সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
কবি জীবনানন্দ দাশের মাতা কুসুমকুমারী দাশ একদা আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’ জীবিত থাকলে ওই আক্ষেপোক্তি তাঁকে প্রত্যাহার করে নিতে হতো বৈকি; কারণ আমাদের ছেলেরা এখন কেবল কথায় নয়, কাজেও যথেষ্ট সেয়ানা হয়ে উঠেছে। ফলে বাংলাদেশ মোটেই পিছিয়ে নেই। দুর্নীতিতে এবং বসবাসের অযোগ্য রাজধানী সৃষ্টিতে আমরা সাধারণত বিশ্বে শীর্ষস্থানের আশপাশেই থাকি। আমাদের ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট বানিয়ে একেক সময় একেক পণ্যের দাম আকাশচুম্বী করে তোলেন; এমনকি নিরীহ যে ছাপার ও লেখার কাগজ, তাকেও মায়া করে না, তার দামও আকাশচুম্বী করে ছাড়ে।
আমাদের লোকেরা কানাডায় গিয়ে বেগমপাড়া আগেই তৈরি করেছেন। এখন শুনে গর্বিত হতে পারি যে লন্ডন শহরের অভিজাত পাড়ায় দুর্মূল্যের বাড়িঘর তারা কিনতে পারছেন। বাংলাদেশ থেকে সম্পদ লুটপাট করে নিয়ে গিয়ে রবার্ট ক্লাইভ একদা লন্ডনে নবাবি হালে জীবনযাপন শুরু করেছিলেন, সম্মানজনক নানা রকম উপাধিও পেয়েছিলেন, পার্লামেন্টের সদস্যও হয়েছেন। সাম্রাজ্য নির্মাণকারী সেই ব্যক্তিও কিন্তু প্রতিবেশীদের সামাজিক ঘৃণায় কাতর হয়ে শেষ পর্যন্ত নিজের গলায় নিজ হাতে ক্ষুর চালিয়ে নিজেকে হত্যা করেছিলেন। আমাদের লোকেরা অমন নাবালক নন, তাঁরা গলায় ক্ষুর চালান না, সামাজিক ঘৃণা তাদের স্পর্শ করে না। নাকি উল্টো বলব, সামাজিক ঘৃণা বলতে এখন কিছু আর অবশিষ্ট নেই, এ দেশে; ওসব অতীত ইতিহাসের বিস্মৃত স্মৃতিমাত্র। দুর্নীতিবাজ বড়লোকদের ঘৃণা তো নয়ই, উল্টো ঈর্ষা করে থাকে। ঈর্ষা তো প্রশংসারই অপর নাম।
একদা আমরা ‘সোনার বাংলা’ গড়ব বলে আওয়াজ দিয়েছিলাম, সেটা ছিল আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের রণধ্বনির অংশ; তার পরে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি ঠিকই, কিন্তু ‘সোনার বাংলা’ দূরে থাক, গণতান্ত্রিক বাংলাও গড়ে তুলতে পারিনি। রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা আসা-যাওয়া করেছেন, নিজেদের তাঁরা নির্ভেজাল জাতীয়তাবাদী বলেই জেনেছেন এবং জানিয়েছেনও; কিন্তু এখন তাঁদের তৎপরতার কারণেই ওই স্বপ্নটা আর নেই। এখন আমরা আধুনিক বাংলা গড়ার তালে আছি, ডিজিটাল স্তর পার হয়ে স্মার্ট স্তরে উন্নীত হতে আমাদের চেষ্টা। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের এই সব বাংলার আসল ব্যাপারটা কী? সেটা তো এই যে বাংলাদেশ পুঁজিবাদী ও আমলাতান্ত্রিকই রয়ে গেছে, আগে যেমন ছিল। এবং ভবিষ্যতে যে আরও অধিক পরিমাণেই পুঁজিবাদী ও অগণতান্ত্রিক হবে, সেটাও নিশ্চিত।
উন্নয়ন ও উন্নতির নিরিখ ও প্রতীকগুলো আমাদের চারপাশেই খেলা করছে। আমরা দেখি এবং মেনে নিই, মনে করি এগুলোই স্বাভাবিক। যেমন ধরা যাক এই ঘটনাটা। সন্ধ্যার অন্ধকারে দুজন লোক, অত্যন্ত স্মার্ট তাঁরা নিশ্চয়ই, আশি বছর পার হওয়া এক নারীকে ফেলে রেখে গেছেন ঢাকা শহরের একটি ছোট রাস্তার এক কোণে। ওই বৃদ্ধা যে সম্ভ্রান্ত পরিবারের, বোঝা যায় তাঁর পরিধেয় দেখে। তাঁর পরনে ম্যাক্সি, ম্যাক্সির ওপরে হলুদ রঙের সোয়েটার। তাঁর চোখেমুখে বেদনা ও বিষণ্নতার ছাপ। গলায় এক গোছা চাবি। চাবির ওই গোছাতেই হয়তো ব্যাখ্যা আছে তাঁর এই পথপ্রান্তিক দুর্দশার। ওই চাবিগুলো নিশ্চয়ই বিভিন্ন রকমের তালার; তালায় আবদ্ধ ছিল যে সম্পদ ও সম্পত্তি, সেগুলো হয়তো ইতিমধ্যে তাঁর নিকটজনদের হস্তগত হয়ে গেছে; এখন না আছে তালার কোনো দাম, না তালার চাবির, না চাবির মালিক বৃদ্ধার। মূল্যহীন বৃদ্ধাকে দেখাশোনার দায়িত্ব এখন কে নিতে যাবে? তাই তাঁকে বিদায় করে দেওয়াই শ্রেয়। বাস্তবতা এটাই। উন্নতির মালিকানা লোভনীয়; উন্নতি হয়ে গেলে উন্নয়নের অবলম্বনের মূল্য কী? তাঁকে পাহারা দেওয়া এক বিড়ম্বনা। তাই ফেলে দিয়ে গেছেন রাজধানীর এক পথে। উন্নয়নের ও উন্নতির আরেকটি ছবি প্রায় একই সময়ে ঘটা এবং সংবাদপত্রে প্রকাশিত ছোট সংবাদে পাওয়া যাবে। হাতিরঝিল এলাকায় মোটরসাইকেলের এক আরোহী দুর্ঘটনায় পড়েছেন, রাস্তায় পড়ে রয়েছেন তিনি, রক্তাক্ত অবস্থায়। তাঁর চারপাশে কিছুটা ভিড় জমেছে। কিন্তু তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানোর কোনো তৎপরতা নেই কারও মধ্যেই। তবে কয়েকজনকে দেখা গেছে মোবাইল ফোনে ছবি তুলতে। হাসপাতালে নিতে গেলে অনেক ঝামেলা, ছবি তুললে সেটা হবে একটা ব্যক্তিগত অর্জন। ঝোঁক ওই অর্জনের দিকেই। বর্জন এবং অর্জন উভয়ে একই পথের পথিক বটে। না হয়ে উপায় কী?
‘শিশুকে বাঁচাও’ আওয়াজটা পুরোনো, এখন তার সঙ্গে যুক্ত হওয়া চাই অনুচ্চারিত নতুন এক আওয়াজ, ‘কিশোরকে বাঁচাও’। কিশোরেরা যে ভবিষ্যৎ গড়বে—এ বিষয়ে তো কোনো সন্দেহই নেই। এবং কিশোরদের ভেতরে ভবিষ্যৎ গড়বার ক্ষমতাও বিস্তর পরিমাণে রয়েছে। আমাদের ইতিহাসেও তার প্রমাণ অনেক। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে বাংলাদেশে যত গণ-আন্দোলন হয়েছে, প্রতিটিতে তরুণেরা ছিল অগ্রবর্তী ভূমিকায়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, এরশাদ পতনের আন্দোলন—সবখানেই দেখব কিশোর-তরুণেরা আছে। অথচ এখন তারা নেই। কোনো আন্দোলনে নেই। উবে গেছে। প্রধান কারণ, রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ চায় না তারা আন্দোলনে থাকুক; উল্টো তারা চায় কিশোরেরা বিপথগামী হোক, যাতে শাসকদের শাসন বিঘ্নিত না হয়। অতীত যেন ফেরত না আসে। রাষ্ট্র জ্ঞান বৃদ্ধিতে মোটেই কিশোর নয়; কিশোরদের তুলনায় রাষ্ট্র অনেক বেশি স্মার্ট বটে।
কিশোরেরা এখন স্মার্ট হচ্ছে সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থে। স্মার্টনেস দেখিয়ে তারা হতাশ, বিষণ্ন, অপরাধপ্রবণ, নেশায় আকৃষ্ট ইত্যাদি হচ্ছে। অর্থাৎ আত্মসমর্পণ করে বসে আছে বিদ্যমান ব্যবস্থার কাছে। আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত সীমা হচ্ছে আত্মহত্যা; যা ঘটছে, দেখতে পাচ্ছি। যথার্থ স্মার্টনেস অবশ্য পোশাক-আশাক, চালচলন, ভাবভঙ্গির ওপর নির্ভর করে না; তার নির্ভরশীলতা ভেতরের সারবস্তুর ওপর। আর ওই সারবস্তু হচ্ছে জ্ঞান। কোনো এক প্রকারের জ্ঞান নয়, নানাবিধ জ্ঞান—যেসব জ্ঞানের মধ্যে কর্তব্যজ্ঞান ও দায়িত্ববোধ থাকা অত্যাবশ্যক। কিশোরদের আমরা বঞ্চিত করছি উপকারী প্রায় সব রকমের জ্ঞান থেকেই। ওদিকে জ্ঞান আবার কেউ একাকী সংগ্রহ করতে পারে না, সামাজিক উদ্যোগ আবশ্যক; সেই উদ্যোগই এখন দেখা যাচ্ছে না।
এ দেশে এককালে কিশোর সংগঠন ও আন্দোলনের কাজকর্ম ছিল। এখন তা চোখে পড়ে না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কালে মুকুল ফৌজ ছিল; পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরেও সংগঠনটির অস্তিত্ব টের পাওয়া যেত। সেটি এখন নেই। পাকিস্তান আমলে খেলাঘর ছিল বামপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত সংগঠন; এখন আছে কি না, বোঝাই যায় না। কচি-কাঁচার মেলা ছিল একটি বড় সংগঠন। এদের কর্মসূচি বুর্জোয়া বিকাশের সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। কচি-কাঁচার মেলাও এখন মৃতপ্রায়।
কিন্তু কিশোরদের যথার্থ স্মার্ট করা চাই। এবং করতে হলে দেশজুড়ে একটি কিশোর আন্দোলন আজ খুবই প্রয়োজন। কিশোরদের ঠিক পথে নিয়ে আসতে পারলে তাদের কাজ মানুষের সংগ্রাম ও প্রতিরোধের বিকাশকে সহায়তা দেবে। অর্থাৎ আত্মসমর্পণের বিপরীতে সমাজ পরিবর্তনের পক্ষে কাজ করবে। কিশোরেরা তখন আধুনিক হবে, কিন্তু পুঁজিবাদী হবে না। কিশোরদের জন্য গড়া এই আন্দোলন মোটেই আদর্শ-নিরপেক্ষ হবে না; তার আদর্শটা হবে রাষ্ট্র ও সমাজকে প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক করা, অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক করে তোলা।
সেই রকমের একটি রূপান্তরের জন্য দরকার একটি সামাজিক বিপ্লবের। তবে সচেতন থাকতে হবে এ বিষয়ে যে, বিপ্লব যদি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকে না এগোয়, তাহলে তা কবজায় চলে যাবে প্রতিবিপ্লবীদের, ইরানে যেমনটা ঘটেছে।
স্লোগানেরও যে বিপুল ক্ষমতা আছে, এক যুগ আগে আমাদের এই ঢাকা শহরেই তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। স্লোগান দিয়েছে তরুণেরা যুদ্ধাপরাধীদের যথার্থ বিচার ও বিচারের রায় কার্যকর করার পক্ষে। স্লোগানমুখর আন্দোলনটি ব্যর্থ হয়নি; আবার তাতে রাষ্ট্র ও সমাজে কোনো মৌলিক পরিবর্তনও কিন্তু ঘটেনি। তার প্রতিক্রিয়ায় প্রতিক্রিয়াশীলরাই বরং সংঘবদ্ধ হওয়ার একটা মওকা খুঁজে পেয়েছে।
আজ তাই প্রয়োজন আত্মসমর্পণের নয়, তার উল্টো যে পথ, সংগ্রাম ও প্রতিরোধের পথ, সেটিকে বেগবান করা। সেটাই হচ্ছে জীবনের পথ, মৃত্যুর বিপরীতে।
কারা করবেন এ কাজ? করবেন হৃদয়বান ও বিবেকবানেরা। কাজটি সব দেশেই প্রয়োজন হবে, বিশেষভাবে প্রয়োজন হবে আমাদের মতো দেশে, যেখান থেকে সম্পদ অবাধে ও অবিরাম পাচার হয়ে যায়, যেখানে দুর্নীতির মাত্রা কমে না, বাড়তেই থাকে; ফেসবুক ব্যবহারের যেটি শীর্ষ তিন দেশের মধ্যে স্থান করে নেয়। বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের এমন যে অবস্থা, তাতে ধারণা করা অসংগত নয় যে ভবিষ্যতে শ্রেণি থাকবে মাত্র দুটি—সুবিধাভোগী এবং সুবিধাবঞ্চিত। এবং পথও দাঁড়াবে দুটিই—হয় আত্মসমর্পণ, নয় প্রতিরোধী। বাঁচতে হলে প্রতিরোধ ছাড়া উপায় কী?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কবি জীবনানন্দ দাশের মাতা কুসুমকুমারী দাশ একদা আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’ জীবিত থাকলে ওই আক্ষেপোক্তি তাঁকে প্রত্যাহার করে নিতে হতো বৈকি; কারণ আমাদের ছেলেরা এখন কেবল কথায় নয়, কাজেও যথেষ্ট সেয়ানা হয়ে উঠেছে। ফলে বাংলাদেশ মোটেই পিছিয়ে নেই। দুর্নীতিতে এবং বসবাসের অযোগ্য রাজধানী সৃষ্টিতে আমরা সাধারণত বিশ্বে শীর্ষস্থানের আশপাশেই থাকি। আমাদের ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট বানিয়ে একেক সময় একেক পণ্যের দাম আকাশচুম্বী করে তোলেন; এমনকি নিরীহ যে ছাপার ও লেখার কাগজ, তাকেও মায়া করে না, তার দামও আকাশচুম্বী করে ছাড়ে।
আমাদের লোকেরা কানাডায় গিয়ে বেগমপাড়া আগেই তৈরি করেছেন। এখন শুনে গর্বিত হতে পারি যে লন্ডন শহরের অভিজাত পাড়ায় দুর্মূল্যের বাড়িঘর তারা কিনতে পারছেন। বাংলাদেশ থেকে সম্পদ লুটপাট করে নিয়ে গিয়ে রবার্ট ক্লাইভ একদা লন্ডনে নবাবি হালে জীবনযাপন শুরু করেছিলেন, সম্মানজনক নানা রকম উপাধিও পেয়েছিলেন, পার্লামেন্টের সদস্যও হয়েছেন। সাম্রাজ্য নির্মাণকারী সেই ব্যক্তিও কিন্তু প্রতিবেশীদের সামাজিক ঘৃণায় কাতর হয়ে শেষ পর্যন্ত নিজের গলায় নিজ হাতে ক্ষুর চালিয়ে নিজেকে হত্যা করেছিলেন। আমাদের লোকেরা অমন নাবালক নন, তাঁরা গলায় ক্ষুর চালান না, সামাজিক ঘৃণা তাদের স্পর্শ করে না। নাকি উল্টো বলব, সামাজিক ঘৃণা বলতে এখন কিছু আর অবশিষ্ট নেই, এ দেশে; ওসব অতীত ইতিহাসের বিস্মৃত স্মৃতিমাত্র। দুর্নীতিবাজ বড়লোকদের ঘৃণা তো নয়ই, উল্টো ঈর্ষা করে থাকে। ঈর্ষা তো প্রশংসারই অপর নাম।
একদা আমরা ‘সোনার বাংলা’ গড়ব বলে আওয়াজ দিয়েছিলাম, সেটা ছিল আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের রণধ্বনির অংশ; তার পরে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি ঠিকই, কিন্তু ‘সোনার বাংলা’ দূরে থাক, গণতান্ত্রিক বাংলাও গড়ে তুলতে পারিনি। রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা আসা-যাওয়া করেছেন, নিজেদের তাঁরা নির্ভেজাল জাতীয়তাবাদী বলেই জেনেছেন এবং জানিয়েছেনও; কিন্তু এখন তাঁদের তৎপরতার কারণেই ওই স্বপ্নটা আর নেই। এখন আমরা আধুনিক বাংলা গড়ার তালে আছি, ডিজিটাল স্তর পার হয়ে স্মার্ট স্তরে উন্নীত হতে আমাদের চেষ্টা। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের এই সব বাংলার আসল ব্যাপারটা কী? সেটা তো এই যে বাংলাদেশ পুঁজিবাদী ও আমলাতান্ত্রিকই রয়ে গেছে, আগে যেমন ছিল। এবং ভবিষ্যতে যে আরও অধিক পরিমাণেই পুঁজিবাদী ও অগণতান্ত্রিক হবে, সেটাও নিশ্চিত।
উন্নয়ন ও উন্নতির নিরিখ ও প্রতীকগুলো আমাদের চারপাশেই খেলা করছে। আমরা দেখি এবং মেনে নিই, মনে করি এগুলোই স্বাভাবিক। যেমন ধরা যাক এই ঘটনাটা। সন্ধ্যার অন্ধকারে দুজন লোক, অত্যন্ত স্মার্ট তাঁরা নিশ্চয়ই, আশি বছর পার হওয়া এক নারীকে ফেলে রেখে গেছেন ঢাকা শহরের একটি ছোট রাস্তার এক কোণে। ওই বৃদ্ধা যে সম্ভ্রান্ত পরিবারের, বোঝা যায় তাঁর পরিধেয় দেখে। তাঁর পরনে ম্যাক্সি, ম্যাক্সির ওপরে হলুদ রঙের সোয়েটার। তাঁর চোখেমুখে বেদনা ও বিষণ্নতার ছাপ। গলায় এক গোছা চাবি। চাবির ওই গোছাতেই হয়তো ব্যাখ্যা আছে তাঁর এই পথপ্রান্তিক দুর্দশার। ওই চাবিগুলো নিশ্চয়ই বিভিন্ন রকমের তালার; তালায় আবদ্ধ ছিল যে সম্পদ ও সম্পত্তি, সেগুলো হয়তো ইতিমধ্যে তাঁর নিকটজনদের হস্তগত হয়ে গেছে; এখন না আছে তালার কোনো দাম, না তালার চাবির, না চাবির মালিক বৃদ্ধার। মূল্যহীন বৃদ্ধাকে দেখাশোনার দায়িত্ব এখন কে নিতে যাবে? তাই তাঁকে বিদায় করে দেওয়াই শ্রেয়। বাস্তবতা এটাই। উন্নতির মালিকানা লোভনীয়; উন্নতি হয়ে গেলে উন্নয়নের অবলম্বনের মূল্য কী? তাঁকে পাহারা দেওয়া এক বিড়ম্বনা। তাই ফেলে দিয়ে গেছেন রাজধানীর এক পথে। উন্নয়নের ও উন্নতির আরেকটি ছবি প্রায় একই সময়ে ঘটা এবং সংবাদপত্রে প্রকাশিত ছোট সংবাদে পাওয়া যাবে। হাতিরঝিল এলাকায় মোটরসাইকেলের এক আরোহী দুর্ঘটনায় পড়েছেন, রাস্তায় পড়ে রয়েছেন তিনি, রক্তাক্ত অবস্থায়। তাঁর চারপাশে কিছুটা ভিড় জমেছে। কিন্তু তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানোর কোনো তৎপরতা নেই কারও মধ্যেই। তবে কয়েকজনকে দেখা গেছে মোবাইল ফোনে ছবি তুলতে। হাসপাতালে নিতে গেলে অনেক ঝামেলা, ছবি তুললে সেটা হবে একটা ব্যক্তিগত অর্জন। ঝোঁক ওই অর্জনের দিকেই। বর্জন এবং অর্জন উভয়ে একই পথের পথিক বটে। না হয়ে উপায় কী?
‘শিশুকে বাঁচাও’ আওয়াজটা পুরোনো, এখন তার সঙ্গে যুক্ত হওয়া চাই অনুচ্চারিত নতুন এক আওয়াজ, ‘কিশোরকে বাঁচাও’। কিশোরেরা যে ভবিষ্যৎ গড়বে—এ বিষয়ে তো কোনো সন্দেহই নেই। এবং কিশোরদের ভেতরে ভবিষ্যৎ গড়বার ক্ষমতাও বিস্তর পরিমাণে রয়েছে। আমাদের ইতিহাসেও তার প্রমাণ অনেক। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে বাংলাদেশে যত গণ-আন্দোলন হয়েছে, প্রতিটিতে তরুণেরা ছিল অগ্রবর্তী ভূমিকায়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, এরশাদ পতনের আন্দোলন—সবখানেই দেখব কিশোর-তরুণেরা আছে। অথচ এখন তারা নেই। কোনো আন্দোলনে নেই। উবে গেছে। প্রধান কারণ, রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ চায় না তারা আন্দোলনে থাকুক; উল্টো তারা চায় কিশোরেরা বিপথগামী হোক, যাতে শাসকদের শাসন বিঘ্নিত না হয়। অতীত যেন ফেরত না আসে। রাষ্ট্র জ্ঞান বৃদ্ধিতে মোটেই কিশোর নয়; কিশোরদের তুলনায় রাষ্ট্র অনেক বেশি স্মার্ট বটে।
কিশোরেরা এখন স্মার্ট হচ্ছে সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থে। স্মার্টনেস দেখিয়ে তারা হতাশ, বিষণ্ন, অপরাধপ্রবণ, নেশায় আকৃষ্ট ইত্যাদি হচ্ছে। অর্থাৎ আত্মসমর্পণ করে বসে আছে বিদ্যমান ব্যবস্থার কাছে। আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত সীমা হচ্ছে আত্মহত্যা; যা ঘটছে, দেখতে পাচ্ছি। যথার্থ স্মার্টনেস অবশ্য পোশাক-আশাক, চালচলন, ভাবভঙ্গির ওপর নির্ভর করে না; তার নির্ভরশীলতা ভেতরের সারবস্তুর ওপর। আর ওই সারবস্তু হচ্ছে জ্ঞান। কোনো এক প্রকারের জ্ঞান নয়, নানাবিধ জ্ঞান—যেসব জ্ঞানের মধ্যে কর্তব্যজ্ঞান ও দায়িত্ববোধ থাকা অত্যাবশ্যক। কিশোরদের আমরা বঞ্চিত করছি উপকারী প্রায় সব রকমের জ্ঞান থেকেই। ওদিকে জ্ঞান আবার কেউ একাকী সংগ্রহ করতে পারে না, সামাজিক উদ্যোগ আবশ্যক; সেই উদ্যোগই এখন দেখা যাচ্ছে না।
এ দেশে এককালে কিশোর সংগঠন ও আন্দোলনের কাজকর্ম ছিল। এখন তা চোখে পড়ে না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কালে মুকুল ফৌজ ছিল; পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরেও সংগঠনটির অস্তিত্ব টের পাওয়া যেত। সেটি এখন নেই। পাকিস্তান আমলে খেলাঘর ছিল বামপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত সংগঠন; এখন আছে কি না, বোঝাই যায় না। কচি-কাঁচার মেলা ছিল একটি বড় সংগঠন। এদের কর্মসূচি বুর্জোয়া বিকাশের সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। কচি-কাঁচার মেলাও এখন মৃতপ্রায়।
কিন্তু কিশোরদের যথার্থ স্মার্ট করা চাই। এবং করতে হলে দেশজুড়ে একটি কিশোর আন্দোলন আজ খুবই প্রয়োজন। কিশোরদের ঠিক পথে নিয়ে আসতে পারলে তাদের কাজ মানুষের সংগ্রাম ও প্রতিরোধের বিকাশকে সহায়তা দেবে। অর্থাৎ আত্মসমর্পণের বিপরীতে সমাজ পরিবর্তনের পক্ষে কাজ করবে। কিশোরেরা তখন আধুনিক হবে, কিন্তু পুঁজিবাদী হবে না। কিশোরদের জন্য গড়া এই আন্দোলন মোটেই আদর্শ-নিরপেক্ষ হবে না; তার আদর্শটা হবে রাষ্ট্র ও সমাজকে প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক করা, অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক করে তোলা।
সেই রকমের একটি রূপান্তরের জন্য দরকার একটি সামাজিক বিপ্লবের। তবে সচেতন থাকতে হবে এ বিষয়ে যে, বিপ্লব যদি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকে না এগোয়, তাহলে তা কবজায় চলে যাবে প্রতিবিপ্লবীদের, ইরানে যেমনটা ঘটেছে।
স্লোগানেরও যে বিপুল ক্ষমতা আছে, এক যুগ আগে আমাদের এই ঢাকা শহরেই তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। স্লোগান দিয়েছে তরুণেরা যুদ্ধাপরাধীদের যথার্থ বিচার ও বিচারের রায় কার্যকর করার পক্ষে। স্লোগানমুখর আন্দোলনটি ব্যর্থ হয়নি; আবার তাতে রাষ্ট্র ও সমাজে কোনো মৌলিক পরিবর্তনও কিন্তু ঘটেনি। তার প্রতিক্রিয়ায় প্রতিক্রিয়াশীলরাই বরং সংঘবদ্ধ হওয়ার একটা মওকা খুঁজে পেয়েছে।
আজ তাই প্রয়োজন আত্মসমর্পণের নয়, তার উল্টো যে পথ, সংগ্রাম ও প্রতিরোধের পথ, সেটিকে বেগবান করা। সেটাই হচ্ছে জীবনের পথ, মৃত্যুর বিপরীতে।
কারা করবেন এ কাজ? করবেন হৃদয়বান ও বিবেকবানেরা। কাজটি সব দেশেই প্রয়োজন হবে, বিশেষভাবে প্রয়োজন হবে আমাদের মতো দেশে, যেখান থেকে সম্পদ অবাধে ও অবিরাম পাচার হয়ে যায়, যেখানে দুর্নীতির মাত্রা কমে না, বাড়তেই থাকে; ফেসবুক ব্যবহারের যেটি শীর্ষ তিন দেশের মধ্যে স্থান করে নেয়। বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের এমন যে অবস্থা, তাতে ধারণা করা অসংগত নয় যে ভবিষ্যতে শ্রেণি থাকবে মাত্র দুটি—সুবিধাভোগী এবং সুবিধাবঞ্চিত। এবং পথও দাঁড়াবে দুটিই—হয় আত্মসমর্পণ, নয় প্রতিরোধী। বাঁচতে হলে প্রতিরোধ ছাড়া উপায় কী?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে