আলতাফ পারভেজ
এ মাসে কলকাতা রায়টের ৭৮তম বার্ষিকী। দীর্ঘ সময় পার হলো। কিন্তু আগস্ট এলে বাংলার আনাচকানাচে ঠিকই মনে পড়ে যায় ‘ছেচল্লিশের দাঙ্গা’ এবং পরেরবছরের ‘দেশভাগে’র স্মৃতি।
ছেচল্লিশের দাঙ্গা নিয়ে বিপুল রাজনৈতিক গবেষণা ও মতামত লেখা হয়েছে। এর অনেকগুলোয় ঘটনাবলির জন্য অনেকাংশে শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে দায়ী করা হয়। কিন্তু কতটা সঠিক এই দোষারোপ?
নেহরু বনাম জিন্নাহ: ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে
কলকাতা রায়টের সময়টায় সোহরাওয়ার্দী বাংলার প্রাদেশিক সরকারের মুখ্যমন্ত্রী। ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। ইতিহাসের এই সময়ে ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ নিয়ে কংগ্রেস, লীগ ও ব্রিটিশ প্রভুদের মাঝে দর-কষাকষি চলছিল। তারই অংশ হিসেবে ১৯৪৬-এর মে-জুনে লর্ড পেথিক লরেন্সের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ব্রিটিশ ‘ক্যাবিনেট মিশন’ কিছু প্রস্তাব নিয়েআসে। তাতে হিন্দুপ্রধান, মুসলমানপ্রধান এবং মিশ্র চরিত্রের প্রদেশগুলো নিয়ে তিন ধরনের স্বশাসিত অঞ্চল গঠনের কথা ছিল। প্রদেশগুলো ক, খ ও গ চিহ্নিত ওই তিন ধরনের অঞ্চলের যেকোনোটিতে যুক্ত হতো। ‘গ’ অঞ্চল ছিল বাংলা-আসাম নিয়ে। খ ছিল পশ্চিম দিকের মুসলমান অঞ্চলগুলো নিয়ে।
এই তিনটি স্বশাসিত অঞ্চলের সমন্বয়কারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রীয় ধাঁচে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকত কেবল প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগের বিষয়গুলো। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার আগপর্যন্ত সাময়িক সময়ের জন্য একটা সরকার ভারত শাসন করবে বলে কথা হয়।
এ সময় নেহরু জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হন এবং ১০ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে বলে বসেন, কংগ্রেস প্রয়োজনে ‘ক্যাবিনেট মিশন সমঝোতা’কে সংশোধন করে নেবে। এতে মুসলিম লীগ মনে করল, সম্ভাব্য স্বাধীন ভারতে কংগ্রেস ফেডারেল ব্যবস্থা থেকে সরে যাবে। ‘খ’ ও ‘গ’ জোনে বিভক্ত মুসলমানপ্রধান এলাকাগুলোর স্বায়ত্তশাসন তারা হয়তো রাখবে না। এ সময় জিন্নাহ (১৯৪৬-এর ২৯ জুলাই) এককভাবে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ নামের কর্মসূচি দিলেন; অর্থাৎ সংঘাতের উসকানি এল নেহরুর কাছ থেকে, জিন্নাহ তাতে শক্তভাবে সাড়া দিলেন। নেহরু-জিন্নাহর এই পাল্টাপাল্টির সময় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সোহরাওয়ার্দীর সবেমাত্র তিন মাস হয়েছে।
কলকাতায় ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র কর্মসূচি ছিল ময়দানে মুসলমানদের জমায়েত হওয়া এবং দিনব্যাপী হরতাল পালন। তবে কর্মসূচির শিরোনামের মধ্যে একটা উত্তেজক ব্যাপার ছিল এবং তাৎক্ষণিকভাবে সেটা কলকাতায় সঞ্চারিত হয়ে যায়।
সৈনিক এল, মোতায়েন হলো না
মুসলিম লীগ যদিও ব্রিটিশ শাসক এবং কংগ্রেসের প্রতি ক্ষোভের অংশ হিসেবে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র কর্মসূচি দেয়, বাস্তবে তাদের নেতৃত্ব বিস্তারিত জানায়নি কর্মসূচিতে ঠিক কী করা হবে। তবে কর্মসূচি অস্পষ্ট হলেও কলকাতায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভেতর উত্তেজনা অস্পষ্ট ছিল না। কর্মসূচি সম্পর্কে লীগ নেতা আবুল হাশিম বলেছিলেন, ব্রিটিশরা বাংলাকে যেভাবে ছেড়ে যেতে চায়, তার বিরুদ্ধে এই কর্মসূচি।
প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অপর গুরুত্বপূর্ণ নেতা নাজিমউদ্দিন ১১ আগস্ট এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন বলতে কী বোঝায়, সেটা মুসলমানরা জানে। আমরা তাদের নেতৃত্ব দিতে পিছপা হব না। আর আমরা কংগ্রেসের মতো অহিংস কোনো নীতির কাছে বন্দী নই।’
নাজিমউদ্দিনের বক্তব্য হিন্দুনেতাদের সমালোচনার খোরাক হয় ব্যাপকভাবে। তবে উত্তেজনা ছড়াতে তাঁরাও কম করছিলেন না। ১৪ আগস্ট বালিগঞ্জে এক জনসভায় কংগ্রেস নেতারা ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডেতে দোকানপাট খোলা রাখতে বলেন হিন্দুদের। একই সভায় একজন শিখ নেতা এ-ও বলেন, ‘যদি দাঙ্গা হয় তাহলে শিখরা কংগ্রেসের পাশে থাকবে। মুসলমানদের একটা উচিত শিক্ষা দেওয়া হবে।’ এসব তথ্য জানাচ্ছেন খোদ তখনকার ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি ফ্রান্সিস টুকের তাঁর গ্রন্থে [Francis Tuker, While memory serves]। তিনি আরও বলছেন: আগস্টের শুরু থেকে কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নেতারা উত্তেজক বক্তব্য রাখছিলেন। এ কারণে রাঁচি, চট্টগ্রাম এবং পার্বতীপুর থেকে বাড়তি সংখ্যায় সৈন্য নিয়ে আসা হয় কলকাতায়। বিস্ময়কর হলো, এই সৈন্যদের ১৬ আগস্ট সকাল থেকে মোতায়েন করা হয়নি।
উত্তেজনার জ্বালানি আসছিল দুই তরফ থেকেই
‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ আপাতদৃষ্টিতে লীগের হিন্দুবিরোধী কোনো কর্মসূচি না হলেও স্থানীয় সংগঠকদের মধ্যে কলকাতার মেয়র এবং দলের স্থানীয় সাধারণ সম্পাদক এস এম উসমানের ভূমিকা ছিল তুলনামূলকভাবে আক্রমণাত্মক। তাঁর প্রকাশিত একটি লিফলেটে এ রকম বলা হচ্ছিল, ‘রমজান কাফিরদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের মাস।’ পাশাপাশি হিন্দু মহাসভাও এই মর্মে প্রচার করছিল, কোনোভাবেই ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে সফল হতে দেওয়া যাবে না। এই ‘দিবস’ সফলভাবে পালিত হওয়া মানেই বাংলা ‘পাকিস্তান’ হয়ে যাওয়া। এভাবে উত্তেজনার জ্বালানি দুই তরফ থেকেই আসছিল। অথচ দাঙ্গা সাহিত্যে একে সোহরাওয়ার্দীর ব্যক্তিগত প্রকল্প আকারে হাজির করা হয়।
ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে ঘিরে লীগ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল ১৬ আগস্ট ছুটির দিন রাখা। এ-ও বলা হয়, থানার দায়িত্বে থাকা পুলিশের হিন্দু অফিসারদের নির্দিষ্ট দিনে ছুটি দিয়ে দেওয়া এবং ২৪ থানার মধ্যে ২২টিতে মুসলমান কর্মকর্তাকে নিয়োগ করা হয়। দাঙ্গার সময় পুলিশের নিয়ন্ত্রণকক্ষে সোহরাওয়ার্দীর উপস্থিত থাকা এবং ময়দানে জনসভায় বক্তৃতায় তিনি শ্রোতাদের ‘দল বেঁধে বাড়ি ফেরা’র নির্দেশ দিয়ে দাঙ্গায় উসকানি দিয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে। তবে ফ্রান্সিস টুকেরের বিবরণে ময়দানে সোহরাওয়ার্দীর ভাষণের যে উদ্ধৃতি আছে তা এ রকম: সোহরাওয়ার্দী বলছিলেন, ক্যাবিনেট মিশন একটা ধাপ্পাবাজি। আমি দেখে নেব নেহরু কীভাবে বাংলা শাসন করেন। মুসলমানদের মুক্তির সংগ্রামে ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে প্রথম পদক্ষেপ। সবাই তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যান। শহরের ভেতর মুসলমানদের শান্তিপূর্ণই দেখেছি। এ রকম মানুষদের যেন কোনোভাবে বিরক্ত না করে সে বিষয়ে আমি পুলিশ-মিলিটারিকে বলেছি।
স্পষ্টত এতে হিন্দুদের ওপর হামলা চালানোর কোনো নির্দেশনা ছিল না। কিন্তু এ রকম অভিযোগ আছে, সোহরাওয়ার্দী দাঙ্গার দিনগুলোয় কলকাতায় এমন অনেক প্রভাবশালী মুসলমানদের সংগঠিতকরেছেন যারা ‘সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন’। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখার দায় ছিল তদন্ত কমিশনের। কিন্তু সেই কমিশন তার প্রতিবেদনে এমন কিছু পায়নি, যাতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় সোহরাওয়ার্দী ‘দাঙ্গার অংশীদার’ ছিলেন বা এতে ‘নেতৃত্ব দিয়েছেন’। তবে এটা প্রমাণিত হয়, সোহরাওয়ার্দী জানতেন, সংঘাত হতে পারে। কলকাতা পুলিশের কমিশনার রোনাল্ড রস হার্ডিককে এবং অন্তত একজন সাংবাদিককে দাঙ্গার এক সপ্তাহ আগে সোহরাওয়ার্দী সংঘাতের অনুমানের কথা বলেছিলেন। তবে ‘দাঙ্গা হতে পারে’ এই বক্তব্যকে যতটা সতর্কতামূলক অনুমান হিসেবে ধরা যায়, ততটা যায় না দাঙ্গায় উসকানি হিসেবে।
এ ছাড়া থানাগুলোর হিন্দু কর্তাদের সরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে তখনকার নথি থেকে দেখা যায় ১৬ আগস্ট কলকাতার ২৪ থানার ১৩টিতে মুসলমান কর্মকর্তা এবং ১১টি থানায় হিন্দু কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিলেন। এ ছাড়া তখন দক্ষিণ কলকাতার পুলিশের ডেপুটি কমিশনার ছিলেন মুসলমান; উত্তর কলকাতায় অনুরূপ পদে ছিলেন একজন হিন্দু।
কলকাতা দাঙ্গার বয়ানে এ রকম অনেক ‘গল্পে’ সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ ঘটে গেলেও দাঙ্গা রুখতে সেনা নামল না কেন—এ প্রশ্নের অনুসন্ধান তুলনামূলকভাবে কম।
সেনা মোতায়েনের জন্য গভর্নর ফ্রেডারিক বারোজ এবং তখনকার সময়ের ফোর্ট উইলিয়ামের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার (টুকেরের অনুপস্থিতিতে) ব্রিগেডিয়ার এরিক সিক্সস্মিথের সম্মতি ও সহযোগিতা দরকার ছিল। কলকাতা পুলিশের কমিশনার রোনাল্ড রস হার্ডিক ১৬ আগস্ট দুপুরেই সেটা চেয়েছিলেন। অথচ সেনা মোতায়েন হয় রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ।
জনসভামুখী সোহরাওয়ার্দী দুপুরেও জানতেন না সেনা মোতায়েন হয়নি। তিনি বরং ইফতারের প্রয়োজনে বিকেল ৪টায় জনসভা সংক্ষিপ্ত করতে চেয়েছেন বলে সাক্ষ্য মেলে। তবে এটা সত্য, তিনি জনসভায় উপস্থিতদের ফেরার পথে ‘দলবদ্ধ’ (in groups) থাকতে বলেছিলেন এবং ‘সধর্মী’দের বিপদে সহায়তার জন্য বলেছিলেন। বারোজ পরবর্তীকালে সোহরাওয়ার্দীর এ রকম বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরে গিয়ে নিন্দার শিকার সোহরাওয়ার্দী
এটা কোনো লুকোছাপা বিষয় নয়, সোহরাওয়ার্দী নিজে ব্যক্তিগতভাবে তখনকার পরিস্থিতিতে হিন্দুদের প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করতেন। ১৯২৬-এর দাঙ্গার অভিজ্ঞতা থেকে হয়তো তিনি মুসলমানদের নিরাপত্তা বাড়াতে ‘দলবদ্ধ’ থাকার আহ্বান জানিয়ে থাকতে পারেন। এমনও নজির রয়েছে, তিনি দাঙ্গার পর গ্রেপ্তার হওয়া কোনো কোনো মুসলমানকে পুলিশের হাত থেকে ছাড়াতে ভূমিকা রেখেছেন। এ বক্তব্যও সঠিক, সাম্প্রদায়িক মনোভাব রয়েছে এমন চিহ্নিত ব্যক্তিদের সঙ্গে সোহরাওয়ার্দীকে ‘আলাপ-আলোচনা করতে দেখা গেছে।’ তাঁর এসব ভূমিকাকে সাম্প্রদায়িক বিবেচনায় ‘একপক্ষীয়’ বলা যায়, কিন্তু ‘দাঙ্গার উসকানি’ বলা দুরূহ।
ময়দানের বিকেলের জনসভা শেষে সোহরাওয়ার্দী পুলিশ সদর দপ্তরে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। এ নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সমালোচনা আছে তাঁর বিরুদ্ধে। আবুল হাশিম, মেয়র মুহাম্মদ ওসমান এবং আরও কয়েকজন ঘনিষ্ঠ লীগ সংগঠকসহ সোহরাওয়ার্দী লালবাজারে ভোর চারটা পর্যন্ত অবস্থান করেন। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ সদর দপ্তরে তাঁর উপস্থিতিতে দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের কাজে সমস্যা হয়েছে।
সোহরাওয়ার্দী অভিযোগের উত্তর দিয়েছেন প্রাদেশিক পরিষদে বিতর্কে অংশ নিয়ে ১৯৪৬-এর ২০ সেপ্টেম্বর। তাঁর মতে, নিয়ন্ত্রণকক্ষে থাকার কারণে আমি ঘটনাবলির বিস্তারিত জানতে পারছিলাম। আমি এটাও দেখতে চাইছিলাম বিভিন্ন দিক থেকে আসা দাঙ্গার প্রতিবেদনগুলো কীভাবে মোকাবিলা করা হচ্ছে এবং কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এটাও সঠিক যে যখন সমীচীন মনে করেছি, আমি পরামর্শ দিয়েছি।...হয়তো এ রকম না করলে আমাকে কর্তব্যে অবহেলার জন্য দায়ী করা হতো।
সোহরাওয়ার্দীর এই বক্তব্যে যুক্তি রয়েছে। কিন্তু মুশকিল হলো, পুলিশ নিয়ন্ত্রণকক্ষে তাঁর দীর্ঘ উপস্থিতি কলকাতার হিন্দু সমাজে যে সন্দেহ-অবিশ্বাস তৈরি করেছে, সেটাও যৌক্তিক। তবে এমনও নজির রয়েছে পুলিশের নিয়ন্ত্রণকক্ষে থাকাবস্থায় সোহরাওয়ার্দী তাঁর বিপরীত রাজনৈতিক আদর্শের দেবী প্রসাদ খইতানের অনুরোধে ৭০ জন পুলিশের একটা দলকে পাঠিয়েছিলেন তাঁদের এলাকায়। ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয় আক্রান্ত হলেও মুখ্যমন্ত্রী অনুরূপ পদক্ষেপ নেন।
এসব নজিরের পাশাপাশি কলকাতার মুসলমানদের জন্য সোহরাওয়ার্দী যদি বাড়তি উদ্বিগ্ন হয়ে থাকেন, তার একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে তাদের সংখ্যালঘুত্ব। তখনকার বাংলায় মুসলমানরা সংখ্যাগুরু হলেও কলকাতায় তারা ছিল মাত্র ৩০ শতাংশ। যে শহরে হিন্দুদের সংখ্যা মুসলমানদের দ্বিগুণের বেশি, সেখানে সোহরাওয়ার্দী মুসলমানদের দাঙ্গায় নামতে উৎসাহিত করবেন, এটা বিশ্বাস করাকঠিন। তা ছাড়া সোহরাওয়ার্দী যদি উসকানি দেনও সংখ্যালঘুরা সে রকম উসকানিতে রাজি হবে কেন, যখন তারা জানে সংখ্যায় তারা প্রতিপক্ষের চেয়ে নগণ্য?
১৯৪৬-এ ‘ক্ষমতা’র চূড়ায় কারা ছিলেন?
দাঙ্গার সামাজিক ফল হিসেবে আগস্টের পরপর কলকাতার পাড়া-মহল্লাগুলো হিন্দু-মুসলমান চরিত্র নিয়ে পরিচিত হতে থাকে। ‘হিন্দুপাড়া’য় মুসলমান পোশাক (লুঙ্গি!) বা ‘মুসলমান পাড়া’য় হিন্দু পোশাক (ধুতি!) পরে ঢোকা মৃত্যু পরোয়ানার মতো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়।
বঙ্গে আগে থেকে সম্প্রদায়ভিত্তিক সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের যেসব শরীরী বা পোশাকি উপাদান ছিল, কলকাতা দাঙ্গা শেষে সেসব নতুন এক তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়। যার রেশ হিসেবে আজকের কলকাতায় আমরা দেখব রাজাবাজার, পার্ক সার্কাস, খিদিরপুর, মেটিয়াবুরুজ, ইকবালপুর, মুমিনপুর এলাকা ‘মুসলমান পাড়া’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ধরে নেওয়া হয়, বাকি এলাকাগুলো তাদের নয়!
এ রকম একটা দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক পৃথককরণ নিশ্চিতভাবে কোনো একক ব্যক্তির কারণে ঘটেনি। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে আড়ালে পড়ে আছে বাংলার ইতিহাসে বিভিন্ন ধরনের‘স্বেচ্ছাসেবক’দের ভূমিকা। কথিত ওই ‘সেবক’রা বহু নামে কাজ করছিল ১৯৪৬ সালে।
কলকাতা ঘিরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ছিল ‘হিন্দুস্তান ন্যাশনাল গার্ড’, ‘হিন্দুস্তান সেবাদল’ ও আরএসএসের ‘স্বেচ্ছাসেবক দল’। এর মাঝে প্রথমটি ছিল শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির গড়া; দ্বিতীয়টি ছিল কংগ্রেসের সহযোগী সাবেক সেনাসদস্যদের সংগঠন। একই ধরনের কাজে মুসলমানদের ছিল ‘মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড’, যা ভারত সরকার ১৯৪৮ সালে নিষিদ্ধ করে। শিখদেরও এ রকম একটা সংগঠন ছিল ‘আকাল ফৌজ’ নামে।
১৯৪৬ সালে নোয়াখালী ও বিহারে যে সহিংসতা হয় তার সঙ্গে তুলনা করলে কলকাতা দাঙ্গার ফারাক হলো প্রথমোক্ত দুই অধ্যায়ে ঘটনা ছিল একতরফা। অন্যদিকে, কলকাতায় উভয়পক্ষে প্রস্তুতি ছিল। উভয়ের ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতা তার প্রমাণ। দাঙ্গার কোনো বিবরণ থেকে এ রকম সিদ্ধান্তে আসা কঠিন যে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনের পক্ষপাতের মধ্য দিয়ে মুসলমানরা রক্ষা পেয়েছিল বা মুখ্যমন্ত্রীর উসকানিতে হিন্দুদের একতরফা ক্ষতি হয়েছে।
এ রকম দাবি তখনকার কলকাতার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে ইস্টার্ন কমান্ডের তিন প্রধান কর্মকর্তা জিওসি ফ্রান্সিস টুকের, এরিয়া কমান্ডার সিক্সস্মিথ ও কমান্ডার ম্যাকইনলের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানকেও অগ্রাহ্য করে। বাস্তবতা হলো, স্থানীয় ও ঔপনিবেশিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জটিল এক প্রশাসন ছিল তখন কলকাতায়। সবার উপস্থিতির মাঝেই দাঙ্গা হয় বা ঘটানো হয়। এটা ঘটে, কারণ কলকাতা দাঙ্গা না হলে বাংলা তথা ভারতকে বিভক্ত করা দুরূহ হতো। এই দাঙ্গা যে ভারতবর্ষের বিভক্তি বেশ এগিয়ে দেয় তা সবাই স্বীকার করে।
কংগ্রেস নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ দাঙ্গার প্রথম দিনের যে বিবরণ দিয়েছেন, সেটা এ পর্যায়ে স্মরণ করা জরুরি। তিনি সেদিন কলকাতায় ছিলেন। কলকাতা থেকে দিল্লির উদ্দেশে বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে যা দেখেছেন,সেটা বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন:
আমি যখন স্ট্র্যান্ড রোড দিয়ে যাচ্ছিলাম, সেই সময় লক্ষ করি, একদল গাড়োয়ান এবং দারোয়ান লাঠিসোঁটা হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
তারা আমার গাড়ি আক্রমণ করতে চেষ্টা করে। ড্রাইভার তখন চিৎকার করে বলতে থাকে, এটা কংগ্রেস সভাপতির গাড়ি। কিন্তু জনতা তার কথায় কান দেয়নি। অনেক কষ্টে প্লেন ছাড়ার কয়েক মিনিট আগে দমদম বিমানবন্দরে আসি। ওখানে আমি সেনা বিভাগের এক বিরাট কোম্পানিকে দেখতে পাই। তারা মিলিটারি ট্রাকে অবস্থান করছিল। আমি তাদের জিজ্ঞাসা করি, অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য তারা কিছু করছে না কেন। উত্তরে তারা আমাকে জানায়, তাদের শুধু দাঁড়িয়ে থাকতে বলা হয়েছে। আর কিছু করতে বলা হয়নি।
সারা কলকাতা শহরেই এ অবস্থা দেখা যায়। সব জায়গাতেই মিলিটারি ও পুলিশকে কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। চোখের সামনে নির্দোষ নর-নারীকে নিহত হতে দেখেও তারা স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। (ভারত স্বাধীন হলো, অনুবাদ: সুভাষ মুখোপাধ্যায়, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান, ১৯৮৯, পৃ. ১৫৪-৫৫) তখনকার সময়ের কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ একজন রাজনীতিবিদের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে এই বিবরণ যদি সত্য হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, সেনাবাহিনী যে উত্তাল দাঙ্গার মাঝেও ‘পুতুলের মতো’ দাঁড়িয়ে থাকল, সেটা কি সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশে? নাকি এর পেছনে বাড়তি কিছু রয়েছে, যা অনুসন্ধান দাবি করে।
বাস্তবে বাংলার সমাজের সাম্প্রদায়িক চরিত্র নেওয়া ১৯৪৬-এর বহু আগে থেকেই শুরু হয়েছিল এবং আগস্ট দাঙ্গার পরও সেটা মোটেই থামেনি। তারপরও সোহরাওয়ার্দী যে বিশেষভাবে কলকাতা দাঙ্গার মূল উসকানিদাতা হিসেবে শনাক্ত হন, তার অন্তত একটি কারণ দেশভাগ পূর্বকালের ঔপনিবেশিক প্রশাসনে মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমতার পরিসর এবং তার বিপরীতে ঔপনিবেশিক ক্ষমতার নেটওয়ার্ক সম্পর্কে সচেতনতার ঘাটতি।
অনেকে ভুলে যান, ১৯৪৩ সালে গভর্নর জন হার্বাট বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হককে বরখাস্ত করেছিলেন মেদেনীপুর দাঙ্গায় ঔপনিবেশিক প্রশাসনের ভূমিকার সমালোচনার ‘অপরাধে’। তারও আগে ফজলুল হক ও তাঁর মন্ত্রীদের মতামত না নিয়ে বা উপেক্ষা করে, প্রশাসনকে ব্যবহার করে গভর্নর যেভাবে উপকূলীয় এলাকার নৌযান ধ্বংস করে চাল সংগ্রহ করে দুর্ভিক্ষ ঘটিয়েছিলেন, সেও স্মরণে আনতে পারি আমরা।
১৯৪৩ সালের শুরুতে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ফজলুল হকের পদত্যাগ এবং তার আগে (২০ নভেম্বর) অর্থমন্ত্রী হিসেবে শ্যামাপ্রসাদের মন্ত্রিসভা ছাড়ার মূল কারণ তৈরি হয়েছিল গভর্নর দ্বারা প্রাদেশিক সরকারকে অবজ্ঞা। ফজলুল হক ১৯৪২ সালের ২ আগস্ট জন হার্বাটকে লেখা চিঠিতে দুঃখ ও হতাশার সঙ্গে বলেছিলেন: ‘প্রশাসনের স্থায়ী কর্মকর্তাদের কোনো দায় নেই অথচ রয়েছে সকল ক্ষমতা, আর জনপ্রতিনিধি মন্ত্রীদের নেই কোনো ক্ষমতা, কিন্তু রয়েছে যাবতীয় দায়িত্ব।’ প্রশ্ন হলো, ভারত শাসন আইনের অধীনে বাংলার প্রাদেশিক সরকার যে ন্যূনতম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি, সেটা যদি ফজলুল হক-শ্যামাপ্রসাদ সরকারের জন্য সত্য হয়, তাহলে সোহরাওয়ার্দী সরকারের বেলায় অসত্য হবে কেন?
কলকাতা দাঙ্গায় সোহরাওয়ার্দী প্রশাসনের একজন নির্দয় সমালোচক শ্যামাপ্রসাদ নিজে ১৯৪২ সালে গভর্নরকে লেখা পত্রে বলছিলেন: প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রহসনমাত্র। গভর্নর অবাঞ্ছিতভাবে মন্ত্রিসভার কাজে হস্তক্ষেপ করেন। একই সময় মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক পদত্যাগপত্রে বলেছিলেন, বাংলায় যে চালের অভাবে দুর্ভিক্ষ হলো, সেটা গভর্নরের কারণে। অথচ এ রকম মহাপ্রতাপশালী গভর্নরকে অজ্ঞাত কারণে ১৯৪৬-এর দাঙ্গার সময়কার দায়দায়িত্বের জন্য সামান্যই দোষারোপ করা হয়।
১৯৪৬ সালে বাংলায় মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও ক্ষমতার পরিসরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল গভর্নর ফ্রেডরিক বারোজ, ভাইসরয় লর্ড ওয়াবেল, এমনকি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলিরও। সোহরাওয়ার্দী ভারসাম্যহীনভাবে প্রশাসনিক ভূমিকা রাখবেন এবং তাঁরা সবাই তাঁকে সে রকম কাজ চালিয়ে যেতে দেবেন, এ রকম অনুমান বাস্তবসম্মত নয়।
এ সময় ১৯৪৬-এর জাতীয় রাজনীতিতে মুসলিম লীগের বিপরীতে কংগ্রেসের স্পষ্ট প্রাধান্য ছিল। ঔপনিবেশিক শাসকদের এটা না বোঝার কোনো কারণ ছিল না কার প্রতি পক্ষপাত করতে হবে এবং কার প্রতি কঠোর হতে হবে। সোহরাওয়ার্দী যদি গভর্নর বা ভাইসরয়কে প্রভাবিত করতে সক্ষম মুখ্যমন্ত্রী হতেন, তাহলে তাঁর স্বাধীন অখণ্ড বাংলা প্রস্তাবের নিশ্চয়ই এত করুণ অপমৃত্যু ঘটত না, যা ১৯৪৬-এর দাঙ্গার পরের বছরই ঘটে।
লেখক: আলতাফ পারভেজ, লেখক ও ইতিহাস গবেষক
এ মাসে কলকাতা রায়টের ৭৮তম বার্ষিকী। দীর্ঘ সময় পার হলো। কিন্তু আগস্ট এলে বাংলার আনাচকানাচে ঠিকই মনে পড়ে যায় ‘ছেচল্লিশের দাঙ্গা’ এবং পরেরবছরের ‘দেশভাগে’র স্মৃতি।
ছেচল্লিশের দাঙ্গা নিয়ে বিপুল রাজনৈতিক গবেষণা ও মতামত লেখা হয়েছে। এর অনেকগুলোয় ঘটনাবলির জন্য অনেকাংশে শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে দায়ী করা হয়। কিন্তু কতটা সঠিক এই দোষারোপ?
নেহরু বনাম জিন্নাহ: ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে
কলকাতা রায়টের সময়টায় সোহরাওয়ার্দী বাংলার প্রাদেশিক সরকারের মুখ্যমন্ত্রী। ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। ইতিহাসের এই সময়ে ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ নিয়ে কংগ্রেস, লীগ ও ব্রিটিশ প্রভুদের মাঝে দর-কষাকষি চলছিল। তারই অংশ হিসেবে ১৯৪৬-এর মে-জুনে লর্ড পেথিক লরেন্সের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ব্রিটিশ ‘ক্যাবিনেট মিশন’ কিছু প্রস্তাব নিয়েআসে। তাতে হিন্দুপ্রধান, মুসলমানপ্রধান এবং মিশ্র চরিত্রের প্রদেশগুলো নিয়ে তিন ধরনের স্বশাসিত অঞ্চল গঠনের কথা ছিল। প্রদেশগুলো ক, খ ও গ চিহ্নিত ওই তিন ধরনের অঞ্চলের যেকোনোটিতে যুক্ত হতো। ‘গ’ অঞ্চল ছিল বাংলা-আসাম নিয়ে। খ ছিল পশ্চিম দিকের মুসলমান অঞ্চলগুলো নিয়ে।
এই তিনটি স্বশাসিত অঞ্চলের সমন্বয়কারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রীয় ধাঁচে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকত কেবল প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগের বিষয়গুলো। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার আগপর্যন্ত সাময়িক সময়ের জন্য একটা সরকার ভারত শাসন করবে বলে কথা হয়।
এ সময় নেহরু জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হন এবং ১০ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে বলে বসেন, কংগ্রেস প্রয়োজনে ‘ক্যাবিনেট মিশন সমঝোতা’কে সংশোধন করে নেবে। এতে মুসলিম লীগ মনে করল, সম্ভাব্য স্বাধীন ভারতে কংগ্রেস ফেডারেল ব্যবস্থা থেকে সরে যাবে। ‘খ’ ও ‘গ’ জোনে বিভক্ত মুসলমানপ্রধান এলাকাগুলোর স্বায়ত্তশাসন তারা হয়তো রাখবে না। এ সময় জিন্নাহ (১৯৪৬-এর ২৯ জুলাই) এককভাবে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ নামের কর্মসূচি দিলেন; অর্থাৎ সংঘাতের উসকানি এল নেহরুর কাছ থেকে, জিন্নাহ তাতে শক্তভাবে সাড়া দিলেন। নেহরু-জিন্নাহর এই পাল্টাপাল্টির সময় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সোহরাওয়ার্দীর সবেমাত্র তিন মাস হয়েছে।
কলকাতায় ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র কর্মসূচি ছিল ময়দানে মুসলমানদের জমায়েত হওয়া এবং দিনব্যাপী হরতাল পালন। তবে কর্মসূচির শিরোনামের মধ্যে একটা উত্তেজক ব্যাপার ছিল এবং তাৎক্ষণিকভাবে সেটা কলকাতায় সঞ্চারিত হয়ে যায়।
সৈনিক এল, মোতায়েন হলো না
মুসলিম লীগ যদিও ব্রিটিশ শাসক এবং কংগ্রেসের প্রতি ক্ষোভের অংশ হিসেবে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র কর্মসূচি দেয়, বাস্তবে তাদের নেতৃত্ব বিস্তারিত জানায়নি কর্মসূচিতে ঠিক কী করা হবে। তবে কর্মসূচি অস্পষ্ট হলেও কলকাতায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভেতর উত্তেজনা অস্পষ্ট ছিল না। কর্মসূচি সম্পর্কে লীগ নেতা আবুল হাশিম বলেছিলেন, ব্রিটিশরা বাংলাকে যেভাবে ছেড়ে যেতে চায়, তার বিরুদ্ধে এই কর্মসূচি।
প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অপর গুরুত্বপূর্ণ নেতা নাজিমউদ্দিন ১১ আগস্ট এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন বলতে কী বোঝায়, সেটা মুসলমানরা জানে। আমরা তাদের নেতৃত্ব দিতে পিছপা হব না। আর আমরা কংগ্রেসের মতো অহিংস কোনো নীতির কাছে বন্দী নই।’
নাজিমউদ্দিনের বক্তব্য হিন্দুনেতাদের সমালোচনার খোরাক হয় ব্যাপকভাবে। তবে উত্তেজনা ছড়াতে তাঁরাও কম করছিলেন না। ১৪ আগস্ট বালিগঞ্জে এক জনসভায় কংগ্রেস নেতারা ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডেতে দোকানপাট খোলা রাখতে বলেন হিন্দুদের। একই সভায় একজন শিখ নেতা এ-ও বলেন, ‘যদি দাঙ্গা হয় তাহলে শিখরা কংগ্রেসের পাশে থাকবে। মুসলমানদের একটা উচিত শিক্ষা দেওয়া হবে।’ এসব তথ্য জানাচ্ছেন খোদ তখনকার ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি ফ্রান্সিস টুকের তাঁর গ্রন্থে [Francis Tuker, While memory serves]। তিনি আরও বলছেন: আগস্টের শুরু থেকে কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নেতারা উত্তেজক বক্তব্য রাখছিলেন। এ কারণে রাঁচি, চট্টগ্রাম এবং পার্বতীপুর থেকে বাড়তি সংখ্যায় সৈন্য নিয়ে আসা হয় কলকাতায়। বিস্ময়কর হলো, এই সৈন্যদের ১৬ আগস্ট সকাল থেকে মোতায়েন করা হয়নি।
উত্তেজনার জ্বালানি আসছিল দুই তরফ থেকেই
‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ আপাতদৃষ্টিতে লীগের হিন্দুবিরোধী কোনো কর্মসূচি না হলেও স্থানীয় সংগঠকদের মধ্যে কলকাতার মেয়র এবং দলের স্থানীয় সাধারণ সম্পাদক এস এম উসমানের ভূমিকা ছিল তুলনামূলকভাবে আক্রমণাত্মক। তাঁর প্রকাশিত একটি লিফলেটে এ রকম বলা হচ্ছিল, ‘রমজান কাফিরদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের মাস।’ পাশাপাশি হিন্দু মহাসভাও এই মর্মে প্রচার করছিল, কোনোভাবেই ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে সফল হতে দেওয়া যাবে না। এই ‘দিবস’ সফলভাবে পালিত হওয়া মানেই বাংলা ‘পাকিস্তান’ হয়ে যাওয়া। এভাবে উত্তেজনার জ্বালানি দুই তরফ থেকেই আসছিল। অথচ দাঙ্গা সাহিত্যে একে সোহরাওয়ার্দীর ব্যক্তিগত প্রকল্প আকারে হাজির করা হয়।
ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে ঘিরে লীগ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল ১৬ আগস্ট ছুটির দিন রাখা। এ-ও বলা হয়, থানার দায়িত্বে থাকা পুলিশের হিন্দু অফিসারদের নির্দিষ্ট দিনে ছুটি দিয়ে দেওয়া এবং ২৪ থানার মধ্যে ২২টিতে মুসলমান কর্মকর্তাকে নিয়োগ করা হয়। দাঙ্গার সময় পুলিশের নিয়ন্ত্রণকক্ষে সোহরাওয়ার্দীর উপস্থিত থাকা এবং ময়দানে জনসভায় বক্তৃতায় তিনি শ্রোতাদের ‘দল বেঁধে বাড়ি ফেরা’র নির্দেশ দিয়ে দাঙ্গায় উসকানি দিয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে। তবে ফ্রান্সিস টুকেরের বিবরণে ময়দানে সোহরাওয়ার্দীর ভাষণের যে উদ্ধৃতি আছে তা এ রকম: সোহরাওয়ার্দী বলছিলেন, ক্যাবিনেট মিশন একটা ধাপ্পাবাজি। আমি দেখে নেব নেহরু কীভাবে বাংলা শাসন করেন। মুসলমানদের মুক্তির সংগ্রামে ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে প্রথম পদক্ষেপ। সবাই তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যান। শহরের ভেতর মুসলমানদের শান্তিপূর্ণই দেখেছি। এ রকম মানুষদের যেন কোনোভাবে বিরক্ত না করে সে বিষয়ে আমি পুলিশ-মিলিটারিকে বলেছি।
স্পষ্টত এতে হিন্দুদের ওপর হামলা চালানোর কোনো নির্দেশনা ছিল না। কিন্তু এ রকম অভিযোগ আছে, সোহরাওয়ার্দী দাঙ্গার দিনগুলোয় কলকাতায় এমন অনেক প্রভাবশালী মুসলমানদের সংগঠিতকরেছেন যারা ‘সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন’। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখার দায় ছিল তদন্ত কমিশনের। কিন্তু সেই কমিশন তার প্রতিবেদনে এমন কিছু পায়নি, যাতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় সোহরাওয়ার্দী ‘দাঙ্গার অংশীদার’ ছিলেন বা এতে ‘নেতৃত্ব দিয়েছেন’। তবে এটা প্রমাণিত হয়, সোহরাওয়ার্দী জানতেন, সংঘাত হতে পারে। কলকাতা পুলিশের কমিশনার রোনাল্ড রস হার্ডিককে এবং অন্তত একজন সাংবাদিককে দাঙ্গার এক সপ্তাহ আগে সোহরাওয়ার্দী সংঘাতের অনুমানের কথা বলেছিলেন। তবে ‘দাঙ্গা হতে পারে’ এই বক্তব্যকে যতটা সতর্কতামূলক অনুমান হিসেবে ধরা যায়, ততটা যায় না দাঙ্গায় উসকানি হিসেবে।
এ ছাড়া থানাগুলোর হিন্দু কর্তাদের সরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে তখনকার নথি থেকে দেখা যায় ১৬ আগস্ট কলকাতার ২৪ থানার ১৩টিতে মুসলমান কর্মকর্তা এবং ১১টি থানায় হিন্দু কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিলেন। এ ছাড়া তখন দক্ষিণ কলকাতার পুলিশের ডেপুটি কমিশনার ছিলেন মুসলমান; উত্তর কলকাতায় অনুরূপ পদে ছিলেন একজন হিন্দু।
কলকাতা দাঙ্গার বয়ানে এ রকম অনেক ‘গল্পে’ সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ ঘটে গেলেও দাঙ্গা রুখতে সেনা নামল না কেন—এ প্রশ্নের অনুসন্ধান তুলনামূলকভাবে কম।
সেনা মোতায়েনের জন্য গভর্নর ফ্রেডারিক বারোজ এবং তখনকার সময়ের ফোর্ট উইলিয়ামের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার (টুকেরের অনুপস্থিতিতে) ব্রিগেডিয়ার এরিক সিক্সস্মিথের সম্মতি ও সহযোগিতা দরকার ছিল। কলকাতা পুলিশের কমিশনার রোনাল্ড রস হার্ডিক ১৬ আগস্ট দুপুরেই সেটা চেয়েছিলেন। অথচ সেনা মোতায়েন হয় রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ।
জনসভামুখী সোহরাওয়ার্দী দুপুরেও জানতেন না সেনা মোতায়েন হয়নি। তিনি বরং ইফতারের প্রয়োজনে বিকেল ৪টায় জনসভা সংক্ষিপ্ত করতে চেয়েছেন বলে সাক্ষ্য মেলে। তবে এটা সত্য, তিনি জনসভায় উপস্থিতদের ফেরার পথে ‘দলবদ্ধ’ (in groups) থাকতে বলেছিলেন এবং ‘সধর্মী’দের বিপদে সহায়তার জন্য বলেছিলেন। বারোজ পরবর্তীকালে সোহরাওয়ার্দীর এ রকম বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরে গিয়ে নিন্দার শিকার সোহরাওয়ার্দী
এটা কোনো লুকোছাপা বিষয় নয়, সোহরাওয়ার্দী নিজে ব্যক্তিগতভাবে তখনকার পরিস্থিতিতে হিন্দুদের প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করতেন। ১৯২৬-এর দাঙ্গার অভিজ্ঞতা থেকে হয়তো তিনি মুসলমানদের নিরাপত্তা বাড়াতে ‘দলবদ্ধ’ থাকার আহ্বান জানিয়ে থাকতে পারেন। এমনও নজির রয়েছে, তিনি দাঙ্গার পর গ্রেপ্তার হওয়া কোনো কোনো মুসলমানকে পুলিশের হাত থেকে ছাড়াতে ভূমিকা রেখেছেন। এ বক্তব্যও সঠিক, সাম্প্রদায়িক মনোভাব রয়েছে এমন চিহ্নিত ব্যক্তিদের সঙ্গে সোহরাওয়ার্দীকে ‘আলাপ-আলোচনা করতে দেখা গেছে।’ তাঁর এসব ভূমিকাকে সাম্প্রদায়িক বিবেচনায় ‘একপক্ষীয়’ বলা যায়, কিন্তু ‘দাঙ্গার উসকানি’ বলা দুরূহ।
ময়দানের বিকেলের জনসভা শেষে সোহরাওয়ার্দী পুলিশ সদর দপ্তরে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। এ নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সমালোচনা আছে তাঁর বিরুদ্ধে। আবুল হাশিম, মেয়র মুহাম্মদ ওসমান এবং আরও কয়েকজন ঘনিষ্ঠ লীগ সংগঠকসহ সোহরাওয়ার্দী লালবাজারে ভোর চারটা পর্যন্ত অবস্থান করেন। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ সদর দপ্তরে তাঁর উপস্থিতিতে দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের কাজে সমস্যা হয়েছে।
সোহরাওয়ার্দী অভিযোগের উত্তর দিয়েছেন প্রাদেশিক পরিষদে বিতর্কে অংশ নিয়ে ১৯৪৬-এর ২০ সেপ্টেম্বর। তাঁর মতে, নিয়ন্ত্রণকক্ষে থাকার কারণে আমি ঘটনাবলির বিস্তারিত জানতে পারছিলাম। আমি এটাও দেখতে চাইছিলাম বিভিন্ন দিক থেকে আসা দাঙ্গার প্রতিবেদনগুলো কীভাবে মোকাবিলা করা হচ্ছে এবং কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এটাও সঠিক যে যখন সমীচীন মনে করেছি, আমি পরামর্শ দিয়েছি।...হয়তো এ রকম না করলে আমাকে কর্তব্যে অবহেলার জন্য দায়ী করা হতো।
সোহরাওয়ার্দীর এই বক্তব্যে যুক্তি রয়েছে। কিন্তু মুশকিল হলো, পুলিশ নিয়ন্ত্রণকক্ষে তাঁর দীর্ঘ উপস্থিতি কলকাতার হিন্দু সমাজে যে সন্দেহ-অবিশ্বাস তৈরি করেছে, সেটাও যৌক্তিক। তবে এমনও নজির রয়েছে পুলিশের নিয়ন্ত্রণকক্ষে থাকাবস্থায় সোহরাওয়ার্দী তাঁর বিপরীত রাজনৈতিক আদর্শের দেবী প্রসাদ খইতানের অনুরোধে ৭০ জন পুলিশের একটা দলকে পাঠিয়েছিলেন তাঁদের এলাকায়। ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয় আক্রান্ত হলেও মুখ্যমন্ত্রী অনুরূপ পদক্ষেপ নেন।
এসব নজিরের পাশাপাশি কলকাতার মুসলমানদের জন্য সোহরাওয়ার্দী যদি বাড়তি উদ্বিগ্ন হয়ে থাকেন, তার একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে তাদের সংখ্যালঘুত্ব। তখনকার বাংলায় মুসলমানরা সংখ্যাগুরু হলেও কলকাতায় তারা ছিল মাত্র ৩০ শতাংশ। যে শহরে হিন্দুদের সংখ্যা মুসলমানদের দ্বিগুণের বেশি, সেখানে সোহরাওয়ার্দী মুসলমানদের দাঙ্গায় নামতে উৎসাহিত করবেন, এটা বিশ্বাস করাকঠিন। তা ছাড়া সোহরাওয়ার্দী যদি উসকানি দেনও সংখ্যালঘুরা সে রকম উসকানিতে রাজি হবে কেন, যখন তারা জানে সংখ্যায় তারা প্রতিপক্ষের চেয়ে নগণ্য?
১৯৪৬-এ ‘ক্ষমতা’র চূড়ায় কারা ছিলেন?
দাঙ্গার সামাজিক ফল হিসেবে আগস্টের পরপর কলকাতার পাড়া-মহল্লাগুলো হিন্দু-মুসলমান চরিত্র নিয়ে পরিচিত হতে থাকে। ‘হিন্দুপাড়া’য় মুসলমান পোশাক (লুঙ্গি!) বা ‘মুসলমান পাড়া’য় হিন্দু পোশাক (ধুতি!) পরে ঢোকা মৃত্যু পরোয়ানার মতো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়।
বঙ্গে আগে থেকে সম্প্রদায়ভিত্তিক সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের যেসব শরীরী বা পোশাকি উপাদান ছিল, কলকাতা দাঙ্গা শেষে সেসব নতুন এক তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়। যার রেশ হিসেবে আজকের কলকাতায় আমরা দেখব রাজাবাজার, পার্ক সার্কাস, খিদিরপুর, মেটিয়াবুরুজ, ইকবালপুর, মুমিনপুর এলাকা ‘মুসলমান পাড়া’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ধরে নেওয়া হয়, বাকি এলাকাগুলো তাদের নয়!
এ রকম একটা দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক পৃথককরণ নিশ্চিতভাবে কোনো একক ব্যক্তির কারণে ঘটেনি। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে আড়ালে পড়ে আছে বাংলার ইতিহাসে বিভিন্ন ধরনের‘স্বেচ্ছাসেবক’দের ভূমিকা। কথিত ওই ‘সেবক’রা বহু নামে কাজ করছিল ১৯৪৬ সালে।
কলকাতা ঘিরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ছিল ‘হিন্দুস্তান ন্যাশনাল গার্ড’, ‘হিন্দুস্তান সেবাদল’ ও আরএসএসের ‘স্বেচ্ছাসেবক দল’। এর মাঝে প্রথমটি ছিল শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির গড়া; দ্বিতীয়টি ছিল কংগ্রেসের সহযোগী সাবেক সেনাসদস্যদের সংগঠন। একই ধরনের কাজে মুসলমানদের ছিল ‘মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড’, যা ভারত সরকার ১৯৪৮ সালে নিষিদ্ধ করে। শিখদেরও এ রকম একটা সংগঠন ছিল ‘আকাল ফৌজ’ নামে।
১৯৪৬ সালে নোয়াখালী ও বিহারে যে সহিংসতা হয় তার সঙ্গে তুলনা করলে কলকাতা দাঙ্গার ফারাক হলো প্রথমোক্ত দুই অধ্যায়ে ঘটনা ছিল একতরফা। অন্যদিকে, কলকাতায় উভয়পক্ষে প্রস্তুতি ছিল। উভয়ের ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতা তার প্রমাণ। দাঙ্গার কোনো বিবরণ থেকে এ রকম সিদ্ধান্তে আসা কঠিন যে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনের পক্ষপাতের মধ্য দিয়ে মুসলমানরা রক্ষা পেয়েছিল বা মুখ্যমন্ত্রীর উসকানিতে হিন্দুদের একতরফা ক্ষতি হয়েছে।
এ রকম দাবি তখনকার কলকাতার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে ইস্টার্ন কমান্ডের তিন প্রধান কর্মকর্তা জিওসি ফ্রান্সিস টুকের, এরিয়া কমান্ডার সিক্সস্মিথ ও কমান্ডার ম্যাকইনলের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানকেও অগ্রাহ্য করে। বাস্তবতা হলো, স্থানীয় ও ঔপনিবেশিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জটিল এক প্রশাসন ছিল তখন কলকাতায়। সবার উপস্থিতির মাঝেই দাঙ্গা হয় বা ঘটানো হয়। এটা ঘটে, কারণ কলকাতা দাঙ্গা না হলে বাংলা তথা ভারতকে বিভক্ত করা দুরূহ হতো। এই দাঙ্গা যে ভারতবর্ষের বিভক্তি বেশ এগিয়ে দেয় তা সবাই স্বীকার করে।
কংগ্রেস নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ দাঙ্গার প্রথম দিনের যে বিবরণ দিয়েছেন, সেটা এ পর্যায়ে স্মরণ করা জরুরি। তিনি সেদিন কলকাতায় ছিলেন। কলকাতা থেকে দিল্লির উদ্দেশে বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে যা দেখেছেন,সেটা বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন:
আমি যখন স্ট্র্যান্ড রোড দিয়ে যাচ্ছিলাম, সেই সময় লক্ষ করি, একদল গাড়োয়ান এবং দারোয়ান লাঠিসোঁটা হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
তারা আমার গাড়ি আক্রমণ করতে চেষ্টা করে। ড্রাইভার তখন চিৎকার করে বলতে থাকে, এটা কংগ্রেস সভাপতির গাড়ি। কিন্তু জনতা তার কথায় কান দেয়নি। অনেক কষ্টে প্লেন ছাড়ার কয়েক মিনিট আগে দমদম বিমানবন্দরে আসি। ওখানে আমি সেনা বিভাগের এক বিরাট কোম্পানিকে দেখতে পাই। তারা মিলিটারি ট্রাকে অবস্থান করছিল। আমি তাদের জিজ্ঞাসা করি, অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য তারা কিছু করছে না কেন। উত্তরে তারা আমাকে জানায়, তাদের শুধু দাঁড়িয়ে থাকতে বলা হয়েছে। আর কিছু করতে বলা হয়নি।
সারা কলকাতা শহরেই এ অবস্থা দেখা যায়। সব জায়গাতেই মিলিটারি ও পুলিশকে কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। চোখের সামনে নির্দোষ নর-নারীকে নিহত হতে দেখেও তারা স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। (ভারত স্বাধীন হলো, অনুবাদ: সুভাষ মুখোপাধ্যায়, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান, ১৯৮৯, পৃ. ১৫৪-৫৫) তখনকার সময়ের কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ একজন রাজনীতিবিদের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে এই বিবরণ যদি সত্য হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, সেনাবাহিনী যে উত্তাল দাঙ্গার মাঝেও ‘পুতুলের মতো’ দাঁড়িয়ে থাকল, সেটা কি সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশে? নাকি এর পেছনে বাড়তি কিছু রয়েছে, যা অনুসন্ধান দাবি করে।
বাস্তবে বাংলার সমাজের সাম্প্রদায়িক চরিত্র নেওয়া ১৯৪৬-এর বহু আগে থেকেই শুরু হয়েছিল এবং আগস্ট দাঙ্গার পরও সেটা মোটেই থামেনি। তারপরও সোহরাওয়ার্দী যে বিশেষভাবে কলকাতা দাঙ্গার মূল উসকানিদাতা হিসেবে শনাক্ত হন, তার অন্তত একটি কারণ দেশভাগ পূর্বকালের ঔপনিবেশিক প্রশাসনে মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমতার পরিসর এবং তার বিপরীতে ঔপনিবেশিক ক্ষমতার নেটওয়ার্ক সম্পর্কে সচেতনতার ঘাটতি।
অনেকে ভুলে যান, ১৯৪৩ সালে গভর্নর জন হার্বাট বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হককে বরখাস্ত করেছিলেন মেদেনীপুর দাঙ্গায় ঔপনিবেশিক প্রশাসনের ভূমিকার সমালোচনার ‘অপরাধে’। তারও আগে ফজলুল হক ও তাঁর মন্ত্রীদের মতামত না নিয়ে বা উপেক্ষা করে, প্রশাসনকে ব্যবহার করে গভর্নর যেভাবে উপকূলীয় এলাকার নৌযান ধ্বংস করে চাল সংগ্রহ করে দুর্ভিক্ষ ঘটিয়েছিলেন, সেও স্মরণে আনতে পারি আমরা।
১৯৪৩ সালের শুরুতে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ফজলুল হকের পদত্যাগ এবং তার আগে (২০ নভেম্বর) অর্থমন্ত্রী হিসেবে শ্যামাপ্রসাদের মন্ত্রিসভা ছাড়ার মূল কারণ তৈরি হয়েছিল গভর্নর দ্বারা প্রাদেশিক সরকারকে অবজ্ঞা। ফজলুল হক ১৯৪২ সালের ২ আগস্ট জন হার্বাটকে লেখা চিঠিতে দুঃখ ও হতাশার সঙ্গে বলেছিলেন: ‘প্রশাসনের স্থায়ী কর্মকর্তাদের কোনো দায় নেই অথচ রয়েছে সকল ক্ষমতা, আর জনপ্রতিনিধি মন্ত্রীদের নেই কোনো ক্ষমতা, কিন্তু রয়েছে যাবতীয় দায়িত্ব।’ প্রশ্ন হলো, ভারত শাসন আইনের অধীনে বাংলার প্রাদেশিক সরকার যে ন্যূনতম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি, সেটা যদি ফজলুল হক-শ্যামাপ্রসাদ সরকারের জন্য সত্য হয়, তাহলে সোহরাওয়ার্দী সরকারের বেলায় অসত্য হবে কেন?
কলকাতা দাঙ্গায় সোহরাওয়ার্দী প্রশাসনের একজন নির্দয় সমালোচক শ্যামাপ্রসাদ নিজে ১৯৪২ সালে গভর্নরকে লেখা পত্রে বলছিলেন: প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রহসনমাত্র। গভর্নর অবাঞ্ছিতভাবে মন্ত্রিসভার কাজে হস্তক্ষেপ করেন। একই সময় মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক পদত্যাগপত্রে বলেছিলেন, বাংলায় যে চালের অভাবে দুর্ভিক্ষ হলো, সেটা গভর্নরের কারণে। অথচ এ রকম মহাপ্রতাপশালী গভর্নরকে অজ্ঞাত কারণে ১৯৪৬-এর দাঙ্গার সময়কার দায়দায়িত্বের জন্য সামান্যই দোষারোপ করা হয়।
১৯৪৬ সালে বাংলায় মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও ক্ষমতার পরিসরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল গভর্নর ফ্রেডরিক বারোজ, ভাইসরয় লর্ড ওয়াবেল, এমনকি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলিরও। সোহরাওয়ার্দী ভারসাম্যহীনভাবে প্রশাসনিক ভূমিকা রাখবেন এবং তাঁরা সবাই তাঁকে সে রকম কাজ চালিয়ে যেতে দেবেন, এ রকম অনুমান বাস্তবসম্মত নয়।
এ সময় ১৯৪৬-এর জাতীয় রাজনীতিতে মুসলিম লীগের বিপরীতে কংগ্রেসের স্পষ্ট প্রাধান্য ছিল। ঔপনিবেশিক শাসকদের এটা না বোঝার কোনো কারণ ছিল না কার প্রতি পক্ষপাত করতে হবে এবং কার প্রতি কঠোর হতে হবে। সোহরাওয়ার্দী যদি গভর্নর বা ভাইসরয়কে প্রভাবিত করতে সক্ষম মুখ্যমন্ত্রী হতেন, তাহলে তাঁর স্বাধীন অখণ্ড বাংলা প্রস্তাবের নিশ্চয়ই এত করুণ অপমৃত্যু ঘটত না, যা ১৯৪৬-এর দাঙ্গার পরের বছরই ঘটে।
লেখক: আলতাফ পারভেজ, লেখক ও ইতিহাস গবেষক
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে