অন্তর্বর্তী সরকার যদি ব্যর্থ হয়...

মহিউদ্দিন খান মোহন
প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০৮: ১৯

সাম্প্রতিক ঘটনাবলি থেকে অনেকেই অনুমান করছেন, দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে বিব্রত ও বিপর্যস্ত করার একটি সূক্ষ্ম প্রয়াস ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সদ্য ক্ষমতাহারা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থক ও সাড়ে ১৫ বছর বৈধ-অবৈধ সুবিধাভোগী শ্রেণিটি সংগত কারণেই অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপর্যস্ত করতে চাইবে। তবে এ সরকার ব্যর্থ হলে তার ফলাফল কী দাঁড়াবে, তা অনুধাবন করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে।

ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার স্বাভাবিক কোনো সরকার নয়। একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এই সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। কেউ যদি সংবিধানের ধারা-উপধারায় এই সরকার গঠনের ভিত্তি খুঁজতে যান, তাহলে তাঁকে হতাশ হতেই হবে। কেননা, যে প্রক্রিয়ায় এই সরকার গঠিত হয়েছে, সংবিধানের কোথাও তার উল্লেখ নেই। তবে ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ বা প্রয়োজনের অনিবার্যতার সূত্র অনুযায়ী কখনো কখনো রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রশ্নে জরুরি সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট সে সিদ্ধান্তই দিয়েছেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার গঠনের আগে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির মতামত চেয়েছিলেন। মাননীয় প্রধান বিচারপতি সাংবিধানিক শূন্যতা রোধকল্পে অন্তর্বর্তী একটি সরকার গঠনের পক্ষে অভিমত দিয়েছেন। সুতরাং এই সরকারের আইনি ভিত্তি বলতে সুপ্রিম কোর্টের ওই রেফারেন্স। আর দ্বিতীয় ভিত্তি হলো জনসাধারণ, যারা সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে ৫ আগস্টের ছাত্র- জনতার গণ-অভ্যুত্থানের জন্ম দিয়েছে।

এটা তো স্বীকার করতেই হবে যে একটি সরকারের বিরুদ্ধে এমন সর্বাত্মক গণ-অভ্যুত্থান আমাদের দেশে খুব একটা হয়নি। পাকিস্তান আমলে ১৯৬৯ সালে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে কিংবা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে আরেক স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে এ বছরের ৫ আগস্ট সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের রয়েছে বিরাট পার্থক্য। ওই দুটি গণ-অভ্যুত্থানেও ব্যাপক জনগণের সমর্থন ছিল, এটা ঠিক। তবে এবার যেভাবে সর্বস্তরের মানুষ রাজপথে নেমে এসেছিল, তেমনটি আগে কখনো দেখা যায়নি। আগের দুটি গণ-আন্দোলন বা গণ-অভ্যুত্থানে ব্যাপক জনসমর্থন থাকলেও এবার ছাত্র-যুবক ছাড়াও বিভিন্ন পেশাজীবী, নিরীহ ক্ষুদ্র দোকানদার, রিকশাচালক এমনকি সাধারণ গৃহবধূরা পর্যন্ত রাজপথে নেমে এসেছিলেন। আর এই গণ-অভ্যুত্থানই অন্তর্বর্তী সরকারের ভিত্তিভূমি। সুতরাং যাঁরা বলার চেষ্টা করছেন, এই সরকারের কোনো ভিত্তি নেই, তাঁরা ভ্রান্তিবিলাসে ভুগছেন।

একটি বিষয় সচেতন ব্যক্তিদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর হঠাৎ করেই দেশে বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণির নানা ধরনের দাবি-দাওয়া নিয়ে মিছিল-সমাবেশ, অবস্থান ধর্মঘট, বিক্ষোভ প্রদর্শন ইত্যাদি বেড়ে গেছে। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড হলো, যেসব দাবি নিয়ে সংশ্লিষ্টরা মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে, বিগত ১৫ বছরে তারা সেগুলো নিয়ে একটি হাঁচি পর্যন্ত দেয়নি। অথচ অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তাদের দাবি আদায়ের চেতনা জেগে উঠল। সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, বাস্তবিকই কি তারা তাদের দাবি আদায় করতে চায়, নাকি এ সরকারকে বিব্রত-বিপর্যস্ত করাই আসল লক্ষ্য? আনসার থেকে শুরু করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক, ডাক্তার, নার্স, শিক্ষক—কে নেই দাবি আদায়ের আন্দোলনে? এরই মধ্যে গত সরকারের আমলে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যেসব কর্মকর্তা বঞ্চিত হয়েছেন, তাঁদের মধ্য থেকে জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নিলেও শুরু হয় হট্টগোল। তাঁরা সচিবালয়ে বিক্ষোভ পর্যন্ত করেন!

