Ajker Patrika

তাওয়া গরমের চেষ্টা অব্যাহত

তাওয়া গরমের চেষ্টা অব্যাহত

রাজনীতিতে তাওয়া গরমের চেষ্টা চলছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতাপ্রত্যাশী বিএনপি পরস্পরের বিরুদ্ধে হুমকি, হুংকার দিয়ে চলেছে। বিএনপি সরকার পতনের এক দফা দাবি আদায়ে যুগপৎ আন্দোলনের মাঠে রয়েছে। তবে অনেক হম্বিতম্বি করার পরও আন্দোলনের তাওয়া রুটি-পরোটা ভাজার মতো যথেষ্ট গরম করে তুলতে পারছে না। আবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও পাল্টা যেসব উদ্যোগের কথা শোনা যায়, তারও তেমন কিছু এখনো দৃশ্যমান হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে না। তবে উভয় পক্ষ যে তৎপর রয়েছে, অন্তত পরস্পরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়ে হলেও, তা প্রতিদিনের খবরের কাগজের পাঠকদের জানা।

দেশের রাজনীতি নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা সহজ নয়। কারণ রাজনীতি যেমন কোনো নিয়ম মেনে চলছে না, তেমনি রাজনৈতিক দলের নেতারাও যা বলেন, সেটা তাঁদের মনের বা বিশ্বাসের কথা কি না, সেটা বোঝা মুশকিল। বিএনপি ক্ষমতার বাইরে থেকে হাঁপিয়ে 
উঠেছে, আবার টানা ক্ষমতায় থাকার কিছু দায় ও যন্ত্রণায় ভুগছে আওয়ামী লীগও। পরিস্থিতি কোন দলের অনুকূলে তা এককথায় বলা কঠিন। রাস্তাঘাটে যদি কাউকে ধরে জিজ্ঞেস করা হয়, দেশে সুষ্ঠু ভোট হলে কোন দল জিতবে, তাতে হয়তো বিএনপির পক্ষেই বেশি মতামত পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পছন্দের তালিকায় শেখ হাসিনার নামই বেশি শোনা যাবে। আবার মানুষের সমর্থন যে বিএনপির প্রতি বেশি তা-ও তো দলটির অবস্থা দেখে বোঝা যায় না। বিএনপির সভা-সমাবেশে জমায়েত কিছুটা বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু সেটা অবশ্যই সরকারের জন্য ভীতিকর নয়।

এটা ঠিক যে আমাদের দেশের মানুষ রাজনৈতিক অবস্থানের দিক থেকে চরমভাবে বিভক্ত। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থক প্রায় সমান সমান বলে মনে করা হয়। তবে যারা ক্ষমতায় থাকে, তারা ভোটে বিজয়ী হলেও ক্ষমতায় থাকার কারণে সমালোচিত হয় বেশি।

ক্ষমতায় থেকে সবাইকে খুশি করা খুব সহজ কাজ নয়। বিভিন্ন প্রচার-প্রচারণা থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে সরকার বুঝি খুব সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। তাহলে সরকার এত বছর টিকে আছে কীভাবে? বিএনপির সমর্থকেরা বলবেন, সরকার টিকে আছে বিভিন্ন বাহিনীর জোরে। পুলিশকে মাঠে না নামালে সরকার নিরাপদ থাকতে পারবে না। যদি পাল্টা প্রশ্ন করা হয়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলেই তো দেশ উন্নয়নের পথে চলছে। বিএনপির শাসনে কি এখনকার চেয়ে মানুষ বেশি সুখে-শান্তি-স্বস্তিতে ছিল? তুলনামূলক আলোচনা এলে মানুষ আমতা-আমতা করবে, নির্দিষ্ট করে কিছু বলবে না। মানুষের বক্তব্য যেহেতু স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট নয়, সেহেতু রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নির্দিষ্ট বা স্পষ্ট কথা বলবেন কেমন করে?

কিন্তু একটি বিষয় অনেকের কাছেই স্পষ্ট যে আগামী নির্বাচনের আগের সময়টা রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুব শান্ত থাকবে না। দুই পক্ষের যখন যুদ্ধ প্রস্তুতি চলছে, তখন ছোট হোক বড় হোক যুদ্ধ একটি হবেই। কে জিতবে, কে হারবে তা এখনই না বলা ভালো। দেশ যেহেতু রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত, সেহেতু বিভক্ত মতামত থাকাই স্বাভাবিক। যাঁরা বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখতে চান, তাঁরা বলবেন, আগামী যুদ্ধে বিএনপি জিতবে। আবার যাঁরা ক্ষমতায় আরও এক মেয়াদে আওয়ামী লীগকেই দেখতে চান, তাঁরা মনে করছেন—আওয়ামী লীগকে হারায় এমন শক্তি কার? তবে রাজনৈতিক কৌশলে আওয়ামী লীগের তুলনায় বিএনপি যে কাঁচা, তার বহু প্রমাণ আগে পাওয়া গেছে। এটা কোনো বানানো গল্প নয় যে আওয়ামী লীগের মুখোমুখি হয়ে জেতার অভিজ্ঞতা বিএনপির নেই।

হয়তো বলা হবে, দিন কি সব সময় সবার এক রকম হয় বা যায়? না, চিরদিন আওয়ামী লীগ অনুকূল পরিবেশ পাবে আর বিএনপি প্রতিকূলে দাঁড় টানবে, তা হতে পারে না। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে, বিএনপি হাঁকডাক যত করে, বাস্তবে মাঠ তত গরম হয় না। একজোট ভেঙে বহু জোট গড়ে যুগপৎ আন্দোলনের নামে বিএনপি এখন যা করছে, তা দেশের কতভাগ মানুষকে কাছে টানতে পারছে? তা ছাড়া বিএনপির মিত্র দল হিসেবে যে দল ও নেতাদের নাম শোনা যায়, তাদের শক্তি বা গণভিত্তি কতটা তা কি কারও অজানা? বিএনপির একটি মিত্র দল বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, যার নেতা মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। বছরখানেক আগে বিএনপির সঙ্গে আন্দোলন বিষয়ে আলোচনার পর দুই দলের নেতারা বলেছিলেন, ‘আগামী দিনে আন্দোলনে বড় চমক আসছে।’

তারপর অনেক সময় চলে গেছে। কোনো চমক কি দেখা গেছে? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, রাজনীতিটা কি আসলে কোনো ‘চমক’-এর বিষয়? কল্যাণ পার্টি তো বহু বছর ধরে বিএনপির সঙ্গেই আছে। এই পার্টির বদৌলতে বিএনপির যদি কিছু কল্যাণ হতো তাহলে এত বছরে কেন হলো না? কল্যাণ পার্টির শক্তি বা জনসমর্থনই-বা কতটা? সৈয়দ ইবরাহিমের ব্যক্তিগত ক্যারিশমাই-বা কতটুকু? সেনাবাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমের অভ্যুত্থানের সময় তিনি যে ‘চমক’ দেখিয়েছিলেন, তা সংশ্লিষ্টদের নিশ্চয়ই মনে আছে। তারপর রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে দল গঠন করে কতটুকু সফল হয়েছেন? ছোট দলের জোরে চমক দেখানোর কথা বললে বিএনপি কি তার শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছেও হাস্যকর হয়ে ওঠে না?

বিএনপির মধ্যে নানামুখী টানাপোড়েন আছে। দলটি ঐক্যবদ্ধ ও সংহত নয়। দলের প্রধান দুই শীর্ষ নেতা রাজনীতিতে সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারছেন না। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান আগামী নির্বাচনেও প্রার্থী হতে পারবেন না। সরকার নতুন করে মামলা-হামলা বাড়িয়ে দিলে দলের অনেকেই আবার গর্তে লুকাবেন। বিদেশি মিত্রদের ওপর ভর করে বিএনপি যতই আস্ফালন করুক তা যে কাজের মুহূর্তে নিষ্ফল হয়, তা-ও দলের ভুক্তভোগীদের অজানা নয়। বর্তমান সরকার ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার জেদ যদি বিএনপি অব্যাহত রাখে, তাহলে দলটি আরেক দফা ভাঙনের মুখে পড়তে পারে।

আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হোক, সেটা সবাই চাইছেন। কিন্তু ক্ষমতার বাইরে থাকা কোনো দল যদি নিজেদের মতো করে মাঠ সাজাতে না পেরে নির্বাচন থেকে দূরে থাকে, তাহলে কী হবে? আওয়ামী লীগের সামনে যেমন সমস্যা আছে, তেমনি বিএনপির সামনেও আছে। আওয়ামী লীগের বড় সম্পদ দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা আওয়ামী লীগের জন্য মুশকিল আসানে বড় ভূমিকা পালন করে। বিএনপির দলে বা মিত্রদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যাঁর ওপর মানুষের ভরসা আছে। তাহলে কীভাবে বা কিসের জোরে বিএনপি আগামী নির্বাচনের আগে রাজনীতির মাঠ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার আশা করছে?

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকেই ক্ষমতাসীন দলের নানা প্রস্তুতির কথা জানা যাচ্ছে। সরকার বা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সামনের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সচেতন নন, সে রকম ভাবারও কোনো কারণ নেই। বর্তমান অর্থনৈতিক টালমাটাল বিশ্বে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা, কর্মসংস্থান নিরাপদ রাখা, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে জনমনে স্বস্তি সমুন্নত রাখাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ।

আওয়ামী লীগের সামনে বড় সমস্যা, দলটি ক্ষমতায় থাকায় ১৫ বছরে এর সাংগঠনিক অবস্থা কিছুটা এলোমেলো হয়ে পড়েছে। সরকারের মধ্যে দল হারিয়ে গেছে। সম্মেলনের মাধ্যমে দল গোছানোর কাজে হাত দিয়ে কতটুকু সাফল্য পাওয়া গেছে, তা স্পষ্ট নয়; বরং রাজনীতি-ঘনিষ্ঠ অনেকেই মনে করেন, অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে তৃণমূল আওয়ামী লীগ। জেলা-উপজেলায় দীর্ঘদিন ধরে সংগঠন প্রায় নিষ্ক্রিয়। এমপি ও স্থানীয় আওয়ামী লীগে দ্বন্দ্ব চরমে। অনেক ক্ষেত্রে ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে ঠাঁই দেওয়া হয়েছে অনুপ্রবেশকারীদের। এভাবে বিশেষ ব্যক্তির বলয় তৈরি করাসহ নানা কারণে তৃণমূলনির্ভর দলটির সাংগঠনিক অবস্থা খুব শক্ত আছে, সেটা বলা যাবে না। তৃণমূলের অনেক অভিযোগ জমা আছে আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে। অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা শোনা গেলেও বাস্তবে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। অথচ বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলা করে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হতে তৃণমূলকে ঐক্যবদ্ধ করার কোনো বিকল্প নেই।

১৮ সেপ্টেম্বর আজকের পত্রিকায় ‘ভোটের প্রস্তুতি জোরেশোরে’ শীর্ষক প্রকাশিত খবর থেকে সরকারপক্ষের নানা প্রস্তুতির তথ্য জানা যায়। মনে হচ্ছে, বিএনপির হুমকি-ধমকিসহ ‘সব ষড়যন্ত্র’ খতিয়ে দেখে এবার আটঘাট বেঁধেই মাঠে নামছে ক্ষমতাসীনেরা। বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে রাজনীতির মাঠ দখলের পরিকল্পনা করেছে আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি কেন্দ্র থেকে তৃণমূলকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগও নিয়েছে দলটি। সেই সঙ্গে সারা দেশে সরকারের উন্নয়ন সাফল্য তুলে ধরে বিএনপির অপপ্রচারের জবাব দিতে নেতা-কর্মীদের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দেখা যাক, কোন পক্ষের প্রস্তুতি কী ফল দেয়।

বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

চীন সফরে সেভেন সিস্টার্স নিয়ে ড. ইউনূসের বক্তব্যে ভারতে তোলপাড়

বাংলাদেশের ১৮ বছরের সেই অপেক্ষা তবে ফুরোচ্ছে

খাবারে চেতনানাশক মিশিয়ে সিঁধ কেটে চুরির সময় গৃহবধূকে ধর্ষণের অভিযোগ

জুলাই আন্দোলনের নারীদের সম্মাননা নিয়ে প্রশ্নে যা বলল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর

চোর সন্দেহে যুবককে পিটুনি, প্রতিবাদ করায় দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত