কোটা-প্রশ্নফাঁস-রাজনীতি: সরকারি চাকরিতে তিন কাঁটা

উবায়দুল্লাহ বাদল ও রাহুল শর্মা, ঢাকা
প্রকাশ : ১১ জুলাই ২০২৪, ০৮: ৩৮

মন্দার বাজারে চাকরি পাওয়াটা খুবই কঠিন। সরকারি চাকরি তো যেন সোনার হরিণ। তবু একটা বয়স পর্যন্ত হাল ছাড়েন না তরুণ-তরুণীরা। দিনরাত এক করে পড়ে যান চাকরির পড়া। ধাপে ধাপে দেওয়া পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও তিন বাধার পাহাড়ে ঠেকে যায় অনেক মেধাবী প্রার্থীর চাকরি পাওয়া। সেই তিন বাধা হলো কোটা, প্রশ্ন ফাঁসের মতো দুর্নীতি এবং সবশেষে রাজনৈতিক বিবেচনা।

চাকরি বঞ্চিতদের দাবি, গত পাঁচ বিসিএসে শুধু রাজনৈতিক কারণে ২৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। 

বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) কর্তৃক নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছিলন রবিউল ইসলাম (ছদ্মনাম)। তাঁর গ্রামের বাড়ি উত্তরাঞ্চলের একটি উপজেলায়। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেখানকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রবিউলের বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠান। এতে বলা হয়, রবিউলের পিতা একজন ব্যবসায়ী এবং বর্তমানে তিনি বণিক সমিতির সহসভাপতি। ২০০৭ সালে তিনি উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সংসদ নির্বাচনে কাজ করেছেন। বিষয়টি স্থানীয় সংসদ সদস্যকে জানানো হলে তিনি রবিউলের জন্য একটি আধা সরকারিপত্র (ডিও) দেন। তার ভিত্তিতে একই বছরের ৭ জুলাই ফের প্রতিবেদন দেন ইউএনও। সে প্রতিবেদনে বলা হয়, তাঁর পিতা একজন ব্যবসায়ী, কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সক্রিয় নন মর্মে স্থানীয় এমপি একটি প্রত্যয়নপত্র প্রদান করেন। তাঁর পরিবারের কোনো সদস্য রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত নয়। একই প্রার্থীর দুই ধরনের প্রতিবেদন থাকায় শেষ পর্যন্ত নিয়োগবঞ্চিত হন রবিউল। 

শুধু রবিউল নন, বিগত পাঁচটি (৩৮তম থেকে ৪২তম) বিসিএসে পিএসসির সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েও নিয়োগবঞ্চিত থেকেন ২৩৯ জন চাকরিপ্রার্থী। আজও তাঁদের নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারেনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। অথচ বিদ্যমান বিসিএস নিয়োগ বিধিমালা-১৯৮১ অনুযায়ী, একজন প্রার্থীকে স্বাস্থ্যগতভাবে অযোগ্য (মেডিকেল আনফিট) বা ‘অপরাধী’ গণ্য করে পুলিশ প্রতিবেদন না দিলে তাঁকে নিয়োগবঞ্চিত করার বিধান নেই। এমনকি প্রার্থীর পিতা-মাতা বা পরিবারের কোনো সদস্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও প্রার্থীকে বঞ্চিত করার সুযোগ নেই। কারণ, সরকারি চাকরিতে যোগদানের জন্য গোয়েন্দা প্রতিবেদনের মূল উদ্দেশ্য হলো চাকরিপ্রার্থী রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত কি না, সেটা যাচাই করা।

 বিগত পাঁচটি বিসিএসের ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৩৮তম বিসিএসে সব ধরনের পরীক্ষা শেষে ২ হাজার ২০৪ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করেছিল পিএসসি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নিয়োগ দিয়েছিল ২ হাজার ১৫১ জনকে। ফলে এই বিসিএসের ৫৩ জন এখনো নিয়োগ পাননি। একইভাবে ৩৯তম বিসিএসে (বিশেষ) ৬ হাজার ৭৯২ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল ৬ হাজার ৭৩২ জনকে। এখানেও ৬০ জন নিয়োগ পাননি। ৪০তম বিসিএসে সুপারিশ পেয়েছিলেন ১ হাজার ৯৬৩ জন। অথচ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল ১ হাজার ৯৩১ জনের। এ দফায়ও ৩২ জন বঞ্চিত হন। ৪১তম বিসিএসে পিএসসি সুপারিশ করেছিল ২ হাজার ৫২০ জনকে, নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল ২ হাজার ৪৫৯ জনকে। এই বিসিএসেও ৬১ জন এখনো নিয়োগ পাননি। সর্বশেষ ৪২তম বিশেষ বিসিএসে ৪ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করেছিল পিএসসি। এখন পর্যন্ত নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ৯৬৭ জন। অর্থাৎ ৩৩ জন এখনো নিয়োগ পাননি।  

এ প্রসঙ্গে সাবেক সচিব ও প্রশাসন বিশেষজ্ঞ আবু আলম মো. শহিদ খান বলেন, ‘সংবিধানের মৌলিক অধিকারের অনুচ্ছেদের ২৯ ধারা অনুযায়ী চাকরিতে পিএসসির সুপারিশের পর তথাকথিত ভেরিভিকেশনের নামে কাউকে বাদ দেওয়া সংবিধানসম্মত নয়। কার বাবা-দাদা, নানা, খালু কখন কী করেছে, কোন দল করেছে, তা বিবেচ্য বিষয় নয়।’ 

প্রায় অভিন্ন ভাষায় মন্তব্য করেন প্রশাসনবিষয়ক বহু গ্রন্থের প্রণেতা ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া। তিনি বলেন, ‘প্রার্থীকে অপরাধী গণ্য করে পুলিশ প্রতিবেদন দিলে ও মেডিকেলে আনফিট হলেই কেবল নিয়োগ বঞ্চিত করা যায়। এর বাইরে অন্য কোনো কারণে কাউকে নিয়োগ বঞ্চিত করার সুযোগ নেই।’

নিয়োগবঞ্চিত ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, শুধু রাজনৈতিক কারণেই তাঁদের নিয়োগ বঞ্চিত করা হয়েছে। তাঁদের অনেকের পরিবারের সদস্য বা আত্মীয়স্বজন সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত। এ কারণেই তাঁদের নিয়োগ হচ্ছে না। 

তবে এ অভিযোগ মানতে নারাজ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি (নিয়োগ, পদোন্নতি, প্রেষণ) অনুবিভাগের প্রধান ও অতিরিক্ত সচিব মো. নাজমুছ সাদাত সেলিম। তিনি গতকাল বুধবার নিজ দপ্তরে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এভাবে ঢালাও বলা যাবে না। কাকে কী কারণে নিয়োগ দেওয়া যায়নি, তা নথি দেখতে হবে। তবে এটুকু বলা যায়, পুলিশি নেতিবাচক প্রতিবেদন, তথ্যের ঘাটতি, অসত্য তথ্যসহ নানা কারণে নিয়োগ না-ও হতে পারে। তবে কেউ পুনঃ তদন্ত চাইলে আমরা সংশ্লিষ্টদের ফের প্রতিবেদন দিতে বলি। সেই প্রতিবেদনের আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

কোটায় চলে যায় অনেক পদ 
সরকারি চাকরিতে প্রবেশে কোটাব্যবস্থা চলে আসছে স্বাধীনতার পর থেকেই। এই কোটা কখনো কমেছে, কখনো বেড়েছে। সর্বশেষ ২০২০ সালে ৩৮তম বিসিএসের মাধ্যমে শেষ হয় কোটার যুগ।

পিএসসির বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২৮তম থেকে ৩৮তম পর্যন্ত ১০টি সাধারণ বিসিএসে ( ৩২তম বিসিএস ছাড়া) নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে ১৩ হাজার ৬৮৯ জনকে। এর মধ্যে মেধার ভিত্তিতে সুপারিশ পেয়েছেন ৮ হাজার ১৭১ জন, আর কোটায় ৫ হাজার ৫১৮ জন। অর্থাৎ মেধার ভিত্তিতে সুপারিশ পেয়েছে ৬০ শতাংশ আর কোটায় ৪০ শতাংশ। উল্লেখ্য, ২৮ থেকে ৩১ পর্যন্ত বিসিএসের সাধারণ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্তরা এ হিসাবের অন্তর্ভুক্ত। 

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিএসসির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, আগের বিসিএসগুলোতে দেখা গেছে কোটার কারণে অনেকে পিছিয়ে থাকার পরও চূড়ান্ত সুপারিশ পান। 

শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে নারী কোটা ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ এবং জেলা কোটা ১০ শতাংশ বাতিল করে পরিপত্র জারি করে সরকার। তবে ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাইকোর্টে রিট করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। ওই আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত ৫ জুন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে। এরপরই আবারও আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। 

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, কোটাব্যবস্থা অবশ্যই সংস্কার করা প্রয়োজন। আর প্রশ্নপত্র ফাঁস ও অন্যান্য যেসব ঘটনার কথা শোনা যায়, তাতেও মেধাবীরা বঞ্চিত হন। তিনি আরও বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা প্রযুক্তি দ্বারা রোধ করার উপায় খুঁজতে হবে। কারণ, মানুষ দ্বারা এগুলো রোধ করা যাচ্ছে না, বারবার প্রশ্ন উঠছে। 

প্রশ্নপত্র ফাঁসে ফের আলোচনায় পিএসসি
সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের বঞ্চিত হওয়ার আরেকটি বড় কারণ প্রশ্নপত্র ফাঁস। পিএসসির নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ নতুন নয়। এর আগেও কয়েকবার পিএসসির প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে পরীক্ষাও বাতিল করা হয়। সর্বশেষ ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ রেলওয়ের ‘উপসহকারী প্রকৌশলী’ পদসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে গত রোববার পিএসসির দুই উপপরিচালক, একজন সহকারী পরিচালকসহ ১৭ জনকে আটক করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

পিএসসি থেকে জানা যায়, প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে গত কয়েকটি বিসিএসের পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ২৪তম বিসিএস, ২৭তম বিসিএস। আর প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ৩৩তম লিখিত পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন করা হয়। 

পিএসসির চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, ‘যে প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রশ্নপত্র পাঠানো হয়, সেখানে ফাঁস করার সুযোগ খুব কম। তারপরও বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। যদি কারও সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়, সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

আরও খবর পড়ুন:

 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত