বাঁকে বাঁকে অবৈধ বালুমহাল

আব্দুর রহিম পায়েল, গঙ্গাচড়া
প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২২, ০৭: ২৩
আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০২২, ০৯: ১৮

রংপুরের গঙ্গাচড়া তিস্তা ও ঘাঘট নদের প্রতিটি বাঁক যেন বালু ব্যবসায়ীদের স্বঘোষিত বালুমহালে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন এখান থেকে অবৈধভাবে প্রায় ১ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এসব বালু রংপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে স্থাপনা নির্মাণ ও খাল ভরাটের কাজে ব্যবহার হচ্ছে। স্থানীয় বাজারে যার মূল্য প্রায় ১০ লাখ টাকা।

অবৈধভাবে বালু বাণিজ্য অব্যাহত থাকায় সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় থেকে। আর হুমকিতে রয়েছে পার্শ্ববর্তী ফসলি জমি ও সরকারি বিভিন্ন স্থাপনা। তিস্তা নদীতে সরকারিভাবে বালুমহাল তৈরির মাধ্যমে অবৈধ বালু বাণিজ্য রোধসহ সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে বালু বাণিজ্যের চিত্র। তিস্তা ও ঘাঘট নদের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে শ্যালো মেশিন এবং শুকনো চরে কোদাল ও বেলচা দিয়ে

বালু উত্তোলন করা হয়। তিস্তা নদী এলাকার পয়েন্টগুলো হলো—মহিপুর তিস্তা ব্রিজের নিচ, মহিপুর, গান্নারপাড়, ধামুর বোল্লারপাড়, দক্ষিণ কোলকোন্দ সিংগীমারী, দক্ষিণ কোলকোন্দ গ্রোইন বাঁধ, দক্ষিণ কোলকোন্দ বাবুপাড়া, পাইকান ব্যাঙপাড়া ও পাইকান পীরপাড়া, উত্তর চিলাখাল, পূর্ব ইচলী ও মধ্য ইচলী।

আর ঘাঘট নদের যেসব জায়গা থেকে বালু তোলা হচ্ছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—পাইকান ডাক্তারপাড়া, পাইকান চওড়াপাড়া, পাইকান দোলাপাড়া, পাইকান বগুলাগাড়ী, দক্ষিণ পানাপুকুর ফকিরপাড়াসংলগ্ন বাগানবাড়ী, বেতগাড়ী মুন্সিপাড়া ও বেতগাড়ী বালাপাড়া। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি স্থানে মৎস্য প্রকল্পের নামে খাল খনন করে মাটি ও বালু বিক্রি করা হচ্ছে। এসব স্থান থেকে বালু ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাব খাটিয়ে, কেউ প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে কিংবা কৌশলে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর ধরে বালু ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।

স্থানীয় লোকজন ও সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য মতে, প্রতি বছর গঙ্গাচড়া উপজেলা থেকে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি ঘনফুট বালু ও ভিটি বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। যার ৫৫ শতাংশ তিস্তা নদী থেকে, ৩০ শতাংশ ঘাঘট নদ থেকে এবং অবশিষ্ট ১৫ শতাংশ বিভিন্ন স্থানের মৎস্য প্রকল্পের খননকৃত খাল থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে। এসব বালু ও ভিটি গঙ্গাচড়া উপজেলাসহ রংপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে।

মহিপুর গ্রামের শেখ হাসিনা তিস্তা সেতু এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেতুর প্রায় ১০০ মিটার দূরেই শ্যালো মেশিন দিয়ে নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। বালু তোলার বিষয়ে জানতে চাইলে শ্যালো মেশিন মালিক মহিপুর গ্রামের বাসিন্দা ভুট্টু মিয়া বলেন, ‘আমি প্রায় ৩ মাস এখানে বালু উত্তোলন করছি মসজিদের কাজের জন্য।’ একটি মসজিদ নির্মাণে এত বালু লাগছে কেন, এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেননি তিনি। তবে দাবি করেন, উপজেলা প্রশাসনের কাছে অনুমতি নিয়ে বালু উত্তোলন করছেন। খোঁজ নিলে এলাকাবাসী জানায়, ভুট্টু মিয়া একজন বালু ব্যবসায়ী।

কোলকোন্দ ইউনিয়নের সিংগীমারী এলাকায় তিস্তার চরে গিয়ে দেখা হয় বালু বহনরত ট্রলিমালিক ও বালু ব্যবসায়ী পুলক মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি তো একা তিস্তা নদীর বালুর ব্যবসা করি না। অনেকেই তো করছেন। আপনারা আগে সেগুলোর বিরুদ্ধে লেখেন।’ তিনি আরও জানান, ধামুর মাঝাপাড়া গ্রামে কয়েকজন তো তিস্তা নদী থেকে সারা বছর বালু উত্তোলন করে ব্যবসা করছেন।

এ সময় স্থানীয় কৃষক জোনাব আলী বলেন, ‘আমাদের জমির ওপর দিয়ে জোরপূর্বক রাস্তা তৈরি করে বালু ব্যবসায়ীরা বালু পরিবহন করছেন। এতে আমাদের খেতের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। বালু ব্যবসায়ীদের হাত অনেক লম্বা। তাই অভিযোগ করেও প্রতিকার পাই না।’

বড়বিল ইউনিয়নের দক্ষিণ পানাপুকুর ফকিরপাড়া গ্রামের মুকুল মিয়া বলেন, বালু উত্তোলনে বাধা দেওয়ায় এলাকাবাসীর বিরুদ্ধে মিথ্যা চাঁদাবাজির মামলাও করা হয়েছিল।

উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নয়ন কুমার সাহা গত ১৪ সেপ্টেম্বর পাইকান গ্রামে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন। ওই দিন তিনি ঘাঘট নদের তলদেশ হতে অবৈধভাবে শ্যালো মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলনের দায়ে পাইকান ডাক্তারপাড়া গ্রামের হামিদুল ইসলামের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেন।

স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনের পরোক্ষ মদদেই অবৈধ বালু ব্যবসা অব্যাহত রয়েছে। এতে জড়িত রয়েছেন স্থানীয় বেশ কিছু প্রভাবশালী বালু ব্যবসায়ী। তাঁদের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন স্থানীয় কতিপয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীও। প্রশাসন সক্রিয় হলে নদী থেকে বালু উত্তোলন করা বন্ধ সম্ভব হতো।

জানতে চাইলে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নয়ন কুমার সাহা আজকের পত্রিকাকে বলেন, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত