টি-বাঁধ ও কলাইরুটি

আব্দুস সাত্তার মন্ডল
প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২৩, ০৭: ৪৯

রাজশাহী গেলে পদ্মার পাড়ে টি-বাঁধে যাওয়াটা যেন নিয়ম হয়ে গেছে। যেমন ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন শহরটা, তেমনি ছিমছাম টি-বাঁধ এলাকা। একেবারে সুনসান বাঁধানো ঘাট। সামনে বিস্তীর্ণ পদ্মা। যেন নিটোল শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে মুঠো মুঠো ঢেউ। বর্ষায় ভরা যৌবনা। হেমন্তে কিছুটা শীর্ণকায়। তাতে কী? সুন্দরী সব সময়ই সুন্দরী। তার আবার কম-বেশি হয় নাকি? শুধু একেক সময় একেক রূপ।

সকালে আসেন প্রাতর্ভ্রমণকারীরা। বাঁধের ওপর দিয়ে হাঁটা, শরীরচর্চা, গায়ে সুবাতাস মাখানো—সবই চলে। বিকেলে আসে দলে দলে আবালবৃদ্ধবনিতা বিলাসভ্রমণে। উন্মুক্ত নদীর অপরূপ শোভা দেখে সময় কাটাতে। এমন উদোম বাতাস আর কোথায়? ঘাটে সারি সারি নৌকা বাঁধা। কেউ কেউ নৌকায় উঠে চক্কর দিয়ে আসে মাঝনদীতে। পদ্মার জলকেলি কার না ভালো লাগে! বিকেলে ফুচকা, বাদাম, চটপটির অস্থায়ী দোকান বসে। তরুণ-তরুণীদের রসনা বিলাসের উত্তম ব্যবস্থা। নিরাপত্তারক্ষীদের টহলদারি শৃঙ্খলা রক্ষা নিশ্চিত 
করে। রাজশাহী শহরবাসী গর্ব করে বলে, ‘এটা মিনি কক্সবাজার।’ হবেই বা না কেন?

শুধু কি বেড়ানো? পদ্মার পাড়ের জীবন-জীবিকায়নও জানা গেল কিছুটা। গবেষণা সহকারী মামুনকে নিয়ে নেমে গেলাম নিচে, জলের কাছাকাছি। চপচপ বালুতীর ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে দেখা নৌকার মাঝিদের সঙ্গে। প্রতিদিন কতশত মজুরি শ্রমিক নৌকায় করে পাড়ি জমাচ্ছেন দূর গাঁও মাঝচরে। কাজের খোঁজে। স্থানীয় ভাষায় তাঁদের বলে পাইট। বর্ষার পানি নেমে যাওয়ায় এখন পদ্মার চরে কলাই, মসুরি, বাদাম, সবজির আবাদ শুরু হয়েছে। পলি পড়া চরের আগাছা জংলা পরিষ্কার, জমি তৈরি, বীজ ছিটানো—হরেক রকমের কাজ।

দুপুরের খাবার নিয়ে যাচ্ছেন পুঁটলি বেঁধে। নৌকাযোগে আবার ফিরে আসবেন বিকেলে। জনপ্রতি ২০-৩০ টাকা ভাড়া। আসা-যাওয়ায় ৫০-৬০ খরচ। বিকেলে আসেন শৌখিন নৌকাভ্রমণ বিলাসীরা। নৌকা ভাড়ার কামাই রোজগার মোটামুটি খারাপ না। খরচাপাতি বাদে গড়পড়তা দিনে হাজার-বারো শ থাকে। কম কী?

২. সাতসকালে অনেকেই নেমেছেন মাছ ধরতে পদ্মায়। বাঁশের চাঁই জড়ো করে রাখা আছে নদীর তীরে। কিছু চাঁই পাতা আছে জলে। একজনকে দেখা গেল চাঁই থেকে কিছু ছোট মাছ বের করে খলুইয়ে রাখতে। আরেকজনকে দেখলাম শক্ত হাতে খ্যাপলা জাল ঝাঁকি মেরে জলে ফেলতে। সামান্য কিছু গাং চেলা, ফ্যাসা মাছ উঠেছে। মহানন্দে সেগুলো জাল থেকে ছাড়িয়ে নিচ্ছে দুজন। শৌখিন মাছ ধরার একটা আধা অর্থনৈতিক ব্যাখ্যাও পাওয়া গেল তাদের কাছ থেকে। প্রথমত, নদীতীরে প্রাতর্ভ্রমণের অপার আনন্দ। এটা অর্থনীতির পরিভাষায় ইন্ট্যাঞ্জিবল বেনিফিট। দ্বিতীয়ত, ঝাঁকি জাল জোরে ফিকে মেরে এবং পরে আবার জল থেকে টেনে তোলার শারীরিক ব্যায়াম।

এটা কিছুটা ট্যাঞ্জিবল ও কিছুটা ইন্ট্যাঞ্জিবল বেনিফিট। তৃতীয়ত, কুড়িয়ে টুকিয়ে যা কিছু মলা-চেলা মাছ পাওয়া যায়, ওইটাই লাভ। এর সবটাই ট্যাঞ্জিবল বেনিফিট। সব বেনিফিট কি টাকার হিসাবে হয়?

৩. অনেকেই সাতসকালে ঘাটে এসেছেন থালাবাটি ধুতে। কেউ আবার কাপড়চোপড় ধুয়ে, গোসল সেরে, বালতি ভরে রান্নার জল নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। শহরের বাসায় এসব করতে যে পানির বিল গুনতে হয়, সেটা এখানে বেঁচে যাচ্ছে। ওই যে অর্থনীতির প্রথম পাঠ, নদীতীরে জলের উপযোগিতা আছে, কিন্তু দুষ্প্রাপ্যতা নেই। কাজেই এখানে ওটার কোনো দাম দিতে হয় না। এই সহজ হিসাবটা কে না বোঝে!

৪. সবচেয়ে মজার দৃশ্য, শৌখিন একজন নারী একটি টিয়া পাখিকে বেড়াতে নিয়ে এসেছেন খাঁচায় করে নদীর ঘাটে। পরম আনন্দে পাখির খাবারের বাসনকোসন ধুইয়ে মুছে নিলেন। খাঁচাটাকে ঘষে-মেজে পরিষ্কার করলেন। তারপর টিয়াকে পদ্মার ভাসান জলে ডুবিয়ে গোসল দিয়ে বাড়ি ফিরলেন। মালিকের দারুণ সখ্য জমে গেছে টিয়া বন্ধুর সঙ্গে। মানুষের কত-কী বিচিত্র শখ!

৫. প্রাতর্ভ্রমণ শেষে মামুনকে নিয়ে চলে আসছিলাম টি-বাঁধ থেকে। রাস্তায় দেখলাম অনেক শ্রমিক লাইন ধরে যাচ্ছেন। গ্রাম থেকে এসেছেন। সবার গায়ে চলনসই জামাকাপড়। পায়ে সবার মোটামুটি স্যান্ডেল-জুতা আছে। প্রত্যেকের বাহন সাইকেল। পেছনের সিটের সঙ্গে সুকৌশলে বাঁধা বাঁশের ঝুড়ি ও ঊর্ধ্বমুখী কোদালের হ্যান্ডেল। বোঝা গেল কোনো নির্মাণকাজে ছুটছেন তাঁরা। দিনমজুরি ছয় থেকে সাত শ টাকা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে কিছুটা চাপে পড়েছেন। তবে বাড়িতে সামান্য কিছু আবাদ আছে। কিছু হাঁস-মুরগি ও দু-একটি গরু-ছাগল পালন করে মেয়েছেলে মিলে। তাতে খেয়ে-পরে মোটামুটি চলে যায়। তবে তাঁদের মাঝে শহুরে মধ্যবিত্তের মতো হা-হুতাশ নেই।

৬. পথেই পড়ল সিমলা পার্ক। সার্কিট হাউস রোডের ঠিক উল্টো দিকে। চোখে পড়ল এক নারীর কলাইরুটির দোকান। মধ্যবয়সী মিনা বেগম। জীবনসংগ্রামের প্রত্যয় চোখেমুখে। রাস্তার ধারে খোলামেলা পরিবেশে ঝুপড়ি দোকান। বাসনকোসনে সাজানো রুটির সব আয়োজন। আটা ডলে মণ্ড করে রাখা আছে। কার না লোভ হয়? রাজশাহীতে এসে কলাইরুটি খাওয়া আমার আরেক নেশা। ওই নারী সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন। বসে পড়লাম কাঠের বেঞ্চে। লাকড়ির চুলোয় গরম-গরম কলাইরুটি। সঙ্গে সরষে তেলে পোড়া বেগুনভর্তা।দারুণ মজা। তা-ও আবার সকালবেলা পার্কের খোলা বাতাসে বসে পদ্মার পাড়ে।

৭. রুটি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কলাইরুটির একটু ইতিহাস জানার আগ্রহ হলো। আরেকজন খদ্দেরও রুটি খাচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন, কলাইরুটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের জনপ্রিয় নাশতা। মিনা বেগম যোগ করলেন, এটা এসেছে ইন্ডিয়া থেকে। ঠিকই তো। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ইন্ডিয়ার গা ঘেঁষা অঞ্চল। চাঁপাই ও রাজশাহীর আশপাশে পদ্মার যেসব চর রয়েছে, সেগুলোতে বর্ষায় প্রচুর পলি পড়ে। পানি নেমে গেলে ওই সব উর্বর মাটিতে প্রচুর মাষকলাই হয়। আর এটাই হচ্ছে কলাইরুটির প্রধান উপকরণ। সঙ্গে অবশ্য কিছু চাল ও আটার গুঁড়িও দিতে হয়। কেউ কেউ ডালের আটাও মেশান।

৮. মিনার কলাইরুটির দাম সাধারণত ২৫-৩০ টাকা পিস। তবে কম-বেশিও নেয়। কোনো জোরাজুরি নেই। দেখলাম একজন পাগল কিসিমের লোক এলেন। তাঁকেও মিনা বেগম একটি রুটি দিলেন খেতে, বিনা পয়সায়। গরিব গরিবকে চেনে। সাধারণ শ্রমিক, রিকশাওয়ালা সবাই আসেন এখানে। সস্তায় রুটি-ভর্তা খান। একজন শ্রমিক জানালেন, কলাইরুটি বেশ সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। পেটে থাকে অনেকক্ষণ। দুই-তিন দিন রাখা যায়, নষ্ট হয় না। তাই তো যাঁরা ওপারে কাজে যান সারা দিনের জন্য, অনেকেই কলাইরুটি নিয়ে যান।  

৯. কলাইরুটি এতটাই জনপ্রিয় যে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত রবার্ট মিলারও নাকি রাজশাহীর কলাইরুটি পছন্দ করেছেন। মিনা বেগম জানালেন, তাঁর রুটি খেতে এখানে ঢাকার বড় বড় নেতাও আসেন। কয়েকজন শীর্ষ স্থানীয় কেন্দ্রীয় নেতার নামও বলে দিলেন গড়গড় করে। স্থানীয় বড় বড় সাহেব নাকি লোক পাঠিয়ে তাঁর দোকান থেকে কলাইরুটি নিয়ে যান। বোঝা গেল, ব্যবসার জন্য মিনা প্রচার ও মার্কেটিং কৌশলটাও বেশ রপ্ত করে ফেলেছেন।

মিনার স্বামী মারা গেছেন কিছুদিন হলো। চার ছেলে বিয়ে থা করে আলাদা থাকেন। একটি মাত্র মেয়ে। টাকার অভাবে বিয়ে দিতে পারছেন না। কন্যাদায়গ্রস্ত একজন মায়ের স্বাভাবিক আকুতি। সাধ্যমতো সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বিদায় হলাম। রাজশাহী উপশহরে কত কলাইরুটির দোকান আছে! দু-একটায় আগেও খেয়েছি। রুটির সঙ্গে হাঁসের মাংস, ভর্তা-ভাজি, কত-কী! মিনা বেগমের কলাইরুটির সঙ্গে হাঁসের মাংস ছিল না। ছিল না কোনো বাহারি নাম বা বিজ্ঞাপন। কিন্তু ছিল অফুরন্ত তৃপ্তির স্বাদ ও পথের পাশে প্রান্তজনের অকৃত্রিম আতিথেয়তা।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত