মামুনুর রশীদ
আমরা যখন কলেজে পড়তাম, তখন আমাদের যৌবনের সূচনাকালে লেখাপড়ার পাশাপাশি গান আমাদের প্রিয় অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, জগন্ময় মিত্র, শ্যামল মিত্রের গান; যেমন ‘ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে...’ অথবা ‘যত লিখে যাই তবু না ফুরায়, চিঠিতো হয় না শেষ,...তুমি আজ কত দূরে...’। তারপর প্রতিমা মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর থেকে শুরু করে বাংলা গানের যাঁরা শিল্পী তাঁদের গান আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রাতের বেলায় লেখাপড়া শেষে কোনো এক চায়ের দোকানে দুই কাপ চা চারজনে ভাগ করে নিয়ে ম্যানেজারকে বলে গানগুলো কলের গানে শোনানোর জন্য অনুরোধ জানাতাম। মাঝে মাঝে ম্যানেজার খুব বিরক্ত হতেন, রেকর্ড বদলাতে চাইতেন না। কারণ হিন্দি ও উর্দু গানেরও সমঝদার ছিলাম আমরা, সেই সব গানের ভক্ত ছিলাম। নওশাদের সুরে মোহাম্মদ রফির গান তখন খুবই জনপ্রিয়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তখন ‘নাগিন’ ছবির সংগীত পরিচালক হিসেবে বিখ্যাত হয়েছেন। উর্দু গজল, হিন্দি গান সমভাবেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশে।
বাংলাদেশের শিল্পীরাও বেশ জনপ্রিয়—আব্দুল জব্বার, মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, আঞ্জুমান আরা, ফেরদৌসী রহমানসহ আরও অনেক সংগীতশিল্পী ছিলেন। পাশাপাশি আমাদের লোকসংগীতের বিশ্বমানের গায়ক আব্দুল আলীম, আব্বাসউদ্দীন আহমদ, হরলাল রায় আর পাকিস্তানের সুকণ্ঠী গায়িকা নুরজাহান আমাদের সংগীতের শ্রুতিকে মুগ্ধ করে রাখতেন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করছি কিন্তু আমরা মেহেদী হাসান, আবিদ ওয়ালী মোহাম্মদের গানের ভক্ত। আর উচ্চাঙ্গসংগীতের তো কথাই নেই। নাজাকাত-সালামাত দুই ভাইয়ের সংগীতেরও আমরা ভক্ত ছিলাম।
সেই সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনেতা-অভিনেত্রী, সুরকার, গায়ক ছাড়াও ছিলেন বোম্বের দিলীপ কুমার, মীনা কুমারী, বৈজয়ন্তী মালা, নার্গিস, মধুবালাসহ আরও বেশ কিছু শিল্পীর অভিনয় ও সংগীত আমাদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করত। সেই সঙ্গে হলিউডের ছবির নায়ক-নায়িকারা এবং তখনকার সময়ে পাশ্চাত্য সংগীতেরও মোহনীয় আবেশে আমরা সময় পার করতাম। এর সঙ্গে তুমুল জনপ্রিয় হলো রবীন্দ্রসংগীত ও নজরুলের গান। ফিরোজা বেগম স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করার আগেই তাঁর কণ্ঠ আমাদের কাছে বিস্ময়কর। রবীন্দ্রসংগীতের শিল্পী কলিম শরাফী তখন ঢাকায়, তাঁর গান ছাড়াও সুবিনয় রায়, দেবব্রত বিশ্বাস, অশোক তরু, সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানে আমরা জগৎকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। নজরুলপুত্র কাজী সব্যসাচীর আবৃত্তি এমনই মনোমুগ্ধকর যে আমরা বারবার শুনতে চাইতাম।
কলের গান থেকে টেপ ক্যাসেটে রূপান্তরের এক ক্রান্তিকাল এল। আটাত্তর আরপিএম থেকে লং প্লেতে রেকর্ডে স্থানান্তর হয়েছে, রেডিও থেকে যেমন ট্রানজিস্টরে রূপান্তর হতে যাচ্ছে, তেমনি রেকর্ড থেকে ম্যাগনেটিক টেপে দ্রুত রূপান্তরের কাল শুরু হয়েছে। সেই মোহনীয় কালে রাজনীতির একটা রূপান্তর পর্ব চলছিল। আমরা ক্রমাগত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চলছি। হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি আমাদের স্পর্শ করলেও হৃদয়ে তখন একদিকে সংগীতের মেলোডিতে আমরা মোহাচ্ছন্ন, শিল্পীদের কণ্ঠের মিষ্টি সুরের মূর্ছনা, আর অন্যদিকে পাকিস্তানি মিলিটারি জান্তার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এ দেশের মানুষ তখন ভাই ভাই। জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ শুধু নয়, আবিষ্কারের ভাবনায়ও তখন আমরা আচ্ছন্ন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল পাশে থাকলেও জীবনানন্দ দাস তখন আমাদের মুখে মুখে। এর সঙ্গে আছে জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, রশীদ চৌধুরীসহ অপরাপর শিল্পীদের ছবি। আমাদের জন্য স্লোগান ছিল—পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা।
একদিকে সংগীত, চিত্রকলা, সাহিত্য আমাদের নিত্যসঙ্গী যার সম্প্রসারণ আমাদের চলচ্চিত্রেও ছিল। জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, আলমগীর কবির বিদেশি চলচ্চিত্রের নতুন আঙ্গিক নিয়ে কথা বলেছেন। উর্দু চলচ্চিত্রের সঙ্গে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আমাদের চলচ্চিত্র বিন্দু থেকে বৃত্তে এসে পৌঁছেছে। একেবারেই ভিন্নধর্মী একজন চলচ্চিত্র পরিচালক ছিলেন, যার নাম ফখরুল আলম। ভিন্নধারার ‘মানুষ অমানুষ’, ‘জয়বাংলা’, ‘শনিবারের চিঠি’ নামে তিনটি ছবি তিনি পরিচালনা করেছিলেন।
শুধু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নয়, ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসন আমাদের রাজনীতির একটি আলোচনার বিষয়। চীন, রাশিয়ার রাজনীতির একটা অনুপ্রবেশ ঘটেছে, আবার কে সঠিক তা নিয়েও দ্বন্দ্ব চলেছে। কমিউনিস্ট শিবির বিভক্ত হয়ে দুই শিবিরেই যথেষ্ট অনুসারী রয়েছে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে জেগে উঠছে পূর্ব বাংলার ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ। এর মধ্যেই বসন্ত উৎসব হয়েছে, পয়লা বৈশাখ উদ্যাপিত হয়েছে, একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরি চলেছে। কিন্তু এই সবকিছুতেই পাকিস্তানি শাসকের বৈরিতা। সবচেয়ে বেশি বৈরিতা ছিল নাটকের প্রতি। নাটকের ওপর সেন্সরশিপের খড়্গ চাপা, সহসা অভিনয় করার সুযোগ মিলত না। একমাত্র করা যেত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্চে। সেখানেও পুলিশের আড়িপাতা আর ছাত্র আন্দোলনের ওপর নানা ধরনের পুলিশি আক্রমণ। আক্রমণ তো চলেছেই, পাকিস্তানপন্থীরা রাষ্ট্রযন্ত্রের বাইরে তেমন কিছু করতে পারছিল না। ধর্মকে ব্যবহার করার পর্যায় প্রায় শেষের দিকে।
ওই যে প্রথমে বলেছি কলেজে কলের গানের প্রভাবে ছাত্র-যুবা এমনভাবে উদ্বুদ্ধ, তাদের আর ঠেকানো যাচ্ছিল না। এমনি তার শক্তি! গান গাইতে গাইতেই একসময়ে সাবমেশিন গান হাতে তুলে নিয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের পাশে ছিল নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ এবং সেই সময়ের কালজয়ী সংগীত। যুদ্ধকালীন স্বাধীন বাংলা বেতারের গান, নাটক, সাহিত্যের উদ্ধৃতি এসবও অনুপ্রাণিত করেছে মুক্তিযোদ্ধাদের বাংকারে, রণাঙ্গনে এবং দেশের ভেতরে, যারা হৃৎপিণ্ডে ধারণ করেছিল একেকটা গ্রেনেড। এভাবেই শিল্প, সাহিত্যের সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছিল রাজনীতি-যুদ্ধ।
খুব অল্প সময়ে মাত্র নয় মাসেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। সেই কলেজের কলের গানের প্রজন্ম নতুন রাষ্ট্রের মুখোমুখি হয়ে উঠল। কিন্তু মাত্র তিন বছরের মাথায় সেই গানের জায়গা দখল করল এক অদ্ভুত আঁধার। মেশিনগান হয়ে দাঁড়াল রাজনীতির প্রকাশমান এক বড় অস্ত্র। সেই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আবার সংগীত খুঁজতে লাগল, কেউ কেউ সাহিত্য খুঁজল। যার ফলাফলে সুদীর্ঘ পনেরো বছর পরে অস্ত্র নামল বটে, কিন্তু নতুন প্রজন্ম তৈরি হলো না। তাদের অভিজ্ঞতায় নজরুল, রবীন্দ্রনাথের বদলে চলে এল জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধগামী এক জান্তা, তারা কলের গান শোনে না। পরবর্তী প্রযুক্তির রূপান্তরের ফলে এক অদ্ভুত সংগীত শোনে তারা। তাদের দেখে দেখে এই নবজাতক তাদের শৈশব কাটিয়ে কৈশোরে এবং যৌবনে পদার্পণ করে তারাও আইডল খুঁজে পায় না। বাংলাদেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে বেড়ানো কোনো রাজনৈতিক চরিত্রকে দেখতে পাওয়া যায় না। ফলে অদ্ভুত আঁধার আরও ঘনীভূত হয়।
ষাটের দশকে যারা গান শুনতে দিতে চায়নি, সেই শক্তি ধীরে ধীরে পুনর্জীবিত হতে শুরু করে। এই নবপ্রজন্মের সংঘবদ্ধ গান শোনাটা একসময় বন্ধ হয়ে যায়, শিল্পচর্চা হয়ে পড়ে একান্ত ব্যক্তিগত। আর প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির ফলে নতুন প্রজন্ম ক্রমাগতভাবে নিমজ্জিত হয় একান্ত ব্যক্তিগত এক অদ্ভুত জীবনাচরণে। গণমাধ্যম খুব দায়িত্ব নিয়ে শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে রাজনীতির সুসমন্বয় ঘটাতে পারেনি। কখনো রাজনীতির বা ক্ষমতা শক্তিশালী হয়েছে তার চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে অর্থ-টাকা। অর্থনীতিবিদেরা তাঁদের মানবিক বিজ্ঞান ভুলে যান, ধনবিজ্ঞানীরা সুকৌশলে সেই জায়গা দখল করে। তাই ধনবিজ্ঞানের এক উল্টোপথে যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশ।
একসময় পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত অর্থনীতিবিদেরাও রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। সাহিত্যের প্রতি ছিল তাঁদের প্রবল ঝোঁক। সংস্কৃতিকে মনে করতেন রাজনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যার একটা বড় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন একদা মওলানা ভাসানী, তিনি মজলুম জনতার নেতা ছিলেন। ১৯৫৭ সালে কাগমারীতে তিনি একটি সম্মেলন ডেকেছিলেন, তিনি তখন আওয়ামী লীগের সভাপতি। মূলত সম্মেলনটি ছিল ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক। কিন্তু সেখানে সংস্কৃতির একটা মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তোরণগুলো ছিল শিল্পী, সাহিত্যিক, দার্শনিক এবং কিছুটা রাজনৈতিক নেতাদের নামে। সেখানে অতিথি হয়ে এসেছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো তখনকার দিনের বাংলা সাহিত্যের এক দিকপাল। নৃত্যশিল্পী এবং কবিরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি মনে করতেন কবি-সাহিত্যিকেরা আন্দোলনের সঙ্গে যতক্ষণ যুক্ত না হবেন, তত দিন কোনো আন্দোলন সফল হবে না। সেই সম্মেলনেই পাকিস্তানকে তিনি বিদায় জানিয়েছিলেন ‘আসসালামু আলাইকুম’ দিয়ে।
এখন সেই কলের গান নেই। তার জায়গায় এসেছে অত্যন্ত শক্তিশালী আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন সংগীতের নানাবিধ যন্ত্র। তারুণ্যের মানসপটে ভাঙা কলের গান যে শক্তি জুগিয়েছিল, আজকের প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে যন্ত্রটি নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
আমরা যখন কলেজে পড়তাম, তখন আমাদের যৌবনের সূচনাকালে লেখাপড়ার পাশাপাশি গান আমাদের প্রিয় অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, জগন্ময় মিত্র, শ্যামল মিত্রের গান; যেমন ‘ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে...’ অথবা ‘যত লিখে যাই তবু না ফুরায়, চিঠিতো হয় না শেষ,...তুমি আজ কত দূরে...’। তারপর প্রতিমা মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর থেকে শুরু করে বাংলা গানের যাঁরা শিল্পী তাঁদের গান আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রাতের বেলায় লেখাপড়া শেষে কোনো এক চায়ের দোকানে দুই কাপ চা চারজনে ভাগ করে নিয়ে ম্যানেজারকে বলে গানগুলো কলের গানে শোনানোর জন্য অনুরোধ জানাতাম। মাঝে মাঝে ম্যানেজার খুব বিরক্ত হতেন, রেকর্ড বদলাতে চাইতেন না। কারণ হিন্দি ও উর্দু গানেরও সমঝদার ছিলাম আমরা, সেই সব গানের ভক্ত ছিলাম। নওশাদের সুরে মোহাম্মদ রফির গান তখন খুবই জনপ্রিয়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তখন ‘নাগিন’ ছবির সংগীত পরিচালক হিসেবে বিখ্যাত হয়েছেন। উর্দু গজল, হিন্দি গান সমভাবেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশে।
বাংলাদেশের শিল্পীরাও বেশ জনপ্রিয়—আব্দুল জব্বার, মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, আঞ্জুমান আরা, ফেরদৌসী রহমানসহ আরও অনেক সংগীতশিল্পী ছিলেন। পাশাপাশি আমাদের লোকসংগীতের বিশ্বমানের গায়ক আব্দুল আলীম, আব্বাসউদ্দীন আহমদ, হরলাল রায় আর পাকিস্তানের সুকণ্ঠী গায়িকা নুরজাহান আমাদের সংগীতের শ্রুতিকে মুগ্ধ করে রাখতেন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করছি কিন্তু আমরা মেহেদী হাসান, আবিদ ওয়ালী মোহাম্মদের গানের ভক্ত। আর উচ্চাঙ্গসংগীতের তো কথাই নেই। নাজাকাত-সালামাত দুই ভাইয়ের সংগীতেরও আমরা ভক্ত ছিলাম।
সেই সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনেতা-অভিনেত্রী, সুরকার, গায়ক ছাড়াও ছিলেন বোম্বের দিলীপ কুমার, মীনা কুমারী, বৈজয়ন্তী মালা, নার্গিস, মধুবালাসহ আরও বেশ কিছু শিল্পীর অভিনয় ও সংগীত আমাদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করত। সেই সঙ্গে হলিউডের ছবির নায়ক-নায়িকারা এবং তখনকার সময়ে পাশ্চাত্য সংগীতেরও মোহনীয় আবেশে আমরা সময় পার করতাম। এর সঙ্গে তুমুল জনপ্রিয় হলো রবীন্দ্রসংগীত ও নজরুলের গান। ফিরোজা বেগম স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করার আগেই তাঁর কণ্ঠ আমাদের কাছে বিস্ময়কর। রবীন্দ্রসংগীতের শিল্পী কলিম শরাফী তখন ঢাকায়, তাঁর গান ছাড়াও সুবিনয় রায়, দেবব্রত বিশ্বাস, অশোক তরু, সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানে আমরা জগৎকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। নজরুলপুত্র কাজী সব্যসাচীর আবৃত্তি এমনই মনোমুগ্ধকর যে আমরা বারবার শুনতে চাইতাম।
কলের গান থেকে টেপ ক্যাসেটে রূপান্তরের এক ক্রান্তিকাল এল। আটাত্তর আরপিএম থেকে লং প্লেতে রেকর্ডে স্থানান্তর হয়েছে, রেডিও থেকে যেমন ট্রানজিস্টরে রূপান্তর হতে যাচ্ছে, তেমনি রেকর্ড থেকে ম্যাগনেটিক টেপে দ্রুত রূপান্তরের কাল শুরু হয়েছে। সেই মোহনীয় কালে রাজনীতির একটা রূপান্তর পর্ব চলছিল। আমরা ক্রমাগত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চলছি। হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি আমাদের স্পর্শ করলেও হৃদয়ে তখন একদিকে সংগীতের মেলোডিতে আমরা মোহাচ্ছন্ন, শিল্পীদের কণ্ঠের মিষ্টি সুরের মূর্ছনা, আর অন্যদিকে পাকিস্তানি মিলিটারি জান্তার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এ দেশের মানুষ তখন ভাই ভাই। জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ শুধু নয়, আবিষ্কারের ভাবনায়ও তখন আমরা আচ্ছন্ন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল পাশে থাকলেও জীবনানন্দ দাস তখন আমাদের মুখে মুখে। এর সঙ্গে আছে জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, রশীদ চৌধুরীসহ অপরাপর শিল্পীদের ছবি। আমাদের জন্য স্লোগান ছিল—পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা।
একদিকে সংগীত, চিত্রকলা, সাহিত্য আমাদের নিত্যসঙ্গী যার সম্প্রসারণ আমাদের চলচ্চিত্রেও ছিল। জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, আলমগীর কবির বিদেশি চলচ্চিত্রের নতুন আঙ্গিক নিয়ে কথা বলেছেন। উর্দু চলচ্চিত্রের সঙ্গে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আমাদের চলচ্চিত্র বিন্দু থেকে বৃত্তে এসে পৌঁছেছে। একেবারেই ভিন্নধর্মী একজন চলচ্চিত্র পরিচালক ছিলেন, যার নাম ফখরুল আলম। ভিন্নধারার ‘মানুষ অমানুষ’, ‘জয়বাংলা’, ‘শনিবারের চিঠি’ নামে তিনটি ছবি তিনি পরিচালনা করেছিলেন।
শুধু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নয়, ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসন আমাদের রাজনীতির একটি আলোচনার বিষয়। চীন, রাশিয়ার রাজনীতির একটা অনুপ্রবেশ ঘটেছে, আবার কে সঠিক তা নিয়েও দ্বন্দ্ব চলেছে। কমিউনিস্ট শিবির বিভক্ত হয়ে দুই শিবিরেই যথেষ্ট অনুসারী রয়েছে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে জেগে উঠছে পূর্ব বাংলার ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ। এর মধ্যেই বসন্ত উৎসব হয়েছে, পয়লা বৈশাখ উদ্যাপিত হয়েছে, একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরি চলেছে। কিন্তু এই সবকিছুতেই পাকিস্তানি শাসকের বৈরিতা। সবচেয়ে বেশি বৈরিতা ছিল নাটকের প্রতি। নাটকের ওপর সেন্সরশিপের খড়্গ চাপা, সহসা অভিনয় করার সুযোগ মিলত না। একমাত্র করা যেত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্চে। সেখানেও পুলিশের আড়িপাতা আর ছাত্র আন্দোলনের ওপর নানা ধরনের পুলিশি আক্রমণ। আক্রমণ তো চলেছেই, পাকিস্তানপন্থীরা রাষ্ট্রযন্ত্রের বাইরে তেমন কিছু করতে পারছিল না। ধর্মকে ব্যবহার করার পর্যায় প্রায় শেষের দিকে।
ওই যে প্রথমে বলেছি কলেজে কলের গানের প্রভাবে ছাত্র-যুবা এমনভাবে উদ্বুদ্ধ, তাদের আর ঠেকানো যাচ্ছিল না। এমনি তার শক্তি! গান গাইতে গাইতেই একসময়ে সাবমেশিন গান হাতে তুলে নিয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের পাশে ছিল নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ এবং সেই সময়ের কালজয়ী সংগীত। যুদ্ধকালীন স্বাধীন বাংলা বেতারের গান, নাটক, সাহিত্যের উদ্ধৃতি এসবও অনুপ্রাণিত করেছে মুক্তিযোদ্ধাদের বাংকারে, রণাঙ্গনে এবং দেশের ভেতরে, যারা হৃৎপিণ্ডে ধারণ করেছিল একেকটা গ্রেনেড। এভাবেই শিল্প, সাহিত্যের সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছিল রাজনীতি-যুদ্ধ।
খুব অল্প সময়ে মাত্র নয় মাসেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। সেই কলেজের কলের গানের প্রজন্ম নতুন রাষ্ট্রের মুখোমুখি হয়ে উঠল। কিন্তু মাত্র তিন বছরের মাথায় সেই গানের জায়গা দখল করল এক অদ্ভুত আঁধার। মেশিনগান হয়ে দাঁড়াল রাজনীতির প্রকাশমান এক বড় অস্ত্র। সেই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আবার সংগীত খুঁজতে লাগল, কেউ কেউ সাহিত্য খুঁজল। যার ফলাফলে সুদীর্ঘ পনেরো বছর পরে অস্ত্র নামল বটে, কিন্তু নতুন প্রজন্ম তৈরি হলো না। তাদের অভিজ্ঞতায় নজরুল, রবীন্দ্রনাথের বদলে চলে এল জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধগামী এক জান্তা, তারা কলের গান শোনে না। পরবর্তী প্রযুক্তির রূপান্তরের ফলে এক অদ্ভুত সংগীত শোনে তারা। তাদের দেখে দেখে এই নবজাতক তাদের শৈশব কাটিয়ে কৈশোরে এবং যৌবনে পদার্পণ করে তারাও আইডল খুঁজে পায় না। বাংলাদেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে বেড়ানো কোনো রাজনৈতিক চরিত্রকে দেখতে পাওয়া যায় না। ফলে অদ্ভুত আঁধার আরও ঘনীভূত হয়।
ষাটের দশকে যারা গান শুনতে দিতে চায়নি, সেই শক্তি ধীরে ধীরে পুনর্জীবিত হতে শুরু করে। এই নবপ্রজন্মের সংঘবদ্ধ গান শোনাটা একসময় বন্ধ হয়ে যায়, শিল্পচর্চা হয়ে পড়ে একান্ত ব্যক্তিগত। আর প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির ফলে নতুন প্রজন্ম ক্রমাগতভাবে নিমজ্জিত হয় একান্ত ব্যক্তিগত এক অদ্ভুত জীবনাচরণে। গণমাধ্যম খুব দায়িত্ব নিয়ে শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে রাজনীতির সুসমন্বয় ঘটাতে পারেনি। কখনো রাজনীতির বা ক্ষমতা শক্তিশালী হয়েছে তার চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে অর্থ-টাকা। অর্থনীতিবিদেরা তাঁদের মানবিক বিজ্ঞান ভুলে যান, ধনবিজ্ঞানীরা সুকৌশলে সেই জায়গা দখল করে। তাই ধনবিজ্ঞানের এক উল্টোপথে যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশ।
একসময় পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত অর্থনীতিবিদেরাও রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। সাহিত্যের প্রতি ছিল তাঁদের প্রবল ঝোঁক। সংস্কৃতিকে মনে করতেন রাজনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যার একটা বড় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন একদা মওলানা ভাসানী, তিনি মজলুম জনতার নেতা ছিলেন। ১৯৫৭ সালে কাগমারীতে তিনি একটি সম্মেলন ডেকেছিলেন, তিনি তখন আওয়ামী লীগের সভাপতি। মূলত সম্মেলনটি ছিল ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক। কিন্তু সেখানে সংস্কৃতির একটা মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তোরণগুলো ছিল শিল্পী, সাহিত্যিক, দার্শনিক এবং কিছুটা রাজনৈতিক নেতাদের নামে। সেখানে অতিথি হয়ে এসেছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো তখনকার দিনের বাংলা সাহিত্যের এক দিকপাল। নৃত্যশিল্পী এবং কবিরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি মনে করতেন কবি-সাহিত্যিকেরা আন্দোলনের সঙ্গে যতক্ষণ যুক্ত না হবেন, তত দিন কোনো আন্দোলন সফল হবে না। সেই সম্মেলনেই পাকিস্তানকে তিনি বিদায় জানিয়েছিলেন ‘আসসালামু আলাইকুম’ দিয়ে।
এখন সেই কলের গান নেই। তার জায়গায় এসেছে অত্যন্ত শক্তিশালী আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন সংগীতের নানাবিধ যন্ত্র। তারুণ্যের মানসপটে ভাঙা কলের গান যে শক্তি জুগিয়েছিল, আজকের প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে যন্ত্রটি নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
পর্দার নায়িকারা নিজেদের বয়স আড়ালে রাখা পছন্দ করেন। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আজমেরী হক বাঁধন। প্রতিবছর নিজের জন্মদিনে জানান দেন তাঁর বয়স। গতকাল ছিল বাঁধনের ৪১তম জন্মদিন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেই জানালেন এই তথ্য।
২ দিন আগে১০ বছরের বেশি সময় ধরে শোবিজে কাজ করছেন অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া। নাটকের পাশাপাশি ওটিটিতে দেখা গেছে তাঁকে। সরকারি অনুদানের ‘দেবী’ নামের একটি সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন। প্রশংসিত হলেও সিনেমায় আর দেখা মেলেনি তাঁর। ছোট পর্দাতেও অনেক দিন ধরে অনিয়মিত তিনি। এবার শবনম ফারিয়া হাজির হচ্ছেন নতুন পরিচয়ে। কমেডি রিয়েলিটি
২ দিন আগেআমাদের লোকসংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য যাত্রাপালা। গণমানুষের সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত এই যাত্রাপালা নিয়ে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করছে ‘যাত্রা উৎসব-২০২৪’। আগামী ১ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে শুরু হবে ৭ দিনব্যাপী এই উৎসব।
২ দিন আগে‘বঙ্গবন্ধু’ পদবি বিলীন হবে না। হতে পারে না। যেমনটি ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাশের পদবি বিলীন হয়নি। ইতিহাসে এসব পদবি অম্লান ও অক্ষয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব ছিল অনন্যসাধারণ। আপনজনকে তো অবশ্যই, শত্রুপক্ষের লোকেরাও ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উচ্চপদের
২ দিন আগে