সাধুসঙ্গে হামলা

সম্পাদকীয়
Thumbnail image

বাউলদের ওপর হামলার ঘটনা কিন্তু ঘটছেই। ঘটেই যাচ্ছে। কেউ বুঝি বাউলগানকে উৎখাত করতে চাইছে এই ভূখণ্ড থেকে। শুধু বাউলগানই নয়, গোটা সংস্কৃতিই পড়ছে বিপদের মুখে। কারা বাউলগানের শত্রু, সেটা বুঝে নেওয়া খুব কঠিন নয়। এদের শায়েস্তা করাও সম্ভব, কিন্তু শর্ষের ভেতরে ভূত থাকলে যা হয়, আমাদের দেশে তা-ই হচ্ছে।

হামলার ঘটনাটি ঘটেছে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার লাউবাড়িয়া গ্রামে বাউলদের সাধুসঙ্গে। যে দুর্বৃত্তরা হামলা করেছে, তারা বয়স বা লিঙ্গের বাছবিচারও করেনি। আহত ফজল ফকিরের বয়স ৯০ বছর। নারীরা পাননি রেহাই। তাঁদের জখম করা হয়েছে।

গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, সাধুসঙ্গ থেকে এমন কোনো উসকানি দেওয়া হয়নি, যার কারণে কেউ হামলা করবে। বাউলেরা প্রকৃতই নির্বিরোধী মানুষ। কোনো ধরনের উসকানি দেওয়ার মতো তাঁদের কার্যক্রম নয়। দেহতত্ত্ব ও অধ্যাত্ম জীবন নিয়েই যাঁরা থাকেন ব্যস্ত। পরমাত্মার সঙ্গে মানবাত্মার মিলনের স্বপ্ন দেখেন তাঁরা। আমরা লালন শাহর কথা বলতে পারি। এই কুষ্টিয়ারই ভাড়রা গ্রামে তাঁর জন্ম বলে লোকশ্রুতি আছে; যদিও কেউ কেউ বলে থাকেন, যশোরের হরিশপুর গ্রামের সন্তান ছিলেন লালন। কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়াতেই ছিল লালনের আস্তানা। দুদ্দু শাহ, পাঞ্জু শাহ, পাগলা কানাইরা ছিলেন লালনের শিষ্য। তাঁরাও লালনকে অনুসরণ করে বহু বাউলগান রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ মোহিত হয়েছেন বাউলগানে।

মূর্খরা জানে না, বাউলগানের মর্ম। মনরে তুমি কৃষিকাজ জান না/এমন মানবজমিন রইল পড়ে/চাষ করলে ফলত সোনা’—এ কথার অর্থ যারা বুঝবে না, তারা তো নিজের মন কর্ষণ না করে হামলা চালাবেই। তারা তো আর বুঝবে না, ‘আপনারে চিনলে পরে যায় অচেনারে চেনা’ শুধু কয়েকটি শব্দের সমাহার নয়, জ্ঞানের এক বিশাল খনি।

ঘরোয়াভাবেই লাউবাড়িয়া গ্রামের পলান মণ্ডলের বাড়িতে প্রতিবছরের মতো সাধুসঙ্গের আয়োজন ছিল। প্রথামতো বিভিন্ন এলাকার বাউল, সাধু, লালনভক্ত ও অনুসারীরা সেই আয়োজনে যোগ দিয়েছিলেন। রীতি অনুসারে সান্ধ্য কর্মসূচি পালন করেন তাঁরা। এশার আজানের পর শুরু হয় বাকি কার্যক্রম। আয়োজনে মাইক বা সাউন্ডবক্স ছিল না, যার বিকট শব্দে এলাকার মানুষের সমস্যা হবে। ফলে এই সন্দেহ অমূলক নয় যে আগে যুক্তি করেই দুর্বৃত্তরা ঠিক করেছিল, শায়েস্তা করবে সাধুসঙ্গে যোগ দেওয়া মানুষদের।

এখন প্রশ্ন: এটা কি কতিপয় খামখেয়ালি যুবকের মুহূর্তের উত্তেজনার প্রকাশ, নাকি এর পেছনে সমাজের কোনো কোনো চাঁইয়েরও দেখা পাওয়া যাবে? ইদানীং সংগীতের বিরুদ্ধে একধরনের প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। আমাদের গানেই তো রয়েছে, ‘সুর যদি হারাম হইত/বেলালে কি আজান দিত/সুর কইরা পড়া হইত/পবিত্র কোরান’। সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা তার লোকসংস্কৃতি। লোকের কর্ষিত মনভূমিতেই তার প্রকাশ। সেই মনভূমিকে কর্তৃত্ববাদী মনোভঙ্গি দিয়ে যদি নিকেশ করার চেষ্টা চলে, তাহলে তা প্রতিরোধের শক্তি তো থাকতে হবে প্রশাসনের। ভয় হলো, প্রশাসনের মধ্যেও সচেতনতার অভাব রয়েছে। সাধুসঙ্গে হামলে পড়া কুষ্টিয়ার এই দুর্বৃত্তদের ধরা হোক। তাদের নাম জানা আছে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই তাদের প্রাপ্য।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত