ডলারের বাজারে অস্থিরতা

জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা
প্রকাশ : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮: ২৬
আপডেট : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮: ৩১

বাজারে ডলার-সংকট মেটাতে ইতিমধ্যে একাধিক ব্যবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য টাকার অবমূল্যায়নসহ নানা উদ্যোগ রয়েছে। এতে কিছুটা সহনীয় ছিল ডলারের বাজার। কিন্তু গত সোমবার ডলারের দাম নতুন করে নির্ধারণ করায় বাজারের অস্থিরতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। যার নেতিবাচক প্রভাব মূল্যস্ফীতি ও আমদানিতে পড়তে শুরু করেছে। একই সঙ্গে খোলাবাজার থেকে ডলার যেন লাপাত্তা হয়েছে।

জানা গেছে, নতুন দাম নির্ধারণের দুই দিন পরেই আমদানি পর্যায়ে ডলারের দাম এক লাফে সর্বোচ্চ ১২ টাকা বেড়ে ১০৬ টাকা ৯০ পয়সা হয়েছে। এর আগে দর ছিল ৯৫ টাকা। গত সোমবার নতুন দর কার্যকর হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকও ডলারের দাম ৯৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৬ টাকা করে। গতকাল বৃহস্পতিবার খোলাবাজারে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ১১৭ টাকা। যদিও ব্যবসায়ীরা ডলারের কেনা দাম ১০৭ টাকা ও বিক্রির দাম ১০৮ টাকা লিখে তালিকা ঝুলিয়ে রেখেছেন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপের ফলে ডলার বাজার এত দিন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু নতুন দর নির্ধারণের ফলে বাজারে বাড়তি অস্থিরতা দেখা গেছে। আবার অস্থিরতা কাটাতে সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করলে বাজার আরও লাগামছাড়া হবে। মূল্যস্ফীতিতে বাড়তি চাপ আসবে।

ব্যাংকগুলোর ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য বলছে, সোনালী ব্যাংক আমদানি দায় নিষ্পত্তিতে প্রতি ডলারে ১০৭ টাকা ৪৫ পয়সা নিয়েছে। অগ্রণী ব্যাংক নিয়েছে ১০৫ টাকা ৪০ পয়সা। আর সাউথইস্ট ব্যাংক নিয়েছে ১০১ টাকা ৩৭ পয়সা। আবার সিটি ব্যাংক আমদানি দায় নিষ্পত্তিতে প্রতি ডলার নিয়েছে ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা। 
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের দাম বাড়ায় বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যয় বেড়েছে। সেই সঙ্গে ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের খরচ বেড়ে গেছে। আবার ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স ক্রয়ের বেঁধে দেওয়া দর ১০৮ টাকার চেয়ে হুন্ডিতে গড়ে ৫ টাকা বেশি পাওয়ায় প্রবাসীদের একটা অংশ ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠাতে নিরুৎসাহিত হয়ে হুন্ডির পথে উদ্বুদ্ধ হবে।

এদিকে আমদানি পর্যায়ে ডলারের দাম এক লাফে প্রায় ১১ টাকা বাড়ায় আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। এতে আমদানি পণ্যের পাশাপাশি নিত্যপণ্য ও শিল্পপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। আবার ডলারের দাম বাড়ার কারণে টাকার মান কমে গেছে। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে, যা বাজারে মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিচ্ছে। 
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডলারের দাম বিচ্ছিন্নভাবে নির্ধারণ করায় বাজার আরও অস্থির হয়ে পড়েছে। সহনীয়ভাবে বাজারকে মোকাবিলা করতে হবে। আর ঘন ঘন দর পরিবর্তন করলে বাজারের প্রতি অনাস্থা তৈরি হবে।

সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এত দিন বাফেদার মাধ্যমে ডলারের দর বেঁধে দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। ব্যাংকগুলো সরকারি খাতের আমদানি ব্যয় মেটাতে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে সর্বোচ্চ ১১২ টাকা দরে ডলার সংগ্রহ করছিল। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর দর ছিল ১০৮ টাকা। এ অস্থিরতা নিরসনে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) এবং বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে সর্বোচ্চ ১০৮ টাকা এবং রপ্তানি বিল ৯৯ টাকায় কেনার সিদ্ধান্ত হয়। নতুন দর গত সোমবার থেকে কার্যকর হয়। কিন্তু বুধ ও বৃহস্পতিবার এক ব্যাংক অন্য ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করেছে ১০৬ টাকা ৯০ পয়সা দরে, যা মঙ্গলবার ছিল ১০৬ টাকা ১৫ পয়সা। সেই হিসাবে এক দিনের ব্যবধানে ১ ডলারের বিক্রয়মূল্য বেড়েছে ৭৫ পয়সা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাফেদার চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম বলেন, বিশ্বে ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। ডলারের নতুন দর নির্ধারণের লক্ষ্য হলো বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো। এটা কোনো স্থায়ী সিদ্ধান্ত না। শিগগির ডলারের বাজারে অস্থিরতা দূর হবে।

গতকাল ফকিরাপুলের মনডিয়াল মানি এক্সচেঞ্জের এক বিক্রয়কর্মী বলেন, তাঁদের দোকানে ডলার নেই। কেউ কিনতে চাইলে বেঁধে দেওয়া দরে দেওয়া যাবে না। ১ ডলার কিনতে ১১৭ টাকা লাগবে।

দিলকুশায় ডলার কিনতে আসা বিদেশে যেতে ইচ্ছুক কৌশিক ইসলাম বলেন, ‘দুপুর থেকে ডলার কিনতে ৯টি দোকানে গিয়েছি। বিক্রয়কর্মীরা জানিয়েছেন, তাঁদের কাছে ডলার নেই। পরে এক ব্যক্তিকে বিশেষ অনুরোধ করে ৮০০ ডলার কিনেছি। তবে প্রতি ডলারের দাম রেখেছে ১১৭ টাকা।’

বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘ডলারের দাম বাড়ায় সব আমদানি ও শিল্পপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন দরে রপ্তানি বিল বিক্রি করতে হবে ৯৯ টাকা। আর বাজার থেকে ডলার কিনতে হবে ১০৭ টাকার বেশি দিয়ে। এতে রপ্তানিকারকেরা বিপাকে পড়েছেন।’

বাংলাদেশ মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব সেখ হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘খোলাবাজারে ডলার লেনদেনের অবস্থা খুবই খারাপ। পুরো সপ্তাহ খোলাবাজারে ডলার কেনাবেচা নেই বললেই চলে। বিদেশ গমনে ইচ্ছুকরাও ডলার পাচ্ছেন না। আমরা ১০৭ টাকায় ডলার কিনে ১০৮ টাকা ৫০ টাকায় বিক্রয় করেছি।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত