Ajker Patrika

গ্রন্থবিহারি হওয়ার সুযোগ যেখানে

আফজালুল বাসার
আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১: ০৮
গ্রন্থবিহারি হওয়ার সুযোগ যেখানে

বাংলাদেশে বইমেলা শুরুর ইতিহাসের সঙ্গে তিনজনের নাম সম্পৃক্ত। বাংলা একাডেমির সরদার জয়েনউদ্দিন, স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের রুহুল আমিন নিজামী এবং মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৬৫ সাল থেকে শুরু হলেও, উদ্যোগটি নিয়মিত আকার ধারণ করে ১৯৭২ সাল থেকে। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের দান একাত্তরের স্বাধীনতা আর একাত্তরের স্বাধীনতার দান একুশের বইমেলা।

আজ অবধি বাঙালির মনন এবং চিত্তবিকাশের অন্যতম নিয়ামক এই বইমেলা। বাংলা একাডেমি স্বয়ং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অবদান। বায়ান্ন সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছিল স্বাধিকার, জাতীয়তা, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার আন্দোলন।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ফলে আমাদের মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেই সুযোগের ভিত্তি দিয়ে আমরা কী কী গড়েছি এবং কী করা প্রয়োজন তা একটি গুরুতর জিজ্ঞাসা। শুধু এটুকু বলা যায়, যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার অন্তর্নিহিত সারবস্তু আজ অবধি অনর্জিত রয়ে গেছে।

বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আগে অনুষ্ঠিত হতো। এখন তা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। এই ব্যাপক বইমেলা আমাদের চিত্তকে দোলা দেয়। প্রতিটি স্টলে কম-বেশি ভালো বই থাকে, কয়েক শ স্টলে প্রকাশকেরা গ্রন্থ সাজান। জাপানি প্রবাদে বই হলো স্বর্গ, এখানে সব বাঙালি মুক্তির নিশ্বাস নিতে পারেন।

বইমেলাকে আরও উন্নত করার জন্য আমরা কয়েকটি দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি। এই মেলা দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। কিন্তু এই চর্চায় বাধা হিসেবে কাজ করছে পাইরেসি। ভালো বই নীলক্ষেত, বাংলাবাজার এবং আরও কোনো কোনো জায়গা থেকে পাইরেসি হয় এবং হচ্ছে। ফলে প্রকাশক ভালো বই প্রকাশ করতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। প্রকাশকের পরিশ্রমের ফসল নিয়ে যায় পাইরেসি মাফিয়ারা। আর প্রকাশক বই ছাপান মাত্র ৩০০-৫০০ কপি। তারও কারণ এই পাইরেসি।

পাইরেসির ফলে প্রকাশক লেখককে রয়্যালিটি দিতে পারেন না। লেখকও হতাশ হয়ে পড়েন। ফলে গোটা ‘ইনটেলিজেন্সিয়া’ মুখ থুবড়ে পড়ারও একটি কারণ হলো বই পাইরেসি। এ বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত বিদেশি ও ইংরেজি বইয়ের সমস্যা। এখানকার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-কলেজে পড়া, ইংরেজিপ্রিয় এবং ইংরেজি জানাদের কাছে যেসব ইংরেজি বই সরবরাহ করা হয়, এর অধিকাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। এটা হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিচর্চার ওপর আগ্রাসী ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক আক্রমণ। সে জন্য দরকার দেশীয় ব্যবস্থাপনায় মুদ্রণকৃত ইংরেজি গবেষণাধর্মী এবং সৃজনশীল বই। তাহলে মেলা সমৃদ্ধ হতে পারে।

রয়্যালটি প্রদান নিশ্চিত করার জন্য প্রকাশককে সচেতন থাকতে হবে। অন্যদিকে ভালো বই মানসম্মতভাবে মুদ্রিত হলে মুদ্রণ খরচ কমে যাবে। আর বই বেশি সংখ্যায় ছাপতে পারলে দামও কম রাখা যাবে। তাই বইয়ের মূল্য নির্ধারণে বিচক্ষণ নীতিমালা গ্রহণ আবশ্যক।
মেলায় গ্রন্থ সম্পর্কহীন স্টল অনাকাঙ্ক্ষিত। তবে খাবারের স্টলের প্রয়োজন আছে।

কপিরাইট আইন নিয়ে সারা বছর সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও ওয়ার্কশপ করা বিশেষ প্রয়োজন। প্রকাশক ও লেখকদের সেখানে মুখ্য ভূমিকা নিতে হবে। তাহলে বইমেলায় এর ভালো প্রভাব পড়বে।

মেলা মাঠের নকশা এবং প্রকাশনীর মান বিবেচনায় বিন্যাস করে নিতে হবে অভিজ্ঞ নকশাকারদের দ্বারা। সামঞ্জস্যপূর্ণ আয়তন নির্ধারণ করাও হবে যাঁদের অন্যতম দায়িত্ব। এর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের প্রকাশকদের বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। গ্রন্থ উন্নয়নের কার্যকরী ও সমন্বিত পদ্ধতি অবলম্বন করা জরুরি। জরুরি গ্রন্থ কী এবং কেন তা নিয়ে প্রকাশক-লেখক-রাজনীতিক-বিদ্বৎজনদের নিয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। বই ছাপানোর জন্য গুণগত মান ঘোষণা করলে মানহীন বই প্রকাশ বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।

পাশাপাশি বইয়ের প্রচারেও সমন্বতি উদ্যোগ প্রয়োজন। বিভিন্ন অঞ্চলের সামাজিক পাঠাগারের সঙ্গে বইমেলার আত্মার সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। অন্যদিকে, বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন সরকারি পাঠাগারে গ্রন্থ ক্রয় নীতিমালার সঙ্গে বইমেলার নাড়ির সংযোগ ঘটাতে হবে।

শিশু-কিশোরদের মেলায় উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের বইমেলা ভ্রমণ, গ্রন্থ কেনা এবং পাঠের সঙ্গে সিলেবাস ও নম্বরের সম্পর্ক থাকা জরুরি। ছাত্রছাত্রীদের জীবন ও কল্পনার বাস্তবসম্মত মূল্যায়ন প্রয়োজন। গ্রন্থপাঠে মানুষ চিত্তে ধনী হয়। ধনী চিত্ত বাস্তবে অসীম ও সুষম সমাজের দিকে যেতে পারে।

মানুষকে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সীমাবদ্ধতা ও এর বাণিজ্যিক দিক সম্পর্কে জানানো প্রয়োজন। সর্বোপরি বাণিজ্যিক দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে এআই দখলি ধারাকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার মধ্য দিয়ে মানুষকে হেয় করে ফেলার পুনঃপ্রকল্প বাস্তবায়ন করতে দেওয়া ঠিক হবে না।

মোবাইল-দাস বা যন্ত্রদাস কথাগুলো রূঢ়, কিন্তু গ্রন্থদাসত্বও আমরা মানতে পারি না—কোনো গ্রন্থ তেমন আহ্বান জানায় না। আকাশেও বিহার কাঙ্ক্ষিত, সেই অর্থে গ্রন্থে বিহারও কাঙ্ক্ষিত। বইমেলা আমাদের গ্রন্থবিহারি হওয়ার সুযোগ করে দিতে পারে। গ্রন্থ অনুশীলনের বিকল্প সংস্কৃতির নামই গ্রন্থ সংস্কৃতি, বইমেলা যার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক।

লেখক প্রকাশক, বাঙ্গালা গবেষণা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত