায়নি।

প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘আমাদের প্রকল্পে সরকারি যে অংশ (ভবন), তাতে কাজ শুরু করতে পারিনি। ছয়বার চিঠি দিলেও পিইউএফএফএল এখনো কোনো সাড়া দেয়নি। ঠিক সময়ে শুরু না হলে প্রকল্পের মেয়াদে তা প্রভাব পড়বে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত