হাসান মোরশেদ
‘নিরস্ত্র, নিরীহ বুদ্ধিজীবীগণ, যাঁরা সাধারণত সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেন না, তাঁরা কেন আক্রান্ত হন?’ এটি একটি চালু জিজ্ঞাসা। এই জিজ্ঞাসার সমাধান করতে হলে প্রথমে নিজেদের একটি অনুধাবন পরিষ্কার করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রশক্তি এখানে একটি দীর্ঘ পরিকল্পিত, পদ্ধতিগত ও উদ্দেশ্যমূলক অপরাধ সংঘটিত করেছে। এই অপরাধের নাম জেনোসাইড। জেনোসাইডের উদ্দেশ্য থাকে একটা জনগোষ্ঠীর পরিচয় মুছে ফেলা আর এই উদ্দেশ্যের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে জেনোসাইড কালে বুদ্ধিজীবী নিধনের কারণ।
আইনি পরিমণ্ডলে জেনোসাইড শব্দটি প্রথম উচ্চারিত হয় ‘বুদ্ধিজীবী হত্যা’ প্রসঙ্গেই, ১৯৪৬-এর ২৫ জুন, ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে। ১৯৪০-এ জার্মান অধিকৃত বোহেমিয়া ও মোরেভিয়ার দায়িত্ব পান দুঁদে কূটনীতিক কনস্ট্যানটিন ফন নুইরাথ। এই অঞ্চলের চেক জনগোষ্ঠী মানুষকে নিয়ে কী করা যায়—এই প্রশ্নের সমাধান হিসেবে তিনি কয়েকটি পথ বাতলে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, ‘যেকোনো উপায়েই চেক বুদ্ধিজীবীদের শেষ করে দিতে হবে।’
ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে তাঁকে জেরা করেন ব্রিটিশ আইনজীবী স্যার ডেভিড ম্যাক্সওয়েল। ম্যাক্সওয়েল সেদিন বলেন, ‘বুদ্ধিজীবী মানে শিক্ষক, লেখক, শিল্পীদের শেষ করে ফেলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এসব মানুষ চেক জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য প্রবাহিত করতেন পরবর্তী প্রজন্মে। তাঁদের হত্যা করা মানে জাতির স্বাভাবিক বিকাশের পথ রোধ করা, জাতি ধ্বংস করার শামিল। এটি জেনোসাইড, অবশ্যই জেনোসাইড।’
ট্রায়ালে পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত রাফায়েল লেমকিনের শরীরজুড়ে আনন্দ বয়ে যায়। তাঁর ১৬ বছরের অ্যাডভোকেসির পর এই প্রথম আইনের জগতে উচ্চারিত হলো—জেনোসাইড! যেহেতু জেনোসাইডারদের প্রধান উদ্দেশ্য জাতির পরিচয় মুছে ফেলা, অথচ বুদ্ধিজীবীরা সেই পরিচয় প্রবাহিত করেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, তাই তাঁরা জেনোসাইডারদের জন্য বিপজ্জনক। বুদ্ধিজীবীদের নিধন করা না গেলে জেনোসাইডের উদ্দেশ্য, অর্থাৎ পরিচয় মুছে ফেলার কাজটি সম্পন্ন হয় না। তাই বুদ্ধিজীবীরা যুদ্ধে না গেলেও জেনোসাইড সফল করতে হলে বুদ্ধিজীবীদের নিধন করতে হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে তৎকালীন পোল্যান্ডের, বর্তমানে ইউক্রেনের লিভিউ বিশ্ববিদ্যালয় ঘেরাও করে নাৎসিরা হত্যা করেছিল ৩২ জন অধ্যাপককে। হলোকাস্টের আগে থেকেই এই নিধনযজ্ঞের শুরু। ইহুদি শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী ও শিল্পীরা আক্রান্ত হয়েছিলেন নাৎসি উত্থানের সময় থেকে। নাৎসিরা প্রবলভাবে আক্রমণ করেছিল ইহুদি সংগীতশিল্পীদের। একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল তাঁদের কনসার্ট, গানের স্কুল। আমেরিকায় পালিয়ে প্রাণে বেঁচেছিলেন ২০ হাজার সংগীতের মানুষ।
যাঁরা পালিয়ে যেতে পারেননি, তাঁদের জন্য ভয়াবহ সব শাস্তি। অসওইচসহ গ্যাস চেম্বারগুলোতে খুন হয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ ইহুদিদের গিয়ে বিদায়ী সংগীত বাজিয়ে শোনাতে হতো ইহুদি শিল্পীদেরই। সবশেষে সেই শিল্পীরাও হতেন হত্যাযজ্ঞের শিকার। এ রকম কতজন সংগীতশিল্পী নিধনের শিকার হয়েছেন হিসাব নেই। মরডেকাই জেবেরটিগ ছিলেন পোল্যান্ডের জনপ্রিয় ব্যালে গায়ক। অধিকৃত পোল্যান্ডে তিনি গান লিখেছিলেন ‘আওয়ার টাউন ইন বার্নিং’। ঘ্যাটেগুলোতে (যেখানে ইহুদিদের আলাদা করে আটকে রাখা হতো) তাঁর এই গান মুখে মুখে গাওয়া হতো। তাঁকেও হত্যা করা হয় ১৯৪২ সালে।
সোভিয়েত অধিকৃত পোল্যান্ডেও রেড আর্মির হত্যাকাণ্ডের শিকার হন জাতীয়তাবাদী পোলিশ বুদ্ধিজীবীরা। কম্বোডিয়ায় খেমাররুজদের প্রধান টার্গেট ছিলেন বুদ্ধিজীবীরা। বুদ্ধিজীবীরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বসনিয়ায়, রুয়ান্ডায়। তালেবানদের হাতে নৃশংসভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে ফাওয়াদ আন্দারাবিকে। আন্দারাব উপত্যকার এই লোকসংগীতের শিল্পী গান গেয়েছিলেন ‘আমার জন্মভূমির চেয়ে সেরা কিছু নেই’। ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনে চলমান জেনোসাইডেও আক্রান্ত হচ্ছেন চিকিৎসক, শিক্ষক, শিল্পীসহ বুদ্ধিজীবীরা।
মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত জেনোসাইড ’৭১-এর এপিসেন্টার বা কেন্দ্রই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এর আগে সংঘটিত কোনো জেনোসাইডে এপিসেন্টার বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। ২৫ মার্চ রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক হত্যা দিয়ে জেনোসাইড ’৭১-এর শুরু। ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত নৃশংসতা ঘটেছে। তবে বুদ্ধিজীবীরা হত্যার শিকার হয়েছেন পুরো ৯ মাস, অধিকৃত বাংলাদেশের সব অঞ্চলে। মফস্বলের একজন শিক্ষক, একজন আইনজীবী, একজন ডাক্তার নিজ নিজ এলাকার বুদ্ধিজীবী ছিলেন। তাঁরা তাঁদের বলয়ে জ্ঞানের চর্চা করতেন, সামাজিক বুদ্ধিবৃত্তির প্রসার ঘটাতেন। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসজুড়েই এসব আলোকিত মানুষ পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের অক্সিলারি ফোর্সের টার্গেট ছিলেন।
আলতাফ মাহমুদ গানের মানুষ, সুরের মানুষ হলেও তাঁর বাসগৃহ হয়েছিল মুক্তিবাহিনীর যোগাযোগকেন্দ্র—অস্ত্র ও বিস্ফোরক সেখানে লুকানো থাকত। এসব না করলেও অধিকৃত ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ দিতে হতো আলতাফ মাহমুদকে। তাঁকে প্রাণ দিতে হতো তাঁর গান ও সুরের জন্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত বন্ধু দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন তাঁর সুলিখিত কলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে, ’৭০-এর নির্বাচন ও নির্বাচন-পরবর্তী অসহযোগ আন্দোলনে। তাঁর লেখাগুলোই নির্ধারণ করেছিল তাঁর নিয়তি, তিনি বিপজ্জনক টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে সমুজ্জ্বল রাখতে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী কারাগারের ভেতরে রচনা করেছিলেন ‘কবর’ নাটক। পাকিস্তানবিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলনে এই নাটক হয়ে উঠেছিল অন্যতম উপকরণ।
বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের সৃষ্টিশীলতা দিয়ে জাতির পরিচয় নির্মাণে অনুঘটক হয়ে উঠেছিলেন, যে পরিচয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছিল। জাতি পরিচয় মুছে ফেলার ধ্বংসযজ্ঞ ‘জেনোসাইড’-এ তাই নিধনের শিকার হয়েছিলেন বুদ্ধিজীবীরা।
জেনোসাইডে বুদ্ধিজীবী নিধনের পরিণতি কী হয়? সেই উত্তর লিখেছেন রাফায়েল লেমকিন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘এক্সিস রুল ইন অকুপাইড ইউরোপ’-এ। বস্তুগত ক্ষতি যা হয় তা পুষিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু জেনোসাইডের শিকার জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি, জীবনাচরণ ও মূল্যবোধে। এই জনপদের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের প্রজন্মের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মগুলোর ‘এনলাইটমেন্ট’-এর তুলনা করলেই লেমকিনের এই উত্তরের সত্যতা মেলে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ তাদের এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার নানা ধরনের সেফটি গার্ড তৈরি ও চর্চা করেছে। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে, নাৎসিজমের বিরুদ্ধে তারা আইন তৈরি করে প্রয়োগ করেছে, মানবাধিকার ফ্রেমওয়ার্ক গঠন করেছে। এত কিছুর পরও ইউরোপে আবারও জেনোসাইড ঘটেছে বসনিয়ায়, আবারও ইউরোপের অনেক রাষ্ট্রে ডানপন্থার উত্থান ঘটছে।
আমরা সেফটি গার্ড তৈরি করা তো দূরের কথা, জেনোসাইডের ক্ষতি নিরূপণ করা তো পরের কথা, জেনোসাইড বিষয়টাই বুঝে উঠিনি। ফলে আমাদের যে পরিচয় নিশ্চিহ্ন করার জন্য আমাদের বিরুদ্ধে জেনোসাইড ঘটানো হয়েছিল, সেই জাতিপরিচয়টিই এখনো অবিকশিত রয়ে গেছে। এখানে যারা জাতীয়তাবাদের কথা বলেন কিংবা জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করেন—দুই পক্ষই বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে স্থূলতার পরিচয় দেন।
জেনোসাইডের পরিণতিতে এই জনগোষ্ঠী বুদ্ধিবৃত্তি, সংস্কৃতি, জীবনাচরণ ও মূল্যবোধে শূন্য হয়ে গেছে। এই শূন্যতা পূরণের জন্য এখানে যোগ্য বুদ্ধিজীবী শ্রেণি গড়ে ওঠেনি। গড়ে ওঠেনি বলেই জেনোসাইডের শিকার হয়ে হারিয়ে যাওয়া বুদ্ধিজীবীরা এখনো প্রাসঙ্গিক, এখনো জরুরি।
‘নিরস্ত্র, নিরীহ বুদ্ধিজীবীগণ, যাঁরা সাধারণত সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেন না, তাঁরা কেন আক্রান্ত হন?’ এটি একটি চালু জিজ্ঞাসা। এই জিজ্ঞাসার সমাধান করতে হলে প্রথমে নিজেদের একটি অনুধাবন পরিষ্কার করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রশক্তি এখানে একটি দীর্ঘ পরিকল্পিত, পদ্ধতিগত ও উদ্দেশ্যমূলক অপরাধ সংঘটিত করেছে। এই অপরাধের নাম জেনোসাইড। জেনোসাইডের উদ্দেশ্য থাকে একটা জনগোষ্ঠীর পরিচয় মুছে ফেলা আর এই উদ্দেশ্যের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে জেনোসাইড কালে বুদ্ধিজীবী নিধনের কারণ।
আইনি পরিমণ্ডলে জেনোসাইড শব্দটি প্রথম উচ্চারিত হয় ‘বুদ্ধিজীবী হত্যা’ প্রসঙ্গেই, ১৯৪৬-এর ২৫ জুন, ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে। ১৯৪০-এ জার্মান অধিকৃত বোহেমিয়া ও মোরেভিয়ার দায়িত্ব পান দুঁদে কূটনীতিক কনস্ট্যানটিন ফন নুইরাথ। এই অঞ্চলের চেক জনগোষ্ঠী মানুষকে নিয়ে কী করা যায়—এই প্রশ্নের সমাধান হিসেবে তিনি কয়েকটি পথ বাতলে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, ‘যেকোনো উপায়েই চেক বুদ্ধিজীবীদের শেষ করে দিতে হবে।’
ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে তাঁকে জেরা করেন ব্রিটিশ আইনজীবী স্যার ডেভিড ম্যাক্সওয়েল। ম্যাক্সওয়েল সেদিন বলেন, ‘বুদ্ধিজীবী মানে শিক্ষক, লেখক, শিল্পীদের শেষ করে ফেলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এসব মানুষ চেক জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য প্রবাহিত করতেন পরবর্তী প্রজন্মে। তাঁদের হত্যা করা মানে জাতির স্বাভাবিক বিকাশের পথ রোধ করা, জাতি ধ্বংস করার শামিল। এটি জেনোসাইড, অবশ্যই জেনোসাইড।’
ট্রায়ালে পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত রাফায়েল লেমকিনের শরীরজুড়ে আনন্দ বয়ে যায়। তাঁর ১৬ বছরের অ্যাডভোকেসির পর এই প্রথম আইনের জগতে উচ্চারিত হলো—জেনোসাইড! যেহেতু জেনোসাইডারদের প্রধান উদ্দেশ্য জাতির পরিচয় মুছে ফেলা, অথচ বুদ্ধিজীবীরা সেই পরিচয় প্রবাহিত করেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, তাই তাঁরা জেনোসাইডারদের জন্য বিপজ্জনক। বুদ্ধিজীবীদের নিধন করা না গেলে জেনোসাইডের উদ্দেশ্য, অর্থাৎ পরিচয় মুছে ফেলার কাজটি সম্পন্ন হয় না। তাই বুদ্ধিজীবীরা যুদ্ধে না গেলেও জেনোসাইড সফল করতে হলে বুদ্ধিজীবীদের নিধন করতে হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে তৎকালীন পোল্যান্ডের, বর্তমানে ইউক্রেনের লিভিউ বিশ্ববিদ্যালয় ঘেরাও করে নাৎসিরা হত্যা করেছিল ৩২ জন অধ্যাপককে। হলোকাস্টের আগে থেকেই এই নিধনযজ্ঞের শুরু। ইহুদি শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী ও শিল্পীরা আক্রান্ত হয়েছিলেন নাৎসি উত্থানের সময় থেকে। নাৎসিরা প্রবলভাবে আক্রমণ করেছিল ইহুদি সংগীতশিল্পীদের। একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল তাঁদের কনসার্ট, গানের স্কুল। আমেরিকায় পালিয়ে প্রাণে বেঁচেছিলেন ২০ হাজার সংগীতের মানুষ।
যাঁরা পালিয়ে যেতে পারেননি, তাঁদের জন্য ভয়াবহ সব শাস্তি। অসওইচসহ গ্যাস চেম্বারগুলোতে খুন হয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ ইহুদিদের গিয়ে বিদায়ী সংগীত বাজিয়ে শোনাতে হতো ইহুদি শিল্পীদেরই। সবশেষে সেই শিল্পীরাও হতেন হত্যাযজ্ঞের শিকার। এ রকম কতজন সংগীতশিল্পী নিধনের শিকার হয়েছেন হিসাব নেই। মরডেকাই জেবেরটিগ ছিলেন পোল্যান্ডের জনপ্রিয় ব্যালে গায়ক। অধিকৃত পোল্যান্ডে তিনি গান লিখেছিলেন ‘আওয়ার টাউন ইন বার্নিং’। ঘ্যাটেগুলোতে (যেখানে ইহুদিদের আলাদা করে আটকে রাখা হতো) তাঁর এই গান মুখে মুখে গাওয়া হতো। তাঁকেও হত্যা করা হয় ১৯৪২ সালে।
সোভিয়েত অধিকৃত পোল্যান্ডেও রেড আর্মির হত্যাকাণ্ডের শিকার হন জাতীয়তাবাদী পোলিশ বুদ্ধিজীবীরা। কম্বোডিয়ায় খেমাররুজদের প্রধান টার্গেট ছিলেন বুদ্ধিজীবীরা। বুদ্ধিজীবীরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বসনিয়ায়, রুয়ান্ডায়। তালেবানদের হাতে নৃশংসভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে ফাওয়াদ আন্দারাবিকে। আন্দারাব উপত্যকার এই লোকসংগীতের শিল্পী গান গেয়েছিলেন ‘আমার জন্মভূমির চেয়ে সেরা কিছু নেই’। ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনে চলমান জেনোসাইডেও আক্রান্ত হচ্ছেন চিকিৎসক, শিক্ষক, শিল্পীসহ বুদ্ধিজীবীরা।
মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত জেনোসাইড ’৭১-এর এপিসেন্টার বা কেন্দ্রই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এর আগে সংঘটিত কোনো জেনোসাইডে এপিসেন্টার বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। ২৫ মার্চ রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক হত্যা দিয়ে জেনোসাইড ’৭১-এর শুরু। ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত নৃশংসতা ঘটেছে। তবে বুদ্ধিজীবীরা হত্যার শিকার হয়েছেন পুরো ৯ মাস, অধিকৃত বাংলাদেশের সব অঞ্চলে। মফস্বলের একজন শিক্ষক, একজন আইনজীবী, একজন ডাক্তার নিজ নিজ এলাকার বুদ্ধিজীবী ছিলেন। তাঁরা তাঁদের বলয়ে জ্ঞানের চর্চা করতেন, সামাজিক বুদ্ধিবৃত্তির প্রসার ঘটাতেন। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসজুড়েই এসব আলোকিত মানুষ পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের অক্সিলারি ফোর্সের টার্গেট ছিলেন।
আলতাফ মাহমুদ গানের মানুষ, সুরের মানুষ হলেও তাঁর বাসগৃহ হয়েছিল মুক্তিবাহিনীর যোগাযোগকেন্দ্র—অস্ত্র ও বিস্ফোরক সেখানে লুকানো থাকত। এসব না করলেও অধিকৃত ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ দিতে হতো আলতাফ মাহমুদকে। তাঁকে প্রাণ দিতে হতো তাঁর গান ও সুরের জন্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত বন্ধু দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন তাঁর সুলিখিত কলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে, ’৭০-এর নির্বাচন ও নির্বাচন-পরবর্তী অসহযোগ আন্দোলনে। তাঁর লেখাগুলোই নির্ধারণ করেছিল তাঁর নিয়তি, তিনি বিপজ্জনক টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে সমুজ্জ্বল রাখতে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী কারাগারের ভেতরে রচনা করেছিলেন ‘কবর’ নাটক। পাকিস্তানবিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলনে এই নাটক হয়ে উঠেছিল অন্যতম উপকরণ।
বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের সৃষ্টিশীলতা দিয়ে জাতির পরিচয় নির্মাণে অনুঘটক হয়ে উঠেছিলেন, যে পরিচয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছিল। জাতি পরিচয় মুছে ফেলার ধ্বংসযজ্ঞ ‘জেনোসাইড’-এ তাই নিধনের শিকার হয়েছিলেন বুদ্ধিজীবীরা।
জেনোসাইডে বুদ্ধিজীবী নিধনের পরিণতি কী হয়? সেই উত্তর লিখেছেন রাফায়েল লেমকিন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘এক্সিস রুল ইন অকুপাইড ইউরোপ’-এ। বস্তুগত ক্ষতি যা হয় তা পুষিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু জেনোসাইডের শিকার জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি, জীবনাচরণ ও মূল্যবোধে। এই জনপদের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের প্রজন্মের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মগুলোর ‘এনলাইটমেন্ট’-এর তুলনা করলেই লেমকিনের এই উত্তরের সত্যতা মেলে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ তাদের এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার নানা ধরনের সেফটি গার্ড তৈরি ও চর্চা করেছে। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে, নাৎসিজমের বিরুদ্ধে তারা আইন তৈরি করে প্রয়োগ করেছে, মানবাধিকার ফ্রেমওয়ার্ক গঠন করেছে। এত কিছুর পরও ইউরোপে আবারও জেনোসাইড ঘটেছে বসনিয়ায়, আবারও ইউরোপের অনেক রাষ্ট্রে ডানপন্থার উত্থান ঘটছে।
আমরা সেফটি গার্ড তৈরি করা তো দূরের কথা, জেনোসাইডের ক্ষতি নিরূপণ করা তো পরের কথা, জেনোসাইড বিষয়টাই বুঝে উঠিনি। ফলে আমাদের যে পরিচয় নিশ্চিহ্ন করার জন্য আমাদের বিরুদ্ধে জেনোসাইড ঘটানো হয়েছিল, সেই জাতিপরিচয়টিই এখনো অবিকশিত রয়ে গেছে। এখানে যারা জাতীয়তাবাদের কথা বলেন কিংবা জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করেন—দুই পক্ষই বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে স্থূলতার পরিচয় দেন।
জেনোসাইডের পরিণতিতে এই জনগোষ্ঠী বুদ্ধিবৃত্তি, সংস্কৃতি, জীবনাচরণ ও মূল্যবোধে শূন্য হয়ে গেছে। এই শূন্যতা পূরণের জন্য এখানে যোগ্য বুদ্ধিজীবী শ্রেণি গড়ে ওঠেনি। গড়ে ওঠেনি বলেই জেনোসাইডের শিকার হয়ে হারিয়ে যাওয়া বুদ্ধিজীবীরা এখনো প্রাসঙ্গিক, এখনো জরুরি।
১০ বছর ধরে নিজের আত্মজীবনী লিখেছেন বরেণ্য অভিনেতা, নাট্যকার ও নির্মাতা আবুল হায়াত। নাম দিয়েছেন ‘রবি পথ’। অবশেষে প্রকাশ হচ্ছে তাঁর আত্মজীবনী। আগামী ২ নভেম্বর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজন করা হয়েছে রবি পথের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান।
৩ ঘণ্টা আগেপর্দার নায়িকারা নিজেদের বয়স আড়ালে রাখা পছন্দ করেন। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আজমেরী হক বাঁধন। প্রতিবছর নিজের জন্মদিনে জানান দেন তাঁর বয়স। গতকাল ছিল বাঁধনের ৪১তম জন্মদিন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেই জানালেন এই তথ্য।
২ দিন আগে১০ বছরের বেশি সময় ধরে শোবিজে কাজ করছেন অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া। নাটকের পাশাপাশি ওটিটিতে দেখা গেছে তাঁকে। সরকারি অনুদানের ‘দেবী’ নামের একটি সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন। প্রশংসিত হলেও সিনেমায় আর দেখা মেলেনি তাঁর। ছোট পর্দাতেও অনেক দিন ধরে অনিয়মিত তিনি। এবার শবনম ফারিয়া হাজির হচ্ছেন নতুন পরিচয়ে। কমেডি রিয়েলিটি
২ দিন আগেআমাদের লোকসংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য যাত্রাপালা। গণমানুষের সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত এই যাত্রাপালা নিয়ে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করছে ‘যাত্রা উৎসব-২০২৪’। আগামী ১ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে শুরু হবে ৭ দিনব্যাপী এই উৎসব।
২ দিন আগে