মামুনুর রশীদ
বরাবরই আমার একটা আগ্রহের জায়গা হচ্ছে বরণীয় মানুষদের আত্মজীবনী। আত্মজীবনী পড়ে যে সময়টা আমি দেখিনি, যে চরিত্রগুলো সম্পর্কে জানি না, তাঁদের জীবন, সাফল্য, ব্যর্থতা এসব জানতে পারি।
অশোক মিত্রের আত্মজীবনী পড়ছিলাম। তিনি গত শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকে আমৃত্যু তাঁর জীবনের গল্প বলেছেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি দেখে আমি ভীষণ অবাক হয়েছি। আরমানিটোলা স্কুলের ছাত্র ছিলেন, সেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পেরে কাশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। ওই সময়টা আমাদের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। একদিকে অখণ্ড ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন, মেধাবী ছাত্রদের মার্ক্সবাদী হয়ে পড়ার প্রবল ঝোঁক, অন্যদিকে ব্রিটিশদের কূট কৌশল এবং কংগ্রেস মুসলিম লীগ নেতাদের ভারত দ্বিখণ্ডিত করার ষড়যন্ত্র। এসবের মধ্য দিয়েই ভারতভাগ, দাঙ্গা, দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব, সন্দেহ, ভুল-বোঝাবুঝি এবং সহিংসতার উত্থান। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর অশোক মিত্র কলকাতাতেই চলে যান। তারপর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে দেশে-বিদেশে শুধু ঘুরেই বেড়াননি, বড় বড় দায়িত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
তাঁর কাজের ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে মুম্বাইয়ের ইকোনমিক উইকলিতে লেখালেখি, নয়াদিল্লিতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করা। গবেষণার কাজে নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নানা দেশ ভ্রমণ করে এসে কলকাতায় থাকতে শুরু করেন।
একসময় গবেষণার কাজের চেয়ে রাজনীতি তাঁর কাছে মুখ্য হয়ে পড়ে। বিধানসভা নির্বাচনে অংশ নেন এবং অর্থমন্ত্রী হিসেবে সিপিএম সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। তবে বেশি দিন তিনি সেই কাজ করেননি। তাঁর স্বভাবের মধ্যেই কোনো একটা জায়গায় বেশি দিন আটকে থাকার ব্যাপার নেই।
এই জীবনপরিক্রমায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অসংখ্য মানব চরিত্রের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা, এর মধ্যে যেমন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা আছেন, তেমনি আছেন একেবারে সাধারণ মানুষ। যেমন আছেন পাচক, গাড়িচালক এবং আরও আরও সাধারণ মানুষ। তবে যে মানুষগুলোকে নিয়ে তিনি লিখেছেন, কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে তার পরিচয়ও দিয়েছেন। এই জীবনের মধ্যে খুব স্পষ্টভাবে রাজনীতির মেরুকরণ, দুই পরাশক্তির স্নায়ুযুদ্ধ এবং শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে অন্তর্বিরোধের বিষয়গুলো খুব স্পষ্টভাবে এসেছে।
এর মধ্যেই আবার রাশেদ খান মেননের ‘এক জীবন’ বইটিও পড়লাম। পঞ্চাশের দশক থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সময়কাল এ বইটিতে তিনি বিবৃত করেছেন। যেখানে তাঁর বাল্যকাল, কৈশোর, যৌবন বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে বেশ সহজিয়া ভঙ্গিতে তিনি বর্ণনা করেছেন। অশোক মিত্র পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি, সিপিএম সরকারের উত্থান এবং পতনের কথা বলেছেন প্রচুর ব্যাখ্যাসহ। রাশেদ খান মেনন প্রথম থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় কিন্তু দুজনের একটা জায়গায় মিল। আর তা হলো—শিল্পচর্চার সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসুসহ আধুনিক কাব্যচর্চা, নৃত্য, সংগীত এবং নাটক এসবের প্রতি তাঁদের আগ্রহ।
বাল্যকাল থেকেই এসব আগ্রহ তাঁদের মানুষের কাছে নিয়ে আসে। যে মানুষ দারিদ্র্য এবং ভুল রাজনীতির কাছে অসহায়। অশোক মিত্র জেল খাটেননি, কিন্তু রাশেদ খান মেনন জেলখাটা, হুলিয়া নিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা এসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন। ভারতবর্ষ অনেক বড় দেশ, সেখানে বামপন্থী রাজনীতি সারা দেশেই প্রভাব সৃষ্টি করেছিল। তাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার যোগ্যতা এবং আকাঙ্ক্ষা দুটোই ছিল। সর্বভারতীয় রাজনীতিতেও তারা ব্যাপক কাজ করেছে, কিন্তু সফল হয়েছে তিনটি রাজ্যে—কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায়। বহুবার ক্ষমতায় থেকেও এবং প্রচুর মেধা থাকা সত্ত্বেও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তারা গঠন করতে পারেনি। কিন্তু গণমানুষের কাজ করেছে প্রচুর।
ত্রিশের দশকে প্রগতি লেখক সংঘ এবং চল্লিশের দশকে ভারতীয় গণনাট্য সংস্থা দেশব্যাপী মেহনতি মানুষের জন্য একটা সাংস্কৃতিক চর্চার দ্বার উন্মোচন করেছিল। যেখানে মুম্বাই ও কলকাতা পথপ্রদর্শক হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। রাশেদ খান মেননের ক্ষেত্রে এ কাজটি তেমন ব্যাপকতা পায়নি। জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম এবং আন্তর্জাতিকতাবাদের যে লড়াই, তার মধ্যে যথাযথ ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত জাতীয় সংগ্রামের বিজয় হয়েছে। সংগত কারণেই ‘এক জীবন’-এ প্রথম পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটে মুক্তিযুদ্ধে। যে মুক্তিযুদ্ধকে তাঁর নেতা মওলানা ভাসানী সমর্থন করেছিলেন। তিনিও সেই পথ ধরে মুক্তিসংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত হন।
কিন্তু অশোক মিত্র আত্মজীবনীর নাম দিয়েছেন ‘আপিলা চাপিলা’। অবচেতনার কোনো লগ্নে এ ছড়াটি তিনি শুনেছিলেন শৈশবে, সেই ছড়াটি ছিল এ রকম, ‘আপিলা চাপিলা ঘন ঘন কাশি রামের হুঁকো শ্যামের বাঁশি’। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অনেক স্মৃতি হারিয়ে গেলেও এ ছড়াটি তাঁর মনে ছিল। তাই আপিলা চাপিলায় জীবনের যতটুকু স্মৃতি আছে উজ্জ্বল এবং ঝাপসা, সবকিছুই তিনি এ বইয়ে লিখে গেছেন। জীবনের শেষে এসে যা হয়—কখনো মনে হয় জীবনের এই যে এত কিছু, সবই বোধ হয় নিরর্থক। শেক্সপিয়ার তো বলেই গেছেন,
ইটস আ টেল টোল্ড বাই অ্যান ইডিয়ট
ফুল অব সাউন্ড ফিউরি
সিগনিফায়িং নাথিং…
আসলেই কি তাই? একেকটা জীবন যোগ করে অশোক মিত্র যে মহাজীবনের মালাটি গেঁথেছেন, তা কি একেবারে নিরর্থক? রাশেদ খান মেননের এক জীবন তো ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। বর্তমানে তিনি আশিতে পড়েছেন। গত ৫০ বছর এবং আরও অনাগত দিনগুলোকে নিয়ে তাঁর জীবন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা অনিশ্চিত। তবে কখনো কখনো এইসব মানুষের মনে প্রশ্ন গভীর থেকে গভীরতর হয়, যাপিত জীবনের অনেক সাফল্য ও ব্যর্থতা মিলিয়ে একটা একাকিত্বের নির্জন প্রান্তরে তাঁরা চলে যান।
কিন্তু আমরা যাঁরা ষাটের দশকের ছাত্র, তারা দেখেছি এই বাংলাদেশে বা ঢাকা শহরে কত ধরনের রাজনীতির উত্থান এবং পতন। আমরা যারা গৌরব-অগৌরব মাথায় নিয়ে ২০২৩-এ এসে পৌঁছালাম, তাঁদের মনেও নানা প্রশ্ন। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় যে রকম একটি অসাম্প্রদায়িক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র তখন ছিল আমাদের হাতের মুঠোয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন। দেশের নতুন সংবিধানে তা যুক্তও হয়েছিল।
কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা দেখি, স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রতিটি দেশে অল্পবিস্তর বিরোধিতা থাকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই বিরোধী শক্তিটা রাষ্ট্রের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের ভাবনাকে রাষ্ট্র পরিচালনার ওপর প্রকাশ্যে বা গোপনে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানকার হিন্দুত্ববাদীরা তাদের মতো করে রাষ্ট্র পরিচালনার চেষ্টা চালায়, কিন্তু সফল হয়নি। আমাদের দেশে দেখা যায়, এই স্বাধীনতাবিরোধীরা খুব গোপনে শিক্ষাব্যবস্থায় এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে জায়গা করে নেওয়ার চেষ্টা করে। এ দেশের মানুষ যেহেতু অসাম্প্রদায়িক, তাই ধর্মকে মুখ্য করার প্রচেষ্টা তেমন একটা সফল হয়নি। কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতির গভীরে তারা পচন ধরাতে সক্ষম হয়েছে। মাদ্রাসাশিক্ষার ব্যাপকতা, হিজাব-বোরকার বিস্তার এবং তরুণদের অপসংস্কৃতির প্রতি আকর্ষণ—সবটা মিলিয়ে কোথায় যেন একটা অশনিসংকেত দেখা যাচ্ছে।
ভারতের স্বাধীনতার পরেও অশোক মিত্রের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে শিক্ষিত মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জ্ঞানচর্চার বিকাশ হয়েছে। রাশেদ খান মেননের অভিজ্ঞতায়—মুসলিম সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও তিনি লক্ষ করেছেন, তারুণ্যের প্রধান শক্তি হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থেকেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে সামরিক শাসনামলে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র দুই-ই উবে যায় এবং স্বাধীনতার বিরোধী শক্তিরা কালক্রমে রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার হয়। ফলে দেশে একধরনের গণতন্ত্র এসেও রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশ রোধ করা যায়নি।
ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু থাকলেও ধর্ম সেখানে সূক্ষ্ম থেকে স্থূলভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রবেশ করেছে। ধর্মের এই রাজনৈতিক ব্যবহার আমাদের মানবিক মূল্যবোধ দিয়ে ঠেকানো যায়নি। দুই দেশের শিক্ষাব্যবস্থাই একটা বিপর্যয়কর পর্যায়ে চলে গেছে। বিশ্বব্যবস্থায় একটি বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে। কিন্তু সে ব্যবস্থাটাও বর্তমানে খুব নড়বড়ে অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে।
পৃথিবীটা কেমন করে পাল্টে যায়, তার সঙ্গে মানুষও! মানুষ বিস্মৃত হয় অতীতের সব আত্মত্যাগ ও মহত্ত্ব থেকে। আমার সৌভাগ্য, বেশ কিছু আত্মজীবনী পড়েছি। তবে নতুন পৃথিবীর কথা হয়তো কোনো নতুন আত্মজীবনী থেকে পড়তে পারব, সেই আশায় রইলাম।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
বরাবরই আমার একটা আগ্রহের জায়গা হচ্ছে বরণীয় মানুষদের আত্মজীবনী। আত্মজীবনী পড়ে যে সময়টা আমি দেখিনি, যে চরিত্রগুলো সম্পর্কে জানি না, তাঁদের জীবন, সাফল্য, ব্যর্থতা এসব জানতে পারি।
অশোক মিত্রের আত্মজীবনী পড়ছিলাম। তিনি গত শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকে আমৃত্যু তাঁর জীবনের গল্প বলেছেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি দেখে আমি ভীষণ অবাক হয়েছি। আরমানিটোলা স্কুলের ছাত্র ছিলেন, সেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পেরে কাশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। ওই সময়টা আমাদের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। একদিকে অখণ্ড ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন, মেধাবী ছাত্রদের মার্ক্সবাদী হয়ে পড়ার প্রবল ঝোঁক, অন্যদিকে ব্রিটিশদের কূট কৌশল এবং কংগ্রেস মুসলিম লীগ নেতাদের ভারত দ্বিখণ্ডিত করার ষড়যন্ত্র। এসবের মধ্য দিয়েই ভারতভাগ, দাঙ্গা, দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব, সন্দেহ, ভুল-বোঝাবুঝি এবং সহিংসতার উত্থান। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর অশোক মিত্র কলকাতাতেই চলে যান। তারপর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে দেশে-বিদেশে শুধু ঘুরেই বেড়াননি, বড় বড় দায়িত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
তাঁর কাজের ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে মুম্বাইয়ের ইকোনমিক উইকলিতে লেখালেখি, নয়াদিল্লিতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করা। গবেষণার কাজে নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নানা দেশ ভ্রমণ করে এসে কলকাতায় থাকতে শুরু করেন।
একসময় গবেষণার কাজের চেয়ে রাজনীতি তাঁর কাছে মুখ্য হয়ে পড়ে। বিধানসভা নির্বাচনে অংশ নেন এবং অর্থমন্ত্রী হিসেবে সিপিএম সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। তবে বেশি দিন তিনি সেই কাজ করেননি। তাঁর স্বভাবের মধ্যেই কোনো একটা জায়গায় বেশি দিন আটকে থাকার ব্যাপার নেই।
এই জীবনপরিক্রমায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অসংখ্য মানব চরিত্রের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা, এর মধ্যে যেমন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা আছেন, তেমনি আছেন একেবারে সাধারণ মানুষ। যেমন আছেন পাচক, গাড়িচালক এবং আরও আরও সাধারণ মানুষ। তবে যে মানুষগুলোকে নিয়ে তিনি লিখেছেন, কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে তার পরিচয়ও দিয়েছেন। এই জীবনের মধ্যে খুব স্পষ্টভাবে রাজনীতির মেরুকরণ, দুই পরাশক্তির স্নায়ুযুদ্ধ এবং শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে অন্তর্বিরোধের বিষয়গুলো খুব স্পষ্টভাবে এসেছে।
এর মধ্যেই আবার রাশেদ খান মেননের ‘এক জীবন’ বইটিও পড়লাম। পঞ্চাশের দশক থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সময়কাল এ বইটিতে তিনি বিবৃত করেছেন। যেখানে তাঁর বাল্যকাল, কৈশোর, যৌবন বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে বেশ সহজিয়া ভঙ্গিতে তিনি বর্ণনা করেছেন। অশোক মিত্র পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি, সিপিএম সরকারের উত্থান এবং পতনের কথা বলেছেন প্রচুর ব্যাখ্যাসহ। রাশেদ খান মেনন প্রথম থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় কিন্তু দুজনের একটা জায়গায় মিল। আর তা হলো—শিল্পচর্চার সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসুসহ আধুনিক কাব্যচর্চা, নৃত্য, সংগীত এবং নাটক এসবের প্রতি তাঁদের আগ্রহ।
বাল্যকাল থেকেই এসব আগ্রহ তাঁদের মানুষের কাছে নিয়ে আসে। যে মানুষ দারিদ্র্য এবং ভুল রাজনীতির কাছে অসহায়। অশোক মিত্র জেল খাটেননি, কিন্তু রাশেদ খান মেনন জেলখাটা, হুলিয়া নিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা এসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন। ভারতবর্ষ অনেক বড় দেশ, সেখানে বামপন্থী রাজনীতি সারা দেশেই প্রভাব সৃষ্টি করেছিল। তাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার যোগ্যতা এবং আকাঙ্ক্ষা দুটোই ছিল। সর্বভারতীয় রাজনীতিতেও তারা ব্যাপক কাজ করেছে, কিন্তু সফল হয়েছে তিনটি রাজ্যে—কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায়। বহুবার ক্ষমতায় থেকেও এবং প্রচুর মেধা থাকা সত্ত্বেও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তারা গঠন করতে পারেনি। কিন্তু গণমানুষের কাজ করেছে প্রচুর।
ত্রিশের দশকে প্রগতি লেখক সংঘ এবং চল্লিশের দশকে ভারতীয় গণনাট্য সংস্থা দেশব্যাপী মেহনতি মানুষের জন্য একটা সাংস্কৃতিক চর্চার দ্বার উন্মোচন করেছিল। যেখানে মুম্বাই ও কলকাতা পথপ্রদর্শক হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। রাশেদ খান মেননের ক্ষেত্রে এ কাজটি তেমন ব্যাপকতা পায়নি। জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম এবং আন্তর্জাতিকতাবাদের যে লড়াই, তার মধ্যে যথাযথ ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত জাতীয় সংগ্রামের বিজয় হয়েছে। সংগত কারণেই ‘এক জীবন’-এ প্রথম পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটে মুক্তিযুদ্ধে। যে মুক্তিযুদ্ধকে তাঁর নেতা মওলানা ভাসানী সমর্থন করেছিলেন। তিনিও সেই পথ ধরে মুক্তিসংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত হন।
কিন্তু অশোক মিত্র আত্মজীবনীর নাম দিয়েছেন ‘আপিলা চাপিলা’। অবচেতনার কোনো লগ্নে এ ছড়াটি তিনি শুনেছিলেন শৈশবে, সেই ছড়াটি ছিল এ রকম, ‘আপিলা চাপিলা ঘন ঘন কাশি রামের হুঁকো শ্যামের বাঁশি’। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অনেক স্মৃতি হারিয়ে গেলেও এ ছড়াটি তাঁর মনে ছিল। তাই আপিলা চাপিলায় জীবনের যতটুকু স্মৃতি আছে উজ্জ্বল এবং ঝাপসা, সবকিছুই তিনি এ বইয়ে লিখে গেছেন। জীবনের শেষে এসে যা হয়—কখনো মনে হয় জীবনের এই যে এত কিছু, সবই বোধ হয় নিরর্থক। শেক্সপিয়ার তো বলেই গেছেন,
ইটস আ টেল টোল্ড বাই অ্যান ইডিয়ট
ফুল অব সাউন্ড ফিউরি
সিগনিফায়িং নাথিং…
আসলেই কি তাই? একেকটা জীবন যোগ করে অশোক মিত্র যে মহাজীবনের মালাটি গেঁথেছেন, তা কি একেবারে নিরর্থক? রাশেদ খান মেননের এক জীবন তো ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। বর্তমানে তিনি আশিতে পড়েছেন। গত ৫০ বছর এবং আরও অনাগত দিনগুলোকে নিয়ে তাঁর জীবন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা অনিশ্চিত। তবে কখনো কখনো এইসব মানুষের মনে প্রশ্ন গভীর থেকে গভীরতর হয়, যাপিত জীবনের অনেক সাফল্য ও ব্যর্থতা মিলিয়ে একটা একাকিত্বের নির্জন প্রান্তরে তাঁরা চলে যান।
কিন্তু আমরা যাঁরা ষাটের দশকের ছাত্র, তারা দেখেছি এই বাংলাদেশে বা ঢাকা শহরে কত ধরনের রাজনীতির উত্থান এবং পতন। আমরা যারা গৌরব-অগৌরব মাথায় নিয়ে ২০২৩-এ এসে পৌঁছালাম, তাঁদের মনেও নানা প্রশ্ন। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় যে রকম একটি অসাম্প্রদায়িক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র তখন ছিল আমাদের হাতের মুঠোয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন। দেশের নতুন সংবিধানে তা যুক্তও হয়েছিল।
কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা দেখি, স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রতিটি দেশে অল্পবিস্তর বিরোধিতা থাকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই বিরোধী শক্তিটা রাষ্ট্রের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের ভাবনাকে রাষ্ট্র পরিচালনার ওপর প্রকাশ্যে বা গোপনে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানকার হিন্দুত্ববাদীরা তাদের মতো করে রাষ্ট্র পরিচালনার চেষ্টা চালায়, কিন্তু সফল হয়নি। আমাদের দেশে দেখা যায়, এই স্বাধীনতাবিরোধীরা খুব গোপনে শিক্ষাব্যবস্থায় এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে জায়গা করে নেওয়ার চেষ্টা করে। এ দেশের মানুষ যেহেতু অসাম্প্রদায়িক, তাই ধর্মকে মুখ্য করার প্রচেষ্টা তেমন একটা সফল হয়নি। কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতির গভীরে তারা পচন ধরাতে সক্ষম হয়েছে। মাদ্রাসাশিক্ষার ব্যাপকতা, হিজাব-বোরকার বিস্তার এবং তরুণদের অপসংস্কৃতির প্রতি আকর্ষণ—সবটা মিলিয়ে কোথায় যেন একটা অশনিসংকেত দেখা যাচ্ছে।
ভারতের স্বাধীনতার পরেও অশোক মিত্রের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে শিক্ষিত মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জ্ঞানচর্চার বিকাশ হয়েছে। রাশেদ খান মেননের অভিজ্ঞতায়—মুসলিম সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও তিনি লক্ষ করেছেন, তারুণ্যের প্রধান শক্তি হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থেকেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে সামরিক শাসনামলে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র দুই-ই উবে যায় এবং স্বাধীনতার বিরোধী শক্তিরা কালক্রমে রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার হয়। ফলে দেশে একধরনের গণতন্ত্র এসেও রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশ রোধ করা যায়নি।
ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু থাকলেও ধর্ম সেখানে সূক্ষ্ম থেকে স্থূলভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রবেশ করেছে। ধর্মের এই রাজনৈতিক ব্যবহার আমাদের মানবিক মূল্যবোধ দিয়ে ঠেকানো যায়নি। দুই দেশের শিক্ষাব্যবস্থাই একটা বিপর্যয়কর পর্যায়ে চলে গেছে। বিশ্বব্যবস্থায় একটি বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে। কিন্তু সে ব্যবস্থাটাও বর্তমানে খুব নড়বড়ে অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে।
পৃথিবীটা কেমন করে পাল্টে যায়, তার সঙ্গে মানুষও! মানুষ বিস্মৃত হয় অতীতের সব আত্মত্যাগ ও মহত্ত্ব থেকে। আমার সৌভাগ্য, বেশ কিছু আত্মজীবনী পড়েছি। তবে নতুন পৃথিবীর কথা হয়তো কোনো নতুন আত্মজীবনী থেকে পড়তে পারব, সেই আশায় রইলাম।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
পর্দার নায়িকারা নিজেদের বয়স আড়ালে রাখা পছন্দ করেন। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আজমেরী হক বাঁধন। প্রতিবছর নিজের জন্মদিনে জানান দেন তাঁর বয়স। গতকাল ছিল বাঁধনের ৪১তম জন্মদিন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেই জানালেন এই তথ্য।
২ দিন আগে১০ বছরের বেশি সময় ধরে শোবিজে কাজ করছেন অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া। নাটকের পাশাপাশি ওটিটিতে দেখা গেছে তাঁকে। সরকারি অনুদানের ‘দেবী’ নামের একটি সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন। প্রশংসিত হলেও সিনেমায় আর দেখা মেলেনি তাঁর। ছোট পর্দাতেও অনেক দিন ধরে অনিয়মিত তিনি। এবার শবনম ফারিয়া হাজির হচ্ছেন নতুন পরিচয়ে। কমেডি রিয়েলিটি
২ দিন আগেআমাদের লোকসংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য যাত্রাপালা। গণমানুষের সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত এই যাত্রাপালা নিয়ে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করছে ‘যাত্রা উৎসব-২০২৪’। আগামী ১ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে শুরু হবে ৭ দিনব্যাপী এই উৎসব।
২ দিন আগে‘বঙ্গবন্ধু’ পদবি বিলীন হবে না। হতে পারে না। যেমনটি ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাশের পদবি বিলীন হয়নি। ইতিহাসে এসব পদবি অম্লান ও অক্ষয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব ছিল অনন্যসাধারণ। আপনজনকে তো অবশ্যই, শত্রুপক্ষের লোকেরাও ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উচ্চপদের
২ দিন আগে