অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সংকট কাটানো, চীনা বিনিয়োগ ও দেশটিতে রপ্তানি বাড়ানো—এই চার লক্ষ্য সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮ জুলাই বেইজিং যাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সঙ্গে চীনের কৌশলগত বৈরিতার মধ্যেও প্রধানমন্ত্রীর বেইজিং সফরকে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। 

চার দিনের এই সফরের দ্বিতীয় দিন ৯ জুলাই চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর ১০ জুলাই বৈঠক হবে দেশটির প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে। একই দিন বৈঠক হবে পার্লামেন্ট ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস অব চায়নার প্রেসিডেন্ট ঝাও লেজির সঙ্গেও।
প্রধানমন্ত্রীর এই চীন সফর বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। গতকাল ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক অনুষ্ঠানের পর তিনি বলেন, ‘এত দিন ধরে চীন আমাদের উন্নয়ন অভিযাত্রায় যে ভূমিকা রেখে আসছে, সেই উন্নয়ন অভিযাত্রাকে বেগবান করতে এই সফর গুরুত্বপূর্ণ।’ 

বড় অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনা অর্থ, প্রযুক্তি ও লোকবল দরকার হয়। এমন প্রকল্পের জন্য চীন থেকে তহবিল সংগ্রহ অন্যতম অগ্রাধিকার বলে ইঙ্গিত দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এর বাইরে সরকার কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের দেশটিতে ফেরত পাঠাতে চীনের প্রভাব কাজে লাগাতে চায়।   

শেখ হাসিনার চীন সফরের বিষয়টি দিল্লিতে গত ২২ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে অনুষ্ঠিত আলোচনায়ও এসেছে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। 
কূটনীতিকদের তথ্য অনুযায়ী, বেইজিংয়ে শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকের পর অন্তত ১০টি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সইয়ের সম্ভাবনা আছে। অবশ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী, চুক্তিগুলো গতকাল পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। 

দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে চীনের কাছ থেকে ৫০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ চীনা মুদ্রা ঋণ চাইবে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনলাইন ব্লুমবার্গকে এ কথা বলেছেন। 

ব্লুমবার্গে গতকাল বুধবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি ও আমদানি বিল পরিশোধের সামর্থ্য বাড়াতে এই ঋণ কাজে লাগানো যাবে, এমনটা মনে করেন গভর্নর। 

চীনা মুদ্রায় নেওয়া এই ঋণ থেকে ব্যবসায়ীরা দেশটি থেকে আমদানি করা কাঁচামালের মূল্য পরিশোধের সুযোগ পাবেন, জানান রউফ তালুকদার। 
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার বর্তমান নিট রিজার্ভ ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। 

কূটনীতিকেরা মনে করেন, ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সফরের মাধ্যমে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। প্রধানত শিল্পের কাঁচামাল ও প্রতিরক্ষা সামগ্রীর উৎস হিসেবে বিবেচিত দেশটি এখানে অবকাঠামো খাতে বড় বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে কৌশলগত সহযোগিতার পর্যায়ে নিয়ে যায়। বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ভারতের আগ্রহ ও প্রভাব বাড়তে থাকায় চীন এবারের সফরে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় করতে চাইবে, এমনটাই স্বাভাবিক মনে করেন তাঁরা। 

চীনের সহায়তায় পায়রা সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বড় ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য এবার একটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের সম্ভাবনা আছে। 

তিস্তা নদী অববাহিকার বাংলাদেশ অংশে নদী সংরক্ষণ, সেচ ও কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের আগ্রহ আছে। তবে একই ধরনের প্রকল্পে বৈরী ভারতের বেশ আগ্রহ থাকায় চীন এবার বিষয়টি জোরালোভাবে সামনে নাও আনতে পারে, এমনটাই মনে করেন স্থানীয় কূটনীতিকেরা। 

শেখ হাসিনা চীনের ব্যবসায়ীদের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করবেন। বরাবরের মতো বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের একটি বড় প্রতিনিধিদল এবারও প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হবেন। তাঁরাও চীনের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ সালে চীন থেকে আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৭৮৩ কোটি ডলারের পণ্য। আর দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৬৮ কোটি ডলারের পণ্য।