সবাই ডিসি হবেন—এমন একটি মনোভাব লক্ষ করা গেছে তাঁদের মধ্যে। অথচ যখন তাঁদের বঞ্চিত করা হয়েছিল, তখন তাঁরা টুঁ শব্দটি করার সাহস করেননি। এই যে সুযোগ পেলেই মাথাচাড়া দেওয়ার প্রবণতা, এটা আমাদের জাতীয় চরিত্রের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য।

অন্যদিকে ঘটে গেছে এক অভাবনীয় ঘটনা। সরকারি চাকরির বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা গত ৩০ সেপ্টেম্বর ঘেরাও করেছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন। উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থীদের নিরস্ত করতে পুলিশকে শেষ পর্যন্ত কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করতে হয়েছে। সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা হয়তো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে অনুরূপ একটি আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। প্রশ্ন হলো, এই আন্দোলনের পেছনে ইন্ধনদাতা কারা? অনেকেই মনে করেন, সদ্য পতিত সরকারের অনুচরেরা এর নেপথ্য কুশীলব। যদিও সরকারের তরফ থেকে ওই দাবির ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করার পর আন্দোলন স্তিমিত হয়েছে, তবে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার।

যেকোনো জাতীয় ও জনগুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ে একটি সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় অনেক ভেবেচিন্তে। গৃহীত সিদ্ধান্তের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর প্রভাব-কুপ্রভাব কতটা পড়বে, সেসব বিষয়ে পর্যালোচনা করে তারপরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া বাঞ্ছনীয়। কেননা, একটি ছোট্ট ভুল সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ পরবর্তী সময়ে বড় ধরনের জটিলতার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

সুতরাং সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধিসহ নানা বিষয়ে যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁদের উচিত ধৈর্য ধারণ করা। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার একটি অস্থায়ী সরকার। এই সরকারের মূল দায়িত্ব রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার করে দেশে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ উন্মুক্ত করা এবং সে রকম একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা। আনসারদের সমস্যার সমাধান কিংবা সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দায়িত্ব এই সরকারের নয়। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত একটি নির্বাচিত সরকারের নেওয়াটাই যৌক্তিক।

অপরদিকে একধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক চাপও অন্তর্বর্তী সরকারকে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। হিসাবমতো যে রাজনৈতিক শক্তির কাছ থেকে এই সরকারের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন পাওয়ার কথা, তারা মুখে সহযোগিতার কথা বললেও কার্যত বৈরিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে চরম নির্যাতিত বিএনপি এখন নির্বাচনের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।

আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে একক শক্তিমান হয়ে ওঠা বিএনপি নেতাদের কথাবার্তায় ক্ষমতার দণ্ড হাতে পেতে উদগ্র হয়ে ওঠার লক্ষণ পরিদৃশ্যমান। অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখন, নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কারসহ যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, সেগুলো সম্পন্ন করতে যে দু-চার বছর সময় লাগবে, তা সবাই মেনে নিলেও বিএনপি মানতে চাইছে না। ইতিমধ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, রাষ্ট্র সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নয়, ওটা নির্বাচিত পার্লামেন্ট করবে।

কথাটা অযৌক্তিক নয়। তবে সে পার্লামেন্ট নির্বাচনের জন্য যে সুস্থ পরিবেশ দরকার তা তো এই সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। এই সরকার রাষ্ট্র সংস্কার সম্পন্ন করবে, তবে তা কার্যকর করবে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার তথা পার্লামেন্ট। এ এক সুকঠিন কাজ। এই কাজটি সম্পন্ন করতে হলে সময়ের প্রয়োজন এবং তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন একটি সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ।

যেকোনো সৃজনশীল কাজের জন্য অনুকূল পরিবেশ অত্যাবশ্যক। আমাদের রাষ্ট্র সংস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সৃজনশীল কাজ। সে জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে নিশ্চিন্তে কাজ করার পরিবেশ দিতে হবে। আর সে দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর। সে জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত রাষ্ট্র সংস্কার সম্পন্ন হওয়ার সময়টুকু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা।

আর যদি তারা ক্ষমতার জন্য উদগ্র হয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছার পথকে এবড়োখেবড়ো করে দেয়, তাহলে ফলাফল হিতে বিপরীত হতে পারে। ক্ষমতা হয়ে যেতে পারে সোনার হরিণ। কারণ, সেই এবড়োখেবড়ো পথ বেয়ে কোন অজগর দৃশ্যপটে আবির্ভূত হবে, কিছুই বলা যায় না।

লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

শিল্পকলার মঞ্চে অভিনয় না করার অনুরোধ মহাপরিচালকের, ক্ষোভ জানালেন মামুনুর রশীদ

আদালতের নিরাপত্তায় বিশেষ বাহিনী চান বিচারকেরা

ইস্টার্ন রিফাইনারি: ১৮ কোটি টাকার কুলিং টাওয়ারের সবই নকল

দুই দিনে ৭ ব্যাংককে ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা দিল বাংলাদেশ ব্যাংক

কোনো পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেননি রয়টার্সের প্রতিবেদক: সিএমপি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত