কোন দিকে যাচ্ছি আমরা?

হাবীব ইমন, লেখক ও সংগঠক
প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০২৪, ০৮: ১১

বড় বিপন্ন, বড় অবক্ষয়ের সময় পার করে ছাত্র-জনতার বিজয় এল। নিঃসন্দেহে ১৬ বছরের গণতন্ত্রহীন-স্বৈরনীতি শাসনের বিরুদ্ধে বিজয় এটি। একদিন যাদের ভোট দেওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, জনগণের ন্যায়সংগত দাবিকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে, সেই গণমানুষের জয় এটি। এটাই প্রমাণিত হয়েছে, জনগণই দেশের মালিক। জনগণের শক্তিই বড় শক্তি। ক্ষমতা কখনো স্থায়ী নয়, জোর করে টিকে থাকা যায় অনেক দিন, কিন্তু জনরোষ থেকে শেষ অবধি বাঁচা যায় না, শেখ হাসিনার করুণ বিদায়ের মাধ্যমে এ সত্য অনিবার্য হয়ে উঠল আবারও।

প্রশ্ন হলো, কোন দিকে যাচ্ছে দেশ, ধোঁয়াশা আছে, অস্পষ্টতা আছে। তবে মুক্তিযুদ্ধের মৌলনীতি হাতছাড়া হওয়ার বিরাট বিপদের দিকে যাচ্ছি না তো আমরা? পরিবর্তনের যে রাজনীতির কথা বলছি, সেখানে এটা আমাদের কোনোভাবেই কাম্য নয়। সমাধানযোগ্য একটি সমস্যাকে আগলে রেখে শুধু চরম অসহিষ্ণুতা, একগুঁয়েমি আচরণ, ক্ষমতার দম্ভ, জনগণের প্রতি তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও জবাবদিহিহীন শাসনব্যবস্থা কীভাবে সহিংস পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে, কয়েক বছর ধরে তার চেহারা দেখেছি। তার প্রতিফলনে অদূর ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে ঠেকবে, জানি না।

কোনো আন্দোলনে পরস্পর বিপরীত দুই শক্তির লড়াই হয়। এ ক্ষেত্রে আন্দোলনের রূপ কোনো এক পক্ষের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। প্রধানত, নির্ভর করে নিপীড়িত যার বিরুদ্ধে লড়ছে, তার প্রতিক্রিয়া কেমন হয় তার ওপর। এটা সত্য, পৃথিবীর ইতিহাসে সহিংস রক্তাক্ত পথ শাসকেরাই তৈরি করেছে, এতে করেই শাসকেরা শেষ পর্যন্ত গদি থেকে নামে এবং নতুন কিছুর সূচনা হয়। শাসকের স্বৈরনীতি এত উগ্র হয়, তাতে ক্রমাগত দমন-পীড়ন মাত্রা বাড়াতে থাকে, আর মানুষ নিপীড়িতের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়। তবে কি নিপীড়িতরা সহিংস হবে? সোজাসাপ্টা উত্তর হলো ‘না।’ সাম্প্রতিক আন্দোলনের প্রধান রূপ হিসেবে যাঁরা সহিংসতাকে বিচার করেন, তাঁরা স্বভাবজাতভাবেই সহিংস?

আমরা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ চেয়েছিলাম, এর বেশি কিছু নয়। জনগণ কখনোই ক্ষমতার জন্য ছিল না। তারা ক্ষমতার পালাবদলে অংশীজন হতে চেয়েছিল। পাকিস্তান আমলে একটা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা ছিল, সেটা দূর করতে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। কিন্তু স্বাধীন দেশে, বিশেষ করে সামাজিক বৈষম্য রয়ে গেল, এখানে যত অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে, তত বৈষম্য বেড়েছে।

মধ্যবিত্তের সেন্টিমেন্ট খুব খারাপ, একবার সেখানে ‘ঘা’ লাগলে, সেটা সারানো খুব কঠিন। সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক—সব দিক থেকে রাষ্ট্র ‘অকার্যকর’ অবস্থায় নিমজ্জিত হয়েছে। সেটাই একটা গভীর ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় যে অভ্যুত্থান হয়েছে, সেদিকে এই আন্দোলন অগ্রসর হচ্ছে কি না, এটা ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যেই পরিষ্কার হয়েছিল।

ঘৃণা এবং মেরুকরণের রাজনীতি অর্থনৈতিক ভিত্তির ক্ষতি করছে। বাক্‌স্বাধীনতা যত খর্বিত হয়েছে, ততই বিজ্ঞানকে পেছনে ঠেলে দিয়ে রাজনৈতিক সুবিধাবাদ-রাজনীতির সাম্প্রদায়িকীকরণ তার জায়গা দখল করছে। এর পরিবর্তন দরকার। কিন্তু আন্দোলনকে তরুণেরা যেভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছে, এই মেজাজটা এখন অন্য কথা বলছে, ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

৩২ নম্বর ধানমন্ডির ৫৭৫ নম্বর বাড়ি, যে বাড়িটি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি, যেটা জাদুঘর, বাঙালির সম্পদ, সেটা পুড়িয়ে দেওয়া হলো। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নকল করে কতজন বক্তৃতা দিলেন, কত কোট করা হলো তাঁকে গোটা আন্দোলনে। কাঙ্ক্ষিত বিজয়ের পর তাঁর বাড়িটি পুড়িয়ে দেওয়া হলো। এ কেমন পরিবর্তনের সূচনা? থানায় থানায় আগুন দেওয়া, পুলিশকে মারা, আওয়ামী লীগ নেতাদের মেরে ফেলা, তাঁদের বাড়িঘর পোড়ানো, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা, হিন্দুদের বাড়িঘর-মন্দির ভাঙা—এসব পৈশাচিক উল্লাস গ্রহণযোগ্য নয়।

দুই 
তরুণদের রাজনৈতিক বোধ নিয়ে আমার দ্বিধা আছে। এসব তরুণের রাজনৈতিক মতাদর্শগত জায়গায় ভিন্নতা থাকলেও এই জনরোষের সঙ্গে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। একটা অগণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি মানুষের মনোভাব এ আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। কিন্তু এ দায় আওয়ামী লীগ কখনোই এড়াতে পারবে না। দলটি যেভাবে গণতন্ত্রকে ধর্ষণ করেছে, ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি করেছে, মানুষের ওপর যেভাবে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে, সাম্প্রদায়িকীকরণকে যেভাবে উসকে দিয়েছে, বিরাজনীতিকরণের দিকে দেশকে এগিয়ে নিয়েছে, তার বড় প্রভাব এ আন্দোলনে পড়েনি, তা বলা যাবে না। 

তিন 
আশা এবং আশঙ্কা, দুটোর কথাই বলব। সরকারের পদত্যাগের যে দাবি, তা বহুদিনের, রাজনৈতিক মহলে এ দাবি চালু থাকলেও সেটাকে কখনোই জনগণের সামনে জোরদার করতে পারেনি দলগুলো। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এ দাবিকে সামনের দিকে অগ্রসর করতে পেরেছে, তবে এখনো অনেক প্রশ্নের জবাব মেলেনি, তার মীমাংসা না হলে বাংলাদেশ তার মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক নীতি থেকে পুরোপুরি সরে যাবে—এ আশঙ্কাই কিন্তু জোরালো হচ্ছে।

সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে গেছেন, অনেকটাই নির্বাসনে যাওয়া। তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বরাতে বিবিসি জানিয়েছে, শেখ হাসিনা আর রাজনীতিতে ফিরবেন না। প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, তিনি দেশ ছেড়ে যেতে চাননি। কিন্তু হাজার হাজার নেতা-কর্মী, যাঁরা দলের দুর্দিনে সব সময় ছিলেন, এখনো থাকবেন বলে বিশ্বাস করি, তাঁদের অরক্ষিত রেখে গেছেন। হয়তো তাঁরাই তাঁকে আবার রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনবেন।

নেতৃত্বশূন্যতায় ভুগবে আওয়ামী লীগ। চিরকালের মতো ঐতিহ্যবাহী এ দলটি রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ হারিয়ে যাওয়াটা রাজনীতির জন্য সুখকর নয়; বরং গণতন্ত্রের জন্য নাজুক। বিএনপিকে শেষ করে দেওয়ার যে প্রবণতা থাকাটা কখনোই সঠিক ছিল না, তেমনি আওয়ামী লীগকে নিঃশেষ করে দেওয়ার চিন্তাটা ভুল হবে। জনগণই নির্ধারণ করুক এ দলের ভবিষ্যৎ। যাঁরা সরকারে আসবেন, তাঁদের ভাবতে হবে, তাঁরা আওয়ামী লীগের পথে হাঁটবেন কি না, না তাঁরা সত্যিকারের পরিবর্তনের দিকে এগোবেন। কর্তৃত্ববাদের বদলে কর্তৃত্ব নয়, কল্যাণকর রাষ্ট্র চাই, সমতার রাষ্ট্র চাই, মুক্তিযুদ্ধের মৌলনীতির রাষ্ট্র চাই, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চাই, তাহলেই নতুন বাংলাদেশের সূচনা হবে প্রকৃতই। অতীত থেকে শিক্ষা না নিলে আগামী ইতিহাস অন্য কথা বলবে।

হাবীব ইমন,  লেখক ও সংগঠক

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত