এই অচলায়তন ভাঙতে হবে

বাসন্তি সাহা
প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৪, ০৭: ৩৭

সাফ ফুটবলজয়ী রাজিয়া খাতুনের মৃত্যু হয়েছে প্রসব-পরবর্তী জটিলতায়। প্রসব-পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে, এটা এখন পুরোনো খবর। মানুষ ভুলেও গেছে। আলোচনার বিষয়ও নয় এটা। আলোচনার বিষয় হচ্ছে, যে নারী একজন জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড়, যাঁর স্বামী একজন ফুটবল খেলোয়াড়, যে নারী ফুটবলার হওয়ার মতো অচলায়তন ভাঙলেন, দেশকে গৌরব এনে দিলেন, সেই নারীর সন্তান প্রসব করতে হলো বাড়িতে, অপ্রশিক্ষিত ধাইয়ের হাতে! এই মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু? নাকি অবহেলায় একটা জীবনকে শেষ করে দেওয়া? মা, ভাই, স্বামী, তাঁর কাছের মানুষ, কেউই এই মৃত্যুর দায়িত্ব এড়াতে পারেন না।

রাজিয়া খাতুন বয়সভিত্তিক ফুটবল পর্যায়ে ছিলেন নিয়মিত মুখ। খেলেছেন বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলেও। বাংলাদেশের হয়ে সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা ফুটবলার ছিলেন তিনি। পত্রিকা থেকে জানা যায়, তাঁর স্বামী সাবেক ফুটবলার ইনাম রহমান রাজিয়ার মৃত্যুর জন্য রাজিয়ার মা ও ভাইকে দায়ী করেছেন। এই সন্তান প্রসবে তাঁর ভূমিকাটা পরিষ্কার নয়। তিনি কেন পাশে ছিলেন না, অথবা দূরে থাকলেও তিনি কি তাঁর সন্তান প্রসব হাসপাতালে হওয়ার ব্যাপারে কোনো ভূমিকা রেখেছিলেন?

সমাজে একটা প্রচলিত ধারণা আছে যে হাসপাতালে সন্তান প্রসবের জন্য গেলে সেখানে অস্ত্রোপচার করতে হয় এবং অস্ত্রোপচারের কারণে পরবর্তী সময়ে কাজকর্ম করতে সমস্যা হয়। সে ক্ষেত্রে এই নারী ফুটবলার ও তাঁর পরিবারের ক্ষেত্রে এই প্রচলিত ধারণা কাজ করেছে কি না, জানি না! যেহেতু তিনি একজন ফুটবলার। অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসব হলে তিনি আর খেলতে পারবেন না—এই ধারণা থাকাও অস্বাভাবিক নয়।

অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৫০ শতাংশ বাড়িতে প্রসব হয়। বাকি ৫০ শতাংশের প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব হয়। এতে প্রতি এক লাখে মারা যায় ১৬৭ জন নারী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পরামর্শ অনুযায়ী, একটি দেশের প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব ৮৫ শতাংশ হওয়া উচিত। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে মা ও শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো সন্তান প্রসবের সময় হাসপাতালে না গিয়ে অদক্ষ ধাত্রীর হাতে বাড়িতে প্রসব করানো। বাড়িতে ধাত্রীর হাতে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মায়েদের রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনি হয়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে অনেক সময় মা ও শিশুর মৃত্যু হয়। আবার অনেক সময় তাদের এমন অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়, তখন আর ডাক্তারদের কিছু করার থাকে না। 

হাসপাতালে বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেসব প্রসব হয় এর মধ্যে বেশির ভাগ সিজারিয়ান। স্বাভাবিক প্রসবকে বেসরকারি চিকিৎসাসেবায় নিরুৎসাহিত করা হয়। এর পেছনে অর্থের কারণ ছাড়াও অনেকগুলো কারণ রয়েছে। অনেক সময় রোগী নিজেও সি-সেকশন করার আগ্রহ দেখান। 

এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাল্যবিবাহের হারে বাংলাদেশ এখনো শীর্ষে। এটি মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বাল্যবিবাহের কারণে কম বয়সে গর্ভধারণের ঝুঁকি বাড়ে। বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ৭৪টি শিশুর জন্ম দিচ্ছেন ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মায়েরা। দেশে মাতৃমৃত্যু কমলেও এখনো তা উদ্বেগজনক। বছরে ৩ হাজার ৭০০ মায়ের মৃত্যু হচ্ছে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে। এর অর্থ হচ্ছে, প্রতিদিন গড়ে ১০ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে এ কারণে। 

আমাদের তথাকথিত মধ্যবিত্ত পরিবার মেয়েশিশুর প্রতি অযত্ন, বাল্যবিবাহ ও মায়ের অনিরাপদ প্রসব—এই অবস্থা থেকে কিছুটা বের হয়ে আসতে পেরেছে। ফলে শিল্প, সাহিত্য, নাটক কোথাও নেই দরিদ্র পরিবারের মেয়েশিশুগুলোর অযত্ন, বাল্যবিবাহ, অনিরাপদ প্রসব বা প্রসবজনিত মৃত্যু বা প্রসব-পরবর্তী জটিলতা নিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপনের কথা। কিন্তু অন্ধকার তো ঘোচেনি। বেড়েছে হয়তো আরও।
আমি যখন নোয়াখালী অঞ্চলের বিভিন্ন চরাঞ্চলে স্যাটেলাইট ক্লিনিকগুলো দেখতে যাই, দেখি যাঁরা এসেছেন তাঁরা বেশির ভাগ নারী, যাঁদের বয়স ১৫ থেকে ১৯, যাঁরা সবাই বাল্যবিবাহের শিকার, রক্তশূন্যতা বা প্রসব-পরবর্তী জটিলতায় ভুগছেন। যাঁরা এই স্যাটেলাইট ক্লিনিকের ডাক্তারের কাছে আসছেন, তাঁরা কিছুটা চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন। বেশির ভাগই কবিরাজ, ঝাড়ফুঁক, পানি পড়া, ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খাচ্ছে। 

বাংলাদেশে সিজারিয়ান নিয়ে আইসিডিডিআরবির তথ্য অনুযায়ী, বাড়িতে প্রসব করানো হলে মাত্র ১ হাজার ৪০০ টাকা খরচ হয়। যখন সরকারি ইনস্টিটিউশনে প্রসব করানো হয়, সেখানে গড়ে ৬ হাজার ৬০০ টাকা খরচ হয়। যখন সি-সেকশন করতে হয়, তখন এই খরচটা গড়ে ২১ হাজার টাকা হয়ে যায়। ফলে এটা দরিদ্র মানুষের ওপর অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করে। তাই তারা সন্তান প্রসবের সময় হাসপাতালে যেতে নিরুৎসাহিত হয়। 

আমার কাছে রাজিয়া খাতুনের মৃত্যুর একটি প্রতীকী মূল্য আছে। এই মৃত্যু যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, বাংলাদেশের হাজার নারী আর মেয়েশিশুর বাল্যবিবাহ, রক্তশূন্যতা ও অযত্নের কথা, ছিঁড়েখুঁড়ে দেখিয়ে দেয় আমাদের অন্ধকারের কথা। বাড়ির মেয়েশিশুটি, ঘরের নারীটি সব সময়ই প্রান্তিক, এমনকি সন্তান জন্মদানের মতো বিপজ্জনক সময়েও গুরুত্ব পায় না। এই মৃত্যু অবহেলাজনিত। একে রোধ করতে হবে। সন্তান প্রসবের সময় হাসপাতালে আসা মায়েদের অধিকার। এই অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এ অচলায়তন ভাঙতে হবে।

লেখক: বাসন্তি সাহা, কো-অর্ডিনেটর-রিসার্চ ও ডকুমেন্টেশন, দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি চাকরিজীবীরা সম্পদের হিসাব না দিলে যেসব শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন

শেখ হাসিনাকে নিয়ে যুক্তরাজ্যে এম সাখাওয়াতের বিস্ফোরক মন্তব্য, কী বলেছেন এই উপদেষ্টা

শিক্ষকের নতুন ২০ হাজার পদ, প্রাথমিকে আসছে বড় পরিবর্তন

লক্ষ্মীপুরে জামায়াত নেতাকে অতিথি করায় মাহফিল বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ

শ্রীপুরে পিকনিকের বাস বিদ্যুতায়িত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ শিক্ষার্থীর মৃত্যু, আহত ৩

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত